সকাল হতেই মিঠু ছাদে চলে আসে। অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে উঠছে আজকাল, হাল্কা স্ট্রেচিং করে নেয় প্রথমে। ও ঘুম থেকে উঠলেই কুন্তী আর গুলগুলে চোখ পিটপিট করে, আড়মোড়া ভাঙতে থাকে। মিঠু বাথরুম ঘুরে এসে বিছানা পরিপাটি করে, রাতের বিনুনি খুলে চুল আঁচড়ায়, এলো খোঁপা বাঁধে। তারপর ছাদে চলে যায়। মিউ মিউ করে কুন্তী পিছু নেয়। গুলগুলে আরো দু’দফা গা মোড়ামুড়ি করে সিঁড়ি ভাঙে। মিঠুদের ছাদে জলের ট্যাংক, আর গোটা দশ ফুলের টব, কাপড় মেলার দড়িতে ভেজা শাড়ি, পাজামা, নাইটি আর পেগক্লিপ ঝুলে আছে। আগে এই ছাদ থেকে অনেক দূর দেখা যেত, এমনকি ট্রেনের আওয়াজ শুনেছে মিঠু, নারকেল গাছের আড়ালে ট্রেনের এক ঝলক দেখাও গেছে ছোটবেলায়। এখন চারদিকেই ফ্ল্যাটবাড়ি মাথা তুলেছে – ওদের ছোট ছাদের দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে রয়েছে সারাক্ষণ। ট্যাংকের কল খুলে মিঠু ছোট বালতিতে জল ভরে, হাতল ভাঙা মগে এ’-টবে, ও’-টবে জল দেয়; ছোট-বড় টবে মরসুমি ফুল, জবা, আর ক্যাকটাস। লঙ্কা গাছ ছিল – শুকিয়ে গেল গত বছর। জল দিতে দিতে হাঁফায় মিঠু, ছাদের পাঁচিল ধরে দাঁড়িয়ে, গলির দিকে তাকিয়ে, বড় শ্বাস ফেলে। শমিতাদির কথা ভাবে, তারপর আলতো করে জল ঢালে ডালিয়া চারার গোড়ায়।
কলেজের শমিতাদির ক্যান্সার ধরা পড়েছিল বছর পাঁচেক আগে; মিঠুকে নিয়ে এখন যেমন হা-হুতাশ শুরু হয়েছে সর্বত্র, সেই সময় শমিতাদিকে নিয়েও একই অবস্থা। শমিতাদি ছুটিতে, কেমো নিচ্ছে, আর স্টাফরুমে রোহিনী বলছে – “ভাবতেই পারছি না”, সংযুক্তা মাথা নাড়তে নাড়তে চোখ মুছছে, দিব্যেন্দু নাটকীয়ভাবে গলা তুলেছে, “কেন, কেন, কেন, হোয়াই?” শমিতাদি কলেজ জয়েন করল বছর ঘুরতেই – মাথায় স্কার্ফ; চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে, সাবধানে থাকতে হবে – এই যা; এখন তো পুরো সুস্থ – পুজোতে নৈনিতাল বেড়াতে যাওয়ার কথা। আজকাল মিঠুকে রোজই ফোন করে, নিজের গল্প বলে। একটা কথাই বারবার বলে – “মনের জোর হারাস না, ওটাই সব।” শমিতাদি ফোন করলে মিঠুর ভাল লাগে। শমিতাদিই ওকে একটা রুটিন মেনে চলতে বলেছে – “এখন কলেজ নেই বলে বেলা অবধি শুয়ে থাকবি না। সকালে উঠবি, হাল্কা কাজকর্ম করবি ঘড়ি ধরে।” সকালে-বিকালে ছাদে হাঁটা, টবে জল দেওয়া – মিঠুর রুটিনে ঢুকে গেল এইভাবে।
