এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অন্য যৌনতা

  • আমার ক্যুইয়র সত্ত্বা আর আমি

    ঋষভ
    অন্য যৌনতা | ০৩ জুলাই ২০২২ | ২০৯২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • ছবি -


    কেমন আছি আমরা?



    গৌরব মাস শেষ। মধুরেণসমাপয়েৎ৷ ১লা জুন দেখলাম পটপট করে নানান ব্র্যান্ড-এর লোগো বদলে গেল সামাজিক মাধ্যমে। বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করি, নিয়মিত ইমেইল আসতে লাগল - গৌরব মাসের পাঠ নিয়ে, সেটা কী, খায় না মাথায় দ্যায়, কী ভাবতে হবে, কী করতে হবে, কী বলতে হবে, কী বলতে নেই, কী করতে নেই, কী ভাবতে নেই.... কত কিছু। গাড়ি ডাকার জন্য উবের খুলেছি, দেখি সাতরঙা ছোট্ট ছোট্ট গাড়ির আইকন স্ক্রিনে দক্ষিণেশ্বরের আশেপাশে দেখাচ্ছে। অ্যামাজনের প্যাকেজে নাকি রামধনু স্টিকার। এরকম নাই নাই করে কত উৎসাহ, কত উদ্যোগ, কত প্যাকেজিং....

    ....আর আমি এই লেখাটা এখনো ছদ্মনামে লিখছি।

    আমি আপাতদৃষ্টিতে প্রিভিলেজড বা সুবিধাভোগী মানুষ, মোটামুটি উচ্চশিক্ষিত বলা চলে, উচ্চবর্ণ, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মোটামুটি কাজ চালানোর মত বুদ্ধিধারী, শিক্ষায় চিকিৎসক, পেশায় গবেষক, গত ৮ বছর ধরে ক্যুইয়র কম্যুনিটির – মানে আমার মত মানুষদের নিয়ে কাজ করে চলেছি নানাভাবে। সেটা চিকিৎসার মাধ্যমে হোক, গবেষণার মাধ্যমে হোক, সাপোর্ট গ্রুপ চালানোর মাধ্যমেই হোক, ইদানীং একটা স্টার্ট আপ বানানোর চেষ্টাও করছি।

    ....আর সাথে সাথে একটা অভিনয়-ও করে চলেছি, নিজের সত্ত্বার কথা সযত্নে গোপন করে রেখে চলেছি নিজের পরিবারের থেকে।

    ফেসবুকের নানান গ্রুপগুলোতে, বন্ধুদের সাথে ঘরোয়া আড্ডায়, এমনকি কম্যুনিটির স্পেসগুলোতেও মাঝেমাঝে এই প্রশ্নটা শুনতে পাই – এই যে প্রাইড বা গৌরব, কীসের গৌরব? কীসের গৌরব ভাই তোমাদের? কই মা-বাবা, ভাই-বোন, বাইরের দুনিয়ায় কাউকে বলতে তো শুনিনা যে আমি গর্বিত! তোমাদের গৌরবটা কী নিয়ে আদতে?
    আমি নিশ্চিত যে এটা আমার একার অবজার্ভেশন নয়। বহু স্বঘোষিত ক্যুইয়র মানুষকে এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সবাই নিজের মতন করে উত্তর দেয়, আমিও নিজের মত করেই দিচ্ছি।

    “ক্যুইয়র” এবং……

    ইংরেজিতে ক্যুইয়র কথাটার সাধারণ মানে “অদ্ভুত” বা “উদ্ভট”। এই শব্দটার সাথে এক দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ইতিহাসে দেখা যায় যে ক্যুইয়র কথাটা ইংরেজি সাহিত্যে এবং কথ্য ভাষায় ব্যবহার হত, যা কিছু অদ্ভুত তার প্রিফিক্স হিসেবে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এই শব্দটি ব্যবহার হতে লাগল অপমানসূচকভাবে, গাল হিসেবে, বুলি করার জন্য – এবং মূলত সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য। ইতিহাসে দেখলে, ইংরেজ সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ডের প্রেমিকের পিতার একটি চিঠিতে প্রথম লিখিতভাবে “ক্যুইয়র” কথাটা সমকামিতার প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়, যার পরেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে এই গোষ্ঠীর মধ্যে ধীরে ধীরে লিঙ্গ এবং যৌন পরিচিতি-র স্বনির্ধারিত পরিচায়ক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। তবে মূল রিক্লেইমেশন বা শব্দের মানের প্রেক্ষিত বদল ঘটার কাজটা হয় ১৯৮০-৯০-এর দশকের এইডস ক্রাইসিস-এর সময়ে। যখন সরকারি উদাসীনতা আর বিদ্বেষের কারণে বিনা চিকিৎসায় সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষজন এইডসের শিকার হচ্ছিলেন – সেই শোক, হতাশা এবং ক্ষোভের প্রেক্ষিতে কেবল “গে”, “লেসবিয়ান”,”ট্রান্সজেন্ডার” এই পরিচিতিগুলোর থেকে আলাদা, র‍্যাডিকাল এক আত্মপরিচিতির জন্মলগ্ন – একটা অপমানসূচক শব্দের রূপান্তর ঘটে, সেটা হয়ে ওঠে ব্যাজ অফ অনার – একটা বৈপ্লবিক আত্মচেতনার স্বচৈত শব্দদ্যোতক। ক্যুইয়র নেশন বলে আমেরিকার একটি দলের লেখায় পাওয়া যায় – “যখন বহু লেসবিয়ান আর গে মানুষ সকালে জেগে ওঠেন, আমরা রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে জেগে উঠি, আনন্দিত হয়ে নয়। তাই আমরা আমাদেরকে ক্যুইয়র বলে ডাকব ঠিক করেছি। “ক্যুইয়র” কথাটা ব্যবহারের উদ্দেশ্য – নিজেদের মনে করানো, আমাদেরকে বাকি দুনিয়া কীভাবে দেখে। আমাদের যে দায় নেই হাসিখুশি ভাল মানুষ সেজে থাকার – যারা আমাদের প্রান্তিকতা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পেরেই খুশি – তা আমাদের মনে রাখার এটা একটা উপায় মাত্র। আমরা ক্যুইয়র এই অর্থে ব্যবহার করি, যে আমরা সমকামী পুরুষ, সমকামী নারী, আর আমরা ক্যুইয়র পরিচয়েই স্বচ্ছন্দ।”

    আজ ক্যুইয়র শব্দের বৃহৎ অর্থে, যা কিছু স্বীয়লৈঙ্গিক বা বিষমকামী অর্থাৎ সিসজেন্ডার বা হেট্রোসেক্সুয়াল-এর বাইরে – তাই-ই ক্যুইয়র হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। ক্যুইয়র আত্ম-পরিচিতি আজ স্বনির্ধারিত এবং এলজিবিটিক্যিউএইচকেআইএ+ - লেসবিয়ান গে বাইসেক্স্যুয়াল ট্রান্সজেন্ডার হিজড়া কোতি ইন্টারসেক্স আসেক্সুয়াল এবং অন্যান্য - লিঙ্গ-এবং-যৌন পরিচয়ের বৈচিত্র্যময় দুনিয়াকে একটা শব্দবন্ধে বর্ণনা করতে ক্যুইয়র কথাটা ব্যবহার করা যায়।

    এটার মানে এই নয় কিন্তু, যে ক্যুইয়র ব্যাপারটা বিদেশী। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক সময়েই শুনি, যে আমাদের আন্দোলনটা নাকি গভীর একটা চক্রান্ত। রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে নানান ন্যারেটিভ বেরোয়। সনাতনপন্থীরা বলেন, আমরা নাকি ভারতীয় সংস্কৃতির কেউ নই – আদপে আমরা পশ্চিমি ষড়যন্ত্রের সভ্যতা দুর্বলকারী সংস্কৃতিভাঙানি কাপুরুষ। বামপন্থীরা বলেন, আমরা নাকি ধনতান্ত্রিক মার্কিনীদের এক্সপোর্ট, কম্যুনিজমের আন্দোলনকে দুর্বল করার প্রয়াস। নানান ধর্মে আমাদের বিরুদ্ধে নানান মতবাদ – এই এক জায়গায় বিভিন্ন আইডিওলজি, বিভিন্ন মৌলবাদ এক সূত্রে গাঁথা।

