গতকাল প্রাইমারি রিক্রুটমেন্ট মামলার রায় এসেছে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। তাই নিয়ে তোলপাড় রাজ্য, সামাজিক মাধ্যম থেকে বাস ট্রেন চায়ের দোকান। এবং যথাযত কারণে বিভিন্ন মানুষ, গোষ্ঠী নেমে পড়েছেন পাবলিক ওপিনিয়ন তৈরির স্বার্থে, narrative building এর স্বার্থে।
আমাদের মিডিয়া, কিছু বিজ্ঞ উকিল (যে উকিলদের SIR নিয়ে কেসে, উমার খালেদের কেসে, electoral bonds নিয়ে কেসে বা সোনালী খাতুনদের কেসে খুঁজে পাওয়া যায়না ) মিলে কাল দুপুর থেকে একধরণের নেগেটিভ বাতাবরণ তৈরির জন্যে সচেষ্ট হয়েছে। এনারা বলতে চেষ্টা করছেন যে প্রাইমারি টিচার রিক্রুটমেন্ট সংক্রান্ত যে রায় মহামান্য হাইকোর্ট দিয়েছেন সেটা শুধু মাত্র দয়ার দান এবং যেহেতু ৯ বছর চাকুরীরতো আছেন এই শিক্ষকরা তাই এখন তাঁদের সরিয়ে দিলে বিপর্যয় নেমে আসবে তাঁদের জীবনে। উকিল মহাশয় (রা) বলছেন এই রায় আবেগতাড়িত। এটি রায়ের অতিসরলীকরণ এবং একটি ছোট আংশিক দিককে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। এবং এটি ৩২০০০ শিক্ষকের মানহানির সমান ও বটে। পুরো রায় পড়লেই বোঝা যায় যে এই আবেগ ও মানবিকতার যুক্তিগুলো মোটেও মূল যুক্তি নয় রায়ের natural justice adherence এর ক্ষেত্রে।
আসলে বারবার বলি, আবারো বলছি মিডিয়ার রিসার্চ টিমগুলো পড়াশোনা খুব কম করে আজকাল তাই ১৪১ পাতার রায় পড়ার ইচ্ছে হয়নি তাঁদের। উকিলদের ব্যাপারে কিছু বলবোনা, ওনাদের দায় নেই মানুষকে সত্যি বলার সেটা সবাই জানি। উকিলসাহেবদের উদ্দেশ্য কোটি কোটি টাকা রোজগার করা, অস্থির অবস্থা সৃষ্টি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং তাঁদেরকে নিজেদের শরণাপন্ন করা এবং মিডিয়া তে গরম গরম নাম কেনা।
মূল রায়ের পিডিএফ নেটে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেই ১৪১ পাতার রায়ে পেজ নম্বর ১৩৯-১৪০, পয়েন্ট ১৮৮, ১৮৯, ১৯০ তে মহামান্য হাইকোর্ট স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন কিছু কথা। সেগুলো তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য এই লেখার। সেই পয়েন্টগুলো সহজ ভাষায় লিখতে চেষ্টা করছি।
১. পয়েন্ট ১৯০ তে উল্লেখিত আছে - "Findings arrived at by the investigating authority would not reveal that the appointed candidates were involved in any corrupt practices". এটার বাংলা অর্থ মিডিয়ার লিগাল টিম বা উকিলগণ বোঝেনি এমনটা হতে পারেনা। তারা পড়েনি বা পড়তে চায়নি কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য মানুষকে ভুল বোঝানো। স্পষ্ট ভাষায় লেখা যে চাকুরীরত শিক্ষকরা কোনধরণের দুর্নীতি বা জালিয়াতি করেছেন এমন কোনও প্রমাণ উঠে আসেনি CBI এর তদন্তে।
2. পয়েন্ট ১৯০ তে উল্লেখিত আছে - ব্যতিক্রমী ৯৬ জন যাদের ক্ষেত্রে malpractice দেখা গেছিলো তাঁদের চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেছিল প্রাইমারি পর্ষদ কিন্তু পরে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত তারা চাকরিতে বহাল আছেন।
3. পয়েন্ট ১৯০ তে উল্লেখিত আছে - "The allegation of fraud and corruption pertaining to the entire recruitment process, is not sustainable and the appointment of the 32000 teachers cannot be interfered with". এটির বাংলা অর্থ একটি ক্লাস ৫ এর শিশু ও করে দিতে পারবে। কিন্তু আমাদের মিডিয়া এবং কিছু ulterior motives ওয়ালা সুযোগসন্ধানী উকিল সেই ইংরিজি থেকে বাংলা অনুবাদটা করতে অক্ষম। সঠিক অনুবাদ হলো - গোটা রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতি সংক্রান্ত যে দুর্নীতি এবং জালিয়াতির অভিযোগ এসেছে সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং তাঁর ফলে গোটা ৩২০০০ শিক্ষকের প্যানেলকে কোনোভাবেই ক্যানসেল করা হচ্ছেনা।
4. পয়েন্ট ১৮৯ এ হাইকোর্ট উল্লেখ করছেন - " For cancellation of the entire examination there must be as a rule possibility of systemic malaise as borne out by materials on record. Assessment of the data does not indicate systemic cheating. It also needs to be mentioned that during the period of service rendered by the appellants there had been no allegation regarding the integrity or efficiency of those teachers. It is not a case that instructions were given to the examiners to give higher marks or that the candidates who paid money had been given high marks in the interview. A group of unsuccessful candidates should not be allowed to damage the entire system and moreso when it cannot be ruled out that innocent teachers would also suffer great ignominy and stigma. The service of the appointees cannot also be terminated only on the basis of an ongoing criminal proceeding." অর্থাৎ, সিস্টেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতির কোনও সত্যতা প্রমাণ হয়নি তাই গোটা প্যানেল বাতিল করা ন্যায় হবেনা। চাকুরীরতো শিক্ষকরা নিজেদের সার্ভিস সময়কালে এমন কোনও ঘটনা ঘটাননি যার ফলে তাঁদের ইন্টিগ্রিটি বা দক্ষতা প্রশ্নের মুখে আস্তে পারে। এখানে কাউকে দুর্নীতির অংশ হিসেবে টাকা দিয়ে ইন্টারভিউ এর নম্বর বাড়ানোর মতন কোনও প্র্যাক্টিস আদালতের চোখে আসেনি। সাথে আদালত এটাও বলেছেন যে গুটিকতক অসফল পরীক্ষার্থী গোটা রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষা ব্যবস্থাকে এইভাবে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলতে পারেনা যেখানে conclusive evidence ই নেই।
5. পয়েন্ট ১৮৮ এ মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন - "There is a difference between a proven case of mass cheating in a Board examination and unproven imputed charge of corruption." স্পষ্ট যে মিডিয়া এবং সমাজের একাংশ যেটা বলছিলো যে বিপুল চিটিং হয়েছে সেটি এই ক্ষেত্রে মানছেনা হাইকোর্ট। তাই তাকে আলাদা করছে অপ্রমাণিত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে।
উপরে উল্লেখিত পয়েন্ট ১৮৮, ১৮৯, ১৯০ এর পর পয়েন্ট ১৯১ এসেছে যেখানে মানবিকতার দিকটি তুলে ধরেছেন হাইকোর্ট। সেখানে হাইকোর্ট বলেছেন যে পুরো প্যানেল ক্যানসেল করলে সেটি শিক্ষকদের এবং তাঁদের পরিবারের উপর ভয়ানক একটি পরিস্থিতি (disastrous impact) নামিয়ে আনবে। ক্লাস ১ এর বাচ্চা ও এইটুকু arithmetic জানে যে ১৮৮, ১৮৯, ১৯০ আগে আসে তারপর ১৯১। মিডিয়ার এবং উকিলদের যে অংশ মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের ১৮৮, ১৮৯, ১৯০ নম্বর পয়েন্টগুলির findings and observations কে উপেক্ষা করে শুধু পয়েন্ট ১৯১ এর মানবিকতার অংশ কে তুলে ধরছেন তারা অসত্য চর্চা করছেন।
এটা তো গেলো গতকালের আদালতের রায় নিয়ে আলোচনা।
প্রাইমারি রিক্রুটমেন্ট বা এসএসসি রিক্রুটমেন্ট সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মূল দাবি তিনটি-
১. যারা দুর্নীতির পান্ডা তাঁদের খুঁজে বার করতে হবে CBI ও ED কে। সেটিই তাঁদের কাজ, তাঁর জন্যে তারা সাধারণ মানুষের করের টাকা থেকে মাইনে পান। এই দুর্নীতির মূলচক্রীদের অবিলম্বে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
2. যে শিক্ষকরা জালিয়াতি বা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে তাঁদের বরখাস্ত করতে হবে। অর্থাৎ proven Tainted দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও আজ মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন যে প্রাইমারিতে চাকুরীরতো এই ৩২০০০ শিক্ষকরা কোনোরকমের দুর্নীতি মূলক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন এমন প্রমাণ নেই।
3. কোনোভাবেই একজন ও নির্দোষ যোগ্য (Untainted) কর্মচারীর (এইক্ষেত্রে শিক্ষক) গায়ে যেন হাত না পরে। একজন ও যোগ্য নির্দোষ শিক্ষকের চাকরি ও যেন খোয়া না যায়, যেন সামাজিক সন্মান না হারায়। দোষী এবং নির্দোষ কে গুলিয়ে দেওয়ার খেলা বন্ধ হোক। নির্দোষ মানুষ কখনোই দোষী মানুষের অন্যায়ের সাজা পেতে পারেনা একটি সভ্য সমাজে।
4. পুরো প্যানেল বাতিলের দাবি অনেকটা মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতন। তাই এই গোটা প্যানেল বাতিলের দাবি থেকে সরে এসে সব ক্ষেত্রে যথাযত তদন্তের দাবি রাখা জরুরি। প্রমানের ভিত্তিতে দোষীরা চিন্নিত হোক এবং শাস্তি পাক। কিন্তু দোষী ও নির্দোষকে আলাদা না করতে পেরে গোটা প্যানেলের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দেওয়া মধ্যযুগীয় প্র্যাক্টিস। সেই রবিনহুড কে খুঁজে না পেয়ে গোটা শেরউড ফরেস্ট জ্বালিয়ে দেওয়ার মতন আরকি।
এই অন্তিম পয়েন্ট দুটি যে বা যারা বলতে পারছেনা, তারাই সেই অসৎ ব্যক্তি যারা আজকের রায়ের অপব্যাখ্যা করছেন। এনারাই আজকের রায়ের পর কিছুটা frustrated কারণ তাদের নির্দোষ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিসন্ধি পরাস্ত হয়েছে।
অবশেষে আবারো বলি রায়টি নিজে পড়ুন। উদ্দেশ্যপ্রনোদিত বক্তব্য কে উপেক্ষা করে নিজে রায়টি পড়ে দেখুন কি লেখা। এতে আপনি অন্যের অসত্য বচনের ভাগিদার হওয়া থেকে রক্ষা পাবেন। আমার লেখাটি ও আগে শেয়ার করবেন না, আমার উল্লেখিত পয়েন্ট গুলো মূল রায়ে পড়ুন। যদি দেখতে পান আমি যথাযত কথা লিখছি তালে শেয়ার করবেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।