পর্ব ৩৮
আজ একটা চলদৃশ্য দেখছিলাম। বাংলাদেশের এক চাষির। জলে ডুবে গেছে পাকা ধান। কেটেছেন। আঁটি বাঁধাও সারা। ঘরে নিয়ে যাওয়ার আগে জাওয়াদের বৃষ্টি। সব শেষ। ধানের বোঝা তুলছেন আর মাথা চাপড়াচ্ছেন। ছোটবেলায় এ দৃশ্য দেখেছি। মানুষের কী হাহাকার। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যম কেন যে কলকাতা না ডুবলে অতিবৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেন না। এর কারণ বোধহয় সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ কর্তাদের অধিকাংশের সঙ্গে জমির কোন সম্পর্ক নেই। ফ্ল্যাট জীবন। এবার মাজরা পোকা বড় ক্ষতি করেছে ধানের। বাকিটুকু শেষ করেছে জাওয়াদ। অন্নের হাহাকার না দেখা দেয়।
আমি চাষির ঘরের ছেলে। ছোটবেলায় চাষ পছন্দ করলেও সপ্তম অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় চাষের কাজে সাহায্য করতে চাইতাম না। একবার বাবা ভাদ্রমাসে একটা জমিতে জলের অভাব দেখায় ছিঁচতে বলায় বলেছিলাম, পড়াচ্ছ কেন তাহলে, চাষের কাজ করাবে যদি।
কী অন্যায় কথা যে শিখেছিলাম। এবং বলেছিলাম। আমাদের শিক্ষা অপচয়ের শিক্ষা। শ্রমকে ঘৃণা করতে শেখানোর শিক্ষা। জঘন্য মনোবৃত্তি গড়ে তোলে। লোকে জিমে গিয়ে শরীর চর্চা করে সবজির বাগান করে না মাটি কুপিয়ে। আজকাল বাংলাদেশের দেখাদেখি ছাদ-বাগান কিছু হচ্ছে। কিন্তু তাও কম। বাংলাদেশের এক সাংবাদিক শাইখ সিরাজের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে শাকবাড়ি ছিল। মানে লাউ কুমড়ো ঝিঙে উচ্ছে লাল শাক নটে শাক পালং শাক বাড়িতেই হতো। হাত ধোয়ার জল ফেলতাম ওখানে। শাক বাড়িতে। আমাদের ঘরেই অনেকটা জায়গা ছিল। তবে সব বাড়িতেই হতো। ফুলের গাছ বরং কম ছিল। বাড়িঘর একটা দুটো ছাড়া সব ছিল খড়ের চালের। একটা চার কামরা পাকা বাড়ি। আর নাই। একজন বিয়েতে ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার পর পাকা বাড়ি করলেন। এখন তো পাকা বাড়ি প্রচুর। দেখার মতও। দু-একটা সল্টলেকের মত তাক লাগান। গ্রামে এসিও চলছে। ফুলের গাছ বহু ঘরে। মা মারা যাওয়ার পর মায়ের কুলখতমে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি নিমন্ত্রণ করতে যাই। ১৯৮২ তে যখন গ্রাম থেকে শহরে পড়তে এলাম ৬৫ টি বাড়ি ছিল। এখন ৩৬৭ বাড়ি। গ্রামের মাঠেও বাড়ি হচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস দেখলাম, সবজির বাগান প্রায় নেই। ফুলের গাছ প্রায় বাড়িতে। শহর ঢুকে গেছে গ্রামের মনে মানসিকতায়। এখন আর সেভাবে গাঁয়ে কেউ এলে তাকে দু’দিন থাকার কথা বলে না। দু’একজন পুরাতন দিনের মানুষ বলেন। বাড়িতে চল, বলে জোর করে নিয়ে গিয়ে আন্ডা ভোগা বা ডিম সেদ্ধ খাওয়ানোর লোক কমছে। বলা উচিত, গ্রামে অতিথি এলে চা বিস্কুট/সরবত এবং দু থেকে চারটি ডিম সেদ্ধ দেওয়া ছিল দস্তুর। ডিমভাজা তখনো মামলেট/ওমলেট হয়নি। ডিম ভাজি নয়, সেদ্ধ খাওয়ানোর প্রথাই ছিল।
পর্ব ৩৯
গ্রামে তখন মিষ্টির দোকান ছিল না। আজও নেই। শীতকালে চপ বেগুনি আর জিলিপির দোকান দিত দুগোদা। পাঁচ পয়সা করে দাম। গ্রামে অতিথি এলে কেউ দু’কিলোমিটার দূরে মিষ্টি দোকান ছুটত না। পরোটা করে দিত। সঙ্গে জিরে আলু ভাজি, ডিমের নিংড়ি এবং চিনির সিরা। অতিথির আনা মিষ্টি অতিথিকে দিতে কেউ লজ্জা বোধ করতেন না। শহুরে আনুষ্ঠানিকতা গ্রামে ছিল খুব কম। বিকেল বেলায় সব খামারবাড়ি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সমাগমে গমগম করত। শীতের সময় স্কুলের পরীক্ষা শেষ। ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে সব হয়ে যেত। এবার মজা দেখে কে? মার্বেল, গুলি ডাং, অ্যাসবেস্টাসের চাকতি ছুঁড়ে তাসখেলা- খুব চলত। শীতে ফুটবল নট। ক্রিকেট ঢুকেছে ১৯৭৬-৭৭ এ। গোপী সরকারের ছেলে মেয়েরা শীতে ধান ঝাড়ার সময় কলকাতা থেকে এলে ক্রিকেট খেলত। লোকে দেখত। বলত, এটা আবার একটা খেলা নাকি। পরে সেটাই নব্বই দশকে প্রধান খেলা হয়ে গেল। এখন লোকে খেলা দেখে টিভিতে, মোবাইলে। খেলে না। গ্রামের খামার ফাঁকা। খামারও খুব কমে যাচ্ছে। খামার ধান ঝাড়ার পর খড়ের কুটি, খড়ের আটি পড়ে থাকত। তারমধ্যে শীতকাল জুড়ে সন্ধ্যা বেলায় লুকোচুরি খেলার হরেক আয়োজন। প্রবল শীতে খড়ের উষ্ণতা অসাধারণ। বড় বয়সে জয়দেব মেলায় গিয়ে এক বাড়িতে খড়ের বিছানায় শুয়েছি। খড় আর চট জুটেছিল।
পশ্চিম তথা বাঁকুড়া পুরুলিয়া থেকে যে সব মুনিষজন ধান কাটতে আসতেন তাঁদের জন্য অস্থায়ী খড়ের ঘর হত। আমার খুব ইচ্ছা করত সেই খড়ের ঘরে শুতে।