বড় রাস্তা থেকে অনেকখানি ভিতরে ইতিহাসবিদের বাড়ি; ফুটবল মাঠ পেরিয়ে কদম গাছের নিচে ইয়াং স্টার ক্লাবের কথা বলেছিল প্রণতিদি- ল্যান্ডমার্ক হিসেবে; অন্ধকারে সাহিলরা গাছটা মিস করেছে। শীতের সন্ধ্যায় ফুটপাথের কোনো কদমগাছকে কেমন দেখতে হতে পারে - সাহিলের ধারণা ছিল না -কঙ্কণার ওপর নির্ভর করছিল আগাগোড়াই। সাহিলরা চারটের মধ্যে বেরোবে ভেবেছিল- লাস্ট মোমেন্টে তপনদা সাইটে মীটিং ডাকে। এই ব্যাপারটা কঙ্কণাকে জানাতে গিয়ে সাহিল তারে আমি শুধাই তুমিতে আটকে যায়। আসলে, কঙ্কণা রিংটোন বদলায় ঘন ঘন। এবারে অনেক দিনের আমার যে গান দিয়েছিল; ফলে , কঙ্কণাকে ফোন করে - দেরি হবে বলতে গিয়ে সাহিল বার কয়েক ওর নতুন রিংটোন শুনেছিল- এতে কিছু সময় যায়। উবের পেয়েছিল সহজে কিন্তু আরো মিনিট কুড়ি মিছিলে আটকে। ফলে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল, মশা তাড়ানোর ধোঁয়া গলি উপচে চোখে ঢুকছিল; মূলত একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ওরা। সাহিল যে উপন্যাস লিখবে মনে করেছিল, তার জন্য সে এক জাদুকরকে খুঁজছিল -যাঁর সন্ধান দেবেন একজন ইতিহাসবিদ। আর এই শীতের সন্ধ্যায়, সেই ইতিহাসবিদের সন্ধানে স্রেফ একটা অচেনা কদমগাছ মিস করে গিয়ে চক্কর খাচ্ছে কঙ্কণাসমেত- গোটা ব্যাপারটার আকস্মিক জটিলতায় মজা পাচ্ছিল সাহিল। কঙ্কণা ভুরু কুঁচকে কদমগাছ খুঁজছিল - ফাইনালি ইয়াং স্টারের নিয়ন সাইন দেখতে পেয়ে গায়ে চাদর টানল; বড় রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকলে তাপমাত্রার অন্তত দু ডিগ্রি ফারাক - বাড়ি খোঁজার টেনশনে এতক্ষণ বোঝেনি। হাল্কা কেশে দু হাতের তেলো ঘষে নিল সাহিল।
ওরা এখন দোতলার ঘরে - অজস্র বই, জাবদা খাতা টেবিলে এবং সোফায়; কাগজের ফাইল টাল করে রাখা সবখানেই ; পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ, রীডিং লাইট - এসবই সাহিল কল্পনা করে নিয়েছিল ঘরে ঢুকবার আগেই। ওকে বিস্মিত করছিল, এ দেওয়াল ও দেওয়াল জুড়ে ম্যাজিক শো'র পুরোনো সব পোস্টার- পলকা ফ্রেমের বাঁধাই, কাচের আবরণ- কার্টার, থারস্টন, কেলার, সরকার, হুডিনি যেন আড়াল থেকে দর্শকদের নিরীক্ষণ করছেন; একটু পরে বেল বাজলেই পর্দা উঠে খেলা শুরু হয়ে যাবে - যাদুকর তখন সটান ফ্রেমের বাইরে এসে অভিবাদন করবেন সাহিল আর কঙ্কনাকে, আস্তিন থেকে বের করে আনবেন লুকোনো সব তাস, রুমাল, খরগোশ টোশ- ঝটপট করে পায়রারা উড়ে বেড়াবে ঘরময়। সাহিল সামান্য ঠেলা দিয়ে জানলার এক পাট খুলে দিল। কার্টারের বিষণ্ণ মুখ, জ লাইনে ঊষ্ণীষের পালক ছায়া ফেলেছে, হাতের ক্রিস্ট্যাল বল ঘিরে অদ্ভূতুড়ে লাল সবুজ ফিগার সব- নিরাবলম্ব; ঘন নীল পোস্টারে থারস্টনের চারদিকে কঙ্কাল, করোটি- সাহিল ঘুরে ঘুরে দেখছিল। পোস্টারের ফ্রেমে আঙুল ছোঁয়ালে ধুলো লাগছিল হাতে। কাচের শো কেসে নানা মাপের ম্যাজিক ওয়ান্ড , লাল নীল বল, একগোছা দড়ি, তাস - বিবর্ণ হয়ে গেছে। এই প্রাচীন ঘরদোর, স্যাঁতা পড়া দেওয়াল, পুরোনো বই এর গন্ধ, অদৃশ্য মিহি ধুলোয় এই যে আচমকা নাক সুড়সুড় করে ওঠা, শো কেসের কাচে আঙুলের ছাপ- এই সব সাহিলকে লেখায় প্ররোচিত করছিল; উত্তেজনা হচ্ছিল সাহিলের। ঈষৎ ভয় সেই সঙ্গে।
কঙ্কণা ইউনিভারসিটির কিছু রেফারেন্স এনেছিল। তারপর চা, আজকের মিছিল, সি এ এ নিয়ে টুকটাক কথা- কঙ্কণার ইউনিভারসিটি থেকে মিছিল সামনের সপ্তাহে-
ইতিহাসবিদ মাথায় আঙুল চালিয়ে অন্যমনস্ক হলেনঃ
- দেখুন, জাহাঙ্গীরনামায় সাতজন জাদুকরের কথা ছিল- এত পুরোনো কিছু আপনারা চাইছেন না সম্ভবত।
এইখানে সাহিল গলা খাঁকরে নিজের উপন্যাসের কথা সংক্ষেপে বলেছিল। সে চান্ডী মুখনের গল্প বলেছিল, তার নোটস রাখার কথা বলেছিল, খ্সড়া শুরু করেছে বলতে গিয়ে সে থেমে যাচ্ছিল বারবার - কখনও আবেগে গলা ধরে যাচ্ছিল, কখনও ভাবতে হচ্ছিল অনেক- কী বলবে, কীভাবে বলবে- তারপর উপন্যাসের চেহারা এখনও তার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয় - বুঝতে পেরে লজ্জিত হচ্ছিল।
-আপনারা তরুণ। লিখবেন নিশ্চয়ই। লিখতে তো হবেই। কিন্তু একটা কথা বলুন, চারদিকে যা সব হচ্ছে, আপনাদের মনে হয় না, আমরা যেন একটা উপন্যাসের মধ্যে অলরেডি ঢুকেই পড়েছি? আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, একটা পপ আপ বই এর পাতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, পাতা ওল্টাবো কেমন করে জানি না-
"আমাদের তুমি করে বলুন, স্যার", কঙ্কণা বলেছিল।
শীতের বিকেলে বৃষ্টি হলে ঠান্ডা যেন চামড়া ফুটো করে হাড়ে ঢুকে যায় সটান, তার ওপর ভেজা ফুটপাথ শুকোতে অনেক সময় নেয়- রাতে শোয়ার জন্য একটা শুকনো জায়গা খুঁজছিল প্রফুল্ল। এমনিতে, মন্দিরের সামনের ফুটপাথে প্লাস্টিক পেতে শুয়ে থাকে। গতবছর একটা কম্বল পেয়েছিল - সেদিন কালীমন্দিরে শ্রাদ্ধ- প্রফুল্ল, কপিল, নাথু আর রঘুবীর ফুটপাথে বসে পিন্ডমাখা দেখছে- ন্যাড়া মাথা দুটো ফরসা ছেলে পুজো করতে করতে চোখ মুছছিল। কাজ মিটে গেলে ছেলেদুটো ওদের হাতে লাড্ডু দিল। তারপর টাকা, ধুতি আর কম্বল। গতবারের শীত এই কম্বলের নিচে দিব্যি কেটেছে; তারপর প্লাস্টিক মুড়ে রেখে দিয়েছিল।
প্রফুল্লর কম্বলটা নীল, ঘন নীল রংএর। এবি ইলেকট্রনিকসের সামনের ফুটে দাঁড়িয়ে পেল্লায় টিভি স্ক্রীনে ও শ্রীদেবীকে কতদিন এই রকম নীল সমুদ্রের সামনে নাচতে দেখেছে। নাথু বলেছিল, "শ্রীদেবী মরে গেছে। এ অন্য কেউ। ক্যাট্রিনা।"
রঘুবীর তর্ক করেছিল, "শ্রীদেবী কখনও মরতে পারে? জোয়ান মেয়েমানুষ। ক্যা লচক।" প্রফুল্লকে বলেছিল, "তুই তো পেপার পড়িস। লিখেছিল পেপারে?"
"বিলকুল লিখেছিল। জলে ডুবে মরে গেছে নাহাতে গিয়ে।" নাথু উত্তেজিত হয়ে চেঁচাল।
মাথা নেড়েছিল প্রফুল্ল, "না, পেপারের লোক ভুল লিখেছিল। শ্রীদেবী একদিন জলের তলা থেকে উঠে আসবে, জাহাজে করে আসবে। পেপারের লোক জানে না"।
-মরা মানুষ আবার ফিরবে কী করে?
- শ্রীদেবী ডুবে গেছে। কিন্তু মরে নি। মরে নি তো। জাহাজ খুঁজছে। পেয়ে গেলেই আসবে।
-যাদুকর না স্টান্টম্যান জানি না। হুডিনির আনডার ওয়াটার এসকেপ স্টান্ট দেখাতো নীলকমল। গণপতি চক্রবর্তীর ভক্ত ছিল। নীলকমলই যে ওর সত্যিকারের নাম- তাও হলফ করে বলতে পারব না। একটা সময় মাদ্রাজে গেল- মানে বলেছিল, মাদ্রাজ যাচ্ছে, কোন সার্কাসে চাকরি করছে, স্টান্ট দেখায়, এসব শুনতাম। ফিল্ম লাইনেও চেষ্টা করেছিল কিছু। বছর দুই পরে ফিরে এসে বলল, ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াবে। পয়সা কড়ি ছিল না। চটের বস্তা, দড়ি, ইঁট, পাথর -এইসব দিয়ে মফস্সলে, গ্রামে গঞ্জে খেলা দেখাত নীলকমল। ম্যাজিকাল রোপ টাইজ অ্যান্ড সিক্রেট পড়ে টড়ে স্পেশাল কিছু নট ব্যবহার করত, তার ওপর ফিটনেস, শরীরের ফ্লেক্সিবিলিটি দুর্দান্ত ছিল- ফলে প্রতিটি শো হিট। তখন অনেক মেলা টেলাও হত তো। হুডিনির খেলাটা সবাই দেখতে চাইত।
-আপনার সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে? ঠিকানা বা ফোন নম্বর?
-ওর ফোন ছিল না। ঠিকানা জানি না- এটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। আমি তখন ঘুরে ঘুরে গণপতি চক্রবর্তীর শিষ্যদের খোঁজ করতাম। নীলকমলের সঙ্গে আলাপ হল। তারপর নিজেই আসত, নানা দেশের ম্যাজিকের গল্প টল্প করত। নীলকমলের একটা ইন্টারভিউ নেব ভেবেছিলাম। তারপর একদিন উধাও হয়ে গেল। আমিও তখন অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত। নীলকমলকে নিয়ে ভাবিই নি আর; তবে নানা কথা কানে এসেছে- সত্যি মিথ্যে তো জানি না। শুনেছিলাম, মহিলাঘটিত ব্যাপারে পুলিশের হাতে পড়েছে, আবার এও শুনতাম নীলকমলের সঙ্গে পুরুষমানুষদেরই সম্পর্ক- জটিল কোনো গোলমালে ফেঁসেছে - জানি না কিছুই। আবার হয়ত সার্কাসেই ফিরে গেছে। অসুখ বিসুখ করে থাকতে পারে। এমনও হতে পারে- বেঁচে নেই। আসলে, ভ্যানিশ হয়ে গেল একদম। তুমি চান্ডী মুখনের কথা বললে, আর আমার নীলকমলের কথাই মনে এল - যেভাবে এন্ট্রি নিয়েছিল একদিন আর যেভাবে ... -ওর মত আর কাউকে দেখি নি, সত্যি-
- নীলকমলের কোনো ছবি টবি আছে আপনার কাছে?
-না। তখন কথায় কথায় অত ছবি তোলা তো ছিল না- সুপুরুষ ছিল নীলকমল, ওয়েল বিল্ট, রাজাদের মত পাকানো গোঁফ - কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সেটা নকল ।
-নকল গোঁফ?
- আমার মনে হয়েছিল আর কী। গোঁফে হাত দিত থেকে থেকে একটু নাটকীয় ঢঙে। শো থাকলে, পাগড়ি টাগড়ি পরে খুব সেজে গুজে আসত , বুঝলে? সঙ্গে একটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, চটের বস্তা, দড়ি, ইট, পাথর, এই তো- কিন্তু ঐ যে কী বলে অ্যাপিয়ারেন্স - ওকে মফস্সলের পুকুরঘাটে মানাতো না, মনে হত রূপকথার জগত থেকে উঠে এসেছে; ওর অনেক শোতে আমি গিয়েছি, প্রচুর মেয়ে সেই সময় ওর প্রেমে পড়েছিল- মুগ্ধ দৃষ্টিতে সব তাকিয়ে থাকত- দেখেছি তো । বিজয় নামে একটি ছেলে আমার কাছে আসত-ম্যাজিকের বইপত্রের খোঁজে- নীলকমলের ভক্ত ছিল খুব; বিজয়ের একটা নম্বর লেখা আছে- দিচ্ছি দাঁড়াও। যদি কোনো ইনফরমেশন দিতে পারে-
-থ্যাঙ্কু স্যার। থ্যাংকস টন।
দরজা অবধি এগিয়ে দিতে এসেছিলেন ইতিহাসবিদ।
"হঠাৎ মনে পড়ল, প্রচুর পড়াশোনা করত নীলকমল। "ডিস্টিঙ্কশন বিটুইন পাস্ট, প্রেসেন্ট অ্যান্ড ফিউচার ইজ অনলি আ স্টাবর্নলি পারসিস্টেন্ট ইলিউশন'.... - খুব আওড়াত। তোমার উপন্যাস শেষ হলে পড়িও কিন্তু। গুড লাক -"
গলির মুখে এসে একবার পিছন ফিরেছিল সাহিল। দেখেছিল, বড় চৌকো অন্ধকার বাক্সের একপাশে ছোটো উল্লম্ব আয়তাকার ক্ষেত্র , ম্লান হলদে আলোয় ইতিহাসবিদের লম্বা শিল্যুট, পিছনে পুরোনো সিঁড়ির আভাস আউট অফ ফোকাস হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ -
গোটা ছবিটায় সাহিল শুধু অ্যাড করেছিল লাল সবুজ উড়ন্ত কিছু ফিগারিন, তারপর এই সন্ধ্যার যাবৎ আলো ছায়া, এবং জ্যামিতি মগজে পুরে নিয়ে মাফলারে কান, মাথা ঢেকেছিল ।
কালীমন্দিরের সামনের ফুটে প্রফুল্লর যখন মাথা চুলকে ওঠে, ও জানে এটা ফিলিম শুরুর সময়। ওর চাঁদির ওপর যে সব ছোটো বড়ো মাঝারি ঘা- তার কোনো একটিতে হাত পড়লেই রীলের পর রীল সাদা কালো ছবি যেন ওর কপাল ফুটো করে কির কির আওয়াজে বেরোতে থাকে - ফুটের উল্টোদিকের দেওয়াল জুড়ে সিনেমা শুরু হয়ে যায় তখন। কাঁসির গায়ে আলতো চাপড় দিতে দিতে প্রফুল্ল হাঁ করে দেখে, লম্বা সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে হাফ প্যান্ট পরা একটা ছেলে ছাদে ওঠে, সাদা ঘুড়ি ওড়ায় কালো আকাশে - সিঁড়িটা এতই প্যাঁচালো যে ছেলেটা ছাদে পৌঁছোনোর আগেই ওর ঢুলুনি আসে-
এত সব ছবি তুললই বা কে আর ওর মগজে তা সেঁধোলো কেমন করে- প্রফুল্ল জানে না। মাথা টলটল করে ওঠে আর নীল কম্বলকে তখন অনেক বড় লাগে -মনে হয় কাউকে ডেকে বলে, অনেক জায়গা আছে এখানে- আ যা মেরে পাস-
ওর পাশে তখন কাঁসি কিম্বা পটল কুন্ডলি পাকিয়ে; রাত বাড়লে, পাশের প্লাস্টিকের ওপর নাথু আর রঘুবীর এক কম্বলের তলায় ঢুকে যায়।
সুনীল অনেকদিন আগে বিয়ের কথা তুলেছিল একবার- " কী রে প্রফুল্ল কত বয়স হয়ে গেল তোর -পাকা চুল, দাড়ি- বিয়ে করবি তো বল। মেয়ে আছে একটা-"
মিষ্টির দোকানে কাজ করত অষ্টমী। সকালে, বিকেলে দোকান মুছতে আসত তারপর সুনীলের বাড়ি যেত- রুটি করতে।
- অষ্টমীকে বিয়ে করলে একটা ঘর ছেড়ে দেব তোকে প্রফুল্ল। ভেবে দেখিস। ভালো রুটি করে মেয়েটা। খুব নরম রুটি রে প্রফুল্ল। খুব নরম। কী রে রাজি?
-বিলকুল নহী
-কেন?
-ম্যয় কোন হুঁ বতা
"তুই তো প্রফুল্ল", থতমত খেল সুনীল।
-মিস্টার ইন্ডিয়া হুঁ ম্যায়-
-যত্ত ইয়ে, অষ্টমীকে পছন্দ কী না বল-
"করতে হ্যায় হাম প্যার মিস্টার ইন্ডিয়া সে" শিস দিয়ে উঠেছিল প্রফুল্ল, সটান হাঁটা মেরেছিল মন্দিরের দিকে।
একদিন আচমকাই বেপাত্তা হয়েছিল অষ্টমী। সুনীলের মেজাজ তিরিক্ষি ছিল অনেকদিন।
আজ মন্দিরের সামনে কাউকে শুতে দিচ্ছে না-কাল কে যেন আসবে; নাথু বলছিল, " ভি আই পি ।" কপিল বলল- "না মন্ত্রীজী।" রঘুবীর চেঁচিয়ে বলেছিল, " মন্ত্রীর নামই ভি আই পি, চুপ হো যা।"
সন্ধ্যার পরে ফুটপাথে সাদা পাউডার ছড়ালো জন দুই লোক তারপর দড়ি দিয়ে ঘিরে দিল জায়গাটা, লাল কাপড় পেতে কয়েকটা ফুলের টব সাজালো। তারপর পুলিস এল- চেয়ার পেতে বসে রইল।
রঘু, কপিলরা কোথায় ভেগে পড়েছিল। প্রফুল্ল ওর প্লাস্টিক আর কম্বল নিয়ে একটা শোয়ার জায়গা খুঁজছে অনেকক্ষণ, কাঁসি ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল- লাইটপোস্টের নিচে কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়েছে এখন। প্রফুল্ল কাঁসির পাশে প্লাস্টিক পাতল। কম্বল টেনে মাথা ঢাকতে যাবে, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল একটা শাদা ঘোড়ায় টানা সোনালি রথ- খটাখট খটাখট আওয়াজ হচ্ছিল ঘোড়ার খুরে । লাল নীল সবুজ ঝিকিমিকি আলো, গান বাজছিল, কাগজ ছড়িয়ে পড়ছিল রাস্তায়। আই ব্বাস- সারে রঙীন - অসলি আদমি, অসলি ঘোড়া- ইয়ে তো ফিলম নহী-
অনেক রাতে রথটা আবার এসেছিল। ঘোড়ার খুরে খুরে মাটির কাঁপুনি টের পাচ্ছিল প্রফুল্ল। কাঁসি কান্নার মত আওয়াজ করে সরে এসেছিল প্রফুল্লর দিকে-
কম্বল সরিয়ে প্রফুল্ল রথের ওপর ধর্মেন্দ্র আর হেমামালিনীকে দেখেছিল একদম স্পষ্ট। ধর্মেন্দ্র খুব হাসছিল। হেমামালিনীর কোমর জড়িয়ে চুমুক দিচ্ছিল বোতলে।
-বেলাপুর রামগড় ফতেপুর কাঁহা যাওগে বোলো
এখান থেকে ডাইনে ঘুরে যাচ্ছিল টিবিএম চন্ডী। মাটির ওপর দেড়শো বছরের ঘর দোর রোয়াক উঠোন, টাইম কলের জল উপচে পড়ছে চৌবাচ্চায়, পাখির খাঁচার পাশে হেলান দেওয়া মোটর সাইকেল; টানা বারান্দা, রান্নাঘর, ডালে সম্বার দেওয়ার গন্ধ, জিরে, মৌরি বাটা, দুধ উথলে গ্যাস নিভিয়ে দিল, গৃহস্থের বসার ঘরে টিভিতে লোকসভায় সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নিয়ে ডিবেট চলছে।
শূন্যে বোতল ছুঁড়ল ধর্মেন্দ্র - হাউইয়ের মত হুউস করে উঠে লাইটপোস্ট ছুঁয়েই আছাড় খেলো রাস্তায়। আলোর ডুম ফটাস করে বার্স্ট করার ঠিক আগের মোমেন্টে হেমাকে অষ্টমীর মত লাগল প্রফুল্লর -
-চল ধান্নো।