এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অন্য যৌনতা

  • পুরুষশরীরে মন যখন নারীসুলভ

    জয়দীপ জানা লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্য যৌনতা | ২৪ মার্চ ২০১৯ | ২৬২৮ বার পঠিত
  • সেই কবে মানিকবাবু লিখেছিলেন, "কুসুম তোমার মন নাই!"

    আজও তথাকথিত অন্য যৌনতার মানুষদের সবটাই শরীর আর শরীর বলেই সাধারণভাবে সকলে মনে করে। সকাল থেকে রাত অবধি ঘুমাতে যাওয়ার মধ্যে কেবলই যৌনতা নয়তো যৌনগন্ধই যে থাকেনা, স্বাভাবিকভাবেই সমাজের বাকি সকলের মত তাদেরও যে জীবনের সকল রূপ-রস-গন্ধ, প্রেম-অপ্রেম, ভালবাসা-খারাপবাসা ও সম্পর্ক-নাসম্পর্কের খোঁজখবর সবকিছুই সমান ভাবে বিদ্যমান, তা আর কজন বোঝে!

    ছোটবেলা থেকেই আমি কী এবং কেন ভাবনার পাশাপাশি নিজেকে সমাজনির্মাণের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে মনোজগতে যে সকল তোলপাড় হয় তার খবর স্বয়ং দেবতাও রাখেন না, তো মানুষ বা পরিবার রাখবে সে চিন্তা বাতুলতা।

    একটা গল্প বলি...
    অনেক ভেবেও অঙ্কটা মেলাতে পারেনা ও। ছোট থেকেই আর পাঁচটা ছেলের থেকে ও একটু আলাদা। সবাই যখন খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াত, ও তখন ঘরে বসে ছবি আঁকত নয়ত গান শুনত। ঠাম্মা বলত, সমু আমাদের লক্ষ্মী ছেলে।

    যখন ছেলেবেলায় সে দিদিদের সঙ্গে পুতুল খেলত বা দিদির ফিতে দিয়ে ফুল করে মাথায় লাগাত, মা বলত, কী যে মেয়েলি ঢং বুঝিনা বাপু। বাবা বলত ওসব ছেলেমানুষি বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সমু ভাবত বড় হওয়া মানে কি? বড় হলে কি ঠিক হয়ে যাবে? দিদি যখন পুতুল খেলে কেউ তো কিছু বলে না। বড়দি যখন কদিন আগে পেয়ারা গাছে উঠেছিল, মা বকেছিল - ধিঙ্গি গেছো মেয়ে, বিয়ে হবেনা। সমু মনে মনে ভাবত সে তো আর গাছে ওঠেনা, তাহলে তার আর ভাবনা কি!

    ঠাম্মা যখন রূপকথার গল্প বলত, পক্ষীরাজে চড়ে রাজপুত্তুর... তখন সেও মনে মনে ভাবত দীপুদার কথা...
    কেননা মাঝে মাঝেই বলতে শুনতো মুখুজ্জেদের ছোট ছেলেটা ঠিক যেন রাজপুত্তুর...
    বড় হতে হতে কখন যে দীপুদা ওর স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল তা ও বোঝেও নি, সবসময়ই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হতে হতে এক নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত সে। তাই পুকুরে দীপুদার সাঁতার কাটতে দেখা, কিংবা আড়াল থেকে রায়বাড়ির বাগানে মুগুরভাঁজা দেখতে খারাপ লাগত না।

    কিন্তু ওর দেবতা, ওর রাজপুত্তুর যখন পুজোর সময় দুগ্গাদালানে দুগ্গাচালার আড়ালে হঠাৎ করেই দৈত্য হয়ে গেল, ওর ভালবাসা-ভাললাগা-রূপকথা ওকে এক চরম বাস্তবের মুখোমুখি করে দিল এক লহমায়।
    সমুর মনে যে ক্ষত হল তাতে লাগানোর মত মলম বোধকরি ওষুধের দোকানে মেলেনা। তাই সমুর বা সমুদের মনের খবর কেউ রাখেনা! আসলে সমুরা যে মনে মনে অন্যরকম, তা না বোঝে বাড়ির লোক না বোঝে সমাজ...
    আজও ৩৭৭ পরবর্তী সমাজেও পুরুষ পুরুষকে ধর্ষণ করবে এটা ক’জন ভাবতে পারে। মানসিক ধর্ষণ যে প্রতিনিয়ত হতে পারে তার স্বীকার সমাজ আজও করেনা।

    একজন শিশুর মনের বিকাশ যেসকল ফ্রেম অফ রেফারেন্স নিয়ে গড়ে ওঠে, যে সকল অনুভূতি নিয়ে সে বেড়ে ওঠে তার ওপরেই তার মানসিক বিকাশ অনেকাংশে নির্ভর করে বলে মনে করা হয়। কিন্ত যদি বেড়ে উঠতে গিয়ে যখন একজন ছেলের শরীর নিয়ে তথাকথিত মেয়েদের মত হয়ে উঠতে চায় বা মেয়েদের সাজপোশাককে আঁকড়ে ধরতে চায়, সবার প্রথমে পরিবারের লোকজনই সেখানে যে ধরনের মন্তব্য করে (কখনও কখনওতো এমনও শুনতে হয়, "চাইয়াছিলাম পোলা, এহন পোলা কয়, আমি মাইয়া", আবার কখনও শুনতে হয় "এক তরকারি নুনে পোড়া") তার বিরূপ প্রভাব যে মনোবিকাশের অন্তরায়, সে শিক্ষা পরিবারের মধ্যে কে দেবে!!!
    তাই প্রতিনিয়ত আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে তাদের মন হয় ক্ষতবিক্ষত।

    নিজেকে বাকিদের সাথে মেলাতে না পারা, স্কুলের বন্ধুদের কাছে অন্যরকম ব্যবহার পাওয়া, এসবে নিজেকে কেমন যেন এলিয়েন বলে মনে হয়। সমলিঙ্গের প্রতি ভাললাগা তো কোনও মতেই প্রকাশ করা যাবেনা। লোকে কি বলবে ভাবতে ভাবতেই হারিয়ে যাওয়া...

    এখানেই শেষ নয়...
    মন আদানপ্রদানের গল্পেও যে কত রকমফের থাকে!!
    সমুর তখন কতই বা বয়স, কুড়ি কিংবা একুশ। ভালবাসার মানুষের বিয়েটা কি সেদিন সত্যিই ও মেনে নিয়েছিল, কেউই জানতে চায়নি। মনে মনে তো ও নিজেই স্বপ্ন বুনত ওর রূপকথার রাজপুত্তুর...পক্ষীরাজ ঘোড়া... 'বর আসবে এখুনি নিয়ে যাবে তক্ষুনি। আর তাই প্রেমিকের বিয়ের আয়োজনে কোথাও কোনও ত্রুটি হোক সে চায়নি। মনের আয়নায় সেদিন তাই নতুন বৌ এর জন্য কেনা শাড়ি গয়না গুলোতে সে নিজেকেই সাজিয়ে দেখে চলেছে কতবার... ভালবাসার মানুষটার পরিবার, তার অসুস্থ হৃদরোগী মা, সকলের কথা ভেবে বুক ফেটে গেলেও মুখ ফোটেনি সেদিন ওর। সমস্ত সামাজিকতাকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে পাকা অভিনেতার মত অভিনয় করে গেছে সে। কিন্তু একবারও কেউ খোঁজ রাখেনি কোন ঝড় বয়ে চলেছে ওর মনের গহনে।

    আসলে রূপকথা তো রূপকথাই, নাহলে যাকে একসময় সবদিয়ে ভালবেসেছিল, তার বিয়ের পাঁচটা বছর সময়ের হিসাবে ষাটটা মাস মাত্র যেতে না যেতেই ও কি আর বুঝতে পারত সব কিছু আসলে মেকি। পাঁচটা বছরের প্রত্যেকটা দিনের যাপন, তনু মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসা আর রান্নাবাটি খেলার সংসারে সে আসলে পুতুল ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। আজ যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস নিয়ে আইন হয়, অথচ দুটি পুরুষের ভালবাসার নেই কোনও সামাজিক স্বীকৃতি তখন তো এটাই স্বাভাবিক! ( আইনি স্বীকৃতি তো এই সেদিন এল, আইন দিয়ে কি আর মন পাওয়া যায়!) আর তাই খেলাশেষে পুতুলটা যখন ফেলে চলে গেল মানুষটা, তখন নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি সমু। মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছিল তা কিভাবে থামাবে, কাকেই বা বলবে, কোন মেঘপিয়ন তার মনখারাপের দিস্তা কোথায় পৌছে দেবে বুঝে উঠতে পারেনি সে, তাইত মনে মনে ভেবেছে, নিজের সমস্ত মূল্যবোধকে বিসর্জন দেওয়াও তো আত্মহননেরই নামান্তর। তাই একগামিতা থেকে বহুগামিতায় হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।

    তাইতো কখনও বা আসলে একটার পর আর একটা, আর একটার পর আরও একটা "মনোগ্যামাস সম্পর্কই" খুঁজে ফেরে সে, ঠিক যেমন "ক্ষ্যাপা পরশপাথর খুঁজে বেড়ায়" তেমনি, খু্ঁজতে গিয়ে কখন যে মনটাই বিষিয়ে যায়, তার খবর কজন রাখে!!!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অন্য যৌনতা | ২৪ মার্চ ২০১৯ | ২৬২৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন