এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অনন্ত চাল

    Nilanjan Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৮০ বার পঠিত
  • “তুমি কি চালটা দেবে, নাকি সারারাত এভাবেই বসে থাকব আমরা?”
    লোকটার গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল, যা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামিয়ে দিল। উল্টো দিকে বসা লোকটা হাসছে। সেই হাসিটা আমার চেনা। 
    বড্ড চেনা। 
    কিন্তু মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি।
     
    বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টির জলের ঝাপটা এমন শব্দ করছে যেন কেউ নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে কাঁচটা। ভেতরে আসার জন্য মরিয়া। টুর্নামেন্ট হলের এই ঘরটা বড্ড নিস্তব্ধ। অনেকটা মর্গের মতো।
     
    আমি দাবার বোর্ডের দিকে তাকালাম। সাধারণ প্লাস্টিকের ঘুঁটি। কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে ওগুলো প্লাস্টিক নয়? আমার আঙুলগুলো কাঁপছে। ওগুলো ঘুঁটি নয়। ওগুলো চিতা। আমার নিজের হাতে দাহ করা সব চিতাগুলো জ্বলে উঠেছে একসাথে।
    আমি বোড়েটাকে এক ঘর এগিয়ে দিলাম। শব্দটা হলে ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। খট।
    আমার মনে হলো কেউ আমার কানে ফিসফিস করে বলল, “দেরি হয়ে গেছে।”
     
    ১. কুইন স্যাক্রিফাইস
     
    আমার রানি। সাদা, উজ্জ্বল, অপরাজেয়। ঠিক যেন কার মতো…
    আমার চোখের সামনে হঠাৎ রেসকোর্সের সেই কাউন্টারটা ভেসে উঠল। ঘেমো গন্ধ। চিৎকার। আর একটা লাশ। কাউন্টারের ফোকর দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি মা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সামনে একটা মৃতদেহ চাদর দিয়ে ঢাকা। হঠাৎ মৃত্যু। আচমকা থেমে গেছে কেউ।
    বসের হুকুম, “ব্যবসা বন্ধ হবে না। লাশের ওপর দিয়ে কাজ চালাও।”
    মা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রানীর মতো। “মৃত্যু কী এতই সস্তা? মানুষটা আর সাড়া দেবে না তাতে কী আমরাও নিঃসাড় হয়ে যাব? যেন কেউ ছিলোনা ওখানে, কেউ নেই ওখানে? অসম্ভব।”
    মা চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল। পথে বসেছিলাম। কিন্তু মা মাথা নোয়ায়নি।
     
    মৃত্যু কিন্তু এতই সস্তা। 
    সহজ…
    অনায়াসে এসে যায়।
     
    বোর্ডে হঠাৎ একটা কালো ছায়া নেমে এল। বিপক্ষের কালো মন্ত্রী। একটা সেকেন্ড। ব্যাস। আমার রানী নেই। বোর্ড থেকে ছিটকে পড়ল সে।
    আমি কি ভুল দেখলাম? নাকি প্লাস্টিকের রানিটা পড়ার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল? “আর পারলাম না রে…”
    আমার বুকটা ধক করে উঠল। উল্টো দিকের লোকটা কি আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল? সে শুধু মুচকি হাসল। 
    সে জানতো। 
    তার জানা আছে আমার জীবন।
     
    ২. বিশপের অভিশাপ
     
    এরপর বিশপ। ঠাকুমা।
    ঠাকুমা সোজা চলতে জানত না। শুধু কোণাকুনি। ঠিক ওই বিশপটার মতো। 
    “বৌমাদের শাসন না করলে সংসার থাকে না”—এটাই ছিল তার মন্ত্র।
    সেই বিশাল বাড়ি। নোনা ধরা দেওয়াল। আর জানালার গ্রিল ধরে বসে থাকা ঠাকুমা। একরোখা জেদ। সবাই ছেড়ে দিলো। 
    বাড়িটা ভেঙে পড়ল। 
    ঠাকুরদাও রইলো না একদিন।
    তবু ঠাকুমা নড়ল না।
     
    বোর্ডে আমার গোঁয়ার বিশপটার মতো। আটকে আছে সেই কোনায়। নড়ছে না। জায়গা নেই। বিপক্ষের ঘোড়াটা আড়াই চালের এক অদ্ভুত লাফ দিল। ঠুক্!
    বিশপটা পড়ে গেল।
    আমার মনে হলো আমি ঠাকুমার গলা শুনলাম, “তুই শুনলি না… তুই কখনো শুনিস নি।”
    ঘরটা কি হঠাৎ খুব ঠান্ডা হয়ে গেল? আমি জ্যাকেটটা টেনেটুনে গায়ে জড়ালাম চাদরের মতো। লোকটা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চেনা। আমার খুব চেনা সেই দৃষ্টি। 
     
    ৩. নাইটের শেষ লাফ
     
    আমার হাত এখন কাঁপছে। ভীষণ কাঁপছে। নাইটটা হাতে নিলাম। হুলোদা।
    আমার নাকে হঠাৎ পচা শ্যাওলার গন্ধ। গোলদিঘীর জল। হুলোদা আমাকে ছুড়ে দিচ্ছে জলে। “ভয় পাস না! ভেসে থাক!”
    হুলোদা নিয়ম মানত না। নাইটের মতোই। বেপরোয়া।
    কিন্তু সেই বেপরোয়া ছেলেটাই ঘরের বিছানায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। নাকে অক্সিজেনের নল। নিশ্বাস নিতে পারছে না। যে ছেলেটা আমাকে জল থেকে বাঁচিয়েছিল, সে ডাঙায় ডুবে যাচ্ছিল।
    “তুই সবসময় পিছিয়ে থাকিস কেন বল তো?”—হুলোদার শেষ কথাগুলো কানে বাজল।
    আমি নাইটটাকে চাললাম। একটা সুইসাইডাল মুভ। আত্মঘাতী।
    কালো ঘোড়াটা উল্টে দিল তাকে। হুলোদা নেই। বোর্ডটা এখন ফাঁকা।
    ভীষণ ফাঁকা।
     
    ৪. দ্য ফাইনাল চয়েস
     
    “তোমার সময় শেষ হয়ে আসছে।”
    লোকটার গলার আওয়াজটা চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। টিক-টিক শব্দটা যেন আমার হৃৎপিণ্ডের ভেতরে হচ্ছে।
    বোর্ডে শুধু আমি। মানে, একটা তুচ্ছ বোড়ে। আর এক ঘর। মাত্র এক ঘর এগোলেই আমি যা খুশি হতে পারি।
    প্রমোশন।
    কিন্তু আমি কী হব?
    রানী? মায়ের মতো শক্তিশালী হলে আমাকেও কি একঘরে হয়ে মরতে হবে?
    বিশপ? ঠাকুমার মতো নিজের জেদে সব হারাতে হবে?
    নাকি নাইট? হুলোদার মতো অকালে ফুরিয়ে যাব?
    বাইরে বাজ পড়ল। ঘরটা আলোয় ঝলসে উঠল। সেই এক মুহূর্তের আলোয় আমি উল্টো দিকের লোকটার মুখটা স্পষ্ট দেখলাম।
    আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।
    ও কোনো অচেনা লোক নয়।
    বহুকাল আগে আয়নায় দেখা হয়েছিলো ওর সাথে। নবীন সংস্করণ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
    “সিদ্ধান্ত নাও,” সে হিসহিস করে বলল। “খেলাটা শেষ করো। তুমি কী হতে চাও?”
    আমি বোড়েটা হাতে তুলে নিলাম। শেষ ঘর। সাদা-কালো চকরাবকরা ঘরটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি মুক্তির পথ? নাকি আরেকটা ফাঁদ?
    আমার হাত কাঁপছে। আমি বোড়েটা নামালাম।
    বোর্ডের ওপর শব্দ হলো— খট।
    খেলা শেষ?
    নাকি এই সবে শুরু?

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • %% | 49.206.***.*** | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৫৪736449
  • বেশ yes
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন