এই গৌরব মাসের ছয় মাস আগেই ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বাপ্পাদা না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন। বাপ্পাদা যখন মারা যান, তখন তাঁর পাশে চেনা কেউ ছিল না, আমরা ক’জন যারা তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর তাঁর দেখাশোনা করতাম, আমরা কেউ কোভিডে আক্রান্ত, তো কেউ কলকাতার বাইরে। তবে ওঁর জীবনের বেশিরভাগটাই এরকম কাটেনি… চারদিকে লোকজন, বন্ধু-বান্ধব-আড্ডা-প্রেম-ঠাট্টা-রঙ্গ-তামাশা… একেবারে হই-হুল্লোড়ের কেন্দ্রস্থলে থাকতে ভালবাসতেন তিনি!
যতদূর মনে পড়ে, বাপ্পাদার সাথে প্রথম দেখা হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে। তখন দেশী-বিদেশী কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন মিলে কলকাতায় যৌনকর্মীদের একটি বিশাল সমাবেশ আয়োজন করেছিল, তার মধ্যে শামিল হয়েছিলেন কিছু রূপান্তরকামী এবং অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গ/যৌনতার মানুষেরাও। বাপ্পাদা যদিও পেশাদার যৌনকর্মী ছিলেন না, প্রচুর চেনা বন্ধু-বান্ধব থাকার দৌলতে তিনিও এসেছিলেন। সমাবেশের দ্বিতীয় দিনে আমরা অনেকে একসাথে বাসে চড়ে সোনাগাছিতে একটি মিছিলে যোগদান করতে যাচ্ছিলাম, দেখি একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, পরনে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট, তিনি হেসে হেসে বাঙালিসুলভ হিন্দিতে এক তামিল মহিলা যৌনকর্মীর সাথে পরিচয় করছেন, “আপ কউন হো? আই অ্যাম টিজি (ট্রান্সজেন্ডার), বাঙালি, হিন্দি নাহি আতা!” ভাষান্তরের সমস্যা সত্ত্বেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ জমিয়ে ফেললেন, শুনলাম বলছেন, “মুঝে এক লাড়কা ঢুন্ডকে দো, শাদি করনা হে! পর এক সে কেয়া হোগা, কাপড়া তো এক নাহি বাহুত পেহেনতে হে, তো এক লাড়কা সে কায়সে হোগা!” তা শুনে সেই মহিলার কি হাসি! পরে অন্যদের মুখে “বাপ্পাদা” ডাক শুনে বুঝলাম, ইনিই বাপ্পাদা। এমনই আমুদে, মিশুকে মানুষ ছিলেন তিনি, যদিও পরে বয়স আর স্বাস্থ্যের সমস্যা বাড়তে অনেকটা খিটখিটে হয়ে যান।
আনুষ্ঠানিক পরিপ্রেক্ষিতে “টিজি” বা “ট্রান্সজেন্ডার” জাতীয় পোশাকি নাম ব্যাবহার করলেও দৈনন্দিন কথাবার্তায় বাপ্পাদা ও তাঁর বন্ধুরা নিজেদের বলতেন “ধুরানি”। “ধুরানি” শব্দের অর্থ বৃহৎ, পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী পরিবর্তনশীল। একজন সমকামী সমাজকর্মীর মুখে শুনেছিলাম, যে তিনি আশির দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া লেকে (রবীন্দ্র সরোবরে) ঘুরতে গেছিলেন, শুনেছিলেন সেখানে মেয়েলি পুরুষদের সমাগম হয়। সেখানে একজন তাঁকে দেখে ডাকে, “এই ধুরানি!” পরে তিনি ধুরানির মানে জিগ্যেস করতে সে বলে, “মানে যারা মুখে নেয়, পোঁদে নেয়!” তিনি বলেন, “কিন্তু আমি তো নিই না!” সে তখন বলে, “আরে যারা একটু মেয়েলি-মেয়েলি, নেচে-নেচে চলে!” তিনি বলেন, “কিন্তু আমি তো ওরকমও না!” শেষে অপরজন বলে, “আরে, আমাদের সাথে যাদের খুব খাতির, তারাই ধুরানি!” হিজড়ে এবং অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গের গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষা উল্টিতে “ধুরানো” কথাটির মানে যৌনসঙ্গম করা, সেই অর্থ অনুযায়ী অনেককে বলতে শুনেছি যে ধুরানি মানে যৌনকর্মী, বা যে অতিরিক্ত যৌনসঙ্গম করে বেড়ায়। কিন্তু বাপ্পাদা সহ আরও অনেকের কাছে ধুরানির অর্থ আরও অনেক বৃহৎ ছিল – একটু সরলীকৃত ভাবে হয়তো বলা যায়, মেয়েলি পুরুষ, রূপান্তরকামী নারী, এবং তৃতীয়/ভিন্ন লিঙ্গ ও যৌনতার ব্যক্তিদের একটি সম্মিলিত জনগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, ও আত্মপরিচয়। ২০১৩ সালে একটি অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত ট্রান্স ব্যক্তিত্বের (নামটি নাহয় উহ্যই থাক) মুখে ধুরানি সমাজের একটি প্রবাদ শুনেছিলাম, “এই ধূসর পৃথিবীতে আমরাই তো রানি, তবেই না বলে ধুরানি!”
আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাপ্পাদা নিজে ছিলেন সেই ধুরানি সমাজের এক মধ্যমণি। কিন্তু ঢাকুরিয়া লেকে তাঁর যাতায়াত ছিল না, তাঁর পুরো দুনিয়াই আবর্তিত হত উত্তর ও মধ্য কলকাতা ঘিরে। ২০১২ সালে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর তিনি একদিন আমায় বলেন, “ধর্মতলায় পারিখ (পুরুষ যৌনসঙ্গী বা প্রেমিক) তুলতাম না, বাড়ির বেশি কাছে ছিল তো! লেকেও যেতাম না, বেশি দূর... তবে কলেজ থেকে ফেরার পথে ক্যামাক স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, এসব রাস্তায় অনেক এনজয় করেছি!” পরে তাঁর পরিচিতি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার পর নানারকম পারিবারিক সমস্যা ও তাঁর বনেদি পরিবারের পৈত্রিক ভিটেতে ভাড়াটেদের সাথে বচসার দরুন তিনি বাড়ি ছেড়ে জানবাজারে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন, সেই বাড়ি হয়ে ওঠে নানান জায়গার ধুরানিদের এক মিলনক্ষেত্র। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি আমায় বলেন,
“জানবাজার বাড়িতে অনেক মজা করেছি... তখন তো এনজিও-টেনজিও কিছু ছিল না, জানতামও না... আমার বাড়িই তখন একটা ঠেক হয়ে উঠেছিল... কত ধুরানি যে আসত, কাঁকিনাড়া থেকে, সিঙ্গুর থেকে! (বাড়িটা) শিয়ালদার কাছে, তাই সবাই আসতে পারত। কত ধুরানির জন্যে যে কত রান্না করেছি! ...তারপর বিকেল বেলায় আমি সাজতাম, মুজরা করতাম, কত ধুরানি আসত, কত ছেলে আসত!”
অতএব নিজে পুরোদস্তুর উত্তর কলকাতার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর গোষ্ঠীর মানুষদের একটি বৃহৎ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন, যা ছিল বিভিন্ন শহর ও জেলা জুড়ে বিস্তৃত। উল্লেখ্য, অন্যান্য অঞ্চলেও এরকম নেটওয়ার্কের হদিশ পাওয়া যায়। বাপ্পাদার মতই নদীয়া জেলার রানাঘাটে ধুরানিদের এক মধ্যমণি ছিলেন বিকাশদা, যিনি আজও বর্তমান – তাঁর ভাষাতে, রানাঘাট হল একটি “ধুরানিদের মহাতীর্থ”, যেখানে নদীয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন গ্রাম ও শহর থেকে ধুরানিদের সমাগম আজও ঘটে চলেছে।
নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে “ধুরানি” কথাটির পরিবর্তে “কোতি” শব্দটি এই গোষ্ঠীদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যার জন্যে কিয়দাংশে দায়ী ছিল তখনকার নবাগত এনজিও বা বেসরকারি সংগঠনদের পরিভাষা, যেখানে এইচ-আই-ভি সংক্রমণের জন্যে একটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার জন্যে “কোতি” কথাটি ব্যবহৃত হত। কিন্তু এনজিওদের আগমনের আগেই বাপ্পাদার মতন মানুষেরা “কোতি” কথাটির সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং পরিচিতিটিকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পশ্চিম বাংলায় আনতে সাহায্য করেছিলেন। ২০১৩ সালে আরেকদিন নানা আলোচনার মধ্যে বাপ্পাদা আমায় বলেন, যে তিনি আশির দশকে দিল্লি বেড়াতে গিয়ে ওখানকার গোষ্ঠীদের মধ্যে “কোতি” কথাটি শোনেন, “আমি ফিরে এসে বন্ধুদের বললাম, জানিস, দিল্লিতে ধুরানিদের কোতি বলে আর পারিখদের বলে গিরিয়া!” এই ধরনের ভাষার আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রান্তিক লিঙ্গ/যৌনতার মানুষদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে ওঠে, যার ফলে পরবর্তীকালে এনজিও এবং সংগঠিত আন্দোলনের বৃদ্ধির পথ খানিকটা মসৃণ হয়ে যায় – এ যেন এক ঘরোয়া বিশ্বায়ন। ২০০০-এর দশকে বাপ্পাদার সেই বাড়ি হয়ে ওঠে আড্ডা-মুজরোর ঠেক ছাড়াও নতুন-নতুন সংগঠনদের আঁতুড়ঘর, “আমার বাড়িতে তো কত মিটিংও হয়েছে!”
সংগঠিত এলজিবিটি আন্দোলনের বৃদ্ধির সাথে আসে নতুন পরিচয়ের পরিভাষা, যা অনেকক্ষেত্রেই ঢেকে দেয় এই ধুরানি-কোতি গোষ্ঠীদের ভাষা এবং পরিচয়ের সাবলীলতা। বাপ্পাদা নিজে ট্রান্স, গে, শিমেল (she-male), ধুরানি, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পরিচিতি ব্যাবহার করতেন – যদিও সাংগঠনিক পরিচয়ের রাজনীতি অনেকক্ষেত্রেই ‘সমকামী’ এবং ‘রূপান্তরকামী’ পরিচয়গুলিকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করে দিতে চায়, উনি ছিলেন একাধারে দুটোই বা একাধিক। তাঁর কাছে রূপান্তর মানে শারীরিক লিঙ্গ-পরিবর্তন ছিল না। নিজের সমকালীন ধুরানিদের কথা বলতে গিয়ে তিনি ২০১২ সালে আমায় বলেন, “আমরা মেয়েদের মতন সাজতে ভালবাসি... কুর্তা পরতাম, কাজল পরতাম!” যদিও ওঁর কিছু ধুরানি বান্ধবীরা শারীরিক লিঙ্গ-চিহ্ন পরিবর্তন করতে চাইতেন, ওঁর ক্ষেত্রে “মেয়েদের মতন” সাজতে চাওয়া মানে মেয়ে হতে চাওয়া নয়। ২০১৪ সালে রানাঘাট বেড়াতে গিয়ে তিনি তাঁর ধুরানি গোতিয়া (বান্ধবি/বোন) বিকাশদাকে বলেন, “মেয়ে তো আমরা কোনোদিন আর হব না, হতেও চাই না! আমরা হলাম শুধু মেয়েলি, মেয়েলি পুরুষ!” আরেকদিন তিনি প্রকাশ্য স্থানে তাঁর খালি গা হতে লজ্জা পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমায় বলেন, “আমি যেমন শিমেল আছি... আমাদের তো সবার সামনে গায়ের জামা খুলতেও লজ্জা লাগে!” আবার পরমুহূর্তেই তিনি নিজেকে “গে বয়” (সমকামী ছেলে) হিসেবে অভিহিত করেন। ২০১৩ সালে একটি নব-প্রতিষ্ঠিত এনজিওর মিটিঙে তিনি নিজেকে “টিজি” (ট্রান্সজেন্ডার) বলার সাথে-সাথে কথাটির প্রচলিত অর্থের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেন, “আচ্ছা, টিজি মানেই কি সাজতে-গুজতে হবে?”
বয়স বাড়ার সাথে ওঁর এই এনজিও জগতের ওপর গভীর অভিমান জন্মায়। জানবাজারের ফ্ল্যাটের সেই স্বর্ণযুগ ২০০০-এর দশকেই শেষ হয়ে যায়। সঞ্চিত অর্থ কিছু চুরি যায় আর কিছু লাগামছাড়া খরচের কারণে ফুরিয়ে যায়, ওঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায় এবং ২০১২ সালে একটি দুর্ঘটনার কারণে একটি হাতও অকেজো হয়ে যায়। ওঁর স্থান হয় বউবাজারে ওঁর এক প্রাক্তন পারিখের একটি ছোট গুদামঘরে, আশ্রয়ের পরিবর্তে শুনতে হয় প্রচুর গঞ্জনা, “কালকে আমার পারিখ বলছে, তুমি যদি ঝাড়-পোঁছ না করতে পার তাহলে চলে যাও! আমার হাত ভাঙা, তাও যতটা পারি করছি! ইঁদুরের কী দৌরাত্ম্য কী যে বলব, আমার ওষুধ পর্যন্ত খেয়ে ফেলছে!” যে সমাজকর্মীরা ওঁর বাড়িতেই এককালে যাতায়াত করতেন, এই ঘোর দুর্দিনে তাঁরাই অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে উনি আমায় বলেন, “আচ্ছা, এই এনজিওগুলি কেন হয়েছে বল তো, আমাদের সাহায্য করার জন্যেই তো? আমাদের দেখিয়েই তো হয়েছে? আমায় যখন যেখানে ডেকেছে সেখানে গেছি, আজ এই বিপদের দিনে দেখ আমাকে এমন করল, বলে কিনা ফ্যামিলিকে কনট্যাক্ট কর, যদিও জানে যে আমার পরিবার আমার সাথে কোনো সম্পর্কই রাখে না!” পরবর্তীকালে অবশ্য একটি গোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠন ওঁর দেখাশোনার আংশিক দায়িত্ব নেয়, কিন্তু পেশাদার সমাজকর্মীদের প্রতি উনি জীবনের শেষ অবধি সন্দিহান থেকে যান।
বাপ্পাদার চলে যাওয়াটা শুধু তাঁর একার প্রয়াণ নয়, কলকাতার আশি-নব্বইয়ের দশকের “ধুরানি সমাজের” এক অনন্য প্রতিনিধির চলে যাওয়া। যেন একটা গোটা প্রজন্ম এবং তাঁদের পৃথিবী অস্তাচলে যাওয়ার প্রতীক। কিন্তু সেই ইতিহাসের চিহ্ন আজও বিরাজমান। আজও ঝাঁ-চকচকে প্রাইড ওয়াকগুলির আড়ালে-আবডালে কোতিরা একে-অপরের সাথে বোন পাতায়; শুধু গ্রামে বা শহরতলিতে নয় মেট্রো কলকাতার নন্দনেও উল্টিভাষা শোনা যায়, যা সেইযুগের ধুরানি-কোতি-হিজড়ে মানুষদের থেকে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে প্রেরিত হয়ে এসেছে। তবু পাশ্চাত্যের আন্দোলনের ইতিহাস বা ভারতীয় স্ববর্ণ/উচ্চবিত্ত ক্যুইয়ার-ট্রান্স মানুষদের লড়াইয়ের ইতিহাসের অপেক্ষায় এই গল্পগুলি আমরা শুনি অনেক কম। আশা রাখব যে আগামী গৌরব মাসগুলিতে আমরা এলজিবিটি আন্দোলনের এই হারিয়ে-যাওয়া অপর মানুষদের এবং তাঁদের অস্তিত্বের ইতিহাসকে উপযুক্ত মূল্য দিতে শিখব।
লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পড়ান এবং গত পনেরো বছর যাবত একজন গোষ্ঠী-সদস্য হিসেবে পশ্চিম বাংলার প্রান্তিক লিঙ্গ/যৌনতার মানুষদের সাথে গবেষণার কাজ করছেন।