কথায় বলে, অপরিমাপিত প্রকৃতিস্বরূপা শতরূপার অনন্ত রূপে বিচলিত হয়ে স্বয়ং ভগবান ব্রহ্মা তাকে নিক্তিতে মেপে মেপে তৈরি করেছিলেন, লোকমায়া সাবিত্রী দেবীকে। যা আমরা মাপতে পারিনা, তুলনা করতে পারি না কারোর সাথে, তার প্রতি ভয় এবং ঘৃণা আসাটা অস্বাভাবিক নয়। আর হয়তো ওরিয়েন্টেশনগত সমস্তপ্রকারের বিদ্বেষের পেছনে এই না মাপতে পারার একটা ভূমিকা আছে। সে আপনি হোমোফোবিক হোন, বা ট্রান্সফোবিক। তবু সেসব ক্ষেত্রেও একটা সীমারেখা থাকে। একটা গণ্ডি থাকে। বাইফোবিয়ার মূল কারণ সেই গণ্ডির অভাব।
তিনটি ঘটনা বলি,
এক, আমার এক বান্ধবী কলেজে ঢোকার সাথে সাথে প্রেমে পড়ে। সিনিয়ার দাদা, প্রচণ্ড হ্যাণ্ডসাম এবং প্রতিভাবান। বন্ধুটিকে খোঁচানোর জন্য আমরা মাঝে মাঝেই বলতাম, “ভুপিদা (দাদাটির কলেজতুতো ডাকনাম) এত সুন্দর, যে আমরা ছেলেরাও ওর প্রেমে পড়ে যাব”। মেয়েটি হেসে উত্তর দিত, “তোরা পড়লে আর কী করব, মেয়ে হলে লড়ে নিতুম”।
দুই, আমার প্রিয়তম বান্ধবী যখন জানতে পারে আমি বাইসেক্সুয়াল, তখন সে খুব অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, সে প্রকৃতিগতভাবে বাইদের পছন্দ করে না (পেশাগতভাবে অসুবিধা নেই, কারণ মেয়েটি সাইকিয়াট্রিস্ট) বরং আমি গে হলে তার মেনে নিতে সুবিধা হত। যদিও তার কিছু করারও ছিল না, কারণ বেস্ট ফ্রেন্ডকে না মেনে নিয়ে কোনো উপায়ও নেই।
তিন, আমি বাইসেক্সুয়াল জানার পর থেকে আমার বাবা মাঝেমাঝেই খবর নেয় – আমি এখনও গে আছি না স্ট্রেট হয়ে গেছি। মানে যখন বিয়ে করেছিলাম তখন স্ট্রেট ছিলাম, এখন ছেলের সাথে আছি মানে নির্ঘাত গে...
উভকামীদের সমস্যা অনেক। প্রথমত, এই জগতে তাদের স্ট্রেট বা গে (বন্ধুবান্ধব হলে) হতে চাপ দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যাপারটা বোঝা খুব কঠিন, (কারণ পুরুষসঙ্গ নারীসঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি সহজে পাওয়া যায়)। তৃতীয়ত, তাদের সব সময় জবাবদিহি করতে হয়, সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে, এলজিবিটি বন্ধুদের কাছেও (যেমন ধরুন, হ্যাঁ, মেয়েদেরকেও পছন্দ হয়, কিন্তু ভালোবাসা হয়েছে ছেলেটির সাথে, কাজেই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য জোর করে লাভ নেই। অথবা, প্রেম করে বিয়ে করেছি একটা মেয়েকে, এবং এর মধ্যে কোনো কম্প্রোমাইজ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি)।
এদিকে তাদের প্রতি সকলের প্রচুর অভিযোগ।
১. বিয়ে তো করবে সেই একটা মেয়েকে।
আরে বাবা, সমাজের চাপে প্রচুর গে ছেলেও মেয়েদের বিয়ে করে, তাদের এডজাস্ট করতে অসুবিধা হয়তো একটু বেশি হয়, কিন্তু এডজাস্ট করতে পারছি বলেই অপরাধী – সরি কত্তা, মানতে পারলাম না। সমস্যাটা হল, মনের জোর আর ডিটারমিনেশন থাকলে, স্ট্রেট হই, বা গে, বা বাই, যাকে পছন্দ, তাকেই বিয়ে করব (বিয়ে মানে একসাথে থাকা বোঝানো হচ্ছে, দয়া করে কেউ জিজ্ঞেস করবেন না, যে আমাদের দেশে বিয়ে করা সম্ভব নয় – তাহলে বিয়ে হবে কী করে!)।
সমাজের চাপে প্রচুর স্ট্রেট মেয়েও অপছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, কত্তা, তাদের সমান ঘৃণা করেন তো (সম্ভবত গে ম্যারেজ সমাজ-স্বীকৃত হলে জোর করে ছেলেদের বা মেয়েদের অপছন্দের সমলিঙ্গের মানুষকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে)?
আর জীবনে কোনো এক সময়, একটি ছেলেকে বা মেয়েকে ভালোবাসলেও, ভালোবেসে অন্য একটি মেয়েকে বা ছেলেকে বিয়ে করতে পারি, সত্যি বলছি, যদি তাই করি, তাহলে অন্তত যদি মনোগ্যামাস হই তাহলে কোনো ছেলে বা মেয়ের দিকে ফিরেও দেখব না। আর যদি পলিগ্যামাস হই তাহলে হেটেরোসেক্সুয়াল হলে গুচ্ছের গার্লফ্রেন্ড বানাতুম, হোমোসেক্সুয়াল হলে গুচ্ছের বয়ফ্রেন্ড আর ফাকবাডি। লিঙ্গের আপাত বেড়া টপকানোটাই কি দোষের?
২. আসলে হোমো, দেখাচ্ছে বাই।
দাদা, সেটা হোমোসেক্সুয়ালদের প্রব্লেম, আমাদের না।
৩. সব বাইসেক্সুয়ালই আসলে অবদমিত (কাম?) হোমোসেক্সুয়াল।
দাদা, এটা সেইসব সঙ্ঘ পরিবার বা মৌলবীদের মত কথা হল না? যারা ভারতবর্ষে হোমোসেক্সুয়ালিটির অস্তিত্ব দেখতে পায় না। নিজেদের তাদের জায়গায় বসিয়ে দেখুন, আর আমাকে আপনার জায়গায়।
৪. আমরা সকলেই আসলে বাইসেক্সুয়াল!
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, আসলে আপনি আমাদের অসম্মান করছেন। আমাদের ওরিয়েন্টেশনকে খেলো করছেন। আপনি নিজেকে যা বলে আইডেন্টিফাই করেন, আপনি তাইই। আর কিছু নন।
৫. আখ্যা কতি/ বুচ, তাও বাইসেক্সুয়াল সেজে থাকে। (এটা মূলত কমিউনিটির লোকেরাই বলে)
দাদা/দিদি, ফেমিনিটি/ম্যাসকুলিনিটি ওরিয়েন্টেশনের সাথে সম্পর্কিত নন। আপনি যে ‘পারিখ/ফেম’ (আপনি তাই দাবী করেন) হয়ে নিজের লিঙ্গের মানুষের সাথে শুয়ে বেড়ান, আমি কি সে নিয়ে কিছু বলতে গেছি?
৬. আসলে সবই শুয়ে বেড়ানোর তাল, শোয়ার বাসনা এতটাই উদগ্র যে বাছবিচার করে না।
অপরপক্ষের কন্সেন্ট নিয়ে যদি শুই, তাহলে আপনার জ্বলে কেন মশাই? আর বিছানার বাইরে যে জগতটা আছে, সেটা আপনি যে স্বীকার করেন না, তাতে আপনার শয্যাসঙ্গী(দে)র জন্য সহানুভূতি ছাড়া আর কিছু রাখতে পারছি না। আমরা কিন্তু প্রেমেও পড়ি (আর বাছবিচারও করি, বাইফোবিক লোকেদের এড়িয়ে চলি)।
দাদা, বাইসেক্সুয়ালিটি কোনো চয়েস নয়, কোনো রোগ নয়, সুবিধা নেবার উপায় তো নয়ই, এমনকি কোনো কনফিউশনও নয়। আর স্পেক্ট্রামের একপ্রান্তে যদি গে হয়, অন্যপ্রান্ত হেটেরোসেক্সুয়াল, তাহলে, বেশি গে বাইসেক্সুয়াল, বেশি স্ট্রেট বাইসেক্সুয়ালের অস্তিত্ব থাকাটা অবশ্যম্ভাবী। এটা যে কোনো ওরিয়েন্টেশনের মতই একটা জন্মগত ব্যাপার।
কাজেই চয়েস দেওয়া বন্ধ করুন। বলবেন না, দুধ আর তামাক (কোনটা কোন লিঙ্গ কে জানে?) দুটোই খেলে তো চলবে না। বিশ্বে অসংখ্য তামাকখোর লোক দুধ খায়, এবং তাতে তামাকজনিত ক্ষতি ছাড়া তাদের বিন্দুমাত্র অতিরিক্ত অসুবিধা হয় না। তার সাথে এটা ভাবা বন্ধ করুন – বাইসেক্সুয়াল মানেই আমার একসাথে একটা গার্লফ্রেন্ড আর একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতে হবে। জানি বাই শব্দের অর্থ দুই। কিন্তু সব বাইসেক্সুয়ালের দুজন প্রেমিক(া) থাকতেই হবে এমন মাথার দিব্যি সংজ্ঞাকারেরা কখনও দেননি। আপনি যেমন দীপিকা পাডুকোন আর রবিনা ট্যাণ্ডনকে স্বপ্নে দেখে, ওপাড়ার পুঁটির সাথে সুখে সংসার করতে পারেন; কিম্বা সলমন খান আর বরুণ ধাওয়ানকে দেখে হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেলেও যদি খ্যাঁদার সাথে দশ বছর একনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন, তবে আমি একসাথে মাধুরী আর শাহরুখের দিকে আকর্ষিত হলে টুনির সাথে কিম্বা ট্যাঁপার সাথে সারাজীবন থাকতে পারব না কেন, সেটা বুঝতে পারি না। আরো মনে রাখবেন, আমি ট্যাঁপার সাথে থাকলেই গে হই না, বা টুনির সাথে থাকলেও স্ট্রেট না হয়ে বাইসেক্সুয়ালই থাকি। আর একটা কথা, আমি বাইসেক্সুয়াল মানে কিন্তু এও নয় – আমি ট্রান্সফোবিক। ঠিক যে কারণে গে-রা নারীবিদ্বেষী নয় কিম্বা স্ট্রেট ছেলেরা পুরুষবিদ্বেষী নয়, ঠিক সেই কারণে। ইনফ্যাক্ট বাইসেক্সুয়াল হওয়ার অর্থ জেন্ডার বাইনারিকে অবিশ্বাস করা নয়, জেন্ডারের অনন্ত স্পেকট্রামের মধ্যে দুটির প্রতি আকর্ষিত হওয়া। দুটির বেশি জেন্ডারে যারা আকর্ষিত হন, অর্থাৎ প্যানসেক্সুয়ালরা, তাঁরা আমাদের নিকটাত্মীয়, শুধু রেঞ্জটা দৃশ্যত খানিক বেশি।
আর এত থিওরি কপচে কীই বা হয়? আমার খোঁজার পরিধি আপনার দ্বিগুণ বলে হিংসে করেই বা কী হবে? চলুন না প্রেমে পড়ি, প্রেমিকের কি আর ওরিয়েন্টেশন হয়? ব্রহ্মা শতরূপাকে মেপে কেটেছেঁটে সাইজ করে নিলেও, শিব কিন্তু অত ঝামেলায় যাননি। শক্তি হোন বা হরি, যেমন-কে-তেমন গ্রহণ করেছেন। প্রেমিকের মাপকাঠিতে তাই তাঁর চেয়ে ভারি আর কেউ নেই। আর একটা কথা, যে থাকার সে থাকবেই, ঠেলে সরিয়ে দিলেও শেষ মুহূর্ত অবধি সম্পর্কটাকে বাঁচানোর জন্য লড়ে যাবে। আর যে না থাকার, সে স্ট্রেট গে বাই ট্রান্স যাই হোক না কেন থাকবে না। বিশ্বাস করুন, মেঘে মেঘে বয়েস তো কম হল না, নিজের ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
(প্রসঙ্গত, লেখক অত্যন্ত ক্লস্ট্রোফোবিক লোক, কাজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে গেলে স্লিপ করে বেরিয়ে যায়। লেখকের প্রেমে কেউ পড়তে চাইলে এটা মনে রাখবেন প্লিজ। তার উপর তিনি এখন প্রেম করছেন এবং জানেন না তিনি আদৌ পলিএমোরাস কিনা! সেটাও একটা রেড ফ্ল্যাগ বটে)