অজয় নদ এই মুহূর্তে যেন বিস্তীর্ণ মরুভূমি । ধু ধু বালির চরে মার্চ মাসের রোদের তাত ঠিকরোচ্ছে। একটু পরেই দেখা যাবে সারে সারে উট চলেছে- কঙ্কণার মনে হচ্ছিল। বালির ওপর বাজার বসেছে -একটা চিল সাঁ করে নেমেই আবার আকাশে উঠে গেল। ক্ঙ্কণার সমুদ্রের কথা মনে হল - এই বালির ওপর সার দিয়ে কয়েকটা ক্যাসুরিনা লাগিয়ে দিলে কেঁদুলি দীঘা হয়ে যাবে এক্ষুণি। সমুদ্রে গেলেই কি ভালো হ'ত? কাটা ডাবে স্ট্র ডোবালো সে। বাজারে ঝুড়ি, চুবড়ি, কুলো, মোড়া, ঘর গৃহস্থালির জিনিস। বালির চর পেরিয়ে লোকজন যায় আসে, কেনাকাটি করে, চা খায়, গল্প জোড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায়, বেলা হ'ল; ঘাম মুছে বাড়ি যায় তারপর। কঙ্কণা আর সাহিল রাধাবিনোদের মন্দির ঘুরে এসেছে একটু আগে। ছবি নিয়েছে অজস্র। তারপর ডাব কিনতে বাজারে এসেছে। সাহিলের মাত্রই ক'দিনের ছুটি - আজ নানুর, কেঁদুলি ঘুরে কাল সকালে মল্লারপুর।
"ইলেকশন হয়ে যাক। তারপর যাব" কঙ্কণা চাইছিল।
-মাত্র তিনটে দিন। প্লীজ চলো। এরপর আর ছুটি পাবো না সহজে।
প্রথমে গাঁইগুইঁ করেছিল- ইউনিভারসিটির কাজ, মীটিং আছে পরপর, মিছিলে হাঁটবে পরের সপ্তাহে- এই সব। ইলেকশনের আগে ওদিকে স্রেফ বেড়াতে যাওয়াটা কতখানি সেফ- সেটাও বলল বার কয়েক। কিন্তু ট্রেনে ওঠার পর থেকেই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল কঙ্কণাকে - দ্বিধাটুকু হাওড়া স্টেশনে ফেলে রেখেই ট্রেনে উঠেছে যেন। কঙ্কণা রাজনগর ঘুরে আসার কথা বলেছিল আগেই; এখন স্ট্রয়ে ঠোঁট ঠেকিয়েই মুখ তুলল, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল - মোতিচুর মসজিদ দেখবে। কিন্তু মল্লারপুর যাওয়ার জেদ করল সাহিল।
-রাজনগর পরের ট্রিপে। শীতে আসব সিউড়ির দিকটা শিওর। রাজনগর, দুবরাজপুর, মামা ভাগ্নে পাহাড়...
-মল্লারপুরে স্পেশাল কী? সেই তো শিব মন্দির ক'টা- আর অবশ্য রামপ্রসাদের গুরুর সমাধি, কাছারি বাড়ি ...আর ,মনে নেই, বাঘ বেরিয়েছিল মাস দুই আগে?
-“তুমি বুঝি বাঘকে ভয় পাও খুকী? বাঘ দেখা ভালো কিন্তু। ধরো, বাঘের পিছন পিছন ভূতের রাজা এসে বর দিয়ে গেল” মজার মুখ করল সাহিল।
-কী বর চাইব আমরা?
-আমার লেখা হোক আর তোমার.. তোমার দল যেন ইলেকশনে জেতে-
সাহিলটা বড় ছেলেমানুষ- কঙ্কণা খুব হাসছিল। তারপর চোখ মুছল দোপাট্টায়। হাসলে কঙ্কণার চোখে জল আসে। ওর দিকে তাকিয়ে রইল সাহিল যেন শিমূল পলাশ টলাশ নিয়ে বসন্ত একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-"স্পেশাল কী বললে না তো!" হাসি থামিয়ে কঙ্কণা জানতে চাইল।
“আরে স্পেশাল মানে গল্প- নইলে মন্দির লইয়া কী করিব?”
-সে তো রাজনগরেও ভূরি ভূরি...
-তা আছে, গল্প আছে, কিন্তু মল্লারপুরে মাটির নিচের গল্প-
-তারপর চাণ্ডী মুখনের গল্পের সঙ্গে জুড়বে?
- বুদ্ধিমতী মাশা আমার, শিওর নই কী করব। ভাবতে হবে।
- কী ভাবছ শুনি?
- এই যে ধর, মাটির ওপরে আর নিচে- দুটো আলাদা দুনিয়া । যখন সাবস্ট্রাকচারে কাজ করতে হয়, খুব ফীল করি। মানে ফিজিক্যালি ফীল করি। যেন প্যারালেল দুটো জগত। পাশাপাশিই আছে- একদম পাশে, অথচ কেউ কারো সম্বন্ধে কিছু জানে না।
সাহিল একটানা এত কথা বলে না। ওর হাতে চক ডাস্টার , পাশে ব্ল্যাকবোর্ড দিলে দারুণ মানাবে এখন- বলতে গিয়েও গিলে নিল কঙ্কণা- সাহিল যদি খেই হারায়।
-অথবা ধরো, মাটির নিচে কী থাকে? সমাধি। হাড় গোড়। মানে অতীত। বর্তমান যার সবটুকু জানে না। কল্পনা করে, আন্দাজ করে, ইতিহাস লেখে, কিন্তু সবটুকু জানে না তো। ব্যাপারটা রূপক হিসেবেও দেখা যায়- জাস্ট রূপক- যেন চেতন আর অবচেতন; আমাদের অবচেতনে কী আছে তা কী জানি?
-ইন্টারেস্টিং-
- এই ব্যাপারগুলো ধরতে চাইছি আর কি-
-ঐ জন্যই তো বলছি- চাকরি ছাড়ো। নইলে লিখতে পারবে না। সিরিয়াস হও সাহিল। সেদিন স্যার যে বিজনবাবুর নম্বর দিলেন, ফোন করেছিলে?
- ক'বার করেছি। বেজে গেল। আবার করব -
- আমিও ট্রাই করতে পারি। নীলকমলকে খোঁজা নিয়েই একটা আস্ত গল্প হয়ে যাবে তোমার। আচ্ছা একটা কথা বলবে?এখানে জাদুকরের রোলটা কী? তার ইন্টারভিউ নেওয়া এত ক্রুশিয়াল কেন?
- কানেকশনের টেকনিক শিখব যে - পাঠকের সঙ্গে কানেকশনের টেকনিক-
- হোয়াই জাদুকর?
-এই যে তুমি মিছিল করে এলে, পোস্টার আঁকলে। আঁকলে না?
-হ্যাঁ, আঁকলাম, স্লোগান দিলাম, হাঁটলাম, তারপর পায়ে ব্যথা হল-
- সবই তো কানেক্ট করার জন্য, তাই না? মানুষের সঙ্গে কানেক্ট করলে তুমি-
-চেষ্টা করি আমরা-চেষ্টা করি, বলতে পারো। তাহলে, জাদুকর কেন? আমার থেকেই শিখতে পারো-
কঙ্কণা হাসল সাহিলের দিকে তাকিয়ে। রোদ পড়ছিল চোখে।
সাহিলকে সিরিয়াস দেখাচ্ছিলঃ " খোলা মাঠে, রাস্তায় জাগলারি দেখেছ?"
-ফটিকচাঁদ?
সাহিল হেসে ফেলল।"জাগলারি তারপর ধরো, টাইট রোপ ওয়াকিং, বা আরো বিপজ্জনক কিছু- একদম খোলা মাঠে খেলা দেখায়। আর তাদের ঘিরে কত লোক হয় -দেখেছ? তুমি পি সি সরকারের ইন্টারভিউ নিতে বলেছিলে একদিন। দেখো , এখানে সাজ নেই পোষাক নেই, বাঘ , সিংহ , আলো বাদ্যি- কিচ্ছু নেই। আঁকা সীন- তাও নেই। না আছে কথা, না আছে গান, বাজনা। তোমার মিছিলের মত কোনো ইস্যু নেই, থীমও নেই- কিন্তু কানেকশন হয়। এগারোজন নয়, জাস্ট একটা মাত্র লোক খেলা দেখায়- সবাই হাঁ করে দেখে। ঐ সময়টা অন্য কিছু ভাবে না, জানো? শুধু ভাবে বলটা ধরে নিতে পারবে তো? ফস্কাবে না তো? দড়ি থেকে পড়ে যাবে না? কী লেভেলের কানেকশন ভাবো! কী করে সম্ভব? খুঁজে খুঁজে গিয়েছি কয়েকজনের কাছে- কেউ কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে নি। বা আমিই বুঝতে পারি নি। শুধু একটা জিনিস বুঝেছি, কঙ্কণা- লেখাকে বিপজ্জনক পথে হাঁটাতে হবে আমাকে; ঐ যে আশঙ্কা, ঐ যে বুক ঢিবঢিব -ওটাই কানেক্ট করে সম্ভবত। সেদিন স্যারের সঙ্গে কথা বলে মনে হল- নীলকমল শেখাতে পারবে। ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। কানেকশনের টেকনিক শিখতেই হবে আমাকে-"
বালির ওপর দাঁড়িয়ে দুদিকে হাত ছড়িয়ে কথা বলছিল সাহিল, আবেগ ভরে আসছিল ওর গলায়, চোখ চিকচিক করছিল। বড় একটা পাখির মত লাগছিল ওকে, কিম্বা এরোপ্লেন- টেক অফ করার জন্য রেডি; আবার কখনও অপুর মত লাগছিল সাহিলকে- সিনেমায় অপু যখন পুলুকে নিজের লেখা নিয়ে বলছিল - সেই রকম। কঙ্কণা তাকিয়ে রইল - সাহিলকে অচেনা লাগছিল ওর।
কঙ্কণাকে দেখছিল সাহিল। বালির ওপর ছায়া পড়েছে ওর- ছায়াপিণ্ডর থেকে হাতে ধরা ডাবের স্ট্রর ছায়া যেন সামান্য পৃথক - ঈষৎ উঁচু হয়ে রয়েছে -সানডায়ালের মত দেখাচ্ছিল অনেকটা-
প্লাস্টিক গুটিয়ে রেখে ঘ্যাস ঘ্যাস করে গা চুলকোচ্ছিল প্রফুল্ল। সুনীলের থেকে তেল চাইবে ভাবল, স্নান করে নেবে তারপর। অন্ধকার কাটে নি এখনও। শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে সরু নদীর মত যে হাওয়া বইছিল এই সময়, তাতে কোনো গন্ধ না থাকায়, হাওয়া বাতাস টের পাচ্ছিল না কেউ। আসলে, আকাশের গা চুলকে দিচ্ছিল বসন্তের বাতাস- চাঁদ তারা ঘন নীল রং এক এক করে মুছে যাচ্ছিল। ভোর হচ্ছিল শহরে। গন্ধহীন এই হাওয়াটুকুর আয়ু শেষ হয়ে আসছিল। গোটানো প্লাস্টিক আবার টান টান করল প্রফুল্ল। ফুটপাথেই পেতে রাখল, ইঁট চাপা দিল দু'দিকে । রোদ কড়া হলে পোকা মরে যাবে।
এদিকের ফুটপাথ রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল একসময়- পথচলতি মানুষজনের বড় তাড়া, লোহার গরাদ হাওয়া করে ফুটপাথ থেকে সটান রাস্তায় নামার পথ করে নিয়েছে অনেকদিন। ধাতব বেড়া যেটুকু বাকি রয়ে গেছে, পুজো নাগাদ রঙের পোঁচ লেগেছিল তাতে, ব্যানার ঝুলেছিল- এখন ছিঁড়ে গিয়ে পুরোনো ন্যাতার মত দেখাচ্ছিল। বসন্তের হাওয়া তার গায়েও লেগেছিল- নিচের দিকটা পত পত করে উড়ছিল - বাড়ি খাচ্ছিল রেলিংএ। একটু পরে বাস টাসের আওয়াজে এই ঝাপটানোর শব্দটুকু হারিয়ে যাবে।
সুনীলের কাছে যেতে রাস্তা পার হতে হয়। প্রফুল্ল রেলিং এর কাছেই ছিল। ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তায় পা রেখেছে দু সেকন্ড, রাস্তা পেরোবে; ডান দিক থেকে গোঁ গোঁ করে ছুটে এল কালো গাড়ি , প্রচন্ড স্পীডে টার্নিং নিতে কাত হয়ে গেল একদিকে, বিকট শব্দে ধাক্কা খেলো ফুটপাথে তারপর উল্টে গেল। চোখের নিমেষে রেলিংএ হাত রেখে রাস্তা থেকে পা তুলে নিয়েছিল প্রফুল্ল, মরচে ধরা রেলিংএ হাতের তালু রেখে শরীরের ভার ট্রান্সফার করেছিল চকিতে ,ঝাঁপ খেয়ে ফিরে এসেছিল ফুটপাথে। শরীর কাঁপছিল প্রফুল্লর- নাথু, কপিল ছুটে এসেছিল। গাড়ির দরজা ভেঙে গিয়ে ড্রাইভারের সীট থেকে পিছলে বেরিয়ে এসেছিল মৃত আরোহী। বিচূর্ণ শকট , থ্যাঁৎলানো মাথা , রক্তে ভেজা ফুটপাথ দেখতে ভীড় জমছিল এই সকালেই।
"পাঁড় মাতাল শালা। মেয়েছেলে নিয়ে ফূর্তিতে বেরিয়েছিল" - দাঁতন করতে করতে কে যেন বলল।
অ্যাম্বুলেন্সের হুটার শোনা যাচ্ছিল। পর পর তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ঝটপট করে আকাশে উড়ল কাকগুলো। পাক খেতে লাগল।প্রফুল্ল বসে পড়েছিল ফুটপাথে। নাথু একটা খুরিতে দুধ এনে দিল।
-ঘাবড়াও মৎ। সারে কুছ বিলকুল ঠিক হ্যায় রে। তোকে কে মারবে? মিস্টার ইন্ডিয়া হ্যায় না তু? ক্যা? পী লে-
গা, হাত পা চুলকোচ্ছিল বড্ড - প্রফুল্ল উঠে পড়ল আবার। সুনীলের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল- তেল নেবে। ওর পিছন পিছন প্রবল উৎসাহে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে শোভাযাত্রা করে চলল কাঁসি আর পটল - - আধঘুমন্ত এই শহরে প্রফুল্লর মারাত্মক স্পীড ভল্টের একমাত্র দর্শক এবং ফ্যান।
সাহিল মোড়ার দর করছিল , হাতে ঝুলিয়ে দেখে নিচ্ছিল ওজন। আবার রেখে দিচ্ছিল।
-কঙ্কণা, এদিকে দেখো, বাড়ির জন্য নেবে না কি?
-ফেরার পথে ইলামবাজারের ওদিক থেকে কিনে নেব-
-খয়েরবুনির মোড়া। হ্যাঁ, সেও করা যায়। তবে কেঁদুলির একটা স্মারক হত, হত না?
- বরং সিদ্ধাসন পাথরটাই নিয়ে চলো- তোমার উপন্যাস শেষ হয়ে যাবে আপসে- উনিই শেষ করে দেবেন-
- আমার মত লেখকের পাণ্ডুলিপিতে উনি হাত ছোঁয়ান না- তাছাড়া, উনি সংস্কৃত ছাড়া আর কিছু জানেন না। আমার লেখা পড়তেই পারবেন না-
- চুপ করো অবিশ্বাসী, কথা কোয়ো না।একটা চুবড়ি নিলাম। দ্যাখো। রং করে নেব- ল্যাম্পশেড হবে। হাতপাখা নেব? দ্যাখো, এদিকের গুলো-কেমন ঝালর দেওয়া-
সাহিলকে মোড়া বেঁধে দিচ্ছিল দোকানী। মাটির একচালা দোকান- পুরোনো খবরের কাগজ, পাতলা বই থেকে পাতা ছিঁড়ে মুড়ে দিচ্ছিল চুবড়ি, হাতপাখা। কঙ্কণা আঁতকে উঠেছিল, “ওমা বই ছিঁড়ছেন কেন? যাঃ ছিঁড়েই ফেল্লেন তো- -দেখো কী লেখা- কত চিঠি- এডিটরকে লেখা চিঠি সব”
-কী ম্যাগাজিন?
- জানি না, মলাট নেই, ছিঁড়ে গেছে- ওমা,এই দেখো কী লেখা আছে- পড়ি? 'প্রিয় সম্পাদক, পুজো সংখ্যা পেয়েছি। বেশ ভালো হয়েছে। সেরা গল্প লিখেছেন…'- এখানটা পড়া যাচ্ছে না , দূর। তারপর লেখা, 'সেটি সেরা কেন, সে লেখার সময় নেই। কারণ এখন রাত্রি ১টা ২০মিঃ। সুযোগ দিলে একটা গল্প লিখব আগামী সংখ্যায়। 'অজয়ের কুলে' লেখাটা পাঠিয়ে দিলাম'।
- হা হা -এই জন্যই উপন্যাস শেষ করছি না- শেষ করলেই ঠোঙা। একটা লেখার আয়ু আর কতদিনের?
-আগে তো লেখো। এই দেখো এই মোড়কে একটা কবিতা-
সাহিল তাকালো না, জিগ্যেস করল-" এই বুদ্ধিমতী মাশা, এস্কোবারের হিপ্পোদের কথা জানো?
- না-
- আরে সেই পাবলো এস্কোবার
-লাভিং পাবলো?
-হ্যাঁ সেই পাবলো- পারসোনাল জু ছিল একটা। সেখানে জলহস্তী এনেছিল কোথা থেকে যেন- কলম্বিয়ায় কোনো হিপ্পো ছিল না তখন। তারপর পাবলোকে তো মেরে ফেলল। কিন্তু জলহস্তী রয়ে গেল। সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে ম্যাগডালেনা নদী ছেয়ে গেছে। মেরে না ফেললে , ইকোসিস্টেম চেঞ্জ করে দেবে। পাবলোকে এখন কী বলে জানো?
-কী?
-ইকোলোজিকাল টাইম বম্ব। টাইম বম্ব। আমার লেখা যেন পাবলোর জলহস্তীর মত হয় - যা আগে ছিল না, তারপর ছেয়ে নিল- যেন ঠোঙা না হয় । কঙ্কণা, যেন ঠোঙা না হয়- টাইম বম্ব হোক বরং
সাহিলের কনুই ছুঁলো কঙ্কণা-হবে। কেঁদুলির বালির চরে, সূর্যের নিচে কঙ্কণার চোখে চোখ রাখল সাহিল-
"That kisses are not contracts and gifts are not promises,
and you start to accept defeat with the head up high and open eyes,
and you learn to build all roads on today,
because the terrain of tomorrow is too insecure for plans…
and the future has its own way of falling apart in half."
ইলেকশনের মুখে এখন রোজই মীটিং। সকাল থেকে মিষ্টির দোকানের সামনে ম্যারাপ বাঁধছিল পার্টির ছেলেরা। সাউন্ড বক্স, চেয়ার ডাঁই করে রাখছিল। দুপুরে কচুরি , মিষ্টি খেল। জল চেয়ে খেলো অনেকবার। সুনীল দুটো প্লাস্টিকের জাগ ভরে জল রেখে গেল। চা দিল দুবার। কচুরি, মিষ্টির দাম নিলো না। রঘু ঠেলা মারল প্রফুল্লকে- "পার্টির ছেলে তো। তোয়াজ করছে হেব্বি। তোর বাড়িটা দখলে রাখতে হবে না? -" প্রফুল্লর মাথা দপদপ করে- একদিন নাথুকে এই কথা শুনে মারতে উঠেছিল - "শালা আমি মিস্টার ইন্ডিয়া। ঘর নেই, বাড়ি নেই, কেউ নেই। ঘর দোর থাকলে শ্রীদেবী আসে না-"
-মিস্টার ইন্ডিয়ার মত উড়তে পারিস তুই?
-মিস্টার ইন্ডিয়া উড়ত না, ভ্যানিশ হয়ে যেত-
- উড়ত । পাক্কা উড়ত । আমি দেখেছি।
প্রফুল্ল এই সব সময়ে চুপ করে যায়। ও ও যে টাঙ্গায় বীরু আর বাসন্তীকে দেখেছে- এই কথা পেট থেকে গলা বেয়ে জিভের কাছে বুড়বুড় করে। গিলে নেয়। চেপে যায় বেমালুম। প্রফুল্ল জানে, নাথুও ওর মত স্টার দেখেছে। রাতের দিকে এই সব সীন দেখা যায় - সারা শহর যখন ঘুমায় , সিনেমাহল থেকে টিভি থেকে স্টাররা বেরিয়ে আসে - টাঙ্গা চড়ে, আকাশে ওড়ে। শুধু শ্রীদেবীকে কেউ দেখে না- জলের তলায় ঘুমিয়ে আছে শ্রীদেবী- জলভর্তি একটা বাক্স- যাকে ওরা বাথটাব বলছিল টিভিতে।
প্রফুল্ল ফুটপাথে চকখড়ি নিয়ে বসে যায়। সূর্য আঁকে, মেঘ আঁকে, পাখিদের উড়ে যাওয়া আঁকে- পাখির ঝাঁকের পাশে একটা টুপি পরা লোক আঁকলে টুপটাপ পয়সা পড়ে। খুচরো কুড়োতে কুড়োতে নাথুর কথা মনে ধরে ওর। ফুটপাথের ওপর দুবার ছোটোলাফ দিয়ে একটা মস্ত বড় লাফ দেয়- দুপাশে দু হাত ছড়িয়ে; এরপর সে দৌড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। ভর দুপুরে বড় রাস্তায় ট্রাক, টেম্পো, বাস, রুটের অটো থিকথিক করছিল। প্রফুল্লর মনে হয়েছিল- ওর একটা লম্বা রানওয়ে দরকার -যার ওপর দিয়ে সে প্রথমে দৌড়ে যাবে অনেকখানি , আস্তে আস্তে স্পীড বাড়াবে তারপরে দুহাত দুদিকে দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে পা তুলে নেবে রাস্তা থেকে- তারপর সম্ভবত একটা ঘুড়ির আকাশে ওঠার মত ফড়ফড় আওয়াজ করে আকাশে ভাসবে ; ব্যালান্স এসে গেলে মিস্টার ইন্ডিয়ার মত রাস্তার প্যারালেল উড়বে - নিচে নাথুর মাথার ওপর ছায়া পড়বে ওর। এইজন্য একটা ফাঁকা লম্বা রাস্তা ওর খুব দরকার। আজ পার্টির ছেলেদের কাজ দেখতে দেখতে প্রফুল্লর মনে হল , একটা বড়া হরতাল হলে ভালো হয়। তখন ফাঁকা রাস্তায় টেক অফ ট্রাই মারবে প্রফুল্ল।