    অথচ একটু কান পাতলেই শোনা যাবে ইতিহাস, সমাজ, জীবন, অর্থনীতি – এগুলো অন্য কথা বলছে।
    প্রাগৈতিহাসিক আদিম যুগের ভীমবেটকার প্রতিবেশী কেভ পেইন্টিং-এ তৎকালীন সমাজের যৌনতার বৈচিত্র্যের প্রকাশ আছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার প্রত্নস্মারকে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটেছে। মন্দির গাত্রের ভাস্কর্য বহুলচর্চিত, কামসূত্রের ভাষ্যে নাগরিক ভারতীয়-র যৌন বৈচিত্র্যের প্রকাশ। আয়ুর্বেদে যৌন এবং লিঙ্গ সংখ্যালঘু পরিচিতির মান্যতা স্বীকৃত। মধ্যযুগে নানান কবিতার মধ্যে, চিত্রের মধ্যে এই বৈচিত্র্যের প্রকাশ। উর্দু সাহিত্যে ক্যুইয়র থিমের কবিতার সংকলন এই দেশে লেখা। কলোনিয়াল যুগে ইংরেজ আগমনের সাথে সাথে ক্যুইয়র-বিদ্বেষের আগমন। কলোনিয়াল প্রভুদের ক্রিশ্চান দৃষ্টিভঙ্গিতে আপাত-সহিষ্ণু সমাজে শুরু হল আইনসিদ্ধ পারসিকিউশন। সিপাই বিদ্রোহ, যাকে ইদানীং ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা হয়, পরবর্তী সময়ে ১৮৬০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মেকলে সাহেব প্রণয়ন করেন। অতএব, হে প্রভুগণ, ক্যুইয়র ফোবিয়া অনেক বেশি অ-ভারতীয়, অনেক বেশি বিদেশী, অনেক বেশি কলোনিয়াল, অনেক বেশি পশ্চিমের দান, অনেক বেশি ধনতান্ত্রিক সমাজের ইন্ডিভিজ্যুয়ালিস্টিক বায়াসের ফল – যা আপনারা সযত্নে লালন করছেন। এ দেশে বহু আগে থেকে কোতি-হিজড়ে-আরাবনী-যোগাপ্পা প্রভৃতি বিভিন্ন গোষ্ঠীর বাস। সমাজ জীবনের বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য এঁরা পালন করেছেন। আবার কেউ কেউ কুখ্যাতনামাও বটে, ইতিহাসের বিখ্যাত ভিলেনদের মধ্যে পড়েন। মোদ্দা কথা, সমাজ পরিত্যক্ত করেনি এই গোষ্ঠীকে, স্বতন্ত্র-বাস সমাজসিদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য ছিল, তেমনি সমাজে এদের কন্ট্রিবিউশনও ছিল। বরং এখন কলোনিয়াল হ্যাঙওভারে আমাদের দম আটকানো দশা। যে গোষ্ঠীগুলোর কথা বললাম, তারা জীবনসংগ্রামের অকূল পাথারে লড়াই করে চলেছেন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে।

    একটু আগেই বললাম, অভিনয় করে চলেছি। নিজের যে মূল সত্ত্বা, আমার যে নানান পরিচয়গুলো বললাম, তার মধ্যে একটা সত্ত্বা হল আমার সমকামিতা। পুরুষ হয়ে পুরুষকে চাই নিজের সঙ্গী হিসেবে। আমার অন্য বন্ধুরা বা ভাই বোনরা দাদা দিদিরা যেরকম বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে জীবনসঙ্গী করে নিয়েছে, আমার মত মানুষরা সমলিঙ্গের মানুষকে সেরকম সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। আমাদের যৌনতা, প্রেম ইত্যাদি অনুভূতিগুলো সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের দ্বারা চালিত হয়।

    অথচ, এই কথাটা আত্মস্থ করার মূল্য বা অন্যদেরকে জানানোর মূল্য বেশ অনেকটাই।

    আমি যখন বড় হয়েছি, কৈশোরে এবং যৌবনের গোড়া অবধি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বজায় ছিল। এতএব, আইনের চোখে তখন আমার মত মানুষরা অপরাধী। যে শিশু/কিশোর মন বিপন্ন বোধ করে, তার সেই বোধের শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত হয়। নিজের কাছে যখন নিজেই স্বীকার করলাম মূলস্রোতের থেকে পার্থক্য, তখনই মাথায় এল - অতঃকিম, সার্ভাইভালের উপায় কী?

    মনে রাখবেন, এটা ২০০০-২০১০-এর দশক। তখন সদ্য ইন্টারনেট এসেছে, হোমোসেক্সুয়ালিটি শব্দটা জানি বায়োলজি বইয়ের কল্যাণে, আর নিজের ব্যাপারে বুঝি। কিন্তু তখনি বুঝে গেছি যে -
    ১. আমার পক্ষে বিয়ে করাটা উচিত নয়, পারব না। ২. এটা হয়তো বাড়ির সবাই বুঝবে না, আমাকে আলাদা থাকার, সার্ভাইভ করার বন্দোবস্ত করতে হবে।

    আমার বিষমকামী বন্ধুদের যে সময় প্রেম আর কেরিয়ার নিয়েই ভাবতে হত, সেই সময় আমাকে বাকি জীবনের প্ল্যানিং শুরু করতে হয়েছে এবং তখন যে স্ট্র্যাটেজিগুলো ভেবেছিলাম – তার মধ্যে সব হয়তো খাটেনি, সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পাল্টেছে – কিন্তু মূল যে ধারণাটা, যে আমাকে স্বাবলম্বী হতে হবে, এমন কিছু পড়তে বা শিখতে হবে, যা আমাকে একটা জায়গায় আটকে না রেখে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেবে, আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে ভিক্ষেবৃত্তি অবলম্বন করতে হবে না, নিজেরটা চালিয়ে নিতে পারব অন্তত – এই বোধটা আমার অত্যন্ত ছেলেবেলা থেকে তৈরি হয়েছিল। আমি দরিদ্র ঘরের নই, কিন্তু নিজের যৌন সংখ্যালঘু পরিচয়ের জন্য বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার ভয়টা ভাল মাত্রায় ছিল।

