সেই কবে মানিকবাবু লিখেছিলেন, "কুসুম তোমার মন নাই!"
আজও তথাকথিত অন্য যৌনতার মানুষদের সবটাই শরীর আর শরীর বলেই সাধারণভাবে সকলে মনে করে। সকাল থেকে রাত অবধি ঘুমাতে যাওয়ার মধ্যে কেবলই যৌনতা নয়তো যৌনগন্ধই যে থাকেনা, স্বাভাবিকভাবেই সমাজের বাকি সকলের মত তাদেরও যে জীবনের সকল রূপ-রস-গন্ধ, প্রেম-অপ্রেম, ভালবাসা-খারাপবাসা ও সম্পর্ক-নাসম্পর্কের খোঁজখবর সবকিছুই সমান ভাবে বিদ্যমান, তা আর কজন বোঝে!
ছোটবেলা থেকেই আমি কী এবং কেন ভাবনার পাশাপাশি নিজেকে সমাজনির্মাণের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে মনোজগতে যে সকল তোলপাড় হয় তার খবর স্বয়ং দেবতাও রাখেন না, তো মানুষ বা পরিবার রাখবে সে চিন্তা বাতুলতা।
একটা গল্প বলি...
অনেক ভেবেও অঙ্কটা মেলাতে পারেনা ও। ছোট থেকেই আর পাঁচটা ছেলের থেকে ও একটু আলাদা। সবাই যখন খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াত, ও তখন ঘরে বসে ছবি আঁকত নয়ত গান শুনত। ঠাম্মা বলত, সমু আমাদের লক্ষ্মী ছেলে।
যখন ছেলেবেলায় সে দিদিদের সঙ্গে পুতুল খেলত বা দিদির ফিতে দিয়ে ফুল করে মাথায় লাগাত, মা বলত, কী যে মেয়েলি ঢং বুঝিনা বাপু। বাবা বলত ওসব ছেলেমানুষি বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সমু ভাবত বড় হওয়া মানে কি? বড় হলে কি ঠিক হয়ে যাবে? দিদি যখন পুতুল খেলে কেউ তো কিছু বলে না। বড়দি যখন কদিন আগে পেয়ারা গাছে উঠেছিল, মা বকেছিল - ধিঙ্গি গেছো মেয়ে, বিয়ে হবেনা। সমু মনে মনে ভাবত সে তো আর গাছে ওঠেনা, তাহলে তার আর ভাবনা কি!
ঠাম্মা যখন রূপকথার গল্প বলত, পক্ষীরাজে চড়ে রাজপুত্তুর... তখন সেও মনে মনে ভাবত দীপুদার কথা...
কেননা মাঝে মাঝেই বলতে শুনতো মুখুজ্জেদের ছোট ছেলেটা ঠিক যেন রাজপুত্তুর...
বড় হতে হতে কখন যে দীপুদা ওর স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল তা ও বোঝেও নি, সবসময়ই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হতে হতে এক নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত সে। তাই পুকুরে দীপুদার সাঁতার কাটতে দেখা, কিংবা আড়াল থেকে রায়বাড়ির বাগানে মুগুরভাঁজা দেখতে খারাপ লাগত না।
কিন্তু ওর দেবতা, ওর রাজপুত্তুর যখন পুজোর সময় দুগ্গাদালানে দুগ্গাচালার আড়ালে হঠাৎ করেই দৈত্য হয়ে গেল, ওর ভালবাসা-ভাললাগা-রূপকথা ওকে এক চরম বাস্তবের মুখোমুখি করে দিল এক লহমায়।
সমুর মনে যে ক্ষত হল তাতে লাগানোর মত মলম বোধকরি ওষুধের দোকানে মেলেনা। তাই সমুর বা সমুদের মনের খবর কেউ রাখেনা! আসলে সমুরা যে মনে মনে অন্যরকম, তা না বোঝে বাড়ির লোক না বোঝে সমাজ...
আজও ৩৭৭ পরবর্তী সমাজেও পুরুষ পুরুষকে ধর্ষণ করবে এটা ক’জন ভাবতে পারে। মানসিক ধর্ষণ যে প্রতিনিয়ত হতে পারে তার স্বীকার সমাজ আজও করেনা।
একজন শিশুর মনের বিকাশ যেসকল ফ্রেম অফ রেফারেন্স নিয়ে গড়ে ওঠে, যে সকল অনুভূতি নিয়ে সে বেড়ে ওঠে তার ওপরেই তার মানসিক বিকাশ অনেকাংশে নির্ভর করে বলে মনে করা হয়। কিন্ত যদি বেড়ে উঠতে গিয়ে যখন একজন ছেলের শরীর নিয়ে তথাকথিত মেয়েদের মত হয়ে উঠতে চায় বা মেয়েদের সাজপোশাককে আঁকড়ে ধরতে চায়, সবার প্রথমে পরিবারের লোকজনই সেখানে যে ধরনের মন্তব্য করে (কখনও কখনওতো এমনও শুনতে হয়, "চাইয়াছিলাম পোলা, এহন পোলা কয়, আমি মাইয়া", আবার কখনও শুনতে হয় "এক তরকারি নুনে পোড়া") তার বিরূপ প্রভাব যে মনোবিকাশের অন্তরায়, সে শিক্ষা পরিবারের মধ্যে কে দেবে!!!
তাই প্রতিনিয়ত আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে তাদের মন হয় ক্ষতবিক্ষত।
নিজেকে বাকিদের সাথে মেলাতে না পারা, স্কুলের বন্ধুদের কাছে অন্যরকম ব্যবহার পাওয়া, এসবে নিজেকে কেমন যেন এলিয়েন বলে মনে হয়। সমলিঙ্গের প্রতি ভাললাগা তো কোনও মতেই প্রকাশ করা যাবেনা। লোকে কি বলবে ভাবতে ভাবতেই হারিয়ে যাওয়া...
এখানেই শেষ নয়...
মন আদানপ্রদানের গল্পেও যে কত রকমফের থাকে!!
সমুর তখন কতই বা বয়স, কুড়ি কিংবা একুশ। ভালবাসার মানুষের বিয়েটা কি সেদিন সত্যিই ও মেনে নিয়েছিল, কেউই জানতে চায়নি। মনে মনে তো ও নিজেই স্বপ্ন বুনত ওর রূপকথার রাজপুত্তুর...পক্ষীরাজ ঘোড়া... 'বর আসবে এখুনি নিয়ে যাবে তক্ষুনি। আর তাই প্রেমিকের বিয়ের আয়োজনে কোথাও কোনও ত্রুটি হোক সে চায়নি। মনের আয়নায় সেদিন তাই নতুন বৌ এর জন্য কেনা শাড়ি গয়না গুলোতে সে নিজেকেই সাজিয়ে দেখে চলেছে কতবার... ভালবাসার মানুষটার পরিবার, তার অসুস্থ হৃদরোগী মা, সকলের কথা ভেবে বুক ফেটে গেলেও মুখ ফোটেনি সেদিন ওর। সমস্ত সামাজিকতাকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে পাকা অভিনেতার মত অভিনয় করে গেছে সে। কিন্তু একবারও কেউ খোঁজ রাখেনি কোন ঝড় বয়ে চলেছে ওর মনের গহনে।
আসলে রূপকথা তো রূপকথাই, নাহলে যাকে একসময় সবদিয়ে ভালবেসেছিল, তার বিয়ের পাঁচটা বছর সময়ের হিসাবে ষাটটা মাস মাত্র যেতে না যেতেই ও কি আর বুঝতে পারত সব কিছু আসলে মেকি। পাঁচটা বছরের প্রত্যেকটা দিনের যাপন, তনু মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসা আর রান্নাবাটি খেলার সংসারে সে আসলে পুতুল ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। আজ যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস নিয়ে আইন হয়, অথচ দুটি পুরুষের ভালবাসার নেই কোনও সামাজিক স্বীকৃতি তখন তো এটাই স্বাভাবিক! ( আইনি স্বীকৃতি তো এই সেদিন এল, আইন দিয়ে কি আর মন পাওয়া যায়!) আর তাই খেলাশেষে পুতুলটা যখন ফেলে চলে গেল মানুষটা, তখন নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি সমু। মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছিল তা কিভাবে থামাবে, কাকেই বা বলবে, কোন মেঘপিয়ন তার মনখারাপের দিস্তা কোথায় পৌছে দেবে বুঝে উঠতে পারেনি সে, তাইত মনে মনে ভেবেছে, নিজের সমস্ত মূল্যবোধকে বিসর্জন দেওয়াও তো আত্মহননেরই নামান্তর। তাই একগামিতা থেকে বহুগামিতায় হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
তাইতো কখনও বা আসলে একটার পর আর একটা, আর একটার পর আরও একটা "মনোগ্যামাস সম্পর্কই" খুঁজে ফেরে সে, ঠিক যেমন "ক্ষ্যাপা পরশপাথর খুঁজে বেড়ায়" তেমনি, খু্ঁজতে গিয়ে কখন যে মনটাই বিষিয়ে যায়, তার খবর কজন রাখে!!!