মাটির নিচে দিনভর তুলকালাম। টি বি এম চণ্ডী পশ্চিমের দিকে টানেল খুঁড়ছে, উর্বীর মুখ পূবে ফেরানো। মৌলানা আজাদ কলেজের কাছ থেকে নির্মলচন্দ্র স্ট্রীটের দিকে বাঁক নিচ্ছে টি বি এম-বৌবাজার মোড়ের নিচে ডান দিকে বেঁকে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীটের তলা দিয়ে শিয়ালদা পৌঁছবে। নির্মল চন্দ্র আর বি বি গাঙ্গুলির অবস্থান নিখুঁত সমকোণে; এইখানে টানেলের কারভেচার বাড়াতে, দুশো বছরের পুরোনো ঘরদোরের চোদ্দো মিটার নিচে মাটি খুঁড়ছে বোরিং মেশিন। সেই সব পুরাতন ঘর দোর উঠান গলি ঘুঁজি পেরিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটছিল দু'জন - যেন সরস্বতী ঠাকুর আর এক পাতাখোর।
সূর্য ডুবে গেলে, কঙ্কণা আর সাহিল একসঙ্গে হাঁটে- সাহিলের গোঁফ, দাড়ি, ঝাঁকড়া চুল, রোগা একহারা শরীরে সারাদিনের ময়লা লাগা শার্ট, জীনসে মাটি তেলকালি আর চায়ের দাগ- পরশু চায়ের ভাঁড় উল্টেছিল ; কঙ্কণার অপার্থিব গ্রীবায় কয়েক ফোঁটা ঘাম, সরু চেন। সাহিল আড়চোখে দেখল। সে জানে না এই মেয়ের সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ- শরীরের খেলার সময় সাহিলের মনে হয়, এই মেয়েটি তাকে ভালবাসে। সে ও। একসঙ্গেই থেকে যাবে বাকি জীবন। আবার বাকি জীবন কথাটাই তার আশ্চর্যরকম অতল মনে হয়, যা মনে মনে উচ্চারণ করলেও যেন দমবন্ধ হয়ে ডুবে যেতে হয়; আলটিমেটলি, কথাটা মাথার ভেতর থেকে একদম শিকড়সমেত উপড়ে ফেললে, কিছু রক্তপাত ঘটে, কিন্তু ভেসে ওঠা যায়। কঙ্কণাও ভালবাসা, বাকি জীবন জাতীয় শব্দ মুখে আনে না; যদিও কঙ্কণারও দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয় কী না- সাহিলের অজ্ঞাত। ভালোবাসা সম্বন্ধে, নিজের উপন্যাসের প্লটের মতই সাহিলের ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়। এই সব অস্পষ্টতা তাকে ঘন ঘন এক সংশয়ের সামনে দাঁড় করায়- সে সংশয়কে কখনও অনতিক্রম্য সুবিশাল পাহাড় মনে হয়; সাহিল ভয় পায়, হতাশ হয়, কঙ্কণার শরীরের কাছে যায়, তারপর আবার লিখতে বসে। সে সংশয় লেখে, ভয় লেখে, অন্ধকার লেখে, তারপর ছিঁড়ে ফেলে; সাহিলের লেখা শেষ হয় না কারণ তার কোনো গন্তব্য নেই, সে কোথায় যাবে -জানে না।
আপাতত দুজনে স্টেশন অবধি যাচ্ছিল। ইউনিভার্সিটি ফেরত কঙ্কণা এলে, দুজনে হাঁটে। তারপর একই ট্রেনে উঠে কঙ্কণা আগে নামে; সাহিলের স্টেশন আসতে আরো এক ঘন্টা। ডাউনের পরপর দুটো ট্রেন বাতিল হওয়ায় আজ প্ল্যাটফর্মে অন্যদিনের তুলনায় ভীড় বেশি, তার মধ্যে বার কয়েক প্ল্যাটফর্ম নম্বর ভুল ঘোষণায় নিত্যযাত্রীর ভীড় একটা অগোছালো প্যাটার্ন ফর্ম করছিল- বাইরে থেকে মানুষজন ধীরে সুস্থে স্টেশনে ঢুকছিল, প্ল্যাটফর্মের ওপর মানুষ তখন হুড়মুড় করে একদিকে ছুটছে; ধীরগতির মানুষের একাংশর গতি কমে যাচ্ছিল, অন্যদল দ্রুতগতির দলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। গতিহীন যাত্রীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে সাহিল আর কঙ্কণা চা খাচ্ছিল তখন।
"আমি তখন ক্লাস ওয়ান, বোন আরো ছোটো, বাবা, মা র সঙ্গে চিড়িয়াখানা দেখে ফেরার পথে এই রকম হট্টমেলার মধ্যে পড়েছিলাম" সাহিল বলল। " ভেবেছিলাম হারিয়ে গেছি-এত লোক চারদিকে -লম্বা লম্বা লোক- কে বাবা কে মা গুলিয়ে গিয়েছিল- সবাইকেই মনে হচ্ছে বাবা- আমাকে খুঁজে নিতে হবে সত্যিকারের বাবাকে - সে কী কান্না! আসলে হারাই নি-কী অদ্ভূত না?
- ছোটো বাচ্চা ভীড় দেখে ভয় তো পাবেই-
- এখন অবাক লাগে। এত ভয়ের কী ছিল - ভাবি। কী মনে হয় জানো? মানুষের মুখ দেখতে না পারলে ভয় তৈরি হয় একটা-
-সব বয়সেই। ছোটো বেলায় অবভিয়াসলি বেশিই-
- একটা হাইটের ব্যাপার আছে কোথাও। কোন হাইট থেকে দেখছ- ধরো, মানে তর্কের খাতিরে ধরো, আমি যদি একটা লম্বা বাচ্চা হতাম মানে ভীড়ের মধ্যেও বাবার মুখ মা র মুখ দেখতে পেতাম-
- মানে এই ভীড়ে আজ আমি হারিয়ে গেলে তুমি একটা লম্বা বাচ্চা -কাঁদবে না। তাই তো?
হাসতে গিয়েও গম্ভীর হ'ল সাহিল।
আজ চায়ের দোকানে প্রফুল্ল ছিল না। রঘুর সঙ্গে সুনীলের দোতলার ঘর পরিষ্কার করছে সকাল থেকে। সুনীল কখনই প্রফুল্লকে কোনো কাজ করতে বলে না; সকালে, রাতে নিজে থেকেই সামান্য খেতে দেয়, তারপর হাত জোড় করে নমস্কার করে- যেন ঠাকুরকে ছোটো থালায় ভোগ দিচ্ছে। আজও সুনীল কিছু বলে নি প্রফুল্লকে, বরং রঘুকে ঘর সাফ করতে বলেছিল- কোন দূর দেশ থেকে কারা এসে থাকবে নাকি। রঘু বলেছিল, "বিলাতী লোক হোটেলে থাকবে, এখানে কেন?" সুনীল ধমকে উঠেছিল- "যা বলছি, তাই কর। দু' বেলার খোরাকি, তিনশো টাকা দেব।" রঘু প্রফুল্লকে বলেছিল, "তুইও চল"।
প্রফুল্ল এর আগে এ'বাড়ির দোতলায় ওঠে নি। দোলের দিনে, কয়েকবার একতলার উঠানে চৌবাচ্চার জল তুলে স্নান করেছিল। আজ রঘুর সঙ্গে দোতলায় উঠেছে - চওড়া সিঁড়ি, লোহার রেলিঙে কলকার কাজ, দোতলার বারান্দায় টবে গাছ; রঘু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল। রেলিংএ হাত বোলাচ্ছিল। মিস্টার ইন্ডিয়ার বাড়ির মত লাগছিল প্রফুল্লর, আর রঘু যেন ক্যালেন্ডার; জিন্দগি কি ইয়ে রিত হ্যায় গাইছিল প্রফুল্ল- গলা ছেড়ে। রঘু বলছিল- কাটে নাহি টা গা।
লম্বা টানা বারান্দা, তারপর একটা দুটো তিনটে চারটে পাঁচটা ঘর- পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে আরো ওপরে- তিনতলায়। রঘু পরপর চারটে ঘরের তালা খুলল- দরজায় ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে জানলা খুলতে শুরু করল; "হাত লাগা"- প্রফুল্লকে বলল। জানলা খুলে দিতে রোদ এসে পড়ছিল সাদা কালোয় ফুলকাটা মেঝেতে। সামান্যই আসবাব ঘরে- চেয়ার, গোল একটা টেবিল, ছত্রীওলা খাট - সবই ভারি কাপড় দিয়ে ঢাকা, ধুলোর গন্ধ ঘর জুড়ে। রঘু হাঁচল চারবার। তারপর নাকে মুখে গামছা জড়িয়ে কাপড়ের ঢাকা সারাতে লাগল টেনে টেনে। ধুলো বালি কিচকিচ করছিল ঘর জুড়ে- মেঝের ওপর ধুলোর স্তর এতই পুরু যে রঘু আর প্রফুল্লর পায়ের ছাপ স্পষ্ট ঠাহর করা যাচ্ছিল। রঘু চেঁচিয়ে বলল-" ডান্ডা মপ লাগেগা সুনীলদা-"
-নিচে এসে নিয়ে যা। তোর মিস্টার ইন্ডিয়াকে বলিস তো ওর থলিটা নিয়ে যেতে-
-কোন সা থলিয়া?
-বারান্দার কোণে পড়ে আছে কবে থেকে। নিয়ে যেতে বলিস।
- প্রফুল্ল, তু ইধার রুক জারা, বালতি, মপ লানা হ্যায়।
প্রফুল্ল ঘুরে ঘুরে দেখছিল। ঘর থেকে বারান্দায়, আবার ঘরে ঢুকছিল, এক ঘর থেকে অন্যঘরে- আসবাবের ওপর জমা ধুলোয় আঙুল দিয়ে ছবি আঁকছিল- তিনটে চোখের নিচে লম্বা একহাত জিভ, পাখি, ঘুড়ি, চাঁদ, সূর্য-
দুই নম্বর ঘরে দেওয়ালের তাকে থাক দেওয়া বইখাতার পাশে কবেকার এক ট্র্যানজিস্টর রেডিও - চৌকো এবং ঘন নীল, ইয়া লম্বা অ্যান্টেনা - প্রফুল্ল অ্যান্টেনা ওঠালো নামালো, নব ঘোরালো - একটা সবুজ আলো জ্বলে ওঠার কথা ছিল। প্রফুল্ল নব ঘোরালো বাঁদিকে, আবার ডানদিকে, হাতে তুলে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। এই সময় রঘু একটা বালতি হাতে ঢুকেছিল, অন্যহাতে চটের থলি - দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা- ' এ প্রফুল্ল, ইয়ে তেরা হ্যায়- হ্যায় কেয়া ইসমে? ' প্রফুল্ল মাথা চুলকালো, তারপর হাত বাড়িয়ে থলিটা নিল। রঘু বালতিতে জল ভরতে বাথরুমে গিয়েছিল। প্রফুল্ল থলির মধ্যে ঢুকিয়ে নিল নীল ট্র্যানজিস্টার- এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে ঢুকিয়ে নেওয়া নয়- যেন নিজের জিনিস ভুলে রেখে গিয়েছিল, আজ ফিরে পেয়ে তুলে নিল।
ঘর মুছছিল রঘু। বালতির জল ঘোর কালো হয়ে উঠলে, সে বালতি দিচ্ছিল প্রফুল্লর হাতে, কোমরে হাত রেখে দম নিয়ে নিচ্ছিল; প্রফুল্ল ময়লা জল বাথরুমের নালীতে ঢেলে, পরিষ্কার জল নিয়ে এলে, রঘু কাজ শুরু করছিল আবার। রঘুর হাতে জলভরা বালতি দিয়ে বারান্দা থেকে সুনীলের একতলা দেখছিল প্রফুল্ল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন, বড় চৌবাচ্চায় টাইম কলের জল আসছে- উঠোন থেকে দু ধাপ সিঁড়ি, তারপর দোতলার মতই টানা বারান্দা, পর পর ঘর- কোনো ঘরের দরজা খোলা- ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে আসছিল বারান্দার দিকে। পাশাপাশি দুটো বন্ধ দরজা একতলায়, বারান্দার দিকের জানলার পাটও ভেজানো। প্রফুল্ল তাকিয়ে আছে- কপাল বেয়ে ঘাম নামছে, মাথা চুলকোচ্ছে আর চোখ পিট পিট করছে; একটা দরজা খুলে গেল আচমকা - ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে গেল অনেকখানি- প্রফুল্ল তখন একটা মেয়েমানুষ দেখ্ল সেই ঘরে- স্রেফ শায়া পরা মেয়েমানুষ- ঘরের ভেতর থেকে বারান্দার দিকে আসছিল যেন। এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল কপাট। প্রফুল্ল মাথা চুলকে নিল- ভরদুপুরে সিনেমা শুরু হওয়ার কথা নয়, সাদাকালো ছবিও ছিল না- শায়ার রঙ সবুজ ছিল, মেঝের রঙ লাল- সে হলফ করে বলতে পারে। প্রফুল্ল কেমন লজ্জা পেল- যেন এই দৃশ্য তার দেখার কথা নয়; সরে এসে তিনতলার সিঁড়ির রেলিংএ হাত রাখল এবারে আর ওর আচমকাই মনে হ’ল, এ সিঁড়ি বেয়ে উঠলে বিরাট ছাদ, ছাদের কোণে একটা ঘর আর বিস্তর পাখি থাকার কথা- প্রফুল্ল যেন এ' রকম কোনো একটা সীন রাতের দিকে সিনেমায় দেখেছে-
সাইটের তপন বলল- "তোমাদের কাগজপত্র সব ঠিক আছে তো? চারদিকে যা চলছে টলছে। বাবা কী বলছেন? অ্যাঁ? সাবধানে থেকো কেমন? দিনকাল ভালো নয়।" সাহিল জবাব দিল না। এই সব কথোপকথন সে এড়িয়ে যায়। এই ধরণের কথা সে যে খুব ঘন ঘন শোনে- তা নয়। কিন্তু যখন শোনে যেন একটা আগুনের শলা ওর বুক ফুঁড়ে, জ্বলন্ত ভয় ভরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। সাইটে কাজের চাপ অবশ্য ওকে এফোঁড় ওফোঁড় হতে দিল না আজ সকালে; সন্ধ্যার দিকে কনস্ট্রাকশন সাইটে দাঁড়িয়ে সাহিলের মনে হল সে যেন হারিয়ে গিয়েছে- তার চারপাশে হলুদ হার্ডহ্যাট আর হাই ভিসিবিলিটি জ্যাকেট, অর্ধসমাপ্ত টানেলে আলো জ্বলছে, অজস্র সরু মোটা নল ঢুকেছে, বেরিয়েছে, কেবল, ল্যাডার, অর্ধ সমাপ্ত কিম্বা অস্থায়ী কাঠামো ও দীর্ঘ সব ছায়া ওকে ঘিরে- যেন ভিন গ্রহের যান ল্যান্ড করেছে ওর সামনে, ওকে ঘিরে ভিন গ্রহের লোক - যেন এই শহরের দখল নেবে এখনই কিম্বা ওকে নিয়ে উড়ে যাবে।
মাথা টলটল করে সাহিলের। চাকরি ছাড়ার কথা মাথায় ঢুকেই বেরিয়ে গেল- একটা খোঁচার মত। চাকরি তো ছেড়ে দেওয়াই যায় - এই ভাবটা মুঠোয় নিয়ে সাইটের বাইরে এলো সে- চা খাবে। কঙ্কণা এই সময় ব্যস্ত থাকে, তাও ওর নম্বর ডায়াল করল - কী গান দিয়েছে কলার টিউনে কৌতূহল হচ্ছিল। আজ কঙ্কণার নম্বর ডায়াল করে কলার টিউন শুনতে পেলো না সাহিল- বিজি বিজি বিজি। কিছুক্ষণ পরে, নিজেই ফোন করেছিল কঙ্কণা।
-'এই আজ বাড়ি চলে যাচ্ছি সটান। কালবৈশাখী আসছে। তুমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিও। রাত কোরো না।
সাহিলের মনমরা লাগে।
-ফোন করেছিলাম তোমাকে কতবার-
- আরে, সেই বিজনবাবুকে ফোন করছিলাম -লাইন পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। তারপরে এই তো একটু আগে কথা হ'ল-
-এনি লাক?
-চট করে বলে নিই এখন। রাতে ডিটেলে বলব। নীলকমল কোথায় থাকতেন- বিজনবাবু শিওর নন। শিয়ালদার দিকে অনেকবার দেখেছেন; সম্ভবত ট্রেন ধরে মফস্বলে গ্রামে গঞ্জে শো করতে যেতেন। সাহেবগলি নামে একটা রাস্তা আছে নর্থের দিকে। বিজনবাবু বললেন, ওদিকেও স্কুলে শো করতেন এক সময় - সবই যে হুডিনির সেই খেলা তা নয়, অন্য ম্যাজিকও দেখাতেন; বিশেষ করে, স্কুল টুলে কুসংস্কার, গুরুদেবদের ভাঁওতাবাজি এই সব নিয়েও শো করতেন-
-কোনো বিজ্ঞান মঞ্চ বা যুক্তিবাদী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? জিগ্যেস করেছিলে?
- করেছিলাম। নীলকমল কোনো সংস্থা বা মঞ্চর সঙ্গে কাজ করেন নি কোন দিন - সম্পূর্ণ একলার শো, একলার স্ক্রিপ্ট। শুধু ঐ হুডিনির খেলা দেখানোর সময়, একটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সঙ্গে রাখতেন- হাত পা বাঁধা, বস্তায় ঢোকানোর জন্য- বেসিকালি।
-ফোটোর কথা জিগ্যেস করেছিলে?
-ছবি নেই। শো র সময় চড়া মেক আপ নিতেন, পাগড়ি টাগড়ি পরতেন, ঘোরাঘুরির সময়ও বোধ হয় কিছুটা সেজেগুজে থাকতেন- বিজনবাবু বেশ ক'বার খোঁজ করতে গিয়েছিলেন- সাহেবগলিতেও গেছেন ; ডেস্ক্রিপশন দিয়েছিলেন চেহারার- কেউ কিছু বলতে পারে নি। হয়তো লোক সাজগোজ করা চেহারাটাই চেনে। তবে সেদিন স্যার যা বললেন, সেটাই কনফার্ম করলেন বিজনবাবু। একটা সময়ের পরে শো যে আর করেন নি সেটা শিওর। ভ্যানিশ হয়ে গেলেন যেন-জেলে যাওয়ার একটা রিউমার উনিও শুনেছিলেন- সত্যি কী না জানেন না।
- থ্যাঙ্কিউ।
-দূর বাবা- কিছুই তো করতে পারলাম না। তবে বিজনবাবু বললেন, কয়েকজনকে জিগ্যেস করবেন; এই, তুমি আর দেরি কোরো না। ঝড় আসছে।
দুপুরে কালীমন্দিরের সামনের ফুটপাথ তেতে ছিল। মিষ্টির দোকানের ফুটে রোদ পড়ে না। আজ ওখানেই বসেছিল প্রফুল্ল। পটল আর কাঁসি হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছিল। সুনীলের দোকান থেকে মাটির হাঁড়ি নিয়ে এসেছিল প্রফুল্ল, তাতে জল ভরে পটলের সামনে রেখে আকাশ দেখছিল তারপর। রঘু সকালে বলছিল- "আজ ঝড় আসবে, টিভিতে বলেছে, বিকেল হলেই সুনীলের বাড়ির একতলায় ঢুকে যাবি। তোর সঙ্গে আমিও। শালা, নিজের বাড়ি থাকতে ঝড়জলে কষ্ট পাস বেকার"- প্রফুল্ল পাত্তা দিল না। রাতের ফুটপাথে স্টাররা নামে - সুনীলের বারান্দায় শুলে সব মজা মাটি। সেই মেয়েমানুষটার কথা মনে হ'ল হঠাৎ- সবুজ শায়া পরা- রঘুকে বলতে গিয়েও বলে নি সেদিন।
বিকেল থেকে মেঘ জমছিল আকাশে, বেগুনী বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল মন্দিরের ওপরে। গুমগুম করে মেঘ ডাকতেই প্রফুল্ল প্লাস্টিক হাতে মন্দিরের সামনে এলো। চায়ের দোকানে দাড়ি গোঁফ অলা ছেলেটা অনেকক্ষণ বসে আছে আজ। মোবাইলে লিখছে না। মন্দিরের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করল প্রফুল্ল। দুপুরের তেতে যাওয়া শান ঠান্ডা হয়েছে অনেক- পেট পেতে আরাম হচ্ছিল প্রফুল্লর।হাওয়া উঠেছিল। চোখের সামনে ধুলোর বৃত্তে ঝরা পাতা, প্লাস্টিক, শালপাতা ঘুরতে দেখছিল সে। আকাশ ফাটিয়ে বাজ পড়ল একটা। রাস্তার বাতি জ্বলে গিয়েছিল। দোকানে দোকানে শাটার নামচ্ছিল এক এক করে। কাঁসি, পটল প্রফুল্লর গা ঘেঁষে কেঁউ কেঁউ করছিল।
দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হয়ে গেল এক পশলা। আবার ঝেঁপে আসবে। প্রফুল্ল টুক করে সুলভে ঘুরে এল। মন্দিরের সামনের ফুটপাথে কতগুলো গর্ত। সেই সব গর্তে বৃষ্টির জল জমে ছিল। ফুটপাথ আর রাস্তার মাঝখানের অংশে অনেকখানি জল। জল পেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল কাঁসি আর পটল। মুখ নামিয়েছিল জলের দিকে। ওদের পিছন পিছন প্রফুল্ল -দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। বৃষ্টি আসবার আগেই প্লাস্টিক খাটিয়ে সেঁদিয়ে যেতে হবে। "জলদি কর পটল, জল খাবি বাদ মে" বলেই থতিয়ে গেল প্রফুল্ল। কাঁসির ঠিক সামনে পটল- নিজের মুখ দেখছে জলে। প্রফুল্ল থেবড়ে বসে পড়ল পটলের পাশে- নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করল জমা জলে। আর তখনি বৃষ্টি জলের দর্পণ ভেঙে দিয়ে জোরে জোরে হেসে উঠল। প্রফুল্ল এক দৌড়ে ফুটে উঠে দেখে সেই ছেলেটা এখনও বসে আছে- মাথায় টুপি, দাড়ি, গোঁফ- অগোছালো মত। ছেলেটাও ওর দিকে তাকিয়েছিল। হাসল তারপর।
-কঙ্কণা?
-হ্যাঁ। বলো।
- একটা কথা মনে হল, ঐ যে স্কুলগুলো-
-কোন স্কুল সাহিল?
-নীলকমল শো করতেন যেখানে - ঝড়ের দিনে যে বললে-
-হ্যাঁ হ্যাঁ
- সেখানে গেলে হয় না? পুরোনো খাতাপত্র ঘেঁটে, সেই সময়ের ছাত্র, স্যারদের নাম টাম যোগাড় করে, এক এক করে তাদের ..গোটা ব্যাপারটা ডকুমেন্টেড থাকবে আমার লেখায়।
-সাহিল
-কী
-আজও তুমি নীলকমল নীলকমল করবে?
-কেন কী হয়েছে?
-ইলেকশনের রেজাল্ট শোনো নি?
-শুনেছি। জানাই তো ছিল এই রেজাল্ট।
-এত খেটেছিল সবাই... কিছুই হল না। হয়ত তুমিই ঠিক, জানো? আমরা কানেক্ট করতে পারি নি-
- সরি কঙ্কণা। তোমার মন খারাপ। আমার আগেই ফোন করা উচিত ছিল।
- নীলকমল নীলকমল করে তুমি অবসেসড হয়ে গেছ। আচ্ছা- নীলকমলকে না পেলে কী হবে?
-উপন্যাসই হয়তো লেখা হবে না আমার- ক'দিন ধরেই মনে হচ্ছে, পারব না আমি-
নীলকমলকে খোঁজার বাইরেও সাহিলের আরো কথা ছিল। কঙ্কণাকে সেই সব খুলে বলতে সে দ্বিধা করছিল। কেঁদুলিতে অজয়ের তীরে সাহিল তার নিজের উপন্যাস টাইম বম্ব হোক চেয়েছিল অথচ কী লিখবে সে সম্পর্কে তার ধারণা তৈরি হয় নি- সাহিলের মনে হত, সে যা দেখছে, যা শুনছে, তার বাইরে আরো কিছু যেন তার অগোচরে রয়ে যাচ্ছে। সেই সব শব্দ, ধ্বনি আর দৃশ্যর জন্য তার আকিঞ্চন বাড়ছিল দিন দিন। সে একই সঙ্গে এই সাইটের জুনিয়র এঞ্জিনিয়র, আর মন্দিরের সামনের লোকটা হতে চাইত- যে লোকটা ফুটপাথে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে থাকে, চকখড়ি দিয়ে ছবি আঁকে। সাহিলের মনে হত, সে যা দেখতে পায় না, শুনতে পায় না- ঐ লোকটা পায়।
-কঙ্কণা, দ্য আওয়ার দেখেছ?
লাইন কেটে গেছে কখন যেন। অদ্ভূত আওয়াজ হচ্ছিল ফোনে যেন কলসী থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ও পাশে কেউ নেই জেনেও বিড়বিড় করে গেল সাহিল -
"আই ওয়ান্টেড টু বি আ রাইটার, দ্যাট্স অল- আই ওয়ান্টেড টু রাইট অ্যাবাউট ইট অল। এভরিথিং দ্যাট হ্যাপেনস ইন আ মোমেন্ট- দ্য ওয়ে দ্য ফ্লাওয়ার্স লুকড হোয়েন ইউ ক্যারেড দেম ইন ইওর আর্মস- দিস টাওয়েল, হাউ ইট স্মেলস, হাউ ইট ফীলস, দিস থ্রেড.. এভরিথিং ইন দ্য ওয়র্ল্ড। অ্যান্ড আই ফেলড। আই ফেলড। নো ম্যাটার হোয়াট ইউ স্টার্ট উইথ, ইট এন্ডস আপ বীইং সো মাচ লেস। সো মাচ লেস কঙ্কণা, সো মাচ লেস।"