এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বই

  • "গভীর নির্জন পথে" ও কিছু কথা

    ইন্দ্রাণী, কল্লোল, রঙ্গন ও দীপ্তেন
    আলোচনা | বই | ০১ জুলাই ২০০৭ | ১৬৬৫ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • ইন্দ্রাণী:
    জনপ্রিয় পাক্ষিকের ধারাবাহিক উপন্যাসে বাউল সাধনত্ত্বের বিশদ কিছু বিবরণে বিব্রত, বিরক্ত পাঠককুল। মাঝপথে উপন্যাস পাঠ বন্ধ করেছেন অনেকেই। শুনতে পাই।
    নিজে যখন পড়ি, একটি ক্ষীণতনু পুস্তকের কথা মনে আসে। অনেকদিন আগে পড়া। একযুগ? তা' হবে হয়তো। খুঁজে বার করে আনি বইটি। জখম শিরদাঁড়া, পাতাগুলি ঈষৎ হলদে। 'গভীর নির্জন পথে'। লেখক সুধীর চক্রবর্তী। প্রথম সংস্করণ ১৯৮৯। প্রকাশক -আনন্দ। সে'সময় চল্লিশ টাকা দাম ছিল বইখানির।

    সর্বমোট ছয়টি লেখা বইটিতে। লেখাগুলি প্রথম প্রকাশ পায় 'এক্ষণ'এর শারদ সংখ্যায় এবং 'বারোমাসে'। গ্রন্থরূপ দেওয়ার সময় ছটি অংশ নতুন করে বিন্যস্ত হয়েছে -'সব মিলিয়ে আসলে একটি লেখা, একই অভিপ্রায়কে ধরতে চাওয়া' -'আত্মপক্ষে' সুধীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন। আরো বললেন, ' ... অমীমাংসিত থেকে গেল লেখাগুলির জাত বিচারের সমস্যা। কেউ ভাবতে পারেন এগুলি কাহিনীমূলক, অন্য কেউ ভাবতে পারেন অন্য কিছু। এক্ষণ -সম্পাদক লেখাগুলি পত্রস্থ করেছিলেন প্রবন্ধ বলে। তাঁর নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল প্রবন্ধের এও একটা ধরণ। তাঁর মনোভাবে আমার সায় আছে।'

    একশো বছরেরও বেশি আগে অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়'বইতে বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের সন্ধান দেন, এইচ এইচ উইলসন যাঁদের বলেছেন 'মাইনর রিলিজিয়ন সেক্টস', যাঁদের আমরা চলতি কথায় বলি বাউল, ফকির, দরবেশ, সুফী-কেমন আছেন তাঁরা-জানতে পথে নামেন সুধীর চক্রবর্তী মশাই, ষাটের দশকে। এ'পারের নদীয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, ও'পারের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া। সুধীরবাবু গোড়াতে স্বীকার করে নিয়েছেন,' লোকধর্মের ভাষা বুঝতে আমার লেগেছে ঝাড়া পাঁচটা বছর। কেননা তাদের ভাষাটাই সন্ধা অর্থাৎ বাইরের মানে আর ভেতরের মানে একেবারে আলাদা। প্রথমদিকের হোঁচট খাওয়ার কিছু নমুনা বলি।
    ১ ... আপনি বাউল?
    উত্তর: আমি সংসার করি নাই।
    প্রশ্ন: ... আপনার ছেলেমেয়ে?
    উত্তর: ... আমার পাঁচহাজার শিষ্যশাবক। ... জানেন না ফকিরী দন্ড নিলে আর সন্তান হয় না।

    ২। ... আজ কি খেলেন?
    উত্তর: খাওয়া নয়, বলুন সেবা। আজ সেবা হলো পঞ্চতত্ত্ব।
    প্রশ্ন: পঞ্চতত্ত্ব মানে? সে তো চৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত ...
    উত্তর: আরে না না, পঞ্চতত্ত্ব মানে চাল, ডাল, আর তিনরকমের আনাজ।

    ৩। ... খুব ফিসফিস করে ... জিজ্ঞেস করলাম: একটা গানে শুনলাম ভগলিঙ্গে হলে সংযোগ/ সেই তো সকল সেরা যোগ। তার মানে? এখানে কি মৈথুনের কথা বলা হচ্ছে?
    একগাল হেসে উদাসীন বললেন: মৈথুন? হ্যাঁ, মৈথুনই তো। তবে কি জানেন এর মানে আলাদা। শুনুন তবে: 'গুরুবাক্য লিঙ্গ হয় শিষ্যের যোনি কান'। এ'বারে বুঝলেন?

    .... আরেকরকম আছে ধন্দবাজি। সেবার যেমন ধাপাড়ার ইমানালি শাহজী ফকির তার খাতা খুলে বললে: লিখুন বাবু কারের খবর। অন্ধকার, ধন্ধকার, কুয়াকার, আকার, সাকার, ডিম্বাকার, নিরাকার, শূন্যাকার, হাহাকার, হুহুকার, নৈরাকার-এই হল একুনে এগারোকার আর চারকার গোপন।
    আমি জানতে চাইলাম, এসবের মানে কি?
    মুরুব্বির চালে মাথা নেড়ে শাহজী বললে, এসব নিগূঢ় তত্ত্ব। আপনি বুঝবেন না।
    আসলে শাহজীও কিন্তু কিছু জানে না। কথাগুলো কোথা থেকে টুকে রেখেছে। শহুরে পন্ডিতমন্যরা যেমন ত্রুফো গদার আওড়ায়।'

    সমালোচনার ধৃষ্টতা রাখিনা। পুরাতন বইখানির সঙ্গে নবীন পাঠকের আলাপ করিয়ে দেওয়াই এই সুতোর উদ্দেশ্য । আর কিছু নয়।

    হে নবীন পাঠক, সঙ্গে থাকুন।

    বাংলার এই উপধর্মগুলি জেগে ওঠে খুব সম্ভব আঠারো শতকের শেষদিকে। কেন? সুধীরবাবুর কথায়, 'বেদ কোরাণ পুরাণ ব্রাহ্মণ মৌলবী মন্দির মসজিদ বৈধী সাধনা সবকিছু খারিজ করতে করতে।' শুনবেন উপধর্মগুলির তালিকা?
    'বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়' অনুযায়ী- 'বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, খুশিবিশ্বাসী, রাধাশ্যামী, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ, বিল্বলভক্ত, কর্তাভজা, স্পষ্টদায়িক বা রূপ কবিরাজী, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই,পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পণারায়নী, বড়ী, অতি বড়ী, রাধাবল্লভী, সখিভাবুকী' .... তালিকা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।
    এখন কথা হল এরা সব গেল কোথায়? এই সব এত উপধর্মসম্প্রদায়? সুধীরবাবু লিখছেন, 'সম্ভবত: ঊনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম সংস্কার আন্দোলন, মিশনারীদের প্রচার, ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-বিজয়কৃষ্ণদের জীবন সাধনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এইসব উপসম্প্রদায়ী পিছোতে পিছোতে গ্রামের প্রত্যন্তে লুকিয়ে পড়ে। ... শ্রীরামকৃষ্ণ তো এ'সব লোকায়ত ধর্মসাধনাকে সরাসরি অভিযুক্ত ক'রে বললেন: বাড়িতে ঢোকার দুটো পথ-সদরের খোলা দরজা আর পায়খানা দিয়ে ঢোকা। সদর দিয়ে ঢোকাই ভালো, পায়খানা দিয়ে ঢুকলে গায়ে নোংরা লাগা স্বাভাবিক। তাঁর মতে কামিনীকাঞ্চনের সাধনা বিপজ্জনক।'
    বিজয়কৃষ্ণের 'শ্রীসদগুরুসঙ্গ' দ্বিতীয় খন্ড থেকে উদ্ধৃত করেছেন সুধীরবাবু যেখানে বিজয়কৃষ্ণ লিখছেন:
    'বাউল সম্প্রদায়ের অনেকস্থলে বড়ই জঘন্য ব্যাপার! ... তাঁরা সব চন্দ্রসিদ্ধি করেন। শুক্র চান্‌, শনি চান্‌, গরল চান্‌, উন্মাদ চান্‌, এই চার চান্‌ সিদ্ধি হলেই মনে করেন সমস্ত হ'লো। ... আমি বললাম, "ওটি আমি পারবো না। বিষ্ঠামূত্র খেয়ে যে ধর্ম লাভ হয়, তা আমি চাই না।" মহান্ত খুব রেগে উঠে বললেন, " ... এখন বলছ সাধন করব না। তোমাকে ওসব করতে হবে।" ... মহান্ত গালি দিতে দিতে আমাকে মারতে এলেন: শিষ্যরাও "মার্‌, মার্‌" শব্দ করে এসে পড়ল। আমি তখন খুব ধমক দিয়ে বললাম, "বটে এতদূর আস্পর্ধা, মারবে? জানো আমি কে?" আমি শান্তিপুরের অদ্বৈত বংশের গোস্বামী, আমাকে বলছ বিষ্ঠামূত্র খেতে?" আমার ধমক খেয়ে সকলে চমকে গেল।'

    বিজয়কৃষ্ণের কথাগুলি লক্ষ্য করুন হে নবীন পাঠক। দম্ভ ঠিকরে বেরোচ্ছে। জাতধর্মের দম্ভ।
    তাই বোধহয় , সেই 'অম্বুবাচীর ক্ষান্তবর্ষণ রাতে' বর্ধমানের সাতগেছিয়ায় জাহন ফকির সুধীরবাবুকে বলেন,'আমাদের দুদ্দুর গানে বলে:
    অজ্ঞ মানুষে জাতি বানিয়ে
    আজন্ম ঘুরিয়া মরে স্বজাতি খুঁজিয়ে।।
    শিয়াল কুকুর পশু যারা
    এক জাতি এক গোত্র তারা
    মানুষ শুধু জাতির ভারা মরে বইয়ে।।
    সেইজন্যই আমরা সত্যিকারের মানুষ খুঁজি। সে মানুষ বৈধিকে নেই, শরায় নেই, শালগ্রাম শিলায় নেই। নোড়ায় নেই, মন্দিরে মসজিদে নেই। যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।'

    হিন্দু সাধকদের প্রতিরোধের থেকেও হাজারগুণ বেশি প্রতিবাদ আসে নিষ্ঠাবান মুসলমানদের থেকে। ফকির দরবেশ বনাম কট্টর ইসলামী সমাজ। সুধীরবাবু লিখেছেন, ".... শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বিপুল পরিমাণ শূদ্র ও গরীব মুসলমান বাউল বা ফকিরী ধর্মে দীক্ষা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। ... বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ছিল খুব বেশি। লালন শাহ থেকে আরম্ভ করে বহুসংখ্যক উদাসীন ধর্মগুরু তাঁদের সৎ জীবনযাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শপ্রচার এবং সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বহু সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ ক'রে নেন তাঁদের উপধর্মে। এতে ... বিশেষ করে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব সমাজ এবং কট্টর ইসলামী সমাজ খুব বড় রকমের অর্থনীতিক ও সামাজিক ধাক্কা খায়। ... পাষন্ড দলন জাতীয় বৈষ্ণবীয় বুকলেট বেরোয় অজস্র, জাতে কর্তাভজা ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়দের আক্রমণ করা হয় অনাচারী, ভ্রষ্ট, নিষিদ্ধাচারী আখ্যা দিয়ে, তাদের নারীভজন ও সহজিয়া সাধনতঙ্কÄকে অপব্যাখ্যা করে। উনিশশতকে দাশরথি রায় তাঁর পাঁচালিতে গালমন্দ করলেন এসব সম্প্রদায়কে, কলকাতার জেলেপাড়ার সং বেরলো কর্তাভজাদের ব্যঙ্গ করে।
    ... সবচেয়ে বড় সংগ্রাম শুরু হল উনিশ শতকের নদীয়া, যশোহর, ও উত্তরবঙ্গের শরীয়তী মুসলমানদের সঙ্গে। ... শরীয়তবদীরা বেশি জোর দিলেন বাউলদের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে। ... আলেম সম্প্রদায়ের নির্দেশে বাউলদের ওপর নানারকম দৈহিক নিপীড়ান শুরু হল এবং প্রায়শ তাদের ঝুঁটি কেটে নেওয়া হতে লাগল। ...
    প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই দলন পীড়ন বাউল-দরবেশ-ফকিরদের দুর্বল ও দলছুট ক'রে দিলেও একেবারে লুপ্ত ক'রে দিতে পারে নি। ... খোঁজ করলে দেখা যাবে অখন্ড বাংলায় যত উপধর্ম সম্প্রদায় গজিয়ে উঠেছিল তাদের বেশিরভাগ প্রবর্তক একজন মুসলমান অথবা হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে। কর্তাভজাদের স্রষ্টা আউলেচাঁদ একজন মুসলমান আর তাঁর প্রধান শিষ্য রামশরণ পাল একজন সদ্‌গোপ। ...
    আসলে বাংলার লৌকিক উপধর্মগুলির ভিত্তিতে আছে তিনটি প্রবর্তনা-মুসলমান বাউল ফকির দরবেশদের প্রত্যক্ষ প্রভাব, শোষিত শূদ্রবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবিরোধ এবং লোকায়ত বৈষ্ণব ধর্মের উদার আহ্বান"।
    সুধীর চক্রবর্তী মশাই বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব প্রসঙ্গে লিখেছেন, "শ্রীচৈতন্য আমাদের দেশে এসেছিলেন এক সময়োচিত ভূমিকায় পরিত্রাতার রূপে। ... কিন্তু শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরেই বৈষ্ণবধর্মে ভেদবাদ জেগে ওঠে। বৃন্দাবনের গোস্বামীরা সংস্কৃতে শাস্ত্রবই লিখে চৈতন্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় বেশি মনোযোগী হলেন। তাঁর লোকশিক্ষা আর সাধারণ মানুষের সংরক্ষণের দিকটি হল উপেক্ষিত। সাধারণ বৈষ্ণব মানুষ আর তাদের মুক্তিদূত শ্রীচৈতন্যের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো রাশি রাশি শাস্ত্র আর পুঁথি। ... সেই সংকটকালে নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্র বা বীরভদ্র আরেকবার নেতা আর ত্রাতারূপে দেখা দিলেন ... এবারকার বৈষ্ণবায়নে এল নানা লৌকিক গুহ্য সাধনা, নি:শ্বাসের ক্রিয়া আর গোপন জপতপ। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল নতুন নতুন আখড়া ও শ্রীপাট। ... কালক্রমে মানুষরা বিশ্বাস করে নিল কৃষ্ণের অবতার গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গের অবতার বীরচন্দ্র। ... আমরা সকোতুহলে দেখতে পাই কর্তাভজা ধর্মের প্রথম দিকের ঘোষণা ছিল: 'কৃষ্ণচন্দ্র, গৌরচন্দ্র আউলেচন্দ্র/ তিনেই এক একেই তিন'। তারমানে বীরচন্দ্র সরে গিয়ে এলেন আউলেচন্দ্র। তৈরি হল এক বৈষ্ণববিশ্বাসী নতুন উপধর্ম।"

    নবীন পাঠক, আসুন,ইতিহাস ছেড়ে এবার গল্পে যাই। সুধীরবাবু যাকে বলছেন, "পায়ে হাঁটা, চোখে- দেখা আর কানে-শোনার সত্য বিবরণ। এতে আছে লৌকিক উপধর্মের সেই পরাক্রান্ততা, সভ্যতা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-শাস্ত্র-নিপীড়ন যাকে আজও মারতে পারে নি।"

    সুধীরবাবু লিখছেন, "সাহেবধনী কথাটা কোনদিন শুনি নি। এই বিশাল ভূগোলে বৃত্তিহুদা নামে একটা গ্রাম আছে , এব্যাপারটাও ছিল অজানা।"
    মফস্বলের এক কাগজ পড়ে সুধীরবাবু জানতে পারলেন নদীয়ায় গত শতকে কুবির সরকার বলে এক বড় লোকগীতিকার ছিলেন। সুধীর হাজির হলেন বৃত্তিহুদায়। সেখানে পেলেন কুবিরের ১২০০ গান, দেখলেন তাঁর সমাধিমন্দির, পাশে কুবিরের স্ত্রী ভগবতী আর সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণমোহিনীর সমাধি।কৌতুহলী সুধীর জিগ্যেস করলেন, 'মাটির ঐ উঁচু ঢিবিটা কেন?'
    উত্তর এল: 'ঐখানে রয়েছে তেনার মাথা। জানেন তো আমাদের সমাধি হয় মাটি খুঁড়ে তাতে শরীর হেলান দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসিয়ে।'
    বাড়ি ফিরে কথামৃত পড়তে পড়তে লেখক আবিষ্কার করলেন 'ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে' কুবিরের লেখা। আরও জানলেন সাহেবধনীর স্রষ্টা দু:খীরাম পাল।তাঁর ছেলে চরণ পাল এই সম্প্রদায়ের মত বিশেষভাবে প্রচার করেন। এই চরণেরই শিষ্য ছিলেন কুবির বা কুবের সরকার।
    এক বৈশাখী পূর্ণিমায় সুধীর গেলেন চরণ পালের ভিটের মহোৎসবে।শুনলেন শব্দ গান। এই গানে একজন প্রশ্ন করে -যাকে বলে দৈন্যতা। জবাবী গানকে বলে প্রবর্ত। মূলত: তঙ্কÄকথা। সেদিন সেই গানের আসরে লালনের দৈন্যতার গানের জবাবে কুবিরের প্রবর্ত গান হচ্ছিল। আর গানের ফাঁকে ফাঁকে লোকে লোকে গর্জন করছিল - 'জয় দীনদয়াল। জয় দীনবন্ধু।' "আমি ভাবছি লোকগুলো বুঝি হরিধ্বনি দিচ্ছে। দ্বিজপদবাবু ভুল ভাঙিয়ে জানালেন, সাহেবধনীদের উপাস্যের নাম দীনদয়াল। এদের সম্প্রদায়কে বলে দীনদয়ালের ঘর। কখনও কখনও দীনদয়ালকে এরা দীনবন্ধুও বলে। এটা ওদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ।"
    সুধীর লিখছেন, "মচ্ছবের সময় দেখলাম যে হিন্দুকে পরিবেশন করছে মুসলমান, মুসলমানকে হিন্দু। ... গৃহী ধর্ম। যে কেউ নিতে পারে। ... সকলেই সাহেবধনী। ..
    এই ব্রজধামের কর্তা যিনি
    সেই ধনী এই সাহেবধনী
    রাইধনী এই সাহেবধনী।।
    আশর্য তো! ব্রজের রাইকে এরা সাহেবধনী বানিয়েছে। তার মানে এরা নারীভজা সম্প্রদায়। এদিকে ছামেদ আলি গান ধরেছে:
    একের সৃষ্টি সব নারি পাকড়াতে।
    আল্লা আলজিহ্বায় থাকেন আপনসুখে
    কৃষ্ণ থাকেন টাকরাতে।
    জানতে চাইলাম: কুবিরের গানের শিষ্য নেই?
    : সে কী? আপনি যাদুবিন্দুর গান শোনেন নি? কুবিরের প্রধান শিষ্য যাদুবিন্দু গোঁসাই। বাড়ি ছিল বর্ধমানের পাঁচলখি গ্রাম। .. ঐ দেখুন যাদুবিন্দুর দৈহিত্রের ছেলে দেবেন গোঁসাই। ও দেবেন বলি এদিকে এসো।
    :যাদুবিন্দু আবার কিরকম নাম? ...
    যাদু আর তার সাধনসঙ্গিনী বিন্দু, এই দুইয়ে মিলিয়ে যাদুবিন্দু।
    ... "
    ক্রমে আলাপ হল শরৎ ফকিরের সঙ্গে। জানলেন অনেক গুপ্তকথা। শরৎ ফকিরের মৃত্যুর সঙ্গে এই অধ্যায়ের ইতি হ'ল -ভাবলেন সুধীরবাবু। হঠাৎ দিল্লির এক প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু অনুদান পেলেন লোকসংগীত সংগ্রহের। মনে পড়লো সেই যাদুবিন্দুর দৈহিত্রের ছেলে দেবেন গোঁসাইকে। পাঁচলখির ঠিকানায় দেবেনকে চিঠি দিলেন তিনি। রিপ্লাই পোস্টকার্ডে। জবাবী চিঠিখানি পড়ুন নবীন পাঠক:
    "পূজনীয় দাদা,
    আপনার একখানি পত্র পাইয়া সকল সমাচার অবগত হইলাম। আপনি যে আমার মতন হতভাগাকে মনে রেখেছেন এইটাই ধন্যবাদ। যাহা হউক, আপনি আমার এখানে ও পাঁচলখিতে আসার ইচ্ছুক, আমার সৌভাগ্য। দয়া করিয়া গরীবের বাড়িতে আসিবেন। আসিতে যেন কুন্ঠিত হইবেন না। বাসস্টপে লোক থাকিবে জানিবেন। ইতি
    আপনার হতভাগ্য দেবেনবাবু।"

    বাসস্টপে লোক ছিল। এগারো বারো বছরের ছেলে। 'এক্কেবারে দেবেন গোঁসাইয়ের ছাঁচ।' লেখক তাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন পথে যেতে যেতে। সে কোনই জবাব দেয় না। 'ঐ আমাদের বাড়ি' বলে দৌড়ে পালায়।
    সুধীরবাবুর মুখে শুনুন এবারে:
    "একখানা মেটে ঘর, তাতে ভাঙা টালির ছাউনি। একটুখানি উঠোন। সন্ধ্যামণি আর গাঁদা ফুলের গাছ। ... ময়লা শাড়ি পরা এক নতনেত্র মহিলা, নিশ্চয়ই দেবেন গোঁসাইয়ের স্ত্রী, নিচু হয়ে মেটে দাওয়ায় আমার জন্য আসন পাতছেন। কিন্তু দেবেনবাবু কই? অস্বস্তি চাপতে না পেরে বলি: কোথায় গেলেন দেবেনবাবু? সামনের সবচেয়ে ছোট্ট ছেলেটি বলে উঠল, 'বাবা মরে গেছে।'
    : সে কি? কবে? কিভাবে? এই যে পরশু তাঁর চিঠি পেলাম?
    অঝোর কান্নায় ঢলে পড়ল আমার পায়ে এক অসহায় স্ত্রীলোক। তারপরে চোখ মুছে বলল,' উনি দেহ রেখেছেন কার্তিক মাসে।টি বি হয়েছিল তিন বচ্ছর, চিকিচ্ছে করান নি। অপরাধ নেবেন না বাবা। চিঠিখান আমিই লিখিয়েছি ধম্মোভাইকে দিয়ে।' একটু থেমে বলল, 'মরণের খবরটা দিই নি, তাহলে তো আসতেন না। বাবা, আমরা বড্ড গরীব, অসহায়। টাকাটা পাবো তো? সব খাতা নিয়ে যান।'
    ... যখন যাদুবিন্দুর গান পড়ি, ... নারীকন্ঠে কানে বাজে, ''মরণের খবরটা দিই নি, তাহলে তো আসতেন না। খুব সত্যি কথা।"

    অবিভক্ত বাংলার মেহেরপুর। ভৈরব নদ। তর্পণ চলছে। উচ্চবর্ণ লক্ষ্য করলেন বুকজলে একজন অন্ত্যজ। মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি।
    "কি রে বলা, তোরাও কি আজকাল আমাদের মত পিতৃতর্পণ করচিস্‌ নাকি?
    কিছুমাত্র কুন্ঠিত না হয়ে বলা হাড়ি জবাব দিল: আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই, আমি আমার শাকের ক্ষেতে জলসেচ করচি।
    বিস্মিত ব্রাহ্মণ বললেন: বলিস কি? এখানকার জল তোর জমিতে যাচ্ছে কি করে ? আকাশ দিয়ে নাকি?
    বলরামের সপ্রতিভ জবাব: আপনাদের তর্পণের জল কি করে পিতৃপুরুষের কাছে যাচ্ছে আজ্ঞে? আকাশ দিয়ে? বুঝলেন ঠাকুরমশায়, আপনাদের জল যেমন ক'রে পিতৃপুরুষরা পাচ্ছেন আমার জলও তেমনই ক'রে জমিনে যাচ্ছে।"
    এই বলরামই প্রবর্তন করেন 'বলা হাড়ির মত'। নাম নেন হাড়িরাম।
    "হাড়ি বলতে কোন জাতি বোঝান নি। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, যিনি হাড়ির স্রষ্টা তিনিই হাড়ি।। হাড় মানে স্ট্রাকচার, তাতে চামড়ার ছাউনি। ভেতরে বল্‌ অর্থাৎ রক্ত। এই হল মানবদেহ। তার মধ্যে হাড্‌ডি, মণি, মগজ, গোস্ত, পোস্ত। সব মিলিয়ে আঠারো মোকাম।"
    ক্রমে লেখকের আলাপ হল বিপ্রদাস হালদারের সঙ্গে। হাড়িরামের অনেক গান জানে সে। নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নিশ্চিন্তপুর। সেখানে সিদ্ধপীঠ বেলতলায় হাড়িরামের খড়মজোড়াও আছে।
    নিশ্চিন্তপুরে বিপ্রদাসের গান শুনলেন লেখক। সুধীরবাবুর মুখে শুনুন:
    "বেলতলার বিপরীত দিকে একটা ঘাসের জমিতে জমিয়ে বসতেই বিপ্র বলতে লাগল: আমাদের মতে গুরু নেই, সাধনসঙ্গিনী নেই। হাড়িরাম বলে গেছেন সবচেয়ে দামী সাধনা সেইটা যাতে 'সখার সখী নেই, সখীর সখা নেই।" একেই বলে খাসতনের সাধনা। আমাদের হাড়িরাম ছিলেন একমাত্র খাসতনের সাধক। কিন্তুক খাসতন বুঝতে হলে আগে আপনাকে বুঝতে হবে আর সব তনের থাক বা ঘর।। ...
    হাড়িরামের ধর্ম বৈরাগ্যের নয়। এ হল গিয়ে গৃহীর সাধনা। তাই আমাদের সাধনার আদি থাক হল এয়োতন। তার মানে হাড়িরামের মনের মানুষ জন্মদ্বারে যাবে অর্থাৎ স্ত্রী সঙ্গম করবে শুধু সৃষ্টির জন্য। ... এই সহবাসই এয়োতনের ধর্ম।
    বিপ্রদাস ক্রমে বুঝিয়ে দিল নিত্যন হল এয়োতনের পরের ধাপ। গৃহস্থ ধর্মে এয়োতন মেনে একটা দুটো সন্তান জন্মালে নিতে হবে নিত্যনের পথ। তখন মনের মধ্যে আনতে হবে সংসারে অনাসক্তি আর জন্মদ্বারে ঘৃণা। ...
    কিন্তু সবচেয়ে কঠিন সাধনা বোধ হয় খাসতনের। একা হাড়িরাম শুধু এ সাধনা করতে পেরেছিলেন।খাসতন হল চরম মুক্তির সাধনা। পৃথিবীর আলো হাওয়া আকাশ ... এরা খাসতালুকের প্রজা। ... এরা কাউকে খাজনা দেয় না। এদের বেঁচে থাকতে গেলে কোনো মূল্য দিতে হয় না। মানুষকে বেঁচে থাকার মূল্য দিতে হয় বীর্যক্ষয় আর বীর্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে। যে মানুষ কোনোদিন তার তার বীর্যক্ষয় করে নি সে খাসতনের সাধক। ...
    এই অবধি বোঝার পর আমি বললাম : এবারে আমি বোধিতন বুঝেছি। বোধিতন মানে কামের দ্বারে বন্দ্বীত্ব আর তার জন্য অনুতাপ। তাই না?
    : ঠিক তাই। বোধিতন হল জ্ঞানপাপীর দশা। আমরা সবাই তাই। ... হাড়িরামের সব শিষ্য এই বোধিতন থেকে মুক্তি খোঁজে। .. এই আমার কথাই ধরুন। প্রত্যেকদিন দু'বেলা বেলতলায় মথা কুটি আর কারিকরকে বলি, খাসতন তো পাবো না এ জন্মে, অন্তত নিত্যনের পথে একটু এগিয়ে দাও। গোষ্ঠদাসের গান শুনুন:
    বোধিতনে বদ্ধ হয়ে থেকো না মন আমার
    হাড়িরামের চরণ বিনে গতি নাহি আর।।
    আর অন্য উপায় দেখিনে আর একিনে
    আবার মানব হবি যদি হাড়িরামের চরণ করো সার।।
    ...
    গানের ভাবে আর সুরে সমস্ত পৃথিবীর কামমোহিত সকল মানুষের অসহায় মাথাকোটা যেন আমি শুনতে পেলাম। মনে হল এ কোনো লৌকিক ধর্মের বানানো তত্ত্ব নয়। এর মধ্যে চিরকালের লৌকিক মানুষের অসহায় অনুতাপ আর কান্না।
    গানের সুর শেষ হলেও কান্না থামে নি বিপ্রদাসের। .. আমি ... বললাম: শান্ত হও। হাড়িরামকে ডাকো। তোমার তো অনেক বয়স হয়েছে। আর ভয় কি?
    বিপ্রদাস করুণ কন্ঠে বলল: বাবু, আমার ভিতরের পশুটা যে আজও মরে নি।"

    কল্লোল:
    একটা কথা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলি ........ জন্মদ্বারে ঘৃণা : বাউল/দরবেশ/ফকিরদের সাধনার এই দিকটি বড় অবাক করে, বড় ব্যথা দেয়। যাদের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে, তারা কেউ এর কোনো জবাব দেয় নি। সনাতন গোঁসাই, কালাচাঁদ দরবেশ, মনসুর ফকির, অর্জুন ক্ষ্যাপা, ভোলা শাহ সকলকেই আমার জিজ্ঞাসা ছিলো - মানুষের ভালোবাসার সুন্দরতম প্রকাশ, মিলনকে ঘৃণা করব কেন? মিলন কি শুধুই বংশধারা বজায় রাখার জন্য! মিলনের আনন্দ (শুধু "দেহের সুখ'' নয়) মানুষকে যে স্তরে উন্নিত করে, সেটা ঘৃণার হবে কেন? আমি মিলন বলতে বুঝি স্বেচ্ছায় মিলন। কোন ধরনের বাধ্যতা/অনিচ্ছা/লোভ/তঞ্চকতায় যা হয় তা কখনই মিলন নয়।

    ইন্দ্রাণী:
    পাটুলি স্রোত। অর্থাৎ সহজিয়া ধারা। সেই ধারার গগন বৈরাগ্যর কথা শুনুন নবীন পাঠক।
    "গুরু মানে নারী। সাধনসঙ্গিনী। ... সত্য নারীদেহ। সেই সবচেয়ে বড় গুরু। তার কাছে ইঙ্গিত নিয়ে তার সাহায্যে তবে সাঁতার দিতে হবে। তার শরীরের বাঁকে মানে দশমীদ্বারে লুকিয়ে আছে মহারত্ন। আলগা স্রোতে ডুবে না গিয়ে ডুবতে হবে তলাতল অতল পাতালে। তবে মিলবে রত্নধন। সেই বাঁকে মাসে মাসে বন্যা আসে। তাকে বলে গভীর অন্ধকার অমাবস্যা। নারীর ঋতুকাল। সেই বাঁকা নদীর বন্যায় মহাযোগে ভেসে আসে মহামীন অধরমানুষ। তাকে ধরতে হবে। তার সঙ্গে মিলনে অটল হতে হবে। তাকেই বলে গুরুপ্রাপ্তি"।
    গগন আরো বলেন লেখককে:
    "বাপ মা কখনও গুরু হতে পারে ? তারা তো মায়াবদ্ধ, অষ্টপাশে বাঁধা। ... "
    সুধীরবাবু প্রতিবাদ করেন: "এসব কোথা থেকে কি সব বলে যাচ্ছেন? চুপ করুন, চুপ করুন আপনি।"
    গগন বলেন, "চুপ করব না। তোমরা ব্রাহ্মণরা আমাদের বহুদিন টুঁটি টিপে রেখেছ। আর নয়। ... শাস্ত্র কি শুধু তোমরা লিখতে পারো? আমরা পারি না? এ শাস্ত্র আমরা লিখেছি। সহজিয়া পুঁথি। চুপ করে শোন-
    "ক্ষণিকের তৃপ্তি হেতু হয়ে মাতোয়ারা।
    মারিল আমারে আর নিজে মরে তারা।।
    মধ্যে পড়ি আমি যবে ভাসিয়া বেড়াই।
    উদ্ধার করিতে মোরে আর কেহ নাই।।
    কিছুকাল কষ্টভোগ করি গর্ভমাঝে।
    আইলাম অবনীতে দোঁহার গরজে।।"

    কল্লোলদা,
    এই যে প্রচলিত শাস্ত্র রীতিনীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, এর থেকেই খুব সম্ভব উঠে এসেছে এই উল্টো স্রোতে ভাসা।
    সে বড় কঠিন কাজ।
    সুধীরবাবুর কথায়:
    "আমি জানতাম না যে কোনো জিনিষ নি:শেষে জানার পর তা মনের মধ্যে পুঞ্জিত করে রাখার যন্ত্রণা এত মর্মান্তিক। আমি স্পষ্ট করে বুঝলাম লালন, পাঞ্জু শা, দদ্দু শাহ, ... কেন এত অন্তহীনভাবে গান লিখে গেছেন। তাঁদের যন্ত্রণা এভাবেই ব্যক্ত করে গেছেন তারা। ... এ যে পদে পদে জীবন সংসক্তির ধর্ম। মল মূত্র বীর্য রজ: কিছুই যাদের ত্যজ্য নয় তাদের বাইরের থেকে বোঝা কি খুব সহজ? ... একে তো প্রচলিত ধর্মের পথ ছেড়ে নির্জন নি:সঙ্গ পথে সাধনা। তারপর সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। তারও পরে.. কাউকে বলতে না পারার গভীর নি:সঙ্গ সন্তাপ। লালনকেও বলতে হয়েছিল," কারে বলব আমার মনের বেদনা/ এমন ব্যথায় ব্যথিত মেলে না।"

    সুধীরবাবুর কথায়, "মানুষের ফুঁপি ফুরোয় না। আমি মানুষের সেই অনন্ত ফুঁপি ধরে ধরে কেবলই ঘুরি। স্বজনে নির্জনে।"
    সুধীরবাবুর হাত ধরে আমাদের দেখা হয়ে যাবে রামদাস, গোপীনাথ, রয়েল ফকির,ইমানালী, মজহারুল, মোহন খ্যাপা, , আরো কতজনের সঙ্গে। জানব কুমীর কি, জানব অমবস্যায় চাঁদের উদয় কাকে বলে ...
    সব আপনার আবিষ্কারের জন্য তোলা রইল, নবীন পাঠক।

    আমি এবার জীর্ণ বইটি বন্ধ করব।মলাটে ঝুঁটি বাঁধা , গেরুয়া পোষাকে একা মানুষটি। তীব্র অথচ বিষাদময় চোখ তাঁর। সেই মুখে কখনও দেখতে পাবো বিপ্রদাসকে , কখনও গগন গোঁসাইকে, কখনও পাঁউরুটির কারখানার হেড মিস্ত্রি বিমল বাউল অথবা অথবা জনপ্রিয় পাক্ষিকের দুলেন্দ্রকে।
    আমাদের এই ইন্টারনেটের শখের মাউসবাজি, কফি টেবিলে পড়ে থাকা জনপ্রিয় পাক্ষিকটি-এর বাইরে, এর অনেক দূর দিয়ে বয়ে যায় এক চোরা স্রোত। সুধীরবাবুর কথায়:" দেহ, দেহ সংস্কার, যৌনতা, বিন্দুধারণ, নিয়ন্ত্রণ। শরীরী ভাবনা। রাত যেমন করে দিনের আলোর মধ্যে লুকিয়ে রাখে তার অন্ধকার, তেমনই বৈরাগ্যের অন্ত:শীল গৈরিকে ভরে আছে কামনাকুসুম ... জীবনের কিছু রহস্য অপ্রকটিত থাকাই ভালো।"

    পাঠককে নমস্কার।

    কল্লোল:
    যারা জ্যান্তে মরার কথা বলে, তাদের বোঝা সহজ বড়ো কাজ নয়, একথা মানতে আমি হাজার বার রাজি। কিন্তু সাধক যখন বলেন ""আমার ভিতরের পশুটা যে আজও মরেনি ......... '' তখন বড় হাহাকার করে ওঠে মনটা। ডাক ছেড়ে বলতে ইচ্ছা করে গোঁসাই এতো ঐ ভদ্রলোক ব্রাহ্মণ্য সংষ্কৃতির কথা। তোমাদের তো তার উল্টোদিকে দাঁড়ানোর কথা। ওরা শিখিয়েছে কাম বড়ই কূ ভাব, তুমিও তাই মানবে!!!!

    রঙ্গন:
    ভদ্রলোক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি এবং লোকায়ত যৌনসাধনের সম্পর্ক কি এতই সরলরৈখিক, যে "এটা" বনাম "ওটা" দিয়ে দুজনের মাঝখানে একটা লক্ষ্মণের গন্ডি টেনে দেওয়া যায়?

    কল্লোল:
    না বাপু, লক্ষণের গন্ডী এক রামায়ণে পড়েছি আর নাসিকে গোদাবরী নদীতীরে, যেখানে আর একটা কুম্ভমেলা হয়, সেখানে দেখেছি সিমেন্ট বাঁধানো পাড়ে বেশ গভীর করে কাটা আছে। তাছাড়া সত্যিই অমন কোন গন্ডী হয় না। তবে যখন দেখি অন্য রাস্তায় হাঁটা সাধকেও ""ভদ্রলোক''-এর ভাষায় কথা বলেন, তার চেয়েও বড় কথা, ""ভদ্রলোকি'' চিন্তাকে মান্যতা দেন, তখন মনে হয় - হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠান বস্তুটার জোর আছে বটে। মন খারাপই হয় তাতে।

    রঙ্গন:
    লক্ষ্মণের গন্ডি নিয়ে দু একটা কথা কই। এটা "ভদ্রলোকের ভাষা" এবং এটা "অন্য রাস্তার ভাষা"- এই ধরনের দ্বিত্বপ্রয়োগ ইতিহাসের কাঠগড়ায় কি আদৌ দাঁড়ায়? প্রশ্নটা উঠেছিল লোকায়ত সাধনায় যৌনতার অনুষঙ্গ উপলক্ষ্যে। "আনন্দের জন্য যৌনতা" নিতান্তই "ভদ্রলোক" সংস্কৃতির দান। যেহেতু আমরা নিজেরা ভদ্রলোক, লোকায়ত সাধনার যৌনতা নিয়ে আমরা চিরকাল একটা "ভদ্রলোকী" ধারণা তৈরি করেছি। একদিকে উনিশ শতকের নবজাগরণের সময়ে প্রায় প্রত্যেকে লোকায়ত সাধনাকে খুব হীনচোখে দেখতেন এই যৌনতার অনুষঙ্গের জন্য। অন্যদিকে বিংশ শতকের শেষভাগে যৌনতা এবং আধ্যাত্মিকতার একধরনের সরস মিক্সচারের জন্য লোকায়ত সাধনা ফ্যাশন হয়ে উঠল। এরা একই পয়সার এ পিঠ ও পিঠ। লোকায়ত দর্শন কোনোদিনই "আনন্দের জন্য অবাধ যৌনতাকে" প্রশ্রয় দেয় নি। লোকায়ত জীবনযাত্রার আমাদের অচেনা যে যৌন আচার ব্যবহারের প্রসঙ্গ তা সব সময় এসেছে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। সেখানে মূলে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় প্রসব এবং জন্ম, প্রক্রিয়াটা বড়ো কথা নয়। নিজের আনন্দের খাতিরে বিনা উৎপাদনে বীজনাশ খুব একটা কদর পাবে না তা বলাই বাহুল্য। কাজেই যদি কোনো বাউল সাধক যদি প্রবৃত্তিগত যৌনতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাকে "ভদ্রলোকী সংস্কৃতির ছাপ" বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। অযৌনতার ভদ্রলোকী সংস্কৃতিকে একটা সুষম ক্যাটেগরি হিসেবে দেখাটাও একটা ভুল। উনিশ শতকের প্রথমভাগের কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতিতে প্রায় অবাধ যৌনতার প্রচলন দেখতে পাই। এর বিরুদ্ধে আঘাত আসে দুই দিক থেকে। একদিকে কেশবচন্দ্র- বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যদিকে রামকৃষ্ণ। কেশব-বঙ্কিমের "যৌনতার" বিরোধিতা অবশ্যই ভিক্টোরিয়া ইংরাজিশিক্ষার ফল। কিন্তু কেশব-বঙ্কিমের বিরোধিতা এবং রামকৃষ্ণের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের সওয়ালকে একই বর্গে ফেলে দেওয়া ঠিক নয়। রামকৃষ্ণের অযৌনতার পাঠের পিছনে লুকিয়ে আছে গ্রামীণ কৃষিসভ্যতার বিভিন্ন উপসর্গ যেখানে কর্তাভজা এবং বাউলদের প্রভাব পরোক্ষ হলেও অস্পষ্ট নয়। যদিও রামকৃষ্ণ কর্তাভজাদের যৌনাচারকে কোনোদিন ভালোচোখে দেখেন নি এবং বলেছেন যে পায়খানার দোর দিয়ে ঘরে ঢোকা কেন, কিন্তু একই সাথে এ কথাও স্বীকার করেছেন যে ঐ পথ দিয়েও ইষ্টের কাছে পৌঁছনো সম্ভব। অবশ্যই উনিশ শতকের ব্রাহ্মভাবাপন্ন ভদ্রলোকদের কাছে রামকৃষ্ণ এই কথা বলতে পারেন নি যে তোমরাও কর্তাভজাদের পথ অনুসরণ করো। কারণ সর্বাঙ্গে "কামিনীকাঞ্চনের" নাগরিক খোলস এঁটে কেউ লোকায়ত বাউল কি তন্ত্রসাধনার পথে এগোলে মুখ্য হয়ে উঠবে যৌনাচার এবং কারণবারি, গভীর নির্জন পথের খোঁজ পাওয়া যাবে না। উনিশ শতকের কলকাতার তন্ত্রসাধনার ইতিহাসও এই বহিরঙ্গের উপকরণ নিয়ে মাতামাতির ইতিহাস। কাজেই দুই সমাজের পথ আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এইভাবেই গ্রাম কখনও শহরের সাথে কথা বলেছে, কখনও শহর গ্রামের সাথে। এই দুইয়ের মিলমিশে গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজের যৌনতার বিভিন্ন আখ্যান।

    কল্লোল:
    রঙ্গন - সাব্বাশ। ঠিকঠাক ধরেছো। আমারই ভুল। আসলে ইচ্ছেপূরনের ইচ্ছেটা বড় বেশী চাগার দেয় সময় সময়।

    দীপ্তেন:
    কয়েকটা কথা কইতে ইচ্ছে হল। আপনেরা অক্ষয় দত্তের "ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়" কিতাবটি তো অবশ্যি পড়েছেন কিন্তু যাদের পাতা উল্টাতে আলস্যি তাদের জানাই, লেখক প্রায় একশো বছর আগে বাংলার এমন আরো সম্প্রদায়ের কথা লিখেছেন।

    খুসীবিশ্বাসী, আউলে ,সাধ্বিনি,সহজী,গৌরবাদী, রাধাবল্লভী, সখীভাবক, কর্ত্তাভজা,স্পষ্টদায়ক। গান ছিলো এই সব ধর্ম প্রচারের একেবরে আদি মাধ্যম।

    বলরামীদের কিছু zen ধর্মী বাক্যবন্ধ।

    ১ রাঁধুনী নেই তো রাঁধলে কে? খাবার নেই তো খেলেন কি? যে রাঁদলে সেই ই খেলে - এই ই দুনিয়ার ভেল্কি।

    ২ যম বেটা ভাই দুর্মুখোথলি, তাই ওর আঁটটা খালি।ও কেবল খাচ্চে খাচ্চে খাচ্চে, ওর পেটে কি কিছু থাকছে থাকছে থাকছে ?

    ৩ যেয়েও আছি, থেকেও নাই। তেমনি তুমি আর আমি এ ভাই। আমরা মরে বাঁচি, বেঁচে মরি। বলাইএর এ কি বিষম চাতুরী। বলাইএর কি বিষম চাতুরী।

    ১লা জুলাই, ২০০৭
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০১ জুলাই ২০০৭ | ১৬৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন