প্রায় আধ ঘণ্টা হ'ল মিঠু অপেক্ষা করছে ডাক্তারের চেম্বারে। এই শহরের নামকরা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট- অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে সময় লেগেছিল। পাড়ার ডক্টর দাস থেকে বড় রাস্তার ডক্টর নাগ, আবার ব্যাক টু ডক্টর দাস এই রকম চলছিল - এঁর প্রেসক্রিপশনে হয়ত এক সপ্তাহ ভালো থাকল মিঠু, আবার যে কে সেই, তখন আবার অন্যজনের কাছে। মিঠুর খেতে ইচ্ছে করে, খায়, খাওয়ার পরেই বমি - রুটিন হয়ে গিয়েছে এখন। ওজন কমছিল খুব দ্রুত। অথচ স্পেশালিস্ট দেখাতে গড়িমসি - আজ ইনভিজিলেশনের ডিউটি, কাল খাতা আনতে যেতে হবে, পরশু প্র্যাকটিকাল, এই কাজের চাপ কমে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে- স্ট্রেস আর কী, বুঝলে না... এই সব চলছিল। মূলত মামু আর কোলীগদের চাপে মিঠু স্পেশালিস্ট দেখানোর উদ্যোগ নিল শেষমেশ; কলেজের দিব্যেন্দু আর রোহিনী এই ডাক্তারকে রেকমেন্ড করে, সঙ্গে 'বহুৎ বিজি ' -ট্যাগ লাগায়। মিঠুরও মরিয়া ভাব এসে গেল- লেগে রইল এবার- ‘ধুর কী সময় নষ্ট’ বলে পালালো না- যেন এসপার কী উসপার; ' ও কিছুনা, হজমের গন্ডগোল' - সার্টিফিকেট পাড়ার ডাক্তারের বদলে স্পেশালিস্টের থেকেই আসুক- সকলের মত এবার মিঠুও চাইছিল খুব। অবশেষে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে এই মুহূর্তে সে ওয়েটিং রুমে আরো পনেরো কুড়ি জনের সঙ্গে বসে। একাই এসেছে কলেজফেরত। ডাক্তারবাবুর আসতে দেরি হয়েছিল আধঘন্টা, ফলে এক নম্বর পেশেন্ট সবে ঢুকেছে , মিঠু আটে।
আজ বাইরে বৃষ্টি, কলেজের দোরগোড়া থেকেই ট্যাক্সি পেয়েছিল মিঠু। জ্যামে আটকে প্রথমে টেনশন করল খানিক। ঘন ঘন ঘড়ি দেখল। ঘামল প্রচুর। ক্লিনিকে পৌঁছে, ডাক্তার দেরিতে ঢুকেছেন জেনে বাথরুমে গেল প্রথমেই। তারপর ডাক্তারের নাম লেখা দরজা ঠেলে ঢুকল। ঠান্ডা ঘর- প্রথমে দিব্যি আরাম-ঘাম টাম শুকিয়ে ফুরফুরে লাগে , কিছুক্ষণ পরেই চাদর খোঁজে মানুষ। গলার বোতাম আটকায়। আঁচল টানে। ওড়নায় কান ঢাকে। এ ঘরে ওয়েটিং- সাদা রঙে লেখা আছে, ডাক্তারবাবু ভিতরের ঘরে। একটি ছেলে চশমা চোখে ডেস্কটপ নিয়ে বসে- সময় হলে, সেই নাম ডাকবে , ভেতরে যেতে বলবে।
মিঠু আশপাশ দেখছিল- বেশিরভাগই মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে, দু'জন বই পড়ছিল, একজন বৃদ্ধকে এক সপ্তাহ আগের পুরোনো খবরের কাগজ পড়তে দেখল সে; একটা বাচ্চা প্রতিটি চেয়ার ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিচ্ছু চাইনি আমি গাইছিল- ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা যাচ্ছিল, ফিরে আসছিল। দেওয়ালে ফ্ল্যাটস্ক্রীন টিভি- শব্দহীন। মিঠু কিছুক্ষণ সংবাদপাঠকের লিপ রিড করল, নিউজ টিকার, স্টক মারকেট ইনফর্মেশনে চোখ বুলিয়ে আবার মানুষজন দেখতে শুরু করল। একটি অল্পবয়সী মেয়ে সামনের টেবিল থেকে একটা সিনেমার পত্রিকা তুলে নিয়ে সঙ্গের বৃদ্ধাকে দিচ্ছিল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিল একটি ছেলে। কাউকেই অসুস্থ মনে হচ্ছিল না মিঠুর- যেন সবাই ' ঐ হজমের গন্ডগোল, তেলটা কম খাবেন' প্রেসক্রিপশন নিতে এসেছে। কে রোগী, কে সঙ্গে এসেছে, কিম্বা রিপোর্ট করতে- বোঝার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ - একটা খেলার মত। তারপর হাল ছেড়ে দিল । তাকে নিয়েও কি কেউ খেলছে এখানে?
পেশেন্ট দেখতে সময় লাগছিল। মিঠু সামান্য অধৈর্য হয়ে ঘড়ি দেখল; তারপর টেবিলের ডাঁই করা ম্যাগাজিন ঘাঁটতে শুরু করল। বাংলা, ইংরিজি, হিন্দি ভাষায় খবরের কাগজ, পত্র পত্রিকা - চকচকে মলাট। খানিক অন্যমনস্ক মিঠু ম্যাগাজিন তুলে নিল, প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতায় তার আঙুলের দ্রুত চালনা ম্যাগাজিনকে ফ্লিপবুকে পরিণত করল অচিরেই- সে বইয়ের গল্প হাস্যমুখ দীপিকা রণবীর, গাঁদা ফুলের মালা গলায় অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদী আবার দীপিকার হাতের মেহেন্দি, রণবীরের গোঁফ হয়ে বক্তৃতারত রাহুলগান্ধীতে ফিরছিল। ফ্লিপবুকের এ গল্প থেমে যেতে জাস্ট পাঁচ মিনিট লেগেছিল এরপর; পত্রিকায় চন্দ্রযানের আসন্ন অভিযান নিয়ে বেশ কটি প্রবন্ধ- সঙ্গে পুরোনো কোনো লঞ্চিংএর ছবি- আকাশ ফুঁড়ে উঠছে রকেট, কমলা আগুন ছিটকোচ্ছে- ছিঁড়ে খুঁড়ে যাচ্ছে মেঘ - মিঠুর হাত আটকে গেল ঐ খানে। এত লোকের মাঝখানে সে একা হয়ে গেল আচমকা। একটা ফুল সাজানো খাটের ওপর কমলা বালুচরী আর ফুলের গয়নায় সেজে গুজে বসে রইল আর দরজা বন্ধ করেই সনৎ বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠুর ওপর -টান মারল শাড়ি ধরে। ছিঁড়ে ফেলল ব্লাউজ। ঘরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল ফুলের পাপড়ি, ছেঁড়া মালা, নতুন বরের পরিধান। সনৎ কামড়ে দিল ওর ঠোঁটে , গলায়, বুকে। সম্পূর্ণ নগ্ন সনতের উত্থিত পুরুষাঙ্গ থেকে তরল গড়াচ্ছিল, ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা- বিড়বিড় করে কী বলে চলেছে মিঠু তার কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। আটচল্লিশ ঘন্টা আগেই যে হৃদয় মন্ত্র পড়ে সনতের হোক বলেছিল, সেই হৃদয় রক্ত মাংস চামড়া শিরা ধমনীর হৃদপিণ্ড হয়ে গলার কাছে চলে এল স্রেফ আতঙ্কে। চোখ বুজে ফেলল মিঠু। সনৎ নখ বসাল, দাঁত বসাল ওর শরীরে- মিঠুর ঠোঁট গলা, বুক , পেট, ঊরু ফালা ফালা করে দিল- কতবার কতবার কতবার।
ম্যাগাজিনের কমলা আগুনের দিকে তাকিয়ে এই সব খুব দ্রুত ভাবছিল সে। ঢাউস বেডকভার, লেপের ওয়াড়, শাড়ি টাড়ি যতক্ষণ বাইরে, হাওয়ায়, রোদে কেমন ফুলে ফেঁপে থাকে, অথচ ভাঁজ করে ইস্ত্রি করতেই এক হাতে এঁটে যায়, এতদিনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নাও তেমন গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেল— মিঠু যেন তার গোটা জীবনটাই দেখে নিল ডাক্তারের অফিসে বসে। কেটে গেল, ছড়ে গেল, রক্ত ঝরল কত বার। তারপর শূন্যতা এল, মিঠু দুহাতে জড়িয়ে ধরল নিজেকে। চোখ মুছে নিয়ে এ'ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখল। দেখল, একজিট লেখা সবুজ আলো, অপেক্ষারত মানুষজনের নিস্পৃহ দৃষ্টি, চেয়ার বেঞ্চ, টেবিলে ম্যাগাজিন; দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক কানে আসছিল, এসির গোঁ গোঁ, বাচ্চাটা এখন মহারাজ একি সাজে গাইছে, চশমাচোখে ছেলেটি গলা খাঁকরে হেঁকে উঠছিল -নাম্বার থ্রী, নেক্সট নাম্বার ফোর...
ক্রমশ এসির ঠান্ডা, নরম গদীর চেয়ার ওকে আবার স্থিতিজাড্যে ফিরিয়ে আনছিল। পুরোনো কথা, ছবি, কান্না, রক্তপাত প্রাচীন টিকটিকির মত লুকিয়ে পড়ছিল ক্যালেন্ডারের তলায়। মিঠুর মনে হচ্ছিল, বসে বসে পুরোনো কথা ভাবার জন্য ডাক্তারের চেম্বারের মত জায়গা আর হয় না-
মিঠু না ফেরা অবধি হাওয়া গরম ছিল। টুম্পা চলে যাওয়ার পর, ছন্দা রান্নাঘর থেকে বারান্দায় যাচ্ছিল, উঁকি দিচ্ছিল নিচে, রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে ছ্যাঁক ছোঁক করছিল আবার। ঝনঝন করে বাসন আছড়ানোর শব্দ হল বার তিনেক। বিপ্লব টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিল।
আটটার খবর শুরু হতে মিঠু বাড়িতে ফিরল ।
-"ডাক্তার কী বললেন? ওষুধ কিনে আনব না কি এনেছিস?" টেবিল থেকে মানিব্যাগ পকেটে নিয়েছিল বিপ্লব।
"তোমাকে এই অন্ধকারে বেরোতে হবে না। বলাইকে বলছি- এনে দেবে"- ছন্দা চ্যাঁচালো।
মিঠুকে ক্লান্ত দেখায়। ঘাম মুছল- " ব্যস্ত হোয়ো না তো, অম্বলের, হজমের ওষুধ দিলেন। বাড়িতেই আছে, আনতে হবে না-
- এতেই সেরে যাবে বললেন?
- আল্ট্রাসাউন্ড আর এন্ডোস্কোপি করিয়ে আবার যেতে হবে শনিবার। ততদিন এই ওষুধ চলবে। আগেই করানো উচিত ছিল। ডক্টর নাগ কেন টেস্ট করাননি - এই সব বললেন।
-বলবে কী ? জানে কিছু যে বলবে? তবু তোর মত বোকারা যাচ্ছে দেখাতে-
-থাক না মা, যা হয়ে গেছে ...
-কোথায় করাবি? বুক করতে হবে তো-
-বুক করেই এসেছি। ঐ ক্লিনিকেই । এই সব করে দেরি হল।
"ওষুধ খা। হাবিজাবিগুলি আর গিলিস না, ঠিক হয়ে যাবি" ছন্দা বলল।
-এন্ডোস্কোপি কবে?
-পরশু। ছুটি নিতে হবে আবার
"আমি যাব তোর সঙ্গে, একা যাস না" ছন্দা আর বিপ্লব আলাদা আলাদাই বলেছিল। ক্লান্ত মিঠুর কানে ঢুকল মার্জ করে- কানে হাত দিল মিঠু। ক্লান্ত গলায় থেমে থেমে বলল, " আরে না না। এর আগেও এন্ডোস্কোপি করিয়েছি। পারব। একাই পারব। তোমাদের যেতে হবে না।"
অম্বল আর হজমের ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কথায় গৃহস্থ সহজে আশ্বস্ত হয়। আবার এন্ডোস্কোপি, আলট্রাসাউন্ডের মত শব্দ তাকে অস্বস্তিতে রাখে, ঘুমোতে দেয় না । সে বারে বারে ওঠে, জল খায়, বারান্দায় দাঁড়ায়। গলির ঘুমভাঙা কুকুর তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নিজের মত কুণ্ডলী পাকায়। বারান্দার রেলিঙ ছুঁয়ে গাছের ডাল -তাতে ঘন সবুজ পাতা - রাস্তার আলো রিফ্লেক্ট করে। সে শশীবাবুর সংসারের তিনতলায় আলো জ্বলা ঘর দেখে। ঝাঁপফেলা দোকান দেখে। আকাশে তাকায়। হাই তোলে। একটা অটো বড়রাস্তার দিকে গেল। তারপর একটা স্কুটার । একসময় তার চোখের সামনে জঞ্জালের ভ্যাটের ওপর আলোর ডুম নিভে যায়। কালো আকাশ রঙ পালটে ঘোলাটে হতে থাকে। মোড়ের মাথা থেকে গলির ভিতরে কাগজ নিয়ে সাইকেল ঢোকে। আবার একটা ভোর। আজ মেঘ করে আছে।
শনিবার বাড়ি থেকে সরাসরি ডাক্তারের কাছে গিয়েছে মিঠু। বিপ্লব আর ছন্দা ওর সঙ্গে আজ; ফেরার পথে কেনাকাটা র প্ল্যান রয়েছে- পুজোর বাজার এখনই শুরু না করলে পরে বড় ভীড় হয়। আল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি হয়ে গিয়েছিল; টিস্যু স্যাম্পল কালেকশন হয়েছে । সমস্ত রিপোর্ট এখন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের কাছে।
আজও সেই কনকনে ঠান্ডা চেম্বার, অপেক্ষারত জনা পনের মানুষ, চশমা চোখে ছেলেটি আর তার কমপিউটার-ঘড়ির কাঁটা টিকটিক ঘুরছিল।
-সেদিনও এতক্ষণ তোকে বসতে হয়েছিল?
-হ্যাঁ
"একা একা বসে ছিলি-ইশ, বড্ড স্লো না এই ডাক্তার" ছন্দা বিজবিজ করল।
-স্লো কেন? যত্ন করে পেশেন্ট দেখেন- সময় লাগে।
-বেশি দেরি হলে, আজ আর কেনাকাটা হবে না, সব বন্ধ হয়ে যাবে। শনিবার না?
পাঁচ নম্বরে ডাক পড়ল মিঠুর।
ডাক্তার আজ গম্ভীর। মাথা নামিয়ে মিঠুর রিপোর্ট দেখছিলেন।
"সব রিপোর্ট এসে গেছে" এই বলে সামান্য থামলেন ডাক্তার
"ভালো তো সব?" ছন্দা আগ বাড়িয়ে বলল।
মুখ তুলে তাকিয়ে চশমা ঠিক করলেন ডাক্তার।
-শুনুন। রিপোর্ট ভালো নয়। অনেক আগে আসা উচিত ছিল আপনার। কী করছিলেন এতদিন? কিচ্ছু বোঝেন নি?
-মানে?
-অংকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন। সম্ভব হলে আজই। এই ক্লিনিকেই পাবেন। রিসেপশনে বলুন । দাঁড়ান আমি বলে দিচ্ছি। না ফীজ দিতে হবে না। আর সময় নষ্ট করবেন না, প্লীজ-
যেন গো গো গো গো স্ট্যাচু খেলায় স্ট্যাচু বলল কেউ। হাত পা মাথা কবন্ধে লাগানো রইল - জোর নেই, অসাড়, চিন্তা করার শক্তি নেই। শুধু ধকধক্ধকধক্ধক্ধক আওয়াজ হচ্ছিল মাথার মধ্যে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে পড়েছিল ছন্দা। বিপ্লব ধরে নিল। রিসেপশনের উল্টোদিকের বাথরুমে দৌড়ে ঢুকেছিল মিঠু।
ছন্দাকে রিসেপশনে বসতে বলে অংকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল বিপ্লব। টেনশন কাটাতে রিসেপশনের মেয়েটির সঙ্গে টুকটাক কথা চালাল কিছুক্ষণ। ব্রোশিওর নিল খান দুয়েক। ছন্দার কাছে এসে বলল- " কাল সকাল দশটায় দেখবেন । খুব নামকরা অংকোলজিস্ট। ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরতে হবে, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। চল। মিঠু বেরোয় নি টয়লেট থেকে?"
ছন্দা মাথা নাড়ল- "না।"
-এখনও বেরোয় নি? দেখো একটু।
ছন্দা উঠে গিয়ে দরজা ধাক্কালো, তারপর রিসেপশনের মেয়েটি। তারপর আবার ছন্দা। ভিতর থেকে জল পড়ার আওয়াজ আসছিল। বিপ্লব দৌড়ে সিকিউরিটিকে ডাকতে গেল । ছোটো একটা ভিড় জমে উঠল বাথরুমের সামনে
….
তখন বেসিনের ট্যাপ খুলে সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছিল মিঠু। আর ফেনায় ফেনায় ভরে যাচ্ছিল বেসিন। মিঠু হাত ধুচ্ছিল আর ধুচ্ছিল। এই ছোট্টো বাথরুম তার অতি নিরাপদ আশ্রয় মনে হচ্ছিল। নিরন্তর জল ঝরে যাওয়ার আওয়াজ যেন এক অস্বচ্ছ পর্দা যার বাইরে সে এন্ডোস্কোপি, আল্ট্রাসাউন্ড, অংকোলজিস্ট আর তার অবয়বহীন ভবিষ্যতকে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছিল- যতক্ষণ পারে।
আজ টুম্পা আসে নি। ছন্দা রান্নাঘরে । ওর এখনও মনে হচ্ছে, ডাক্তার কিচ্ছু জানে না, অংকোলজিস্টের ডায়াগনসিস ভুল, যাবতীয় টেস্টের রেজাল্ট মিঠুরই নয়। বিড়বিড় করতে করতে রান্না করছিল ছন্দা, ফ্যান গালছিল। খুন্তি ঠুকছিল কড়াইতে।
মিঠু কলেজে গিয়েছে সকালে। ছুটি নেবে। কেমো শুরু হবে পরশু।
বাজার এনে আবার বেরোচ্ছিল বিপ্লব।
-কোথায় চললে?
-মাণিকের বাড়ি
- জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে আবার পুলিশের ঝামেলা আনতে চাও? আমরা সবাই মরি-তাই চাও?
- পুলিশের ঝামেলা কেন হবে? ওদের যা জানার ছিল, সবই তো ..
-ন্যাকামি কোরো না। কী দরকার সেখানে?
- অনেকদিনই তো বলেছি, কাজকর্ম আবার শুরু করব। কিছু কন্ট্যাক্ট মাণিক জোগাড় করেছিল। টুম্পাকে খুঁজে রাখতে বলেছিলাম-
-পাগল হয়ে গেছ তুমি- একদম ঘোর উন্মাদ- কী সব বলছ!!
-অনেক টাকা লাগবে মিঠুর চিকিৎসায়। লাখ লাখ টাকা। মিঠুর সেরকম সেভিংস আছে? ক' দিন আর চাকরি করল। বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব, দরকার হলে-
-কটা টাকা রোজগার করবে তুমি? অ্যাঁ? কটা টাকা? আর এই বয়সে, এই শরীরে পারবে তুমি? কী করবে?
-চেষ্টা করব। আমারও তো মেয়ে-
ছন্দা খুন্তি ছুঁড়ে ফেলল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড়াল ।
-তোমার মেয়ে! তোমার মেয়ে! চেয়েছিলাম তো। পারলে দিতে? সে ক্ষমতা আছে? মগা একটা। মগা মগা মগা- সব শেষ করে দিল- সব শেষ করে দিল-
কাঁদতে কাঁদতে বিপ্লবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছন্দা। চুলের মুঠি ধরে নখ বসিয়ে দিল বিপ্লবের গালে-