“তুমি কি চালটা দেবে, নাকি সারারাত এভাবেই বসে থাকব আমরা?”লোকটার গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল, যা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামিয়ে দিল। উল্টো দিকে বসা লোকটা হাসছে। সেই হাসিটা আমার চেনা।
বড্ড চেনা।
কিন্তু মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টির জলের ঝাপটা এমন শব্দ করছে যেন কেউ নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে কাঁচটা। ভেতরে আসার জন্য মরিয়া। টুর্নামেন্ট হলের এই ঘরটা বড্ড নিস্তব্ধ। অনেকটা মর্গের মতো।
আমি দাবার বোর্ডের দিকে তাকালাম। সাধারণ প্লাস্টিকের ঘুঁটি। কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে ওগুলো প্লাস্টিক নয়? আমার আঙুলগুলো কাঁপছে। ওগুলো ঘুঁটি নয়। ওগুলো চিতা। আমার নিজের হাতে দাহ করা সব চিতাগুলো জ্বলে উঠেছে একসাথে।
আমি বোড়েটাকে এক ঘর এগিয়ে দিলাম। শব্দটা হলে ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। খট।
আমার মনে হলো কেউ আমার কানে ফিসফিস করে বলল, “দেরি হয়ে গেছে।”
১. কুইন স্যাক্রিফাইস
আমার রানি। সাদা, উজ্জ্বল, অপরাজেয়। ঠিক যেন কার মতো…
আমার চোখের সামনে হঠাৎ রেসকোর্সের সেই কাউন্টারটা ভেসে উঠল। ঘেমো গন্ধ। চিৎকার। আর একটা লাশ। কাউন্টারের ফোকর দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি মা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সামনে একটা মৃতদেহ চাদর দিয়ে ঢাকা। হঠাৎ মৃত্যু। আচমকা থেমে গেছে কেউ।
বসের হুকুম, “ব্যবসা বন্ধ হবে না। লাশের ওপর দিয়ে কাজ চালাও।”
মা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রানীর মতো। “মৃত্যু কী এতই সস্তা? মানুষটা আর সাড়া দেবে না তাতে কী আমরাও নিঃসাড় হয়ে যাব? যেন কেউ ছিলোনা ওখানে, কেউ নেই ওখানে? অসম্ভব।”
মা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল। পথে বসেছিলাম। কিন্তু মা মাথা নোয়ায়নি।
মৃত্যু কিন্তু এতই সস্তা।
সহজ…
অনায়াসে এসে যায়।
বোর্ডে হঠাৎ একটা কালো ছায়া নেমে এল। বিপক্ষের কালো মন্ত্রী। একটা সেকেন্ড। ব্যাস। আমার রানী নেই। বোর্ড থেকে ছিটকে পড়ল সে।
আমি কি ভুল দেখলাম? নাকি প্লাস্টিকের রানিটা পড়ার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল? “আর পারলাম না রে…”
আমার বুকটা ধক করে উঠল। উল্টো দিকের লোকটা কি আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল? সে শুধু মুচকি হাসল।
সে জানতো।
তার জানা আছে আমার জীবন।
২. বিশপের অভিশাপ
এরপর বিশপ। ঠাকুমা।
ঠাকুমা সোজা চলতে জানত না। শুধু কোণাকুনি। ঠিক ওই বিশপটার মতো।
“বৌমাদের শাসন না করলে সংসার থাকে না”—এটাই ছিল তার মন্ত্র।
সেই বিশাল বাড়ি। নোনা ধরা দেওয়াল। আর জানালার গ্রিল ধরে বসে থাকা ঠাকুমা। একরোখা জেদ। সবাই ছেড়ে দিলো।
বাড়িটা ভেঙে পড়ল।
ঠাকুরদাও রইলো না একদিন।
তবু ঠাকুমা নড়ল না।
বোর্ডে আমার গোঁয়ার বিশপটার মতো। আটকে আছে সেই কোনায়। নড়ছে না। জায়গা নেই। বিপক্ষের ঘোড়াটা আড়াই চালের এক অদ্ভুত লাফ দিল। ঠুক্!
বিশপটা পড়ে গেল।
আমার মনে হলো আমি ঠাকুমার গলা শুনলাম, “তুই শুনলি না… তুই কখনো শুনিস নি।”
ঘরটা কি হঠাৎ খুব ঠান্ডা হয়ে গেল? আমি জ্যাকেটটা টেনেটুনে গায়ে জড়ালাম চাদরের মতো। লোকটা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চেনা। আমার খুব চেনা সেই দৃষ্টি।
৩. নাইটের শেষ লাফ
আমার হাত এখন কাঁপছে। ভীষণ কাঁপছে। নাইটটা হাতে নিলাম। হুলোদা।
আমার নাকে হঠাৎ পচা শ্যাওলার গন্ধ। গোলদিঘীর জল। হুলোদা আমাকে ছুড়ে দিচ্ছে জলে। “ভয় পাস না! ভেসে থাক!”
হুলোদা নিয়ম মানত না। নাইটের মতোই। বেপরোয়া।
কিন্তু সেই বেপরোয়া ছেলেটাই ঘরের বিছানায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। নাকে অক্সিজেনের নল। নিশ্বাস নিতে পারছে না। যে ছেলেটা আমাকে জল থেকে বাঁচিয়েছিল, সে ডাঙায় ডুবে যাচ্ছিল।
“তুই সবসময় পিছিয়ে থাকিস কেন বল তো?”—হুলোদার শেষ কথাগুলো কানে বাজল।
আমি নাইটটাকে চাললাম। একটা সুইসাইডাল মুভ। আত্মঘাতী।
কালো ঘোড়াটা উল্টে দিল তাকে। হুলোদা নেই। বোর্ডটা এখন ফাঁকা।
ভীষণ ফাঁকা।
৪. দ্য ফাইনাল চয়েস
“তোমার সময় শেষ হয়ে আসছে।”
লোকটার গলার আওয়াজটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। টিক-টিক শব্দটা যেন আমার হৃৎপিণ্ডের ভেতরে হচ্ছে।
বোর্ডে শুধু আমি। মানে, একটা তুচ্ছ বোড়ে। আর এক ঘর। মাত্র এক ঘর এগোলেই আমি যা খুশি হতে পারি।
প্রমোশন।
কিন্তু আমি কী হব?
রানী? মায়ের মতো শক্তিশালী হলে আমাকেও কি একঘরে হয়ে মরতে হবে?
বিশপ? ঠাকুমার মতো নিজের জেদে সব হারাতে হবে?
নাকি নাইট? হুলোদার মতো অকালে ফুরিয়ে যাব?
বাইরে বাজ পড়ল। ঘরটা আলোয় ঝলসে উঠল। সেই এক মুহূর্তের আলোয় আমি উল্টো দিকের লোকটার মুখটা স্পষ্ট দেখলাম।
আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।
ও কোনো অচেনা লোক নয়।
বহুকাল আগে আয়নায় দেখা হয়েছিলো ওর সাথে। নবীন সংস্করণ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
“সিদ্ধান্ত নাও,” সে হিসহিস করে বলল। “খেলাটা শেষ করো। তুমি কী হতে চাও?”
আমি বোড়েটা হাতে তুলে নিলাম। শেষ ঘর। সাদা-কালো চকরাবকরা ঘরটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি মুক্তির পথ? নাকি আরেকটা ফাঁদ?
আমার হাত কাঁপছে। আমি বোড়েটা নামালাম।
বোর্ডের ওপর শব্দ হলো— খট।
খেলা শেষ?
নাকি এই সবে শুরু?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।