রামধনুর অনেক রঙ, তেমনি ভালোবাসারও অনেক রঙ। প্রতিটা মানুষ যেমন আর একজনের থেকে আলাদা, তেমন তার ভাললাগা, ভালবাসা, ভাল থাকাও আলাদা।
তখন আমি সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে সদ্য সদ্য একটা এন জি ও তে কাজ শুরু করেছি...
মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে ছেলে রোজগার শুরু করলেই বাড়ির লোক বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করে, আত্মীয়স্বজনের মাথাব্যথাও বাড়তে থাকে, এ যেন “যার বিয়ে তার চাড় নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই”। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে, খাওয়ার সময় দিদা আর বড়মামা আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু করতেই আমি জানালাম, “আমি বিয়ে করব না। আমার বিয়ে করার কোনও ইচ্ছে নেই”। আমার মায়ের স্বতঃস্ফূর্ত রিঅ্যাকশন ছিল, “কেন ডাক্তার দেখানোর দরকার!” আমি জানালাম - না, “আমি তো সুস্থ”। মায়ের এবার প্রশ্ন, তাহলে কি কাউন্সেলিং প্রয়োজন? আমার ছোট্ট উত্তর, “না”। বড়মামার প্রশ্ন, “তবে?” আমি সরাসরি জানালাম, “আমার আসলে ছেলেদের ভাল লাগে, মেয়েদের ভাল লাগে না”। মায়ের মন্তব্য – “তাতে কি? বিয়ে করতে গেলে এত কিছু ভাবতে হবে নাকি?” আমি জানালাম, “আমি বিয়ে করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চাই না। যাকে ভালবাসতে পারব না তার সঙ্গে সংসার করব কী করে!” সবাই চুপচাপ। আমার গ্রাম্য তথাকথিত পাঠশালা পাশ করা দিদা উত্তর দিয়েছিল, “একটা কোথায়, বল দুটো জীবন। তোর জীবনটাও তো জীবন”। বড়মামা মাকে বুঝিয়েছিল, “ও যখন বুঝেছে, তখন ওর জীবনটা ওকেই ভাবতে দে। এ নিয়ে ওকে কখনও জোর করিস না”। রাতের বেলা বাবা শুনে বলেছিল, “সমাজ বলে তো একটা ব্যাপার আছে”। মা বাবাকে বুঝিয়েছিল, “সমাজ আবার কী! সমাজ তো তুমি আর আমি, চুরি ডাকাতি তো করছে না – নিজের মত ভাল থাকতে চাইছে”। আমাকে মুখে কিছু না বললেও ক’দিন গুম মেরে গিয়েছিল বাবা।
আজ এত বছর বাদে বুঝি, সেটা হয়তো বাবার জন্য স্বাভাবিকই ছিল।
মায়ের শেষদিন পর্যন্ত মায়ের এই সাপোর্ট শুধু আমিই না, আমার বন্ধুরাও পেয়ে এসেছে।
একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল...
৩৭৭-এর বিপক্ষে নিজের সন্তানের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের কাছে ৩৭৭ ধারা পরিবর্তনের জন্য হলফনামা দাখিল করার পর আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার মায়ের আমার সাথে ছবি সহ একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। এরপর স্বাভাবিকভাবেই বৃহত্তর পরিবারে বিষয়টা মুখরোচক হয়ে উঠলেও, সামনাসামনি আমাকে কেউ কখনও কিছু বলেনি। আত্মীয়দের কেউ কেউ মাকে আমার পাশে থাকার জন্য কনগ্র্যাচুলেট করলেও, আড়ালে-আবডালে রসালো মন্তব্য চলবে মা জানত, তবে সেটা নিয়ে খুব একটা পাত্তা কোনওকালেই দেওয়া তাঁর স্বভাবে ছিল না। আর তাই আমার ওপর সেটা কখনও কোনও প্রভাব ফেলেনি। মায়ে-পোয়ে এ নিয়ে বরং দু’জনে জমিয়ে পিএনপিসি করতাম।
একবার মামার বাড়ির কোনো এক সোশাল গ্যাদারিং-এ আমি যাইনি। ফিরে আসার ক’দিন বাদে মা বেশ রসিয়ে আমাকে জানাল, মায়ের কোনো তুতো দিদি মায়ের কাছে জানতে চেয়েছে আমার লিঙ্গচিহ্ন আসলে কী? (অভিজ্ঞতা থেকে জানি, শহর-গ্রামে আজও অনেকে মনে করেন সমকামীদের লিঙ্গচিহ্নে গোলমাল থাকে, তাই নাকি তারা সমকামী জীবনযাপন করেন) যাই হোক, হাসতে হাসতে মাকে জানতে চাইলাম তিনি কী উত্তর দিয়েছেন। তিনিও হাসতে হাসতে বললেন, “কী আর বলব, বলেছি মা হয়ে আমি তো জানি আমার ছেলেই ওটা, তবে আমার থেকে বেশি তোমরাই বলতে পারবে, কেননা ওদের ছোটবেলায় ওদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলে তোমাদের ওপর ছেড়ে তো এবাড়ি ওবাড়ি গল্প করতে যেতাম। তোমরাই সবসবময় তেল সাবান মাখিয়ে নাওয়াতে খাওয়াতে, তোমরা কিছু অন্যরকম দেখেছিলে কী! তখন যখন কিছু অন্যরকম বোঝনি, তখন এত ভেব না। আর তা ছাড়া ভালবাসা কি এত বুঝে হয়! ওটা মনে মনে হয় ও ছেলে হয়েও ছেলেকে ভালবাসে সেটা বলতে পেরেছে আর আমি সেটা বুঝেছি – এর বেশি কিছু না”।
এমন উত্তর শোনার পর আর সেই মাসি মাকে ঘাঁটানোর সাহস করেনি।
মাঝে মাঝে ভাবি, একজীবনে কতরকম বৈপরীত্য।
আজ থেকে চার দশক আগে কুড়ি-একুশের তরুণীটি তার দ্বিগুণ বয়সী স্বামীর ঘর করতে এসে বুঝেছিল, বাপ-মা না থাকায় দাদা-দিদিদের কাছেই দাসী আনতে যাচ্ছি বলে সে যুগে বিয়ে করতে গেছিলেন তার ভালমানুষ স্বামী। আর তাই ননদ-জা-ভাসুর পরিবেষ্টিত শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই বুঝে গিয়েছিল, যতই পাড়াগাঁয়ে সম্ভ্রান্ত চাষীর ঘর থেকে বেরিয়ে শহরে বিবাহের সাধ তাঁর গ্রাম্য স্কুলমাস্টার বাবা পূরণ করার চেষ্টা করুন না কেন, আসলে তো “টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস” করা শুরু হল। মুখচোরা মেয়েটির সেদিন তার বাবার মানসম্মান নিজের সুখের থেকেও অনেক বেশি বলে মনে হয়েছিল। আর তাই মানিয়ে নিতে চেয়েছিল মানুষটা সবকিছুকে। সেকালে মধ্যবিত্ত বাঙালির ডেস্টিনেশন পুরীতে মধুচন্দ্রিমায় শ্বশুরবাড়ির গুষ্টিসুদ্ধ লোকের সাথে যাওয়ার কারণে মধুর অভাব থাকলেও মানিয়ে নিতে কসুর করেনি সে। সুতরাং অবিবাহিত ননদদের সাথে অশান্তি এড়াতে সুবিবেচনায় স্বামীকে বলেছিল, সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসার থেকে হলিডে হোমের ঘরে বসে স্বামীর গীতাপাঠ শুনতে তার অনেক বেশি ভাল লাগবে। অদ্ভুতভাবে মধ্যবয়সী স্বামী ভদ্রলোক ধর্মকর্মে স্ত্রীর মতিগতিতে যারপরনাই খুশি হয়ে একবারও খোঁজ নেননি তরুণী স্ত্রীর মনে অন্য কোনও স্বপ্ন থাকলেও থাকতে পারে কিনা। তারপরেও বহুবছরে বহুসাধ নিজের মনের মাঝেই রেখে দেওয়া প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় আসা মহিলাটিকে একদিন যখন আড্ডা দিতে দিতে জানতে চেয়েছিলাম, এতগুলো বছর কীভাবে কাটালে, উত্তর এসেছিল, অতগুলো বছর আগে উপায় কী ছিল বল্, ছোট থেকে তো শিখেছিলাম স্বামীর ঘরই মেয়েদের ঘর। যতই ওই সময়ে শহরের কলেজ থেকে পড়াশোনা করি না কেন, আসলে তো গ্রাম মফস্বলে বেড়ে ওঠা মুল্যবোধ বিসর্জন দিতে পারিনি। বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলে একটা সময়ের পরে কিন্তু দাদা-ভায়েদের সংসারে ঝি গিরি করতে হত, তার থেকে তো নিজের সংসার অনেক ভাল। আর তোদের মত কথায় কথায় অতগুলো বছর আগে বিয়ে ভাঙা এত সহজ ছিল না। আজও তো মেয়েরা বিয়ে ভাঙলে লোকে তাদের দিকেই আঙুল তোলে, সেখানে অতদিন আগে অত সাহস আমার ছিল না। গ্রাম ঘরে ঢিঢি পড়ে যেত। তার থেকে এ অনেক ভাল।
অথচ ভাবি এই মানুষটাই নিজের সন্তান ও সন্তানসমদের ভাল থাকার জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৭ ধারা রদ করার জন্য সবকিছুকে অতিক্রম করে ভারতীয় সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে লিখিত আবেদন করতেও পিছপা হননি। কেউ কিছু বললে বলতেন, সমাজ আবার কী? সমাজ তো আমি আর তুমি, সমকামী বিষমকামী বুঝি না, গর্ভে থাকা সন্তান ছেলে না মেয়ে নাকি অন্য কিছু জানার দরকার নেই, সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতেই মায়েরা চায়। আর তাই সন্তানের পাশে দাঁড়ানোয় এতটুকু পিছপা হননি যে মানুষটা, তিনি আমার গর্ভধারিণী ভেবে আজ নিজের পিঠটা নিজেই চাপড়াই।
তবে শুধু আমার মাতৃদেবী একা নন। তাঁর মত অনেক অভিভাবকই মনে করেন তাদের সন্তানরা কোনও অন্যায় করছে না। রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই তাঁদের সন্তানদের সুখে থাকায় হস্তক্ষেপ করার। নিজের যৌনপছন্দের ভিত্তিতে ভালবাসার মানুষের সঙ্গে যাপনের অধিকারে তারা পাশে আছেন। তাঁদের সন্তানদের ভাল থাকার দাবিতে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের কাছে এ ব্যাপারে হলফনামা দাখিল করতেও তাঁরা কেউ কেউ পিছপা হননি। কোথাও ধারা ৩৭৭ পরিবর্তনে এঁদের কথাও উল্লেখযোগ্য।
আমার মা মমতা জানা, আমার ক্যুইয়ার আন্দোলনের সহযোদ্ধা অনীশ রায়চৌধুরীর বাবা প্রমথনাথ রায়চৌধুরী ও মা বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরী, রাজর্ষি চক্রবর্তীর মা আভা চক্রবর্তী, বন্ধু তীর্থঙ্কর গুহঠাকুরতার মা বীণা গুহঠাকুরতা, দেবজ্যোতি ঘোষের মা কেয়া ঘোষ – সহ সারা ভারতবর্ষের উনিশজন বাবা-মা মিলে এই হলফনামা দাখিল করেছিলেন। এঁদের অনেকেই আজকে ইহলোকে নেই।
রামধনু উৎসবে ওঁরাও তো আমাদের সাথে সামিল। সন্তান হিসাবে আমরা ওঁদের জন্য গর্বিত। তাই তাঁদের প্রত্যেককেই বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই এই গর্বের রামধনু মাসে।