শরতের আকাশে যথারীতি হাল্কা নীলের উজ্জ্বলতম শেড সকালের দিকে – ত্যারছা রোদ এসে জবার টবে পড়েছে আপাতত, ঘুরে ঘুরে অন্য গাছের কাছে যাবে বেলা বাড়লে। এই একফালি রোদটুকু যেন মিঠুর ডাস্টার – যেন ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে লেখা আছে ক্যান্সার, লেখা আছে মৃত্যু, হাড়গোড়, নরকঙ্কাল – এই সব আঁকা রয়েছে যেন – দুষ্টু ছাত্ররা যেমন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে বোর্ডে অকথা-কুকথা লেখে – কোনো শিক্ষক রিঅ্যাক্ট করেন, কেউ নির্লিপ্ত মুখে মুছে দেন, যেন কিছুই হয়নি – সকালের এই রোদ, এই নীল রঙ হাতে নিয়ে মিঠু সব মুছে দেয়, নতুন কিছু লিখবে বলে চক নেয় হাতে; রোদ চড়া হলে ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচে নামে। সিঁড়িতে ওর চটির শব্দ হতেই ছন্দা এসে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ায়, তারপর মিঠু শেষ ধাপে পৌঁছলে, ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। ছন্দার চোখে বিষণ্ণতা আর টেনশন চিরকালই, এখন সে’ চাহনিতে ভয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজে। ইদানিং মা’র চোখে চোখ রাখলে প্রবল শোককেও চিনতে পারে মিঠু – সে যে তার মায়ের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে, ছন্দা যেন তা বিস্মৃত হয়; ওর মনে হয়, ছন্দা যেন সিঁড়ির ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে ঘোলা চোখে মিঠুর শব দেখছে।
সকালের এই সময়টা বিপ্লব বাড়ি থাকছে না আজকাল – আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে যায় একটা ব্যাগ নিয়ে। দুপুরে ফেরে। “গঙ্গাস্নান করি, ভাল লাগে” – বিপ্লব নিজেই এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছিল। স্পষ্টতই মামুর আচমকা এই গঙ্গাস্নানের বাসনার কারণ অবভিয়াস মনে হয়েছে – শমিতাদির কট্টর নাস্তিক স্বামী-পুত্রকে মন্দিরে, দরগায় মাথা কুটতে দেখেছে মিঠু। বিপ্লব টুম্পাকে সকালের বাজারের দায়িত্ব দিয়েছে অনেকদিন। ছন্দার এই নিয়ে চেঁচামেঁচি করা স্বাভাবিক ছিল – অথচ বিপ্লব, তার গঙ্গাস্নান, সকালের বাজার নিয়ে আগাগোড়া উদাসীন ছন্দা; যেন সে ঝড়ের রাতে প্রদীপ নিয়ে বেরিয়েছে, দু’-হাতের চেটো দিয়ে আড়াল করে আছে শিখাকে – হাওয়ার ঝাপ্টা আসছে, সে গতি কমাচ্ছে ঈষৎ, তারপর হাতের পাতা আরো ঘন করে গুটিয়ে আনছে, আবার গতি বাড়াচ্ছে, একমনে হাঁটছে – আর কোনো দিকে মন নেই তার।
শরতের রোদ জবার টবের ডানদিকে ক্যাকটাসের রোয়াঁয় পড়েছে এখন। গুলগুলে আর কুন্তীকে নিয়ে মিঠু নিচে নামল। আজ ওর সেকেন্ড কেমোর দিন। আজ বেরোনোর আগে, বিপ্লব বলেছিল, “হাসপাতালে যাওয়ার সময় টুম্পা তোমাদের ট্যাক্সি ডেকে দেবে। সেরকম মনে করলে আজ টুম্পাকে সঙ্গে নিও। আমার ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।” ছন্দা চোয়াল শক্ত করে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
তিনতলা সাদা ইয়ট – বেলুন, আলো, ফুলে মালায় সেজে – গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে। লাগোয়া অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। নদীর পাড় ধরে টানা রাস্তা, মানুষজন বেঞ্চে বসে জল দেখছে। ছবি তুলছে। সেলফির জন্য পোজ দিচ্ছে। সার দিয়ে বাহারি লাইট পোস্ট – রাত হওয়ার অপেক্ষায়। ইয়টের একতলা আর দোতলার ডেকে হৈ হৈ করছে লোকজন। বাচ্চারা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে নামছে, মাথা ঝুঁকিয়ে জল দেখছে কেউ। গান চলছে। নাচও। লোকজনের আসা-যাওয়া। দুপুরের আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসে গঙ্গার জল আরও ঘোলাটে এবং কালচে। হাওয়া রয়েছে। ছোট ছোট ঢেউ ইয়টের গা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে – কোলাহল বন্ধ হলে তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাবে ডেক থেকে। দোতলার ডেক পেরিয়ে ডানদিকের ঘেরা জায়গায় সোফা, ঢাউস টেবিলে তিন লেয়ার চকোলেট, ক্রিম-ঠাসা কেক – আইসিং করে ‘হ্যাপি বার্থডে’ লেখা।
পার্কের অন্যদিকে আরও তিনজনের সঙ্গে বিপ্লব একটা ছোট নৌকায় উঠছিল। তিনজনেরই লাল টি শার্ট – হলুদ রং দিয়ে তাতে অ্যাবরাকাড্যাবরা লেখা। সঙ্গে নানাবিধ সরঞ্জাম – দড়ি, শিকল, চৌকো ধাতব রেলিং; নৌকা টলমল করে উঠে স্থির হল। বিপ্লবকে আজ রাজার মত দেখাচ্ছে – নীল পালক লাগানো ঊষ্ণীষ, সিল্কের চোস্ত পাঞ্জাবিতে জরির কাজ, চড়া মেকাপে বয়স ঢাকা পড়েছে – কুচকুচে কালো চুল, পাকানো গোঁফ। নৌকায় উঠে বড় করে নিঃশ্বাস নিল বিপ্লব, বুক টান করে দাঁড়াল। নৌকা ছেড়ে দিয়েছিল – ইয়টের কাছাকাছি গিয়ে থামবে। বার্থডে স্পেশাল হুডিনি ট্রিক বিকেল পাঁচটায় – ফ্লেক্স ঝুলছিল ইয়টে, ডেকের রেলিং-এর পাশে একে একে জমা হচ্ছিল সবাই। ছোট নৌকায় একনম্বর লাল শার্ট, হ্যান্ড মাইক টেস্ট করছিল। লাল শার্ট – নাম্বার টু – চারটে আলাদা ধাতব অংশ জুড়ে জুড়ে খাঁচা তৈরি করে ফেলল। বিপ্লবের পায়ে শিকল জড়িয়ে তালা লাগাচ্ছিল তৃতীয়জন – জোলো বাতাসের ঝাপটা মুখে লাগল – শিরশির করল শরীর, দু’হাতের চেটো ঘষে নিল। বিপ্লব কনসেন্ট্রেট করার চেষ্টা করছিল – শিকল বেঁধে খাঁচার মধ্যে স্টান্ট দেখায়নি কোনোদিন; ওর হাতে, পায়ে দড়ি বাঁধত মাণিক, বিপ্লবের সেই সময়ের চেলা – হাতে ধরে দড়িতে গিঁট বাঁধার বিবিধ কৌশল শিখিয়েছিল বিপ্লবই। হুডিনি নট ব্যবহার করত মাণিক – তারপর বিপ্লবকে বস্তায় ঢুকিয়ে জলে ফেলে দিত। বাকিটা দম ধরে রাখার খেলা – জলের নিচে শ্বাস বন্ধ রেখে বিপ্লব দ্রুত খুলে ফেলত হাত-পায়ের বাঁধনের গিঁট। ছোট ছুরি গোঁজা থাকত কোমরে – বস্তার মুখ কেটে বেরিয়ে আসত এক দমে। ইদানিং মাণিক সবজির ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলত; বিবিধ হুল্লোড়ের পার্টিতে নাকি স্টান্ট-শোর ডিম্যান্ড বাড়ছে – মাণিক খোঁজখবর রাখতে শুরু করেছিল। নিজস্ব একটা ব্যবসা শুরু করার জন্য বিপ্লবকে খোঁচাত অহরহ; বস্তুত, আবার সেইসব বিপজ্জনক দিনে ফিরে যেতে চাইছিল মাণিক। তিনটে কোম্পানির ঠিকানা মাণিকের খাতা খুঁজে পেয়ে যায় বিপ্লব – টুম্পা হেল্প করেছিল যথেষ্ট। অ্যাবরাক্যাড্যাবরা কোম্পানি জলের তলায় স্টান্ট দেখানোর জন্য রীতিমত ট্রেনড লোক খুঁজছিল হন্যে হয়ে – ভাল টাকা দেবে। বিপ্লব ওর পুরোনো কিছু ছবি, খবরের কাগজের কাটিং, সার্টিফিকেট দেখাতে কাজটা হয়ে যায়; কোম্পানির মালিক, চোখ নাচিয়ে বলেছিল – “বস্তা, দড়ি দিয়ে খেলা দেখিয়েছেন যখন, নকল তালা বেঁধে স্টান্ট তো আপনার কাছে নস্যি মশাই। বয়স কোনো ব্যাপারই না। মনোহর আইচ এই সেদিন অবধি... আসল কথা হল, দম রাখতে পারবেন কি না – ঐটা আমরা একটু দেখে নেব। বড় অসুখ-টসুখ হয়নি তো রিসেন্টলি?”
এরপর এক নম্বর আর দু’নম্বর লাল শার্ট ট্রেনিং দিয়েছিল বিপ্লবকে – লুকোনো বোতামে হাত-বাঁধা অবস্থাতেও কীভাবে চাপ দিতে হয়; প্রথমে হাতের, তারপর পায়ের তালা খুলে খাঁচার নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় – এই সবের কায়দাকানুন। গঙ্গায় প্র্যাকটিস করাচ্ছিল টানা। জলের তলায় দম রাখার ব্যাপারে কনফিডেন্ট ছিল বিপ্লব। মাইক টেস্টিং শেষ করে এক নম্বর লাল শার্ট চোঙা ফুঁকে হাঁকল – “গুড আফটারনুন লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, বয়েজ অ্যান্ড গার্লস...”
টুম্পা ট্যাক্সি ডেকে এনেছে বড় রাস্তা থেকে। ছন্দা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে। মিঠু বাথরুম থেকে বেরোলেই ট্যাক্সিতে উঠবে।
- আমি সঙ্গে যাই, মাসি? দিদির শরীর হঠাৎ খারাপ করলে, তুমি একা ট্যাক্সি নিয়ে আসতে পারবে?
- না পারার কী আছে? হাসপাতালের সামনেই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। তুই বরং এখানেই থাক, বাড়ি যাস না। স্নান করে খেয়ে নে। আমরা ফেরার আগে যদি তোর মামা আসে, খেতে দিয়ে দিস। না খেয়ে বেরোল কোন সকালে।
- আচ্ছা, মাসি, তুমি ভেবো না একদম।
মিঠু বাথরুম থেকে বেরিয়ে চটি পরছিল – তিনদিন হল পায়ের পাতা ফুলে রয়েছে – চটি গলাতে সময় লাগছে। ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজল তখনই। “টুম্পা, ফোন ধরে বল আমরা বেরিয়ে গেছি”, ছন্দা চেঁচিয়ে বলেছিল। মিঠু তার আগেই রিসিভার তুলল – “হ্যালো।”
“মিঠু, মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিস কেন? চিন্তায় মরে যাচ্ছি আমরা। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ল্যান্ডলাইনের নম্বর পেলাম অতসীর কাছ থেকে” – গার্গী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল –
- একটু বেরোচ্ছি। পরে কথা বলব রে।
- কোথায় বেরোচ্ছিস এখন? তোর অসুখের কথা শুনলাম। এ কী হল, মিঠু?
- অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে। চিন্তা করিস না। রাখি এখন। কেমো নিতে যাচ্ছি –
“কেমো?” এমন আঁতকে উঠল গার্গী, যেন কোনো চিকিৎসাবিভ্রাটের কথা শুনেছে। আরো তারস্বরে অ্যাড করল, “ওরে বাবা! কেমো নিলে সব চুল টুল পড়ে যায়। মিঠু, তোর এত সুন্দর চুল।”
- চুলই তো, আবার গজাবে। রাখি রে –
- শোন শোন, কার সঙ্গে যাচ্ছিস? বর ফিরেছে ট্যুর থেকে?
“হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই তো যাচ্ছি। লম্বা ছুটি নিয়েছে...” গার্গীর ইয়র্কারকে হাফ ভলিতে মাঠের বাইরে ফেলে ট্যাক্সিতে উঠল মিঠু।
হাওড়া ব্রিজকে পিছনে রেখে বিপ্লব এখন খাঁচার মধ্যে সটান দাঁড়িয়ে। ইয়টের সমস্ত দর্শকের চোখ এখন ওর দিকে – হাতে হাতে মোবাইল, ভিডিও উঠছে। এক নম্বর লালশার্ট হ্যান্ড মাইকে অবিশ্রান্ত বকে যাচ্ছিল – কোম্পানির বিজ্ঞাপন, এ’খেলার ইতিহাস, চটকদার সব লাইন, মাঝে মাঝে দু’কলি গান গুঁজে দিচ্ছিল। বিপ্লবকে কলকাতার হুডিনি বলছিল লালশার্ট – এক। বাকি দুই লালশার্ট কপিকল দিয়ে খাঁচা নামিয়ে দিচ্ছিল গঙ্গায়। হিসেব করা সময়ের পরে শূন্য খাঁচা তুলে আনবে আর স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী, এক নম্বর লাল শার্টের কাজ তখন, ঐ মুহূর্তকে নাটকীয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার – সে সব রিহার্স করাই আছে। হাততালিতে ফেটে পড়ছিল কলকাতা। বুক টান করে জলের তলায় নেমে যাচ্ছিল বিপ্লব – যেন উঠে আসবে মিঠুর জন্য বিশল্যকরণী নিয়ে; বড় করে শ্বাস নিয়ে দম বন্ধ করল নাক ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে – হই হই করে উঠল শহর। গঙ্গার ওপরে কৌতূহলী বিকেলের আলো, মেঘ সামান্য ফাঁক করে মুখ বাড়াল এই সময়।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি পেয়ে গেল মিঠুরা। বাইপাস পেরোচ্ছে এখন। গা হেলিয়ে বসেছিল মিঠু। অবসন্ন। চোখ বুজে আসছিল ওর।
- শরীর খারাপ লাগছে, মিঠু?
- মামু এল না কেন আজ?
- কী সব কাজ আছে, ব্যাঙ্কে যেতে হবে। আরে বাদ দে – তোর মামুর কথা। ভীতু একটা। ভীতু লোক। মহাভীতু। আজ এত বছর দেখছি তো –
সিট ঘষটে মায়ের দিকে সরে এল মিঠু। ছন্দার মুখের সাইড প্রোফাইল – কপালে, চুলে, গালে, চোখে, চিবুকে অনন্ত বিষাদ; মা’র কাঁধে মাথা রাখল মিঠু। চোখ বন্ধ করল। খুলল। জানালার বাইরে তাকাল। দেখল চলন্ত গাড়ি, শহরের পিচঢালা চওড়া রাস্তা, চায়ের দোকানের জটলা আর একটুকরো ঘাসজমি – ঘন সাদা কাশ ফুটে আছে। সে মাথা তুলে আঙুল বাড়াল – “মা, এদিকে, দেখো দেখো, কী সুন্দর।”
ছন্দার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। ড্রাইভার রিয়র ভিউতে তা দেখতে পাচ্ছে মনে হতেই, চোয়াল শক্ত করল – “একটু তাড়াতাড়ি চালান না দাদা, দেখছেন তো শরীর ভাল নয় মেয়ের।”
- কী জ্যাম দেখছেন না – উড়ে যাব নাকি?
“এইভাবে কথা বলছেন কেন?” গলা চড়াচ্ছিল ছন্দা। ওর কনুই ছুঁল মিঠু – “থাক না, মা।”
বাস্তবিকই ট্যাক্সির সামনে বাস, ট্যাক্সি, অটো জট পাকিয়ে, সম্ভবত মিছিল বেরিয়েছে কোথাও – স্লোগান শোনা যাচ্ছিল। স্তব্ধগতি ট্রাফিকের সামনে হাত ধরাধরি করে রাস্তা পেরোচ্ছিল মা-বাবা-বাচ্চা, হাতে বেলুন – আনন্দময়, হাস্যময় মানুষজন – পুজোর বেশি দেরি নেই –
ছন্দা দাঁতে দাঁত ঘষল – “এত লোক চারদিকে। এত লোক। এত লোক। মরেও না, মরেও না!”
এই খেলায় সময়কে হারাতে হয় – “টাইম ইজ ইওর এনিমি” মনে মনে আওড়াচ্ছিল বিপ্লব। দম ধরে রেখে বোতামে চাপ দিতেই হাতের শিকল খুলে গেল। এবারে পায়ের শিকলের বোতামে চাপ দিল বিপ্লব – একসঙ্গে পায়ের শিকল আর ফল্স মেঝে খুলে গিয়ে বিপ্লব বেরিয়ে আসবে – ভুস করে উঠে এসে হাত নাড়বে। কিন্তু তালা খুলল না। দম ধরে রেখে আবার চাপ দিল বোতামে। আবার। আবারও। খাঁচা ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকি দিল সে এবারে। এর ফলে জলতলে যতটুকু আলোড়ন হয়েছিল, তিনজন লাল টি-শার্ট, এবং দর্শককুল তাকে খুব স্বাভাবিক ভেবেছিল। লালশার্ট অঙ্গভঙ্গি সহকারে তার ডায়ালগ আউড়ে যাচ্ছিল, দর্শকরা পশ্চিমের সূর্যকে ব্যাকড্রপে রেখে কলকাতার হুডিনির জল থেকে উঠে আসার শট নেবে বলে রেডি –
বিপ্লব শ্বাস নেওয়ার জন্য খাবি খাচ্ছিল। জল ঢুকছিল শ্বাসনালীতে, গলায়; যন্ত্রণায় মনে হচ্ছিল সমস্ত শরীর ফেটে চৌচির হয়ে যাবে এইবার, চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করছিল বিপ্লব, খাঁচা ঝাঁকাচ্ছিল – রঙেরা দ্রুত মুছে যাচ্ছিল ওর চোখের সামনে – কমলা রঙের ছিটেটুকু প্রথমেই উধাও হয়েছিল, তারপর গেল নীলের আভাস; এবার জলের রঙ ঘোলা থেকে ঘন কালো হয়ে গেল পুরোপুরি।
কপিকল গুটিয়ে খালি খাঁচা তুলে আনার কথা এই সময়। দুই আর তিন নম্বর লালশার্ট দড়ি টানছিল সময় নিয়ে – যাতে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে দর্শক; পুলির চাকা ঘুরছিল, খাঁজের ওপর দড়ি সরছিল মসৃণভাবে। দর্শক হর্ষধ্বনি করে উঠবে এইখানে। অথচ সমবেত চিৎকার চড়ায় উঠেই খাদে নামল। খাঁচা উঠে এসেছে গঙ্গার ওপরে – জল ঝরছে। আর খাঁচার শিক শক্তমুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজার পোষাক পরা বিপ্লব – চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ হয়ে আছে। কপিকল জলের নিচ থেকে খাঁচা তুলে এনেছে – কলকাতার হুডিনির মৃতদেহ সমেত – স্ক্রিপ্টে যা লেখা নেই।