    তারপর আরেকটু বোধ যখন বাড়ল, দেখলাম যে একা সার্ভাইভ করাটা অসম্ভব। পরিবারের সাপোর্ট থাকবে কিনা জানি না, কিন্তু একটা সাপোর্টিভ কম্যুনিটির প্রয়োজন খুব বেশি। এটা আরো বোধ করলাম, যখন আমি যে বন্ধুদের সাথে কলেজের সময়ে থাকতাম, অন্য একটি ঝামেলার সময়ে তারা আমার যৌন পরিচিতির সম্বন্ধে বিদ্বেষমূলক আচরণ করেছিল। সেই অত্যন্ত দিশাহারা সময়ে যদিও আমার বিষমকামী বন্ধুরাই সবচেয়ে বেশি পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, আমি এটাও অনুভব করেছিলাম, যে আমি যেরকমভাবে বিপন্ন বোধ করছি, সেটা তারা অনেকটা বুঝতে পারলেও পুরোটা পারছে না। পরবর্তী সময়েও এটা ঘটেছে, যে অন্য কোনো কনফ্লিক্টেও আমার যৌন পরিচিতিটাকে টেনে এনে গাল দেওয়া হয়েছে, যেটার সাথে হয়তো সে ঝামেলাটার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এইটা যেহেতু সফট টার্গেট, সেই কারণে এটাকে ব্যবহার করে সহজেই মনে করিয়ে দেওয়া যায়, যে তুমি যতই যাই হও না কেন, তুমি সেই সংখ্যালঘু, তুমি আলাদা৷

    এতটা পড়ে কেউ যদি মনে করেন, যে আমি কেবল ট্র্যাজেডির কথাই বলে চলেছি, সেটা কিন্তু নয়৷ আমি এটা বোঝাতে চাইছি, যে, আলাদা হওয়ার একটা মূল্য আছে। সেটা ব্যক্তিগত স্তরে দিতে হয়েছে নানান ভাবে, নানান জায়গায়, নিজের অনিচ্ছেয়, নিজের বিপন্নতা বোধের সময়গুলোতে। এই পুরো প্রক্রিয়াটার একটা বাড়তি মানসিক শ্রম বা ইমোশনাল লেবার আছে।

    আমরা যারা ক্যুইয়র, তারা আমাদের অথেন্টিক পরিচিতিটাকে লুকিয়ে বড় হই। যারা লুকোতে পারি না – মেয়েলি ছেলে, পুরুষালি মেয়ে – তাদের সাধারণত হয়রানিটা শুরু হয় পরিবারের মধ্যেই, নইলে স্কুলে। এই অভিনয় বা এক্সক্ল্যুশন – উচ্চশিক্ষা, কর্মজীবন - সবকিছুতেই প্রভাব ফেলে যায়। আমার নিজের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা বলতে পারি। কলেজে পড়াকালীন আমার অভিব্যক্তিতে পুরুষালি ভাব যেমন ছিল, কিছুটা মেয়েলি ভাবও ছিল। স্কুলে সেই নিয়ে কথা শুনেছি, তবে মোটামুটি বন্ধুরা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভালবাসাও পেয়েছি। কলেজে এসে বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন কাম আউট করেছি, দু’-একটি এক্সেপশন বাদ দিয়ে বন্ধুদের থেকে গ্রহণযোগ্যতাই পেয়েছি। কিন্তু যেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, তা হল একজন সিনিয়রের বিশ্রী বুলিইং – এফিমিনেট হওয়ার জন্য। জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে পেশেন্টের সামনে অপমানিত হওয়ার অসম্মান মনে গভীর দাগ কেটেছিল। নিজেকে বদলানো শুরু করি তখন – আরো বেশি পুরুষালি করে তুলতে চেষ্টা করি নিজেকে, যাতে রোগীর শুশ্রুষার সময় ডাক্তারের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। নিজেকে বদলানোর প্রক্রিয়াটার ট্রমা অনেক গভীরে দাগ কাটে – পরবর্তীকালে কর্পোরেট কালচারে একটা টার্ম শিখেছিলাম – ইম্পস্টার সিন্ড্রোম – মানে নিজেই নিজের দক্ষতার সম্পর্কে সন্দিহান থাকা। এখনো নিয়মিত এতে ভুগি, এবং এটার পেছনে যে বুলিইং, এত বছরের অভিনয়, এই যে ডাবল লাইফের বোঝা আছে – সেটা এখন বুঝতে পারি। আর বড়বেলায় এসে এখন তাই কাজ চলছে এই জিনিসগুলো আনপ্যাক করার, এগুলোর তলায় নিজের যে অথেন্টিক সেলফটা আছে – সেটাকে চেনার, বোঝার, জানার। এই কাজটা বেশ সময় আর শ্রম-সাপেক্ষ। কারণ কোন অংশটা নিজের, আর কোন অংশটা নিজেকে সুরক্ষিত করার জন্য তৈরি, সেটা চেনাটা কঠিন। ছদ্মনামে লেখাটা এরকমই একটা অ্যাডাপ্টেশন - নিজের সুরক্ষার কারণে।

    পরিবার ও ক্যুইয়রনেস

    এই আলাদা হওয়ার মূল্যটা পারিবারিক স্তরে এখনো দিতে হয়নি, কারণে পরিবারের কাছে নিজের পরিচিতিকে বা এই সংক্রান্ত নিজের কাজকে এখনো গোপন রেখেছি। পরিবারের কাছে একবার আত্মপ্রকাশ করলে আর ফেরত যাওয়ার জায়গা থাকে না। যাদের পরিবার মেনে নিতে পারে, তারা তাদের অথেন্টিক সেল্ফ নিয়ে জীবন যাপন করতে পারেন, যদিও তাদেরকেও নানান ভাবে সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়৷ পরিবারের কাছে সেই আত্মপ্রকাশের মূল্যটা অনেক বেশি, কারণ সেটা অনেক বেশি ইন্টিমেট স্পেস-এ। ব্যক্তি আমি যে সমস্যাগুলোর মধ্যে দিয়ে গেছি, আমার অভিভাবক বা পরিবার তখন সেই সমস্যার কিছুটা যেমন সম্মুখীন হবেন, তেমনি তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হবে আমার পরিচিতির প্রতি – সেটার জন্য আমাকে আরেক প্রস্থ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সন্তানের অন্যরকম হওয়া মা-বাবার পক্ষেও একটা ইমোশনাল ধাক্কা। লেখক সন্দীপ রায় লিখেছেন একটা প্রতিবেদন-এ, “I have often said, only half-jokingly, that in the West, coming out historically meant leaving your family in some small mid-western town and heading to San Francisco or New York. In India, coming out often meant the whole family going into the closet with you.” ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ আর গোষ্ঠী বা পরিবার-কেন্দ্রিক সমাজে তাই লিঙ্গ বা যৌন সংখ্যালঘু হিসেবে আত্মপ্রকাশ ব্যাপারটার প্রভাব খানিকটা সমান, আবার খানিকটা আলাদাও। কেবল নিজের পক্ষে নয়, অভিভাবক, বৃহত্তর পরিবার, সহোদর-সহোদরা প্রভৃতি নানান পরিবারজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের পক্ষে এই ঘটনার প্রতি নানান রকম রেস্পন্স হয়। ভিন্নতা-কে বোঝা, মেনে নেওয়া, উদযাপন করা – এটা একটা লম্বা যাত্রা, যেটা পরিবারের মানুষদের করতে হয় এবং অনেক সময়েই এই উত্তরণের পেছনে যে মানসিক শ্রম, সেটার ভারটাও এসে পড়ে পরিবারের সেই ক্যুইয়র মানুষটার ওপর – অন্য সবাইকে বোঝানো, ভিন্নতার সাথে ঘর করার পাঠ দেওয়া প্রভৃতিতে। আবার কোনো কোনো পরিবারের সদস্য নিজে থেকেই সংবেদনশীল হন। কারো কারো এই পাঠের প্রয়োজনই হয় না, ভালবাসা বা সন্তানস্নেহই হয়ে ওঠে অ্যাক্সেপ্ট্যান্সের প্রাণশক্তি। যে সকল অভিভাবক/পরিবার অ্যাবিউজিভ, মেনে নিতে অপারগ বা মনোকষ্টে আছেন সন্তানের বা কাছের মানুষটার ভিন্নতার জন্য, তাঁরা যাতে মুক্তি লাভ করেন তাঁদের মনের কারাগার থেকে, ভয়ের থেকে, বিদ্বেষের থেকে, ধর্মভীরুতা, সমাজভীরুতার থেকে, সেই আশা রইল – একটু ভালবাসাকে মনের মধ্যে জায়গা দিয়েই দেখুন না? আর যাঁরা নিজগুণে ভালবাসার সাথে আমাদের গ্রহণ করেন, আমাদের সাথে এগিয়ে চলেন নিজেদের সকল ভয়, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনাকে জয় করে, আমাদের প্রকৃত পরিবার এবং আশ্রয় হয়ে ওঠেন, আমাদের ভিন্নযাপনের ভিন্নতাকে আলিঙ্গন করে “আপন জন” হয়ে ওঠেন, তাঁদের জানাই কুর্ণিশ।

    যা কিছু প্রাপ্তি…

    আবার এটাও ঠিক, যে, ক্যুইয়রনেসের জন্যই দুনিয়াকে অন্যরকম একটা লেন্স দিয়ে দেখা শিখেছি এবং শিখছি। নর্মেটিভিটিকে প্রশ্ন করতে শিখেছি। আলাদা হয়েও, একই জীবনে বহু জীবন যাপন করেও বেঁচে আছি, হাল ছেড়ে দিইনি। ক্লান্তি লাগলেও এগিয়ে চলেছি। এরকম নানান অভিনয়, নানান শ্রম, নানান অসুবিধা সত্ত্বেও নিজেদের নানাবিধ যাবতীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে চলেছি শুধু তাই নয়, সমাজকে নানান ভাবে প্রশ্ন করে, নিজেদের অভিজ্ঞতা আর নিজেদের কাজ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। এটার জন্যই গর্ব হয়৷ নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার না করে বেঁচে মরার জীবন্মৃত দশায় আটকে না থেকে একটা ভাইব্র্যান্ট, স্বপ্নালু, খাটিয়ে গোষ্ঠীর অংশীদার আমি। আমি আমার কম্যুনিটি-র থেকে শিখি রেসিলিয়েন্স কথাটার অর্থ কী। আমি শিখি – প্রশ্ন করার স্পর্ধা কাকে বলে। আমি শিখেছি সলিডারিটি কাকে বলে – মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে আমার মত মানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, একে অপরের পাশে দাঁড়াতে, সাহস যোগাতে, অচেনা মানুষ এর পাশে দাঁড়াতে – একটা ফোন কলের ভিত্তিতে। আমরা নিজেরা গভীর ট্রমায় ছারখার হয়ে যাই, কিন্তু সেই ট্রমা থেকে ফিনিক্সের মতো উড়তে শিখি। আমরা হয়তো প্রচণ্ড জাজমেন্টাল, কিন্তু হয়তো সেই কারণেই আমরা গভীরভাবে সমাজকে নিয়ে ভাবি, প্রান্তিকতা নিয়ে ভাবি, লড়াই করি অসাম্যের বিরুদ্ধে। আমরা বিচিত্র। আমাদের যাপন বৈচিত্র্যের, বহুত্বের। আমরা যেমন আর পাঁচজনের মত সাধারণ – সকলের মতই, তেমনি আমরা স্বতন্ত্রও বটে। এই দ্বৈত আপাত-কনফ্লিক্টিং অথচ ইউনিফাইং স্টেট অফ এক্সিস্টেন্সটাই আমার জীবন দর্শন-এর উৎস, কাজের অনুপ্রেরণা, চলার পথের পাথেয়।

    এতেই আমার গৌরব।

    আজ যে মানসিকভাবে আমি নিজের পরিচিতি সম্পর্কে স্টেবল; আইসোলেটেড বোধ করি না – তার জন্য এই বন্ধুবৃত্তের অ্যাক্সেপ্টান্সটা, সাপোর্টটা, অ্যালাইশিপটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগের যে ইমোশনাল শ্রমের কথা বললাম, সেটা কিছুটা হলেও লাঘব হয় কারণ বন্ধুদের মধ্যে আমাকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় না, কিছুক্ষেত্রে বন্ধুদের অভিভাবকরাও আমার পরিচিতির কথা জানেন এবং আমাকে সেই ভিন্নতা নিয়েই গ্রহণ করেছেন, ভালবাসা দিয়েছেন। আমার কিছু কাজিনদের কাছে আমি আউট, আগে প্রচণ্ড মন খারাপ হত, যে, আমার একান্ত আপন যে আমি-টা সেটায় পরিবারের কেউ চেনে না। ওদের পাশে পাওয়ার পর সেই মন খারাপটা কিছুটা হলেও কমেছে এবং সেই স্পেসগুলোয় আমাকে অভিনয় করতে হয় না, সেখানে আর পাঁচজনের মতই আমি সমান। যতক্ষণ না এই অবস্থানটা মূলধারায় পরিণত হচ্ছে, সকলের জন্য, ততক্ষণ গৌরবের উদযাপনের প্রয়োজন। যখন আলাদা করে “কাম আউট” করার প্রয়োজন হবে না – আমি সমলিঙ্গে প্রেম করি, বিবাহ করি, পরিবার শুরু করি, রক্তদান করতে পারি, সন্তান দত্তক নিতে পারি, আমার অবর্তমানে আমার পার্টনার বা আমার নির্দিষ্ট করা কোনো মানুষ আমার প্রাপ্যগুলো, আমার ইনহেরিট্যান্সকে পেতে পারে – যতক্ষণ এগুলোকে সাধারণভাবেই দেখা হবে, বিতাড়িত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না, বৈষম্য-র বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে না, কনভার্শন থেরাপি, কারেক্টিভ রেপ – এই শব্দগুলো ইতিহাস হয়ে যাবে, বিষমকামী জীবনযাপনের পাল্লায় যা সুবিধা – এবং অসুবিধা – সেগুলোর পাল্লা সমকামী জীবনের সাথে সমান হবে, ততক্ষণ অবধি প্রাইডের প্রয়োজন।

    যৌবনের গোড়ার দিকে এক্স-মেন সিরিজের সিনেমাগুলোর সাথে পরিচয় হয়। যখন ক্যুইয়র সিনেমা দেখিনি, তখন এই এক্স-মেন সিনেমাগুলোর সাথে প্রচণ্ড রিলেট করতে পারতাম। আজ আমার বন্ধু গ্রাসরুট স্তরে কাজ করে, ওদের থেকে শুনি আমার মতো আরো বহু মানুষের দুরবস্থার কথা। আমার পারিবারিক জেনারেশনাল সম্পদএর জন্য আর্থিক ভাবে স্টেবিলিটি আছে। বহু ক্যুইয়র মানুষের সেটা নেই, এবং প্যান্ডেমিক পরবর্তী সময়ে তারা দারিদ্র্য এবং অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। যেহেতু এদের পরিবারের থেকে সাপোর্টটাও নেই, ফলে অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। আমার এক্স মেন সিরিজের সেই সিনেমাটার কথা মনে পড়ে - যেখানে দেখানো হয়েছিল যে মিউটেশনের একটা ওষুধ বেরোনোর ফলে মিউট্যান্ট সমাজ বিভক্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ লাইন দেয় ওষুধ পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। কেউ কেউ লড়াই করে বলে - মিউট্যান্ট অ্যান্ড প্রাউড! যখন আমি বন্ধুদের থেকে শুনি নিঃসঙ্গতার কথা, দারিদ্র্যের কথা, লিঙ্গবৈচিত্র্য না চেয়ে পাওয়া অভিশাপের মতন এরকম কথা - তখন বারবার এই সিনেমাটার ওই দৃশ্যগুলো মনে পড়ে।

    তাহলে, প্রাইড ওয়াক কেন?

    এবার আসি ওই প্রশ্নটায়: তুমি ক্যুইয়র তো কী হয়েছে, এটা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে রাস্তায় নেমে নেচেকুঁদে বলার কী আছে? ঐ যে তোমাদের প্রাইড ওয়াক না ছাই, কী লাভ হয় ওতে?

    আছে মশাই, আছে। আমরা এমন একটা গোষ্ঠীর মানুষ, যারা না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে বাঁচি, অন্তত বেশিরভাগ মানুষ যারা ফেসবুক ইন্সটা সেলেব্রিটি নয়। আপনাদের রীতি-রেওয়াজের এমন চাপ, যে অনেকেই নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে ছাদনাতলায় হাঁটে, অন্য লিঙ্গের মানুষের সাথে। এই মানুষগুলো যদি একটু সাহস করত, তাহলে হয়তো আমাদের মত মানুষজনের কথা আরো আগে, আরো বেশি করে জানতে পারতেন। আর ওই যে প্রতিষ্ঠানটি, বিবাহ, ওইটি যে আপনাদের স্ট্রেট প্রাইড! ভেবে দেখুন – পুরো পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-পড়শি মায় আজকাল আদরের পোষ্য পর্যন্ত সেজেগুজে, বাজনা বাজিয়ে, নেচেকুঁদে, কবজি ডুবিয়ে খেয়েদেয়ে, আনন্দ করতে করতে উদযাপন করে কীসের? না, আপনি বাকি জীবনটা কার সাথে শোবেন, কার সাথে ঘর করবেন, কার সন্তানের অভিভাবকত্ব করবেন, কে আপনার সুখ-দুঃখের সমস্ত মুহুর্তের সঙ্গী হবেন, কার ইন্সিওরেন্সের বেনিফিট আপনি পাবেন বা আপনার ইন্সিওরেন্সের বেনিফিট কে পাবে, আপনার অসুস্থতার সময়ে কে নির্ধারণ করবেন আপনার চিকিৎসা কেমন ভাবে হবে সেটা, আপনার নেক্সট অফ কিন কে হবেন, আপনার অবর্তমানে আপনার সম্পত্তি, আপনার লিগ্যাসি কে বহন করবেন, আপনার উত্তরাধিকারী কে হবেন – যাবতীয় ভালমন্দের সঙ্গীর সাথে যে সম্পর্ক, নেটাল ফ্যামিলি-র পরবর্তী যে সবচেয়ে আইনের এবং রাষ্ট্রের চোখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃত সম্পর্ক – তার অ্যাত্ত বড় উদযাপন। আর যে-ই এই রাস্তায় হাঁটে, তার জন্যেই বাঁধাবরাদ্দ। প্র্যাক্টিকাল জগতে যাই হোক না কেন, অন্তত আইডিয়াল টুকু তো ঠিক আছে!

    আমাদের সেসবের খুদকুঁড়োটুকুও নেই। ফি বছরে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা মেক-বিলিভ জগতের সৃষ্টি করি আমরা। স্টোনওয়াল রায়টের স্মারক হিসেবে আমরা পালন করি – যে স্টোনওয়ালে প্রান্তিক ড্র্যাগ ক্যুইন, মেয়েলি ছেলে, পুরুষালি মেয়ে আর রূপান্তরকামী যৌনকর্মীরা রুখে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রের পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে প্রতিটি দেশের ক্যুইয়র আন্দোলনের নিজস্ব ইতিহাস আছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যুইয়র আন্দোলনের একটা টার্নিং পয়েন্ট এই স্টোনওয়াল, যেটার উদযাপন করা হয়। আমাদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান, তাদের পরিবার-বান্ধবরা এতে অংশগ্রহণ করে। আমি নিজে হেঁটেছি বেশ কিছু প্রাইডে, ক্যুইয়র বন্ধুদের সাথে – কখনো মুখোশের আড়ালে, কখনো মুখোশ ছাড়া। স্বপ্ন দেখি – যদি কোনোদিন আমার পরিবার আমার সাথে হাঁটে, সেটাই আমার কাছে হবে আমার ক্যুইয়রনেসের স্বীকৃতি। কিছুক্ষণের জন্য আমরা সৃষ্টি করি তাসের দেশের সেই মুহুর্ত – যেখানে বাইরের সাজ খসে পড়ে, ভেতরের সাজ বেরিয়ে আসে। আমাদের মনের গভীর গোপন কোণের যে আমি-টাকে সারা বছর সযত্নে অন্যান্য পরিচয়ের তলায় তুলে রাখি, সেই আমি-টাকে বের করি। হ্যাঁ, সভয়ে, কিন্তু তাও প্রত্যয়ের সাথে। অনেকেই মুখে মুখোশ পরে নেন, যাতে ওই কয়েক ঘণ্টার পরের জীবনটায় ফেরত গেলে প্রশ্নের মুখে পড়তে না হয়। এই এক জায়গায় জড়ো হয়ে সবাই মিলে জানান দেওয়া – ‘আমরাও আছি” – আমাদের সব রকম দোষ-ত্রুটি-বিচ্যুতি-স্বপ্নভঙ্গ-নিঃসঙ্গতা নিয়েও আমরা আমাদের বৈচিত্র্যকে উদযাপন করি। এইটাও আমাদের অনেকের কাছেই কিছুক্ষণের রসদ, কিছুটা মুক্তির শ্বাস নেওয়ার সুযোগ। এটাও আমাদের প্রাইডের প্রয়োজনীয়তা।

    শেষ পাতে…

    আমার গৌরব অনেকটাই আমার প্রিভিলেজের ফসল। কেবল গৌরব দিয়ে পেট ভরে না। সাম্য আনতে হলে প্রচুর কাজ করতে হবে, প্রচুর সাহায্য প্রয়োজন, প্রচুর এম্প্যাথির প্রয়োজন। আর চাই নন-কুইয়র মানুষের অ্যালাইশিপ – allyship। এটার বাংলা প্রতিশব্দ মিত্রতা বা বন্ধুত্ব, কিন্তু এই শব্দগুলোতে অ্যালাইশিপ-এর মানেটা পূর্ণ প্রকাশ হয় না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে - অ্যালাই কথাটা নাউন (বিশেষ্য) নয়, ভার্ব (ক্রিয়াপদ)। আমি মুখে বলছি আমি লিঙ্গ-যৌন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অ্যালাই – এটা স্রেফ ভার্চু সিগন্যালিং। সেটার প্রয়োজন কতটা জানি না, কিন্তু যেটা সত্যিই প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে সক্রিয় সহযোগিতা। আপনার জীবনে ক্যুইয়র মানুষের উপস্থিতি আছে। আপনি জানতে না পারলেও, তাঁরা আছেন, আপনার সাথে তাঁরা তাঁদের কাজ করছেন, জীবন যাপন করার চেষ্টা করছেন। যদি কিছু না পারেন, অন্তত বিদ্বেষমূলক আচরণ কোনটা – সেটা চিনতে-জানতে শিখুন এবং সেটা না করার চেষ্টা করুন। হয়তো তাতে সেই মানুষগুলো আপনাকে ধন্যবাদ দেবেন না, কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনার উত্তরণ ঘটবে। আর যদি কেউ আপনার জীবনে ভরসা করে আপনার কাছে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন, তাঁর পরিচিতকে স্বীকৃতি দিন, তাঁকে সহযোগিতা করুন, তাঁর কাছে জানুন কীভাবে অ্যালাই হতে পারবেন। আপনার জন্য হয়তো একটা ছোট প্রশ্ন, কিন্তু অন্য কারো পক্ষে হয়তো সেটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ, সবচেয়ে নির্ভরতার আশ্রয়। মানুষ হয়ে এটুকু কি আমরা করতে পারি না একে অপরের জন্য? 



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অন্য যৌনতা | ০৩ জুলাই ২০২২ | ২০৯২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Debabrata Dutta | ০৩ জুলাই ২০২২ ২৩:৫২509621
  • সমৃদ্ধ হলাম।❣️
  • kk | 2601:448:c400:9fe0:2107:955d:4c73:***:*** | ০৪ জুলাই ২০২২ ০০:৫৮509625
  • খুব ভালো লাগলো এই লেখাটা।
  • | ০৪ জুলাই ২০২২ ২০:৩৩509645
  • ভাল লাগল লেখাটা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন