“Do you know or could tell me anything about Mrs Ganguly, or give me any advice? … (she) has already passed what is called the first licentiate in medicine and surgery examinations and is to go up for the final examination in March next. This young lady, Mrs. Ganguly, married! after she made up her mind to become a doctor! and has had one, if not two children since. But she was absent only thirteen days for her lying-in!! and did not miss, I believe, a single lecture!!”
“কে এই মিসেস গাঙ্গুলী, আমায় কিছু জানাতে পারো? সে নাকি এর মধ্যেই ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছে আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এই তরুণী বিয়ে করে ফেলেছে, ডাক্তার হবে ঠিক করার পরে! তার পর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যদি না দুটি জন্মে থাকে। কিন্তু ছুটি নিয়েছিল মাত্র ১৩ দিন, আর শুনছি নাকি একটাও লেকচার মিস করেনি!” (২০ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৮)
এই কথাগুলো ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্বয়ং তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, সুদূর বিদেশে বসে। আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত নাইটিঙ্গেল, যিনি দ্যা লেডি ইউথ দ্যা ল্যাম্প আখ্যা পেয়েছিলেন, আহত, পীড়িত মানুষকে যিনি দিয়েছিলেন শুশ্রূষার কালজয়ী আশ্বাস, তাঁর এই চিঠিটি এক অমূল্য দলিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আজীবন কর্মরত প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে যাঁকে ভাবা হয়, সেই কাদম্বিনী গাঙ্গুলী বিশ্বের জ্ঞানীগুণী মহলে কী বিশাল বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন এই চিঠিটিতে তার নিদর্শন রয়েছে।
কাদম্বিনীর মুকুটে রয়েছে অনেকবার “প্রথম” হওয়ার গৌরব, যেমন -
হীরকখণ্ডের মত ছিল কাদম্বিনীর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। প্রতিভা, অপরিসীম সাহস ও আত্মশক্তির বলে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন অত্যন্ত সফল মহিলা চিকিৎসকরূপে, অসংখ্য প্রতিবন্ধকতাকে নির্ভয়ে জয় করে রেখেছিলেন অতুলনীয় কীর্ত্তির স্বাক্ষর। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী (জন্ম ১৮ জুলাই, ১৮৬১ - মৃত্যু ৩ অক্টোবর, ১৯২৩) তাঁর সময়ের থেকে তো বটেই, সম্ভবত বর্তমান শতাব্দীর থেকেও এগিয়ে থাকা একজন আশ্চর্য মানুষ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে যিনি নিজের আসনটি অর্জন করে নিয়েছিলেন মেধা, আত্মবিশ্বাস ও অপরাজেয় মনোভাবের শক্তিতে।
১৮৬১ সালে জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকারের। আর এই বছরেই জন্ম কাদম্বিনী বসুরও, ১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই বিহারের ভাগলপুরে (মতান্তরে পরিবারের আদি বাসস্থান বরিশালের চাঁদসীতে)। ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক তাঁর পিতা ব্রজকিশোর বসু ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ও অভয়চরণ মল্লিক ভাগলপুরে মহিলাদের অধিকারের আন্দোলন করেছিলেন এবং প্রথম ভারতীয় মহিলা সংগঠন ভাগলপুর মহিলা সমিতি স্থাপন করেছিলেন ১৮৬৩ সালে। ব্রাহ্ম সমাজের অনুপ্রেরণাতেই কাদম্বনীর বাবা ব্রজকিশোর বসু মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে উদ্যোগী হন। কাদম্বিনীর শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার ইডেন মহিলা বিদ্যালয়ে।
মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে কাদম্বিনী আসেন ভাগলপুর থেকে কলকাতায়, ভর্ত্তি হন ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে’। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন Annette Susannah Akroyd Beveridge নামে একজন উচ্চশিক্ষিত ইংরেজ মহিলা, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী,দুর্গামোহন দাশ, আনন্দমোহন বসু, ভগবান চন্দ্র বসু, মনমোহন ঘোষ, অন্নদাচরণ খাস্তগীরের সহায়তায়, ১৮৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ কয়েকজন সমাজপতির ধারণা ছিল, অঙ্ক, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি কঠিন বিষয় মেয়েদের পড়ার জন্য নয়, কিন্তু এই যুক্তিহীন নীতি মানতে রাজি ছিলেন না দ্বারকানাথ প্রমুখরা। মেয়েদের যে আবাসিক বিদ্যালয় শুরু হল, সেখানে গণিত, ভূগোল, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস, গান, সেলাই ইত্যাদির সঙ্গে বিলিতি কায়দায় কাঁটা-চামচ দিয়ে খাওয়া শেখান হত ,মেয়েরা স্কুলের হিসাবপত্র রাখতে শিখত এবং তাদের রান্নাও শিখতে হত, পালা করে রান্নাঘরের ভার নিতে হত, নিয়মিত মেয়েদের বনভোজন ও ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হত। এই বহুমুখী শিক্ষা কিশোরী কাদম্বিনীর ব্যক্তিত্ব গঠনে ও পরবর্ত্তী জীবনের নানা ক্ষেত্রে খুবই কাজে লেগেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৮৮২ সালে বেথুন বিদ্যালয়ের পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে Marchioness of Ripon-কে কাদম্বিনীর হাতের তৈরী একটি সুন্দর “পেপার বাস্কেট” উপহার দেওয়া হয় (The Bethune School, Calcutta. Journal of the National Indian Association,137, May1882, 269-275)।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় প্রবল উৎসাহী ব্রাহ্ম সমাজনেতা ও অবলাবান্ধব নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক পণ্ডিত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী । এই পত্রিকাটির উদ্দেশ্য ছিল, বিভিন্ন নারীবিরোধী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, Historian David Kopf-এর মতে - “this was the world’s first magazine that dealt with women’s issues.” Annette ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়ার পর এই বিদ্যালয়ের অগ্রগতি কমে যেতে থাকে, তবে প্রগতিশীল ব্রাহ্মরা ১৮৭৬ সালে এই বিদ্যালয়টিকে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় নামে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং স্থির করেন এন্ট্রেন্স পরীক্ষার জন্য এখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনুসরণ করা হবে। দু বছর পরে এটি যুক্ত হয় প্রায় অর্ধমৃত বেথুন স্কুলের সঙ্গে, বেথুন স্কুল নামেই পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (১লা অগাস্ট, ১৮৭৮)।
কাদম্বিনী এই বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় ও বেথুন স্কুলে পড়েছিলেন, ১৮৭৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় তিনি ও সরলা যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। কিন্তু যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার উপযুক্ত হলেন, তখন দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি অনুযায়ী মহিলারা পরীক্ষায় বসতে পারেন না (অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজের নিয়মকে অনুসরণ করে এই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল)। এই সময়ে দেরাদুন থেকে চন্দ্রমুখী বসু নামে আর একজন মহিলাও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদন করেন। দ্বারকানাথ এই মেয়েদের জন্য প্রচন্ড লড়াই করে, বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য Sir Arthur Hobhouse এর সাহায্যে পরীক্ষায় বসার অনুমতি আদায় করেন। উপাচার্য কাদম্বিনী ও সরলা দাসকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে দিতে রাজি হন এই শর্তে যে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ইংরেজীর, অধ্যাপক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসের, অধ্যাপক গ্যারেট গণিতের আর পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলার পরীক্ষা নিলেন । দু’জনেই যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং পূর্ণ গঠিত বেথুন স্কুল থেকে প্রথম বার দুটি ছাত্রী কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাসকে (ব্রাহ্মনেতা দুর্গামোহন দাসের কন্যা) ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পাঠানো হল। অধ্যাপক প্রসন্নকুমার রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার জন্য সরলা অবশ্য পরীক্ষা দিতে পারেন নি।
কাদম্বিনী প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন, মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ পান নি। চিত্রা দেব বলেছেন, এই ঘটনা সমস্ত ভারতে প্রথম ও অভূতপূর্ব। চন্দ্রমুখীকে Junior Board of Examiners “এন্ট্রান্স স্ট্যান্ডার্ড” এর উপযুক্ত বলে ঘোষণা করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্ত্তন উৎসবে উপাচার্য Sir Alexandra Arbhutnot বলেছিলেন, “I must not omit to mention a circumstance which is interesting and important, I refer to the fact of the senate having passed rules for fee examination of female candidates, under the operation of which one Hindu young lady educated at the Bethune School, passed the Entrance examination with great credit The young lady, to whom I refer, Kadambini Bose, obtained very high marks in Bengali, tolerable marks in History and even in exact science - a subject which is not usually considered to be congenial to the female intellect, she acquitted herself creditably.” (Minutes of the Calcutta University,1878-89, p110)।
এরপর শুরু হল কাদম্বিনীর একটির পর একটি বাধা অতিক্রম করে ইতিহাস নির্মাণ করার ইতিহাস। মনে রাখতে হবে, সমস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা পড়ত না। মেয়েরাও যে বিজ্ঞানসাধনা করতে পারে তার উদাহরণ সৃষ্টি করলেন কাদম্বিনী বসু । ডাক্তারি পড়ার জন্য কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে আবেদন করলেন, কিন্তু কলকাতা মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল সম্মতি দিল না। তবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁর গভীর আগ্রহে প্রভাবিত হয়ে সরকার কলকাতায় মহিলাদের একমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান বেথুন স্কুলে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাক্রম, প্রথমে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) এবং তারপর অন্যান্য স্নাতক শ্রেনী চালু করার উদ্যোগ নেয়।
শুধুমাত্র কাদম্বিনী বসুকে ছাত্রী তালিকাভুক্ত করে ১৮৭৯ সালে বেথুন কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। Sir Ashley Eden একটি বিশেষ scholarship দেন। কটক থেকে Professor Sasi Bhusan Dutt কাদম্বিনীকে দর্শনশাস্ত্র, অঙ্ক, ইতিহাস ও ইংরাজি পড়াতে আসেন। ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ কাদম্বিনীকে স্বর্ণপদক ও বই উপহার দেন। ১৮৮০ সালে কাদম্বরী বেথুন কলেজ থেকে ও চন্দ্রমুখী Free Church of Scotland College থেকে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) পাশ করেন।
১৮৮৩ সালে কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী হিসেবে কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু বিএ পরীক্ষায় অংশ নেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন (৫ ই মার্চ,১৮৮৩ সাল)। তাঁরাই ছিলেন ভারতে এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট (বিএ) কেন না, তখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের স্নাতকস্তরের পরীক্ষায় বসার অধিকার ছিল না। ব্রিটিশ মহিলারা বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকস্তরে পড়ার অনুমতি পান কাদম্বিনীদের এক বছর পর। এই অনুমতি দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিরাট প্রগতিশীল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী নারীশিক্ষার জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। সেই সময় একজন বালিকার পক্ষে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসাই স্বপ্নের অতীত, স্নাতক হওয়া তো অনেক দূরের কথা। চন্দ্রমুখী ও কাদম্বিনীর বিএ পাশ করার বিষয়ে Director of Public Instructions মন্তব্য করেছিলেন “the most notable event in the history of Female education in Bengal”.(Convocation Address,University of Calcutta, 10 March,1883)।
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অশিক্ষিতা, অবহেলিতা বাঙালী মেয়েদের দেখে সখেদে লিখেছিলেন, “হায়,হায়,ওই যায় বাঙালীর মেয়ে।” তিনি এখন এই দুজনকে স্বাগত জানিয়ে লিখলেন -
“হরিণ-নয়না শুন কাদম্বিনী বালা
শুন ওগো চন্দ্রমুখী কৌমুদীর মালা,
তোমাদের অগ্রপাঠী আমি একজন,
ওই বেশ ও উপাধি করেছি ধারণ।
যে ধিক্কারে লিখিয়াছি “বাঙালীর মেয়ে”
তারি মত সুখ আজি তোমা দোঁহে পেয়ে।
বেঁচে থাকো, সুখে থাকো, চিরসুখে আর
কে বলে বাঙালির জীবন অসার।
-------------------------
ভাসিল আনন্দ ভেলা কালের জুয়ারে,
ধন্য ধন্য বঙ্গনারী, সাবাশি তুহারে।”
স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কাদম্বিনী দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার। নারী শিক্ষার সমর্থক পিতা ব্রজকিশোর বসু সানন্দে কন্যার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ভারতীয় মহিলা চিকিৎসকদের অগ্রদূত হিসাবে আমরা জানি আনন্দীবাঈ যোশি, অ্যানি জগন্নাথন ও কাদম্বিনীর নাম, তাঁরা মেডিকেল কলেজে পড়া শুরু করেন ১৮৮৩ সালে, কিন্তু চিত্রা দেব বলেছেন, এঁদের আগে, ১৮৮২ সালে অবলা বসু ও অ্যালেন ডি আবরু মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে পড়তে যান। অবলার অবশ্য শেষ পর্যন্ত পড়া হয় নি।
১৮৮২ সাল পর্যন্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল কোন নারীকে শিক্ষালাভের অনুমতি দেন নি। আবার দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সংগ্রাম শুরু হয় এবং ১৮৮৩ সালে তিনি অসাধ্যসাধন করেন। মেডিকেল কাউন্সিলের কাছে হতাশ হয়ে ডিপি আই সরকারের কাছে জানতে চান, ডাক্তারি পড়তে ইচ্ছুক ও যোগ্য মহিলাদের কি জবাব দেওয়া হবে? ১৮৮৩ সালের ২৯শে জুন সরকারীভাবে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বাতিল করে কাদম্বিনীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হল। মেডিকেল কলেজের নিয়ম ছিল, বিএ পাশ করলেই বিনা খরচে মেডিসিন পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে, কাদম্বিনী এই সুযোগ নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করলেন প্রথম ছাত্রী হিসাবে, যুগযুগান্তের এক রুদ্ধদ্বার খুলে দিলেন নারীদের জন্য। তাঁকে মাসিক কুড়ি টাকা জলপানিও দেওয়া হয়। কাদম্বিনীর মেডিকেল কলেজে প্রবেশ করার এই ঘটনা অবশ্য সমাজের অনেকের কাছেই অসহ্য মনে হয়, নানা তিক্ত মন্তব্য ও বিরোধিতা চলতেই থাকে।
ঐ সময়ে ডাক্তারী পড়তে কলেজে ভর্ত্তি হওয়া, যে কত অনমনীয় মানসিকতা ও সাহসের পরিচয়, তা বোঝার জন্য বাবু নীলকমল মিত্রর লেখা একটি আবেদনপত্র (১৮৭৫) দেখা যাক। পত্রের প্রথমাংশে তিনি জানতে চেয়েছেন, একজন হিন্দু নারী যদি মেডিকেল কলেজে পড়ার যোগ্য হয়, তবে সে ঐ কলেজের বাংলা ক্লাশে যোগ দিয়ে ডিপ্লোমা পেতে পারে কিনা, সে অবশ্য সরকারের কাছে কোন চাকরি চাইবে না। আবেদন মঞ্জুর হলে তিনি তাঁর পনের বছরের দৌহিত্রীকে পড়াবেন। তবে হিন্দু সমাজের কিছু রীতিনীতি মেনে তাকে পড়তে বা পড়াতে হবে। মেয়েটি ঘরে বসে Anatomy, Surgery, Materia Medica, Midwifery, Chemistry, Botany ইত্যাদি পড়বে, মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তার স্বামীর কাছে, পর্দানশীন মেয়েটির জন্য কলেজে পর্দাঘেরা আসনের ব্যবস্থা করতে হবে, শব ব্যবচ্ছেদের সময় মেয়েটির স্বামী বা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ নীলকমল মিত্র নিজে উপস্থিত থাকবেন। সেই সময়ে মেডিকেল বোর্ড কিন্তু এই চিঠিটি অগ্রাহ্য করেন নি, অধিকাংশ দাবিই মেনে নিয়েছিলেন। মেয়েটির অবশ্য ডাক্তারি পড়া হয় নি।
অন্যদিকে ইন্ডিয়ান মেডিকেল গেজেট ১৮৭৫ সালে লিখেছিল, "...female doctors are really demanded by the people of India is a pure assumption to start with; that females of any kind are fit to be doctors is a very doubtful point."
---- "It is doubtful, in the highest degree, whether the smattering of knowledge and soupgon of experience which these women thus obtain in a few months really fit them for what they pretend to be, and what they are declared competent to be, by authority."
এই লেখার আট বছর পর হলেও কাদম্বিনীর মেডিকেল কলেজে পড়া নিয়ে সমাজে ভয়ংকর সমালোচনা হয়েছিল, অদ্ভুত বিরোধিতা ছিল ডাক্তারদের মধ্যেও। ১৮৮৩ সালের ২রা জুলাই আনন্দবাজার (অমৃতবাজার বলেছেন কেউ) পত্রিকায় মেডিকেল কলেজে পুরুষ ছাত্রদের সঙ্গে মহিলা ছাত্রীদের একত্র অধ্যয়নে কি কি অসুবিধা তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়, যার মধ্যে মোক্ষম অস্ত্র ছিল, “আরও অন্যান্য আপত্তির মধ্যে উক্ত কলেজের একদল ছাত্র বলেন যে ,নিয়ম আছে, সমস্ত বক্তৃ্তাতে উপস্থিত না থাকিলে পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। এবং যদি এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে যদি কোন রমণীর গর্ভ হয়, তবে প্রসবকালীন তিনি কি করিয়া বক্তৃ্তায় উপস্থিত থাকিবেন? আপত্তি কয়েকটি যুক্তিসঙ্গত।” তবে কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় কোন অশালীন ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছিলেন বলে জানা যায় না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত গম্ভীর ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী।
কোন অজ্ঞাত কারণে শিক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র আগাগোড়াই মেডিকেল কলেজে কাদম্বিনীর (বা নারীদের) শিক্ষালাভের ভয়ংকর বিরোধিতা করেছিলেন, তিন বছরের শেষে প্রথম পরীক্ষায় তাঁর কাছে Materia Medica and Comparative Anatomy পেপারে (নারায়ণ দত্তের মতে ও ডি পি আই রিপোর্ট অনুযায়ী মেডিসিনে) মাত্র ১ নম্বরের জন্য ফেল হলেন কাদম্বিনী। Science and Culture এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বি কে সেন বলছেন, “This prevented her from getting the certificate of the first MB examination held in 1888. As a result, she got only the certificate of First LMS examination from CU.” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Minutes, 1886-87 এ লেখা হয়েছিল “First MB result was accepted by University as equivalent of a pass in the First LMS examination.”
এমবি (ব্যাচেলর অফ মেডিসিন) পড়া সম্ভব হল না, কিন্তু সেনেট ‘লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ পড়ার অনুমতি দিল। আশ্চর্য এই যে, দু’বছর পর ফাইনাল পরীক্ষায় আবারও একই পরীক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র ফেল করালেন। সেনেটের অনুরোধে পুনর্মূল্যায়ন করা হল, তাতেও পাশ করালেন না। কাদম্বিনীর উপর সাংঘাতিক অবিচার হচ্ছে, তা অধ্যক্ষ সহ অনেকে বুঝেছিলেন, কিন্তু রাজেন্দ্রচন্দ্রর সমর্থক কম ছিল না। ভারতবাসী পত্রিকা লিখেছিল, “The Bharatbasi of the 28th August cannot approve the action of the syndicate of Calcutta University in passing, by an extension of grace, Mrs. Ganguli, the first female medical student in Bengal for special reasons. As far as the writer is aware she has been passed only because she is a female. Such grace is not shown to male students.”
অবশেষে, অধ্যক্ষ ডঃ কোটস তাঁর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অব দ্য মেডিকেল কলেজ অব বেঙ্গল’ উপাধি (ডিপ্লোমা বলা হয়েছে কয়েক জায়গায়) দিলেন । কাদম্বিনী ডাক্তারি প্র্যাকটিস করার পূর্ণ অধিকার পেলেন। ১৮৮৭ সালের কনভোকেশনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর উচ্চ প্রশংসা করেন -
“Another example on the side of progress is the noble organisation set on foot by the greatest lady in the land, to bring female medical aid within the reach of India. That movement is calling into existence a body of highly trained women, devoted to one of the most sacred of human employments.”
তিনি ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়াতে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রথম দুজন মহিলা চিকিৎসকের একজন। অন্যজন ডাঃ আনন্দী গোপাল যোশী, উইমেন'স মেডিকেল কলেজ অব পেনসিলভ্যানিয়া থেকে তিনি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ এমডি ডিগ্রী লাভ করেন। ডিগ্রী লাভের পর কোলাপুর রাজ্যের কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ পেলে আনন্দী দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পরে অসুস্থ অবস্থায় বোম্বাই ফিরে এসে হাসপাতালে কাজে যোগদান করেন, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই পুনরায় অসুস্থ হয়ে তিনি কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে ভর্তি হন। কালাপানি পেরিয়ে আসা জাতিচ্যুত আনন্দীকে তাঁর সহকর্মী এবং অন্যন্য চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন। প্রায় বিনা চিকিৎসায় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী রাত দশটায় আনন্দীবাঈয়ের মৃত্যু হয়।
মেডিকেল কলেজে নাম registration করার এগারো দিন আগে (১২ই জানুয়ারী, ১৮৮৩) কাদম্বিনী তাঁর শিক্ষক, বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও মানবদরদী সাংবাদিক, বিপত্নীক, উনচল্লিশ বছর বয়ষ্ক, দুই সন্তানের পিতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিবাহ করেন। দ্বারকানাথের পুত্র সতীশচন্দ্র ছিলেন মানসিক প্রতিবন্ধী (কেউ বলেছেন রিকেটগ্রস্ত) কাদম্বিনীর গভীর স্নেহে তাঁর পরিচর্যার সমস্ত ভার নিয়েছিলেন। “আসামের চা কুলি ও দ্বারকানাথ” বইতে অমর দত্ত লিখেছেন “কাদম্বিনী বসু কর্ত্তৃক দ্বারকানাথকে বিবাহের জন্য নির্বাচন নারীজাতির হৃদয়ের পুষ্পাঞ্জলি বলে অভিহিত করা অযৌক্তিক হবে না।” দ্বারকানাথ নিজে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন নি, কিন্তু তিনিই বাংলার নারী-শিক্ষার জন্যে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা এবং জ্ঞানার্জনে নারী-পুরুষের সমাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও দৃঢ় অবস্থানের জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার ও প্রথম ডাক্তার হবার সুযোগ মেলে কাদম্বিনীর, অন্য নারীদেরও উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয় তখনই।
অথচ, যেহেতু সেই সময় বিয়ের পরে মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারতেন না, অনেক নিকটজন এমন কি অনেক ব্রাহ্ম নেতাও এই বিয়ে মেনে নিতে পারেন নি। হিতৈষীরা ভেবেছিলেন, কাদম্বিনীর মত অসাধারণ মেধাবী ও দৃঢ়চেতা নারীর পড়াশোনা এখানেই শেষ হবে যেমন হয়েছিল দুর্গামোহনের দুই কন্যা, সরলা ও অবলা দাশের। রাগ করে এই বিয়েতে তাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী পর্যন্ত আসেন নি।
এই বিবাহ উপলক্ষে “Rayes and Ryot” পত্রিকার সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখেন, "A famous girl of the period Miss Kadambini has, for a being (sic?) of light and leading who was to revolutionize our society by her example suddenly married (sic?) to-beneath hear-it is said, but that is her affair and of the disappointed lovers. We can appreciate better the opposition of her friends to the match-an opposition which had nearly caused another schism in the continually divided Brahmo community"।
সবচেয়ে মজার কথা এই যে, শম্ভুচন্দ্রই আবার নববধূর রূপের প্রশংসা করে একটি সনেট লেখেন, যার প্রথম কয়েকটি পংক্তি এই রকম -
“She was phantom of delight
When first she gleaned upon my sight,
A lovely apparition sent
To be a moment’s ornament
Her eyes as stare of
Twilight fair”
পন্ডিত রামকুমার বিদ্যারত্ন, দুর্গামোহন দাশ প্রমুখের উপস্থিতিতে Act 111, 1872 অনুযায়ী ব্রাহ্ম পদ্ধতিতে সম্পন্ন এই বিবাহ অনুষ্ঠানে বহু ভারতীয় ও ইয়োরোপীয় অতিথি এসেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী দেবে, প্রেম, নির্ভরতা ও পারষ্পরিক সম্মানবোধের ভিত্তিতে এই দম্পতির জীবন পরিপূর্ণ, সার্থক ও কল্যাণময় হয়ে উঠেছিল। কাদম্বিনীর সংগ্রাম ও প্রতিষ্ঠালাভের জন্য তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা, দৃঢ়তা, পরিশ্রম, মেধা ও ক্ষমতার সঙ্গে স্বামীর অকুন্ঠ সহযোগিতারও অত্যন্ত মূল্যবান ভূমিকা ছিল ।
মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পর, সমাজের বিভিন্ন অংশের মহিলাদের চিকিৎসা করার সুযোগ পাবেন মনে করে কাদম্বিনী প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। Bengalee পত্রিকায় প্রায় এক বছর ধরে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বিজ্ঞাপনটি ছিল এইরকম -
"Mrs. Ganguly B.A. (45/5 Beniatola Lane, College Square, North East Comer, Calcutta). Having studied in the Medical College for five years and obtained a college diploma to practice MEDICINE, SURGERY AND MIDWIFERY has commenced practice and treats WOMEN AND CHILDREN. Consultation free for poor patients at her home between 2 and 3 daily."
তিন বছরের মধ্যেই তিনি ঠিকানা পরিবর্তন করেন, পরের বিজ্ঞাপন ছিল -
"Mrs. Ganguly B.A. GMCB Medical Practitioner Can be consulted at her residence 57, Sukia Street, Calcutta, where she has now removed, terms moderate."
কেবলমাত্র মহিলা রোগীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ডাফরিন হাসপাতালে কাদম্বিনী ৩০০ টাকা মাসিক বেতনে যোগ দেন, তখনকার হিসেবে যা ছিল বেশ উচ্চ বেতন। ডাফরিন হাসপাতালে কাজ পেতে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অনেক সাহায্য করেছিলেন। তিনি 1888 সালে বন্ধু Mary Scharlieb কে লেখেন “Mrs. Gangooly is, I believe, a woman of high caste and cultivation and it would be great encouragement to the Hindoo ladies to embrace medicine, if she was appointed. (Women in South Asia Published on the Occasion of One Hundred and Fifty Years of Bethune School Bethune Praktani Samlty, Calcutta, 2001. P. 133.)
একজন দৃঢ়চেতা বাঙালী নারী, যিনি নিজের সাহস ও আত্মবিশ্বাসের বলে ঊনবিংশ শতাব্দীর রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামীর বাধা ভেঙে স্বাধীনভাবে মানবসেবায় যোগ দিয়েছিলেন, অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তাঁকে ফ্লোরেন্স জানিয়েছিলেন অকুন্ঠ সম্মান।
কিন্তু এখানেও তিনি জাতি-বৈষম্যের শিকার হলেন। মেমসাহেব ডাক্তাররা কাদম্বিনীকে রোগীদের সরাসরি চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে, অন্য ধরনের কাজ করিয়ে নিত।
অন্যদিকে, গোঁড়া হিন্দুরা তাঁর ডাক্তার হওয়াটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখে নি, সমাজছাড়া জীব হিসেবে তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মস্করা, এমনকি চরিত্রহনন শুরু হয়। তখনকার ‘বঙ্গবাসী’ গোষ্ঠীর ‘বঙ্গবানিবাসী’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল একটি কার্টুন (বারবণিতা ডাঃ কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাক ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন) ছেপে কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’র সঙ্গে তুলনা করেন, কারণ কাদম্বিনীর সংসারের দিকে মনোযোগ নেই, তিনি নাকি আদৌ সন্তানবৎসল নন, সর্বদাই তিনি চিকিৎসা, সমাজ ও দেশের সেবা, সভাসমিতি করে বেড়ান। দ্বারকানাথ অবিলম্বে পত্রিকা অফিসে হাজির হয়ে সম্পাদককে কার্টুনটি জল দিয়ে গিলে খেতে বাধ্য করেন ও আদালতে মামলা করেন। সম্পাদকের ১০০ টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হয়। এক নারীর সম্মানরক্ষার্থে তাঁর স্বামীর করা ১৮৯১ সালের এই মামলাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ।
বলা বাহুল্য, বিষাক্ত বাউন্সারের সেই শুরু, দাম্পত্যজীবনের পিচে উল্টোদিকের ব্যাটসম্যান সহযোগী হলেও কাদম্বিনীর ইনিংস ছিল অতি কঠিন, কিন্তু প্রতিটি সংকট মুহূর্তে সহযোদ্ধা হয়েছিলেন তাঁর স্বামী। কাদম্বিনীর জীবনে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর প্রভাব সুগভীর ও সুবিস্তৃত - একাধারে তাঁর শিক্ষক ও জীবনসঙ্গী নিজের জীবনবোধ ও আদর্শের নিরিখে গড়ে তুলেছিলেন কাদম্বিনীকে, স্বেচ্ছায় সংসারের দায়িত্ব সামলেছিলেন। পাশে শোয়ানো রয়েছে সদ্যোজাত সন্তান, লন্ঠনের আলোয় পড়ে চলেছে মেয়েটি, রান্নাঘরে বিধবা অগ্রজার জন্য নিরামিষ ব্যঞ্জন তৈরী করছেন মেয়েটির স্বামী, এ ছিল দৈনন্দিন চিত্র । তাঁরা দুর্গম পথে প্রেমের নিশান উড়িয়েছিলেন, দুঃসহতম কাজকে ভয় পান নি। সে সময়ে মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের বিরুদ্ধে অজস্র কুযুক্তি খাড়া করা হত, এই দম্পতি তার বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা চিরকাল অমর হয়ে থাকা উচিত।
এত কিছুর পরেও কিন্তু লোকের মন থেকে তাঁর দক্ষতার ব্যাপারে ভুল ধারণা ভাঙা যাচ্ছিল না। কাদম্বিনী বুঝতে পারেন, বিলিতি ডিগ্রি নাহলে এইসব বাধা বা দ্বিধা দূর করা যাবে না। দ্বারকানাথের অতুলনীয় উৎসাহ, প্রেরণা ও সহায়তায় এক বছর বয়সের কনিষ্ঠ পুত্রসহ পাঁচটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে স্বামী এবং সৎ কন্যা বিধুমুখীর তত্ত্বাবধানে রেখে এক রবিবারের সন্ধ্যায় (২৬ শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৯৩) তারিখে কাদম্বিনী জাহাজে বিলেত যাত্রা করেন। (পুণ্যলতা লিখেছেন, বিধুমুখীর সঙ্গে কাদম্বিনীর সম্পর্ক এত সুন্দর ছিল, যে তাঁর সন্তানরা অনেকদিন পর্যন্ত জানতেন না যে কাদম্বিনী তাঁদের নিজের দিদিমা নন।) জাহাজে কাদম্বিনী মিস প্যাশ নাম্নী এক মহিলার সহকারিণী রূপে উঠেছিলেন, যে জন্য কেউ কেউ ব্যঙ্গ করেন, কিন্তু যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এইসব হীনতা অনায়াসে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তা ভাবলে শ্রদ্ধা হয়।
নারায়ণ দত্তর লেখা “কাদম্বিনী ও তাঁর বিলিতি ডিগ্রি” (দেশ, ১৪ই মার্চ, ১৯৮৭) প্রবন্ধ অনুযায়ী ঐ সময় আমেরিকা আবিষ্কারের ৪০০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে শিকাগোতে এক বিশাল শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন হচ্ছিল। কাদম্বিনী জাহাজের ভাড়া জোগাড় করার জন্য এই সুযোগ কাজে লাগান। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি নানা শিল্পদ্রব্য (ত্রিপুরার হস্তশিল্প, আসামের মেখলা, ঘাগরা, শাল ইত্যাদি, কাত্যায়নী বিশ্বাস নাম্নী এক মহিলার হাতের কাজ করা কাঁথা, সোনার জরি বসানো শাড়ি, কাজ করা রুমাল, কলকাতার বাঁশের তৈরী নানা জিনিস, হাতের কাজ করা শাড়ি ইত্যাদি) সংগ্রহ করেন ও লন্ডনে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের কাছে জমা করেন, শিকাগো পাঠানোর উদ্দেশ্যে। বামাবোধিনী পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, রাজপরিবারের মহিলারা এই শিল্পদ্রব্যগুলি দেখে খুবই প্রশংসা করেন ও শিকাগো পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
লন্ডন পৌঁছনোর কুড়ি দিনের মধ্যে কাদম্বিনী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরত্তির জন্য আবেদনপত্র জমা দেন ও তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা 35, Blackfield road, Mydavelle, London থেকে ক্লাশ করা শুরু করেন। তিনি পরতেন শাড়ি, ফুলহাতা ব্লাউজ, স্কার্টব্লাউজ, নয়। সেই সময় বিলেতের বুকে বিলিতি পোশাককে অগ্রাহ্য করে ভারতীয় পোশাকে ক্লাস করাটা কত কঠিন ছিল, সেটা আজ হয়তো বোঝা সম্ভব নয়।
অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তিনটি উপাধি লাভ করেন, Licentiate of the College of Physicians, Edinburg (LRCP); Licentiate of the College of Surgeons, Glasgow (LRCS); and, Licentiate of the Faculty of Physicians and Surgeons, Dublin (LFPS).
নাতনী পুণ্যলতা লিখেছেন বিদেশ প্রত্যাগত কাদম্বিনীকে নিয়ে পারিবারিক উৎসবের কথা, শিশুপুত্রটি কাছে আসছে না দেখে কাদম্বিনীর মন খারাপের কথাও।
এখন তিনি হলেন বিলিতি ডিগ্রিধারী প্রথম ভারতীয় পেশাদার মহিলা ডাক্তার।
ডাফরিন হাসপাতালে এবার তিনি পেলেন সিনিয়র ডাক্তারের পদ, এক বছরের মধ্যে পান ইডেন ফিমেল হাসপাতালে ডক্টর ইন চার্জের পদ। কর্ত্তৃপক্ষ আর তাঁকে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। পারিজাত ভট্টাচার্য লিখেছেন, ১৮৯৪ সালে নিয়ম পরিবর্তন করে তাঁকে দেয়া হয় Campbell Medical School (R.G. Kar Medical College) এ Professor of Gynaecology & Obstetrics(Midwifery)-র পদ। তিনি হলেন চিকিৎসাবিদ্যায় প্রথম ভারতীয় মহিলা অধ্যাপিকা।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর নিজস্ব প্রাকটিস এত জমে ওঠে যে তিনি হাসপাতালের কাজ ছেড়ে দেন। তখন দেশীয় মহিলা ডাক্তারের অসম্ভব প্রয়োজন ছিল, তাই ভারতে ফেরার পর কাদম্বিনীকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নীলরতন সরকার, জে এন মিশ্র, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য ইত্যাদি সুবিখ্যাত চিকিৎসকদের সঙ্গে তখন তাঁর নাম উচ্চারিত হত। তাঁর খ্যাতির জন্য তিনি ১৮৯৫ সালে সুদূর নেপাল থেকে ডাক পান রাজমাতার চিকিৎসার জন্য, নেপালে একমাস থেকে তিনি রাজমাতাকে সুস্থ করে তোলেন। দীর্ঘ দিন নেপালের রাজপরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর, কৃতজ্ঞ রাজপরিবার থেকে পেয়েছিলেন প্রচুর উপহার - সোনা ও মুক্তার গয়না, রূপার বাসন, বহুমূল্য পোশাক, হাতির দাঁত, একটা সাদা গোলগাল ছোট্ট টাট্টু ঘোড়া, রায় ও গাঙ্গুলী পরিবারের বাচ্চারা মহানন্দে তার পিঠে চড়ত আর দেড় বছরের ছেলে প্রভাতচন্দ্রের জন্য রাজপোশাকের খুদে সংস্করণ ইত্যাদি। কিন্তু এও শোনা যায়, যশ ও খ্যাতির শিখরে থাকা কাদম্বিনী ও তাঁর ধাত্রী নগেন্দ্রবালাকে কলকাতার কোন বনেদী ঘরে জটিল প্রসব করানোর পর বারান্দায়, কলাপাতায় খেতে দেওয়া হয়, বলা হয় “দাইরা” যেন খেয়ে উঠে পাতা তুলে ফেলে দেয়, দাসীরা ওতে হাত দেবে না। একবার কারো মুখে “ধাইমানি” - এই সম্বোধন শুনে পুত্রবধূ সরলা কেঁদে ফেলেছিলেন, কাদম্বিনী অবিচলিতভাবে তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, “কেঁদো না বউমা, এ সব কথায় মনে করতে গেলে কি আমাদের চলে?”
বিশেষ স্নেহাষ্পদ নাতি সুকুমারের সন্তান সত্যজিৎ জন্মায় তাঁর তত্ত্বাবধানে, ১৯২১ সালের ২রা মে।
ডাক্তারির পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজে ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতেও দেখা গেছে তাঁকে সারা জীবন। তিনি কখনো ভুলে যাননি সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্বের কথা।
১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বারকানাথ কংগ্রেসে নারীদের প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলেন, ফলে কাদম্বিনীর নেতৃত্বে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ৬ জন নারী কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী ও তাঁর কন্যা সরলা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে কাদম্বিনী ইংরাজীতে ধন্যবাদ (Vote of Thanks) দেন। কাদম্বিনী-ই কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম কোনো নারী বক্তা। মাতৃভাষার মতো স্বচ্ছন্দে ও নিখুঁত উচ্চারণে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য সকলের মনে দাগ কেটেছিল। রাজনীতি ও নারী আন্দোলনের নেত্রী আনি বেসান্তের মতে, “The first woman who spoke from the Congress platform, is a symbol that India’s freedom would uplift India’s womanhood.”
১৯০৬ সালে কলকাতায় মহিলাদের কনফারেন্সের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তখনকার দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ছিলো প্রবল জাতিবিদ্বেষী। সেখানকার ট্রান্সভালের কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে কলকাতায় সভার আয়োজনের প্রধান হোতা ছিলেন কাদম্বিনী। শুধু তাই নয়, গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সাহায্যের জন্যে কলকাতায় যে সভার আয়োজন করা হয় সেই সভার সংগঠক ও প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯১৪ সালে গান্ধীজীর কলকাতায় আসা উপলক্ষে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের যে সভা হয় সেই সভায় সভা পরিচালনা করেন কাদম্বিনীই।
সেই সময় আসামের চা-বাগানগুলিতে বাগিচা-শ্রমিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতো ইংরেজ বাগান-মালিকরা। দ্বারকানাথ আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির তীব্র নিন্দা করেছিলেন - স্বামীর সঙ্গে কাদম্বিনীও এই ব্যাপারে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন খনিতে কর্মরত নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যহানি ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এই বিষয়ে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্যে পরামর্শ দেন এই দম্পতি। ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচারের খবর দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা সঞ্জীবনীতে প্রকাশিত হয় এবং এর ফলে গণসচেতনতার মাধ্যমে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯২২ সালে সরকার বিহার ও ওড়িশার খনিগুলিতে কর্মরত মহিলা শ্রমিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগ করে। এই কমিটির সদস্যা হিসেবে কাদম্বিনী মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখার জন্যে বিহার ও ওড়িশায় যান।
তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে কাদম্বিনী বুঝেছিলেন, কর্মরতা মায়েদে্র সমস্যা, তিনি কলকাতা কর্পোরেশনে আবেদন করেছিলেন ক্রেশ খোলার জন্য, ভাবলে এই মহিয়সীর জন্য সমীহ জাগে।
কাদম্বিনী-দ্বারকানাথ দম্পতি ও রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ সমসাময়িক ছিলেন। এঁদের মধ্যে কি যোগাযোগ হত? লীলা মজুমদার লিখেছেন কাদম্বিনী-দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী পরিবার কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের বিখ্যাত ১৩নং বাড়ির (প্রকান্ড তিনতলা লালচে রঙের দালান) তিনতলায় থাকতেন, দোতলায় থাকতেন জামাতা উপেন্দ্রকিশোরের পরিবার। এর পাশে ছিল বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউসন ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দির ঠিক বিপরীতে। এই মন্দিরে যাতায়াত ছিল রবীন্দ্রনাথ ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা ছিলেন কাদম্বিনীর ঘনিষ্ঠ, কংগ্রেসের ও নারীকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজে প্রায়-ই দুজনে মিলিত হতেন। সেই সময়ের দুই বিখ্যাত পরিবারের, রায় পরিবার ও গাঙ্গুলী পরিবারের মধ্যে ছিল বহুদিনের মিত্রতা। তারই ফলশ্রুতি উপেন্দ্রকিশোর ও দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ। এর পর কি হ’ল তা লীলা মজুমদার এইভাবে বলেছেন – “উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মকন্যাকে বিয়ে করেছেন এবং নিজেও ব্রাহ্মমতে দীক্ষা নিয়েছেন শুনে সারদারঞ্জন খুবই রুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, “ওর বাড়ি থেকে একটুকরো কাগজও যেন কখনো এ বাড়িতে না আসে”। স্বাতী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “শোনা যায়, দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর ছয় নম্বর গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়িটির ছাদে রবীন্দ্রনাথ মাঘোৎসবের গান শেখাতে আসতেন, গান গলায় তুলে নিতে আসতেন যে যুবকরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্র দত্ত, বেহালা হাতে বসতেন উপেন্দ্রকিশোর।” সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা প্রথম সারির, তাঁরা সকলেই পরিচিত ছিলেন গাঙ্গুলী পরিবারের সঙ্গে ।
তাঁর নাতনী পুণ্যলতা চক্রবর্তীর লেখায় পাওয়া যায় এক ঘরোয়া কাদম্বিনীকে - “একদিকে খুব সাহসী আর তেজস্বিনী অন্যদিকে ভারী আমুদে মানুষ… মাতৃভাষার মত অনর্গল ইংরেজি বলতে পারতেন। তখনকার সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশনের শাড়ি, জামা, জুতো পরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতেন… একটুও সময় তিনি নষ্ট করতেন না।… যখন যেখানে বসতেন হাসি গল্পে একেবারে মাতিয়ে তুলতেন। সঙ্গে সঙ্গে হাতও চলত। আমরা হাঁ করে তাঁর গল্প শুনতাম আর সুন্দর আঙুলগুলির খেলা দেখতাম। কী অদ্ভুত তাড়াতাড়ি কী সুন্দর সুক্ষ্ম লেস বোনা হচ্ছে!” ফিটন চেপে তিনি রোগী দেখতে যেতেন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, যাতায়াতের সময়টুকুও নষ্ট না করে কুরুশ-কাঠিতে অপূর্ব কাজের লেস বুনতেন ।
লীলা মজুমদার “উপেন্দ্রকিশোর” বইতে লিখেছেন, “সাজসজ্জাতেও কাদম্বিনী ছিলেন তখনকার আধুনিকা। তখনকার মহিলারা কৃত্রিম কিছু ব্যবহার করতেন না কিন্তু ভারতের ভিক্টোরীয় যুগের এই আধুনিকা মহিলার চালচলন সাজসজ্জাতে ভারি একটা সম্ভ্রান্ত রুচির সঙ্গে গাম্ভীর্যের মিশ্রন ছিল। অনেকটা পারসি মেয়েদের মত করে কাপড় পরে বাঁ কাঁধে সোনার সেফটিপিন লাগাতেন।মাথায় তিনকোনা ভেল পরতেন, দুটি খুদে খুদে ব্রুচ দিয়ে আটকে, কনুই পর্যন্ত লম্বা জামার হাত থেকে চার ইঞ্চি চওড়া লেসের ঝালর ঝুলত, পায়ে থাকত কালো মোজা আর ছোট্ট একটুখানি গোড়ালি তোলা বন্ধ জুতো। উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের ওপর তাঁর যে একটা গভীর প্রভাব থাকবে, এ ত বলাই বাহুল্য।” তিনিই ১৯২০ সালে লেখেন, “তাঁর (কাদম্বিনীর) জীবনটাই এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার (উপেন্দ্রকিশোরের স্ত্রী, দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখী) চাইতে সামান্য বড় ছিলেন। দেখে মনে হত অনেক ছোট। মস্ত দশাসই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রং, থান পরে এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না তবে কেমন একটু কড়া ধরণের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম, তিনিও কাছে ডাকতেন না।”
১৮৯৮ সালের ২৭শে জুন মৃত্যু হয় দ্বারকানাথের, সেই বেথুন স্কুলে পড়ার সময় থেকে যিনি প্রতি মুহূর্ত্তে কাদম্বিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন, পায়ের জমি শক্ত করেছেন, প্রয়োজনমত দশভুজা স্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন, তিনি কাদম্বিনীকে একা রেখে অনন্তের পথে যাত্রা করলেন। এই মহাবিচ্ছেদের পরেও প্রায় চব্বিশ বছর কাদম্বিনী ঘরে ও বাইরে তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখেন। আটটি (কেউ বলেছেন ন’টি) ছেলেমেয়ের প্রত্যেককে কৃতী মানুষ করে তোলেন, তাদের বিয়ে দেন, নাতি ও নাতনীদের নিয়ে তাঁর বিশাল সংসার ছিল জমজমাট।
জীবনের শেষ দিকে উচ্চরক্তচাপের কারণে রোগী দেখা অনেক কমিয়ে দিলেও মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন। সেইদিন সকালেও তিনি একটা জটিল অপারেশন করেন। নারায়ণ দত্ত লিখেছেন, বাড়ি ফিরে পুত্রবধূকে বলেছিলেন “বউমা, লোকে বলতে শুরু করেছে, ডাক্তার গাঙ্গুলী নাকি বুড়ো হয়ে গেছেন, তাঁর হাত আর আগের মত চলে না। আজ যে অপারেশন করে এলাম, সে্টা দেখলে তারা আর এ কথা বলতে সাহস করবে না।” স্বাতী ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিনি বলেন “আমার আজ উড়তে ইচ্ছে করছে।” এর পর সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়, মারা যান ডাক্তার আসার আগেই। হাতব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল সে দিনের ফি ৫০ টাকা।
কাদম্বিনীর মৃত্যু ঠিক কাদম্বিনীরই উপযুক্ত।
বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ David Kopf লিখেছেন, "Ganguli's wife, Kadambini, was appropriately enough the most accomplished and liberated Brahmo woman of her time. ---- Her ability to rise above circumstances and to realize her potential as a human being made her a prize attraction to Sadharan Brahmos dedicated ideologically to the liberation of Bengal's women." (David Kopf History at Minnesota. Regents of the University of Minnesota, Source Wikipedia)।
প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা হবে এটাই প্রত্যাশিত। কয়েকটি বইয়ের নাম -
* মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডক্টরাল গবেষণা, "কাদম্বিনী গাঙ্গুলী: দি আর্কিটাইপাল উওম্যান অব নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল" (দ্য উইমেন প্রেস, ২০১১)। খবরের কাগজ, সরকারি বিজ্ঞপ্তি, চিঠিপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে কাদম্বিনীকে তাঁর সমকালীন সমাজের পৃষ্ঠপটে দেখাবার চেষ্টা করেছেন লেখিকা। একটি তথ্য খুব কৌতুহল জাগায় - ১৮৮০ র দশকে কাদম্বিনীকে কেন্দ্র করে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা নিয়ে বিশাল আলোড়ন হল, অথচ ১৮৭১ সালের সালতামামিতে কলকাতায় ২৯০ জন মহিলা কবিরাজ আর ২১৫ জন মহিলা হাকিমের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। তা হলে কি পর্দা থেকে বেরোনর ব্যাপারটাই বেশি আপত্তির ছিল?
* নারায়ণ দত্ত কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথকে নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করছেন, তাঁর লেখা বই ও প্রবন্ধ সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন অনেক গবেষক। "ঝড়ের মেয়ে কাদম্বিনী" (সূত্রধর) বইটি কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা - কাদম্বিনীর একটি সংক্ষিপ্ত, সহজ জীবনী। তাঁর “অবলাবান্ধব - দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী” প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে, অমৃত পত্রিকায়।
* বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন মালবিকা কার্লেকর - বিশেষ উল্লেখযোগ্য Voices from Within: Early Personal Narratives of Bengali Women (Women's Studies) 1991 by Oxford University Press, USA।
* "কালজয়ী কাদম্বিনী" (পারুল প্রকাশনী) বইটির লেখিকা সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
* "Kadambini Ganguly - Portrait of a doctor at dawn" লিখেছেন সোমা বসু (রূপালী)
* স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর লেখার সূত্র হিসাবে উল্লেখ করেছেন বরুণ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রবুদ্ধ চট্টোপাধ্যায় লিখিত বই "দায়বদ্ধ দাম্পত্য: কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ" (ছাপাখানা)। আনন্দবাজার পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী পাঁচশো পাতার এই বইটিতে বিদেশের পত্র-পত্রিকা, নথিপত্র থেকে কাদম্বিনীর চিকিৎসক-জীবন এবং দ্বারকানাথের সমাজ আন্দোলনের জীবন বিষয়ে নানা তথ্য আহরণ করা হয়েছে, আছে অদেখা কিছু ছবিও ।
* "Rays before Satyajit" বইটির লেখক Chandak Sengupta লিখছেন “Barun Chattopadhyay, who is himself working on a comprehensive biography of Dwarakanath and Kadambini Ganguly led me to sources and issues that were new to me, providing me with beautifully scanned copies of innumerable essential but scarce documents.”
* বহু মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ বই - চিত্রা দেব, মহিলা ডাক্তার: ভিন গ্রহের বাসিন্দা (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৭)।
* নান্দীকার গোষ্ঠী মঞ্চস্থ করেছেন একটি নাটক “রাণী কাদম্বিনী”।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ঊনবিংশ, বিংশ এমন কী একবিংশ শতাব্দীর নিরিখে ও একজন আশ্চর্য মানুষ, যাঁকে কোন মানদন্ডেই সম্পূর্ণ মাপা যায় না। তাঁর জীবনের যত ছবি পাওয়া গেছে, তা একটি অ্যালবামে সাজালে দেখা যাবে, কোন ছবিতে তিনি দৃপ্ত ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন গ্রাজুয়েট অফ দ্য মেডিকেল কলেজ অফ বেঙ্গল ডিগ্রি নিয়ে, মাত্র একটি নম্বরের জন্য ফেল করানোর ঘৃণ্যতাকে পরোয়া না করে নিয়ে আসছেন তিন তিনটি বিদেশী ডিগ্রী, যে শহরে প্রথমদিকে তিনি ডাক্তার হিসেবে গুরুত্ব পান নি, সেখানেই প্রবল প্রতাপে রোগী দেখে বেড়িয়েছেন ফিটনগাড়ি চেপে, যে রোগিণীর পেটে টিউমার আছে বলে বড় বড় ডাক্তাররা নিদান দিয়েছেন, তাকে দেখে তিনি নিশ্চিতভাবে বলেছেন বধূটি অন্তঃসত্ত্বা, নির্বিঘ্নে তার প্রসব করিয়েছেন। কোন ছবিতে তাঁর নেতৃত্বে নারীরা প্রথম কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন, কোথাও তিনি বিহার ও ওড়িশায় চলেছেন মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশা সরেজমিনে দেখে সরকারকে রিপোর্ট দেবার জন্য, কাউন্টেস অফ ডাফরিনস ফান্ডের জন্য একাই সংগ্রহ করছেন চব্বিশ হাজার টাকা। বিলেত থেকে ফিরে তিনি নানা সুন্দর জিনিস দিয়ে বাড়ি সাজাচ্ছেন, কিন্তু তার মধ্যেই একটি ঘরে ঝুলছে কঙ্কাল, যেটি নাতিদের ভাষায় “দিদিমার পড়ার ঘর”। কোন ছবিতে তিনি স্বামীর প্রথম পক্ষের অসুস্থ ছেলেটিকে মাতৃস্নেহে বুকে নিচ্ছেন, বিধবা ননদকে সারাজীবন গভীর শ্রদ্ধা করছেন, সামাজিক নিয়ম মেনে তাঁর খাবার রান্না করে দিচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের জামায় নিজের হাতে সূঁচসুতো দিয়ে শিল্পসৃষ্টি করছেন। অন্য দৃশ্যে কন্যা জ্যোতির্ময়ী বেথুন স্কুলে্র নিয়ম ভেঙে রঙিন শাড়ি ও বড়গলার ব্লাউজ পরার জন্য তাকে তিরষ্কার করছেন, আবার স্নেহে্র পুত্রবধূ কে চিঠি দিচ্ছেন, “কাল বিকালেও রাঁধুনি আইসে নাই। আজও ক্যাঁও ক্যাঁও করিয়াছে শরীর ভাল না। কাল আসিবে কি না জানি না”, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সগৌরবে কাজ করে গেছেন।
কাদম্বিনীকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল - তাঁর মধ্যেই সমাজ প্রথম দেখেছিল, বহির্জগত ও ব্যক্তিগত জীবন দুদিকেই বিশাল দায়িত্বের ভার অবলীলায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন এক নারী, যথাশক্তি তিনি তা বহন করছেন আপন বিদ্যা, মেধা ও ক্ষমতা দিয়ে, এবং তাঁর সফলতা ঈর্ষণীয় বললে খুব কমই বলা হয়। জীবনচর্যায় তিনি আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার সঙ্গে প্রচলিত সমাজরীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন।
মালবিকা কারলেকরের কথাকে একটু অন্যভাবে বললে, এটিই কি ছিল তাঁকে নিয়ে অস্বস্তির কারণ?
পরম পরিতাপের বিষয়, এত মূল্যবান ও ব্যতিক্রমী একটি জীবন সম্বন্ধে যা জানা যায় তা খুবই অল্প। নারায়ণ দত্ত বলেছেন, কাদম্বিনীর শিক্ষা ও পেশাগত গুণাবলীর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তিনি পেয়েছিলেন লন্ডন থেকে, স্বদেশে নয়। ইন্টারনেটে এই মহিয়সী নারীর একটিই ছবি পাওয়া গেল, তাঁর স্বামীরও তাই, অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। নীলরতন সরকার বঙ্গবন্ধু পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলায় সহায়তা করেন, এইটুকু জানা যায়, কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও কাদম্বিনীর কি সংযোগ হয়েছিল? ১৮৯৩ সালে কাদম্বিনী বিদেশ যাত্রা করেন, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ গল্পগুচ্ছের গল্পগুলি লিখছেন, শিলাইদহে যাচ্ছেন, প্রকাশিত হয়েছে চিত্রাঙ্গদা। সংকটে, সম্পদে অবিচলিত এই নারী, অনেক বন্ধদ্বার যিনি খুলে দিয়েছেন, তাঁর কথা কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কোথাও?
কাদম্বিনী অনেক উজ্জ্বল মশাল জ্বেলেছিলেন, নতুন পথ দেখিয়েছিলেন।
“দুর্গমের দুর্গ” থেকে সাধনার ধন আহরণ করে এনেছিলেন, জয় করেছিলেন আপন ভাগ্যকে।
তাঁকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
Thank you eto information deoar jonno onar bapare
Onek lekha porechhi onake niye kintu segulote eto bistarito bornona deia nei