ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল বৌবাজারে। পরপর আস্তর-খসা বাড়ি পশ্চিমের আলো রিফ্লেক্ট করায় গোটা পাড়া এখন গাঢ় কমলা। ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তুলে নিল সাবধানী গৃহস্থ। এবারে জলের পাইপ বেয়ে সাঁৎ সাঁৎ করে ছায়া নামবে রাস্তায়। কালো মোটা কেবল, দোতলার গ্রিল পেরিয়ে ঘরে ঢুকে টিভি সিরিয়াল চালু করে দেবে। গলির আলো জ্বলে উঠলে, মানুষজন ভাত বসিয়ে নিউজ দেখবে, তারপর দাদাগিরি; দোকানপাট বন্ধ হবে এক এক করে। এই গলির ঠিক নিচে টিবিএম চাণ্ডী তার আর্থ প্রেসার ব্যালান্স শিল্ড সমেত তিনশ’ ষাট মিটার ব্যাসার্ধের বক্ররেখা বরাবর মাটি খুঁড়ে চলেছে – আর আটশ’ মিটার এগোলেই শিয়ালদা পৌঁছে যাবে টানেল।
সন্ধ্যার শিফট সবে শুরু হয়েছে। তপন বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল – শেষ দুটো টান মেরে কাজ শুরু করবে; মোবাইল বাজছিল অনেকক্ষণ, দুটো কল মিস করে গেছে – ফোন সাইলেন্ট ছিল; তিন নম্বরটা ধরে নিতেই ওদিকে বিকাশ – টিবিএমের কাটার হেড দিয়ে ঘোলা জল ঢুকছে টানেলে। বিকাশ, পারমিন্দার দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে অলরেডি – লেবারদের ইনস্ট্রাকশন, বড়কর্তাদের ফোন করা – তপন এসে চার্জ নিল; আফটারনুন শিফট কংক্রিট আর কেমিক্যালের মিক্সচার দিয়ে গ্রাউটিং শুরু করে দিয়েছিল, ঘণ্টাখানেক পরে জল আসা বন্ধ হয়েছে দেখে তপন সবে ফোন তুলেছে – বলবে, ‘সিচুয়েশন আন্ডার কনট্রোল’, সঙ্গে সঙ্গে হুড়হুড় করে আবার জল ঢুকতে শুরু করল। ভাদ্রের গুমোট গরম আর টেনশনে ঘাম হচ্ছিল তপনের, মেজাজ সপ্তমে; শার্টের হাতা দিয়ে কপাল মুছে বলল, “আজই সাহিলটা এল না দেখলেন?” “এই নিয়ে এখন আর শুরু করবেন না তো, এল না আবার কী? আপনাকে বলেই তো ছুটি নিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে আসবে বলেছে। বলেনি? ছাড়ুন ওসব। চৌহান সাব, আর মিস্টার দত্তকে ফোনে ধরুন – বলুন অ্যাকুইফার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, কনফার্মড। অ্যাকুইফার ছাড়া আর কী? পারমিন্দার, উয়ো মিকসচার কা প্রোপোরশন চেক কিজিয়ে জারা। ওয়েট এ মিনিট, আমিই যাচ্ছি-” বিকাশ আবার দৌড়ল।
সারা বর্ষা ভিজে ভিজে কাজ করে সাহিলের সর্দি কাশি সারছিল না। হালকা জ্বর আসছিল প্রায়ই। সাইটে কোম্পানির রেনকোট, গামবুট, ফেরার পথে নিজের অথবা কঙ্কনার ছাতা – তবু সে ভিজেছিল প্রচুর। একজন ভাল ডাক্তার দেখানো, চেস্ট এক্স-রে সব ডিউ থেকে ওভারডিউ হয়ে যাচ্ছিল। আধারকার্ডের কিছু কাজও বাকি অনেকদিন – বাবা তাগাদা দিচ্ছে রোজ। এবারে জ্বর আসতেই, দু’দিন ছুটি চাইল – ডাক্তার, এক্স-রে, আধার কার্ড – সব সেরে ফেলবে। তপন গাঁইগুঁই করেছিল, একটা ড্রয়িং-এর কাজ শেষ করার চাপ দিচ্ছিল। ডাক্তার দেখানোর পরে আজ একবার সাইটে যাবে ঘণ্টাদুয়ের জন্য – এইরকম রফা হল শেষমেশ। গতরাতে ড্রয়িং নিয়ে বসতেই কঙ্কণার ফোন এসেছিল: “কাল একবার দেখা করা যায়?”
“কেনাকাটা করবে, সঙ্গে যেতে হবে, তাই তো? তুমি যেন কবে চলে যাচ্ছ...” সাহিল কেটে কেটে কথা বলছিল –
- সাহিল, ঝগড়া কোরো না এখন। খবরটা দেখলে?
- কোন খবর?
- হুডিনি ট্রিক দেখাতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে যাওয়ার খবরটা...
- হ্যাঁ। দেখলাম তো।
- আমি যা ভাবছি, তুমিও তাই ভাবছ?
- আশ্চর্য, তুমি কী ভাবছ, তা আমি কেমন করে জানব? আমি কি জ্যোতিষী?
- বলছি যে, পরে ঝগড়া করলে হয় না?
- পরে মানে কবে? তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা – কী যেন গানটা –
- প্লিজ সাহিল।
- ঠিক আছে, কী ভাবছ বল –
- ইনিই নীলকমল নন তো? একবার পুলিশের কাছে গিয়ে কথা বললে হয়… যাবে?
- প্রথমত, পুলিশ আমাকে ইনফরমেশন দেবে কেন? দু’নম্বর, মানে সব থেকে বড় কথা – হয়তো এই বি পালিত-ই নীলকমল। হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কী হবে জেনে? দ্য ম্যাজিশিয়ান ইজ ডেড –
- লং লিভ দ্য ম্যাজিক। হয়তো ইনি নীলকমল নন। অন্য কেউ। সেটা জানতে হবে না?
সাহিল চুপ করে রইল।
- তুমিই তো বলেছিলে, নীলকমল জাস্ট প্লেসহোল্ডার – খুঁজে যেতে হবে –
- বলেছিলাম। এখন সব বকোয়াস মনে হচ্ছে – আসলে, লেখক মরে গেছে – রাইটার ইজ ডেড কঙ্কণা –
- কী যা তা বকছ! কাল একবার দেখা করা যায়? একটা কথা বলার আছে। জরুরি কথা।
- কী কথা? এখনই বল – কাল সময় হবে না।
- হবে, একটু সময় ঠিক হবে।
- এখন বলতে কী হয়?
- দেখা হলে বলব, কোথায় আসব?
- সাইটে আসতে পারবে? সন্ধ্যার দিকে? রোজ যে সময়টায় আসতে –
কালীমন্দিরের সামনের ফুটপাথে সাষ্টাঙ্গে শুয়েছিল প্রফুল্ল। তেতে-ওঠা শাণ এখন ঠান্ডা হয়ে আসছে। দিব্যি আরাম হচ্ছিল, হাত-পা টানটান করল সে। তখনই মাটি কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল পেট, বুক, সর্বশরীর। অন্যদিনের মত হাল্কা দুলুনি নয়। টানা কাঁপুনি – থরথর করে উঠছিল সর্বাঙ্গ। রঙিন চকখড়ি ফুটের একদিক থেকে অন্য দিকে গড়িয়ে গেল। রঘু বলল, “কী বে ভোচাল নাকি?” গুমগুম করে আওয়াজ উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দমকলের ঘণ্টা। একটানা। পটল আর কাঁসি কুঁইইই করে উঠেই চুপ করে গেল। প্রফুল্ল দু’হাতের চেটো ফুটে রেখে মাথা তুলল। শ্বাস টানল বড় করে। ওর মনে হল, এতদিনে শ্রীদেবীর ঘুম ভেঙেছে। এবার সময় হয়েছে – জাহাজ আসবে গলিতে – ডেকে দাঁড়িয়ে থাকবে শ্রীদেবী – হলুদ শাড়ি পরে; এই ফুটে এসে জাহাজ থামবে মন্দিরের ঠিক সামনে। প্রফুল্ল লাফিয়ে উঠল। প্লাসটিক, ঝোলাঝুলি গুটিয়ে রাখল একপাশে। ওর ছোট বালতি আর সাবান নিয়ে সুলভের দিকে দৌড়ল – স্নান করে রেডি হবে।
আধারকার্ডের কাজ সেরে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে মোবাইল অফ করে রেখেছিল সাহিল। বেরিয়ে গুচ্ছের অ্যান্টিবায়োটিক আর মাল্টিভিটামিন কিনল ফার্মেসি থেকে। তারপর ফোন অন করল ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। টুং-টাং, টুং-টাং অনবরত মেসেজ ঢুকছিল সাহিলের মোবাইলে। গোটা কুড়ি মিসড কল – সাইট থেকে, বন্ধুদের মেসেজ, বাবার মেসেজ, মা-র মিসড কল – ‘তুই কোথায়? ঠিক আছিস তো? মেসেজ কর এক্ষুণি।’ কী ব্যাপার বুঝতে পারছিল না সাহিল। সাইটে কিছু হল? তপনকে ফোন করতে যাবে, ওষুধের দোকানের ছোট টিভিতে খবর শুরু হয়ে গিয়েছিল, “আজ সন্ধ্যায়, কলকাতার বৌবাজার এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ চলাকালীন, টানেল বোরিং মেশিন ভূগর্ভস্থ জলাধারে ধাক্কা মারে। টানেলে জল ঢোকা এখনও বন্ধ করা যায়নি। এই ঘটনায়, অঞ্চলের বসতির ভিত ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানা গেছে। ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ বিবরণ এখনও এসে পৌঁছয়নি। ঘটনাস্থল থেকে একটু পরেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন আমাদের প্রতিবেদক। সঙ্গে থাকুন। চোখ রাখুন চ্যানেলে।” বাকি মেসেজ চেক করল সাহিল – কঙ্কণার কোনো মেসেজ নেই। ফুটপাথে দাঁড়িয়েই কঙ্কণার নম্বর ডায়াল করল – কল থ্রু হচ্ছে না – কোনো আওয়াজ নেই ওদিকে। সাহিল ডায়াল করল আবার, আবার, আবার; তারপর মাথা ঘুরে উঠল – ফুটপাথেই বসে পড়ল ধপ করে। কঙ্কণা কি সাইটে গেছে?
সুলভের সামনে কেউ নেই তখন। ভেতরে, মেঝে জুড়ে ভাঙা কাচ। দেওয়াল কাঁপছিল, দরজা, স্কাইলাইট – সব; ঘুলঘুলির সামনে পাখির বাসা মাটিতে ঠিকরে পড়তে তিনটে ডিমই ভাঙল। বাথরুমে ঢুকে কল খুলল প্রফুল্ল – লালচে জল চড়বড় করে পড়ছিল বালতির ভিতর। তারপর প্রফুল্লর চোখের সামনে কলের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে জল বেরল, চিড় ধরল দেওয়ালে। পাশের স্নান করার খোপ থেকে জল বেরিয়ে আসছিল গব গব করে, মাথার ওপরে ছাদের আস্তর খসে পড়ল এইবার; জাহাজ তাহলে গলিতে ঢুকেছে – সাবান-মাখা, আদুল-গা প্রফুল্ল দৌড় মারল মন্দিরের দিকে।
তপনকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল সাহিল, তারপর পারমিন্দার, বিকাশ, শাহিদুল আর খগেনের নাম্বার ট্রাই করল – কোনো ফোনই বাজল না; লাইনের ওপারে জমাট নিস্তব্ধতা, যেন এক বোবা জগত ওদিকে, যেন ভারি মোটা কম্বলে সমস্ত কথা আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া – তারা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল সম্ভবত – কথাদের নড়াচড়ায় খসখস শব্দ হচ্ছিল লাইনে। সাহিল ফুট থেকে রাস্তায় নামল – সন্ধ্যার জমাটজমাট ট্রাফিক – গাড়ি, বাস, অটোর লাল টেল লাইট, সিগনাল যথাবিহিত লাল, হলুদ, সবুজ হচ্ছে, যেন কোথাও কিছু ঘটেনি – শুধু একা সাহিলই দুঃস্বপ্ন দেখে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে ঘুম চোখে; সামনে খালি ট্যাক্সি দেখে হাত নেড়ে দাঁড় করাল, “বৌবাজার যাবেন?” গন্তব্য শুনেই ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল ধোঁয়া ছেড়ে, “দাদা, কোনো গাড়ি যাবে না ওদিকে আজ। বাসও পাবেন না।” কানে ফোন চেপে সাহিল হাঁটতে শুরু করল – একটানা ডায়াল করে যেতে লাগল কঙ্কণার নম্বর।
ঘন্টাখানেকের মাথায় সাইটের কাছাকাছি পৌঁছল সাহিল। গোটা এলাকা কর্ডন করা – পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। সাহিল এগিয়ে গেল – বোঝাতে চাইল নিজের কথা, সাইটের কথা, কঙ্কণার কথা। গলা তুলেই কথা বলতে শুরু করেছিল সে, আবেগে আর টেনশনে গলা আরো চড়ছিল ক্রমশ। ওয়াকিটকি হাতে অফিসার গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, “প্লিজ। সম্ভব নয়। এখানে ভিড় করবেন না, রাস্তা খালি করুন। সহযোগিতা করুন আমাদের সঙ্গে।” সাহিল পকেট হাতড়ে ওর আইডি কার্ড বের করে গলায় ঝুলিয়ে নিল, আবার সাইটে ঢোকার অনুমতি চাইল। এবারে, অফিসার ওকে হাত নেড়ে সরে যেতে বলতেই সাহিল শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারল পুলিশকে, পা স্লিপ করল নিজেরই, ব্যালান্স রাখতে চেপে ধরল পুলিশের কলার – ঘামে চপচপে উর্দিতে হাত পড়তেই সে বুঝেছিল ভুল করেছে, ছেড়ে দিল তৎক্ষণাৎ। দু’জন পুলিস লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল - সাহিল হাত জোড় করল, কপালে ঠেকাল। তারপর পিছনে হটে গেল – স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে প্রফুল্ল ওর ভুরু-বরাবর হাতের পাতা রেখে ঠাহর করতে চাইছিল জাহাজ কতদূর। রাস্তার সমস্ত আলো নিভে গেছে। অন্ধকার ঘরবাড়ি। একটু আগে কোণের দিকের বাড়ি – পুরোনো ছাদ, থাম, বারান্দাসমেত ভেঙে পড়ল। দমকলের ঘণ্টা, হেলিকপ্টারের আওয়াজ, আর গুমগুম শব্দ; সাইটের দিকটা ফ্লাডলাইট দিয়েছে – সে আলোয় লাল-সাদা ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে, থিতিয়ে যাচ্ছে। মিষ্টির দোকানের দিক থেকে সুনীল আর ওর বৌ দৌড়ে বেরিয়ে এল – পিছনে কয়েকজন অচেনা মেয়েমানুষ। কালীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা ক’জন – নাথু, প্রফুল্ল, রঘুবীর, কপিল। সুনীল প্রফুল্লর পায়ের কাছে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছিল – ওর পা ধরছিল – জড়ানো গলায় যা বলছিল, তাতে পাপ, ক্ষমা এই সব শব্দের আধিক্য ছিল। সুনীলের বৌ চোখ মুছছিল নিঃশব্দে। তিনজন অচেনা মেয়েমানুষ পুঁটলি বুকে চেপে আকাশ দেখছিল। কাঁসি, পটল ভৌ ভৌ করে ডাকছিল – রাস্তার এ’মুড়ো ও’মুড়ো দৌড়ে বেড়াচ্ছিল।
স্টেশনের সামনের সিঁড়িতে বসেছিল সাহিল – জামা-প্যান্টে ময়লা, হাতের প্লাস্টিকে ওষুধ ছিল – ধাক্কাধাক্কিতে কোথায় পড়ে গেছে – মোবাইলের স্ক্রিনে চিড় ধরেছিল। গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছিল সাহিলের – যেন সিনেমা দেখছে। ও চাইছিল সিনেমা শেষ হয়ে পর্দায় ক্লোজিং ক্রেডিট আসুক এবার, থিয়েটারের আলো জ্বলে উঠুক, আধো অন্ধকার থেকে বড় রাস্তায় বেরিয়ে ওর চোখ ধাঁধিয়ে যাক। চাণ্ডী মুখনকে এখন খুব দরকার – ওর মনে হচ্ছিল। স্টেশনের সামনের চত্বর শুনশান। শারদোৎসবের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন এতক্ষণ আলোর মালায় সাজানো ছিল – দপ দপ করে নিভে গেল এই মাত্র; অন্ধকারে হুটার আর দমকলের ঘণ্টির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। প্যান্টে মোবাইল ঘষে নিয়ে কঙ্কণার নম্বর আবার ডায়াল করল সাহিল – একবার, দু’বার, তিনবার – এবারে ফোন বাজছে – বেজেই চলেছে; কঙ্কণার রিং-টোনে শর্মিলা রায়ের গলায় শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা শোনা যাচ্ছিল। স্টেশনের সিঁড়ির ধুলোয় বসে তরুণ প্রেমিক শৃন্বন্তু বিশ্বে শুনতে পাচ্ছে প্রেমিকার রিংটোনে – এইরকম সুপার ড্রামাটিক সিচুয়েশন কোনোদিন আসবে না সাহিলের উপন্যাসে - তৎসত্ত্বেও, যতবার সে তমসো পরস্তাত শুনছিল – ত এ ত ঠেকছিল শর্মিলার গলায় – ততবার তার চোখ বেয়ে জল নামছিল, ঠোঁট কামড়ে ধরছিল নিজের।
শরৎ, তবু কাটে নাহি কাট্টের সিনের মত বৃষ্টি নেমেছিল ঝমঝম করে। মন্দিরের সামনে থেকে পুলিশ প্রফুল্লদের হটিয়ে দিয়েছিল অনেকক্ষণ। পটল আর কাঁসিকে নিয়ে প্রফুল্ল স্টেশনচত্বরে বসেছিল। এতক্ষণে জাহাজ ভিড়েছে নিশ্চয়ই – শ্রীদেবী ওকে খুঁজছে – এইখানেই বসে থাকা ভালো – শ্রীদেবী খুঁজে খুঁজে এখানেই আসবে। সিঁড়ির একদম ওপরের ধাপে গিয়ে বসল প্রফুল্ল। ছেলেটাকে তখনই দেখল, একা বসে আছে; বারবার ফোন কানে দিচ্ছে, নামিয়ে এনে খুটখাট করছে, আবার কানে ধরছে – অস্থির দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে – যেন প্রফুল্লর মতই অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ – এখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ওকে দেখে হাসল। হাত দিয়ে বৃষ্টি দেখাল – কাঁধ ঝাঁকিয়ে যেন বলতে চাইল – ফেঁসে গেছে। প্রফুল্ল আজ খুব কাছ থেকে দেখছে ছেলেটাকে। কত আর বয়স? ছোটা ভাই য্যায়সা – ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হল প্রফুল্লর, ও বলতে চাইল ধৈরজ রাখ, মেরে ভাই, শান্ত হো যা; এই সব কথা প্রফুল্লর মন থেকে পাক খেয়ে গলায় এসে বদলে গিয়েছিল। সে বলল, “বারিষ মে কাঁহা যাওগে? খেল দেখোগে কেয়া?” ছেলেটা অবাক হয়ে তাকাল। প্লাস্টিক হাতড়ে প্রফুল্ল বের করে আনল নীল ট্রানজিস্টর – সেদিন সুনীলের ঘর সাফ করতে গিয়ে পেয়েছিল – বেটারি ফুল একদম। প্রফুল্ল রেডিও চালাল, পুঁটলি থেকে বের করে আনল চারটে বল, বাঁশি, লম্বা টুপি – সাজিয়ে রাখল পরপর; এফএম স্টেশনে গান দিয়েছিল - লাগি আজ শাওন কি। তালে তালে প্রফুল্ল বলগুলো ওপরে ছুঁড়ে লুফে নিচ্ছিল হাঁটু গেড়ে বসে। পটল, কাঁসি আর বৃষ্টি ওদের ঘিরে রইল বাকি সময় – পিচরাস্তায় হাজার হাজার জলের মুকুটে স্ট্রিট লাইট আর বিদ্যুতের আলো ঠিকরোতে লাগল। একটা বলও মিস করছিল না প্রফুল্ল – হাঁ করে দেখছিল সাহিল। কভি টুট কর চিজ কই জুড়ি হ্যায়-এর জায়গাটা যখন হচ্ছিল, প্রফুল্ল শ্রীদেবীকে দেখতে পেল স্পষ্ট – হলুদ শাড়ি পরে, ভাঙা ঘরদোরের দিক থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এদিকেই আসছে। সাহিলও দেখেছিল, সে আসছে। ফ্লাড লাইটে হলুদ আকাশ, তুমুল বৃষ্টি আর অন্ধকার এই শহরকে ব্যাকড্রপে রেখে সে আসছে। সে ওর কাছেই আসছে। মুহূর্তরা নদীর মত বয়ে যাচ্ছে সাহিলের সামনে দিয়ে। সাহিল শব্দ খুঁজছিল, লিখতে চাইছিল। ওর আঙুল নিশপিশ করছিল, অক্ষর, শব্দ, বাক্য ছেনে ও আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছিল এই গান, এই বৃষ্টি, এই খেলা, এই আশ্চর্য আবির্ভাব – এই যে মুহূর্তরা একটু আগেই ঘটমান বর্তমান ছিল, ওর চোখের সামনে অতীত হয়ে যাচ্ছে – এই সব মুহূর্তদের ধরে রাখা দরকার – সাহিলের মনে হচ্ছিল। গলায় ঝোলানো সাইটের আইডি কার্ড টান মেরে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে –
ধরা যাক, একগাদা তারা, ছায়াপথ, চাঁদ-টাঁদ পরে আকাশ খুব সেজেছে আজ রাতে। ভ্যান গঘের ছবির মত দেখাচ্ছে। আকাশের তলায় এই মুহূর্তে একটা রাস্তা, একটু আগে নদী ছিল। রাস্তায় দু’জন – দূর থেকে পিঁপড়ের মত দেখাচ্ছে। একজন লেখক। পাঠক অন্যজন। কথা বলছে –
-সব পাড়াতেই একজন ম্যাজিশিয়ান থাকে
-সব পাড়াতেই?
-নাকি জীবনে? সবার জীবনে –
-সবার জীবনে?
-একজন যাদুকর – জাস্ট ম্যাজিকওয়ান্ড হাতে যাদুকর – থাকে না?
-কী জানি! কী করে বুঝব!
-পাড়া বদলে যায় যখন –
-সে তো সময়
-জীবন বদলে যায় যখন –
-সে তো প্রেম
-না তুমি নিজেই যখন –
-মানে তুমিই জাদুকর?
-জানি না।
-সময়ই যাদুকর তবে?
-নাকি প্রেম?