এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গুন্ডা ফাইলস

    পাপাঙ্গুল লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ আগস্ট ২০২৫ | ৫৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)


  • বাংলা সরকারের ১৯২৬ সালের গুন্ডা আইনে পুলিশের জন্য গুন্ডাদের আলাদা খাতা খোলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। গুন্ডা অর্থে চুরি, পকেটমারি, জুয়াখেলা, চোরাচালান, কোকেন বিক্রেতা এমনকি রাজনৈতিক চরিত্ররাও। আইনে প্রতি ফাইলের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। আসামীর পরিচয়, কি কি অভিযোগ আছে, স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য ইত্যাদি। ১৯৪৬-৭১ সালের এই ১২৩ টি পুলিশ ফাইলের মধ্যে মাত্র আঠেরো জন মুসলিম গুন্ডার নাম আছে। যদিও বাস্তব অন্যরকম ছিল যেহেতু অগস্ট ১৯৪৬র দাঙ্গায় মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নেতা এবং কলকাতার মুসলিম অপরাধ জগতের সম্পর্ক জনসমক্ষে এসেছিল। লেখকদের অনুমান মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন পুলিশ খাতা থেকে মুসলিম গুন্ডাদের নাম সরিয়ে ফেলেছিল। এই সব ফাইলের মধ্যে এমনকি দুজন এংলো গুন্ডা - এরিক মিচেল এবং চার্লস নেভিল চেম্বার্স, নির্মলা দাসীর মত মহিলার, চীনা পাসপোর্ট ধারী চীনা টনি [নুং ওয়াই] রও নাম আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর হিসেবে, লন্ডনের মতই কলকাতারও অপরাধ জগৎ, আলোর নিচে অন্ধকারের মত। সেখানে শ্বেতাঙ্গদের এলাকার পাশেই ছিল 'নেটিভ' এলাকা, বস্তির পাশেই ছিল বাঙালি এবং মাড়োয়ারি ধনীদের প্রাসাদ। জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ ছিল অভিবাসী যারা শ্রমিক, কুলির কাজ করত। ফলে অপরাধের প্রভূত সুযোগ।

    এই গুন্ডা ফাইলগুলিতে অনেকেরই সেনা ইতিহাস ছিল। অনিল বোস ভারতীয় নৌসেনায় যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু ১৯৪৬ সালে নৌবিদ্রোহে যোগ দেবার জন্য চাকরি হারান। প্রকাশ দাস ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে ঢাকুরিয়ায় এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা ছাউনিতে কাজ করতেন কিন্তু একজন নার্সকে যৌন হেনস্থার অভিযোগে জেলে যান। বসন্ত সাহা রিষড়ার মার্কিন বায়ুসেনা ঘাঁটিতে কাজ করতেন কিন্তু পেট্রোল পাচারের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে কাজ খোয়ান। রাম সিং গিল ভারতীয় সেনায় জমাদারের কাজ করতেন। যুদ্ধ শেষের পর মার্কিন সেনারা সস্তায় অস্ত্র বেচে দিয়ে চলে গেছিল, সেইসব অস্ত্র দখল করে নেয় কলকাতার অন্ধকার জগৎ এবং গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ে বহুল ব্যবহৃত হয়।

    ১৯৪৬ দাঙ্গা অনেককেই অপরাধ জগতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সবার প্রথমেই নাম আছে মলঙ্গা লেনের গোপাল মুখার্জির, যিনি দাঙ্গার সময় হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য 'ভারত জাতীয় বাহিনী' গড়েছিলেন, যা 'প্রাইভেট আর্মি' ছিল অন্তত ৪০০ জন সদস্যের। এদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন দার্জিলিঙে জন্ম কৃষ্ণবাহাদুর নেপালি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ টেরিটি বাজার এলাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে চলে এসেছিল। বাঙালি মধ্যবিত্তদের মধ্যে বাহিনীর সদস্য ছিল দীনবন্ধু দত্ত, সন্তোষ কুমার পাল বা ভানু বোস। সেই দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিডন স্ট্রিটের চেনা মাস্তান বসন্ত সাহাকেও গোপাল মুখার্জি সেই দলে নিয়েছিলেন। বসন্তের কাছে ছিল যুদ্ধের বাজারে কেনা স্টেনগানের মত আগ্নেয়াস্ত্র, দাঙ্গার পরে সে সেসব অস্ত্র এবং নকল নাম্বার প্লেটের গাড়ি সহযোগে অপরাধ করত। দীনবন্ধু দত্ত ১৯৫০ সালে শিয়ালদা পুলিশ ছাউনিতে বোমা ছোঁড়ার জন্য গ্রেফতার হন। দাঙ্গার সময় বাহিনী নামকরা হিন্দু ব্যক্তিত্ত্বদের থেকে আর্থিক সাহায্য /চাঁদা পেয়েছিল। কিন্তু দাঙ্গা থেমে যাবার পর বাহিনী সেই সাহায্য হারিয়ে ফেলে। গোপাল মুখার্জি এবং তার অনুগামীদের নাম সোনারপুর, বালিগঞ্জের গিনি ম্যানসনে ডাকাতি, হার ছিনতাই, দোকান ডাকাতি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে। একটি অংশ কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। গোপাল মুখার্জি নিজেই বিধান রায়ের সঙ্গে তার পরিচিতির কথা স্বীকার করেছেন। বাহিনীর রাম চ্যাটার্জি দাঙ্গার পর চন্দননগরে 'ভবানী দল' খোলেন। বাম দল ফরোয়ার্ড ব্লকে (মার্ক্সিস্ট) যোগ দিয়ে পরে ১৯৫৮ সালে খাদ্য আন্দোলনে নেমে গ্রেফতার হন, ছাড়া পেয়ে ১৯৭৭ সালে তারকেশ্বর থেকে জিতে মন্ত্রীও হন। গোপাল মুখার্জি প্রথম গ্রেফতার হন ১৯৫০ সালে একটি অপহরণের কেসে। তারপরে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে ২৩০০০ টাকা লুঠের অভিযোগে, ১৯৫১ সালে বিশ্বনাথ তেলকলে ডাকাতির অভিযোগেও ধরা পড়েন কিন্তু প্রমাণের অভাবে খালাস।

    দাঙ্গার সময় আলাদা দল খুলেছিলেন বিহারের দ্বারভাঙা থেকে নারকেলডাঙায় আসা পুনিত গোয়ালা। দেশভাগের পরের মুসলিম গুন্ডাদের মধ্যে নাম আছে ময়মনসিংহের ভৈরববাজারের লান মিঁয়ার। ১৯৪১-৪৬ সালের ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বহু দাঙ্গায় তার নাম ছিল। ভৈরব রেলস্টেশনে ডাকাতির পর পুলিশের তাড়ায় আগরতলায় চলে আসে, তারপর কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড। ১৯৫৩ সালে চিৎপুর থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার।

    ঢাকা থেকে হিন্দুস্তান পার্কে চলে এসেছিলেন রঞ্জিত কুমার বোস (রুনু বোস), ফুটবলার হিসেবে কালীঘাট স্পোর্টিংয়ে খেলতেন। ৩০০০ টাকা ঘুষ খেয়ে ১৯৪৪ সালে ডালহৌসির বিরুদ্ধে এক খেলায় কালীঘাট হেরে যায় বলে অভিযোগ। চীনা টনি ছাতাওলা গলিতে সাট্টার কারবার করতেন। ছাপড়ার বিক্রম নুনিয়া বেলেঘাটায় আর এন্টালিতে আসার পর বাঙালি -অবাঙালিদের মধ্যে ঝামেলা লাগাতেন। এরকম আরেকজন ছিলেন বালা সাউ। ১৯৬৭ সালে বেলেঘাটা আর এন্টালিতে বাঙালি বিরোধী দাঙ্গার পরে তাকে পুলিশ ধরে। উল্টোদিকে বাঙালিদের পক্ষে ছিলেন ঢাকা থেকে বেলেঘাটায় চলে আসা সুবোধ চন্দ্র দে।

    বইটি মাত্র একশো পাতার হলেও সব তথ্যই পুলিশের খাতা থেকে তুলে আনার কারণে গবেষণাধর্মী। ভূমিকায় লালবাজারে পুলিশের তথ্যভাণ্ডারে খোঁজাখুঁজির অনুমতি দেবার জন্য তৎকালীন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।

    [Goondas Towards a Reconstruction of the Calcutta Underworld / সুরঞ্জন দাস এবং জয়ন্ত কুমার রায়]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২১ আগস্ট ২০২৫ ২১:৫০733547
  • এটার পিডিএফ পড়েছি। সিএস সেবারে বইমেলায় বলল বটে কোথা থেকে যেন আবার পাবলিশড হয়েছে। কোন প্রকাশক গো? 
     
    আর একটা প্রশ্ন হল এবারে একটা বই বেরিয়েছে কলকাতার তলপেট মস্তানির সেকাল একাল নামে। সেটায় কি এমন কিছু আছে যা এটায় নেই? জান? 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন