প্রথম কাকে চুমু খেয়েছিলাম, মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে – সেটা এক পুরুষ ঠোঁট ছিল। ওর কি কচি দূর্বা ঘাসের মত গোঁফ ছিল, নাকি বুকের নরম আস্তরণ ভেদ করে হৃদয় রক্তাক্ত করে দেওয়ার মত খোঁচা খোঁচা দাড়ি? পুরু কালচে সিগারেটে পোড়া ঠোঁট, নাকি কমলা লেবুর কোয়ার মত নরম? মনে নেই – বিশ্বাস করুন – অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না। কারণ এই স্মৃতিগুলো যে কোনোদিন রোমন্থন করতে পারব, তেমন কথা কোনোদিন ভাবিনি। ভেবেছি এ কোনো রোগ, যা বড় হলে সেরে যায়। একজন পুরুষমানুষের আরেকজন পুরুষমানুষকে চুমু খাওয়া, তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কাছে পাওয়ার উদগ্র বাসনা যে এক স্বাভাবিক অনুভূতি। এরও যে উদযাপন হতে পারে, এ নিয়েও যে কোনোদিন কলম ধরতে পারব, তা যদি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে জানতাম, তাহলে আমারও আর পাঁচ জনের মত প্রথম চুমুর অভিজ্ঞতা খুঁজতে স্মৃতির অতলে গিয়ে গভীর ডুব দিতে হত না।
আমাকে বলা হয়েছে প্রাইড নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে। কিন্তু প্রাইড কী, কেন, কবে এসব বৃত্তান্তে যাওয়ার আগে আমার শেকড়ের সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। আমার জন্ম আসামের করিমগঞ্জ জেলার এক অখ্যাত গ্রামে। এমন গ্রাম, যা Google Map অন্তত লোকেট করতে পারে না। আমার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের সিলেট থেকে এদেশে চলে আসেন দেশভাগের সময়। সেই যে উদ্বাস্তু বা refugee হয়ে আমার ঠাকুর্দা এদেশে এসেছিলেন, আজ অবধি আমরা সেই অর্থে থিতু হতে পারিনি। না আর্থিকভাবে পেরেছি, না সামাজিকভাবে। আজও আমাদের একখানা বাড়ি হয়ে ওঠেনি। আমাদের আছে বাসা, মানে শহরের ভাড়াবাড়ি। ভাবছেন, কথাগুলোর সাথে প্রাইডের কী সম্পর্ক? আমি মনে করি আছে, তাই ২০১৯-এর দিল্লি প্রাইড মার্চে আমি NRC ও CAA-এর প্রতিবাদ জানাতে যে ব্যানার নিয়ে হাঁটি, তাতে লিখেছিলাম, “মোদের কোনো দ্যাশ নাই, মোদের কোনো বাসা নাই” – খুব সম্ভবত ঋত্বিক ঘটকের কোনো একটা চলচ্চিত্রের ডায়ালগ এটা (ভুল হতে পারে আমার)। কলকাতার এক ফেসবুক বন্ধু, কিংশুক, আমাকে সাহায্য করেছিলেন এমন একটা স্লোগান লিখতে। প্রান্তিকতার যে কত স্বরূপ হতে পারে, প্রাইডের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে পরোক্ষভাবে জড়িত না রাখলে হয়তো স্পষ্ট বুঝতে পারতাম না। কারণ আমাদের প্রত্যেকটি পরিচয়ই সমানভাবে অর্থবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পরিচয়কেই আমি খাটো করতে পারি না। তাই আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, ‘আমার পরিচয় কী?’ – যদি সেটা পলিটিক্যাল স্পেস হয়, আমি অবশ্যই নিজেকে আসামের বাঙালি সমকামী পুরুষ হিসাবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব। কারণ এখানে ব্যবহার করা প্রতিটি পরিচয় আমার ভৌগোলিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার দ্যোতক। তাই আমি যদি প্রাইডে যোগ দিই, আমি আমার কোনো পরিচয়কেই খাটো করব না। এটা আমাকে প্রাইডের বহুমাত্রিক রাজনীতিই শিখিয়েছে।
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে এত কথা কম পরিসরে লিখতে গেলে বারবার মনে হয়, বিষয়টাকে স্পষ্ট করতে পারলাম কি? আচ্ছা আপনাদের নিয়ে চলি আমার শৈশবের গ্রামে। আর পাঁচটা গ্রামের মতো আমাদের গ্রামেও শীতের সকালে কুয়াশাভেজা দূর্বা ঘাসের ডগায় সূর্যের প্রথম আলো পড়লে রামধনুর সাতটি রং দেখা যেত। ঠিক যেমন বৃষ্টিভেজা বিকেলের শেষলগ্নে যখন সূর্য দেখা দিত, তখনও স্পষ্ট দেখতে পেতাম সাতরঙা রামধনু। তবে তখনও জানতাম না প্রাইড ফ্ল্যাগ বলে কিছু হয় বা প্রাইড ওয়াক একটি বিশাল জনসমুদ্রের নাম। জানতাম না LGBT+ কাকে বলে। শুধু জানতাম একটি শব্দ ‘Gay’ আর এটাও জানতাম যে আমাকে সবসময় প্রমাণ করতে হবে যে আমি কোনো অবস্থাতেই Gay নই। তার জন্য নিজের হাঁটা-চলা, কাপড়-চোপড় সবকিছুর উপর নজরদারি করতাম। যেন পাছে কেউ না ভাবে, আমি Gay। আমার কাছে এটা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। “এই বেটা, বেটিন্তর মতো হাটস কিতা, বুক ফুলাইয়া হাট” (মেয়েদের মতো হাঁটছিস কেন, বুক ফুলিয়ে হাঁট), বাবার এই কথাগুলো এখনো মাঝে মাঝে কানে বাজে। বা বোনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটু রূপচর্চা করলে বাবা যখন বলতেন, “দুনিয়ার যত বেটিয়ামী কাম তোর” (পৃথিবীর সব মেয়েলোকের কাজ তোকে করতেই হয়) তখন মনের অজান্তেই একটা প্রশ্ন জাগত, কেন আমি এমন। কেন আমি এত হাত নাড়িয়ে কথা বলি, কেন আমার ছেলেদের শরীরের কাছঘেঁষা হয়ে থাকতে ভাল লাগে, কেন আমি ছেলেদের মত হাঁটতে পারি না। স্পষ্ট উত্তর জানা ছিল না, গ্রেজুয়েশন অবধি। তাই একদিকে যত বেশি পারি পুরুষ বন্ধুদের কাছঘেঁষা হয়ে থেকেছি আর অন্যদিকে সিনেমার নায়কদের অনুসরণ করেছি, “পুরুষদের মত” হাঁটা শেখার জন্য। বিচিত্র জীবন, তাই না? একেই কি বলে hypocrisy? আমি বলব, না – একে অজ্ঞতা বলে।
আমার কাছে ইন্টারনেট আসে, যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার মুক্তির পথ অবারিত হয়। নিজের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করি, কিন্তু সাহস হয়নি Mass Communication নিয়ে পড়ার সময় সমকামিতার উপর একটি শর্টফিল্ম বানানোর। ‘বন্ধুরা’ সবাই জানত আমি Gay, কেউ সামনে বলত না, যেহেতু বরাবরই পড়ায় মোটামুটি ঠিকঠাক ছিলাম। কিন্তু সবাই যে এটুকু জানত, যে আমি Gay, এটা যে কতটুকু লজ্জাজনক বিষয় ছিল আমার কাছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।
গ্রেজুয়েশন অবধি যাদের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছি, তাদের দেখলাম প্রত্যেকেই এই ঘনিষ্ঠ হওয়াকে অন্য কোনো একটা জিনিসের বিকল্প হিসাবে দেখে। কিন্তু খোলাখুলিভাবে নিজেকে সমকামী হিসাবে কেউই গ্রহণ করে না। ২০১০-এ যখন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলি, তারপর থেকে আমি যথেষ্ট সাহস পেতে শুরু করি। কলকাতার অনেকের সঙ্গে কথা হত ফেসবুকে, কিন্তু তখনও নিজেকে দোষী মনে হত। কারণ আমার মত তো কেউ ছিল না আমার চারপাশে। নিজের যৌনতাকে যেভাবেই হোক, চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। তবে এটুকু ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, যে বাঁচতে হলে বড় শহরে যেতে হবে। তাই জীবিকার তাগিদের চেয়েও বেশি নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য, খোলা আকাশের নীচে পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর আশা নিয়ে ২০১৩-তে দিল্লি গেলাম।
ঠিক ওই বছরই ডিসেম্বরে সমকামিতা আবারও আইনের চোখে অপরাধ বলে গণ্য হল। মনে হল, এত দূর এসে এবার পাড়াপড়শির বদলে আইনের চোখ ধাওয়া করতে লাগল। খুবই ধীরে ধীরে নিজেকে রাজধানী দিল্লীর কুইয়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে শুরু করলাম, অবশ্যই ভয়ে ভয়ে। তখন ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, প্রাইড ওয়াকের কথা। তাই প্রচুর উৎসাহ নিয়ে, শুধু “নিজের মত” হাজারো লোকজনকে দেখতে দিল্লিতে ২০১৪ সালে প্রথম দিল্লি কুইয়ার প্রাইডে যোগদান করি। না, মুখোশ পরে নয়। নিজেকে এই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখে প্রথমবারের মত ভয় হল না।
২০১৩ থেকে ২০২২ – এই ৯ বছরে অনেক কিছু পাল্টেছে আমার শহরের। আমার শহরের ১৮ বছর বয়সের ছেলের কাছে android মোবাইল আছে। তারা Grindr-এ মেসেজ করে শর্ত রাখে, “যদি বিয়ে করতে রাজি হও, তবেই মিট করব”। অনেকেই এখন যথেষ্ট খোলাখুলিভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে। এমন নয়, যে ‘সমাজ’ তাদেরকে কথা শোনাচ্ছে না। কিন্তু অন্তত ইন্টারনেটের দৌলতে ওরা নিজেদের মত আর পাঁচজন লোকের সাথে কথা বলতে পারছে। নিজেকে হয়তো আমার মতো কিম্ভূতকিমাকার ভাবছে না।
আশা করি, ইট গেটস বেটার…