কেমন করে সময় দেখতাম আমরা? সত্তর দশকে? বাড়িতে প্রথমে একটাই ঘড়ি। যে ঘড়ি বাবা ষাট বছরের বেশি সময় পরেছেন। পরে দাদার একটা ঘড়ি হয়। কিন্তু দাদাও তো বাইরে থাকেন। আমরা সময় মেলাতাম নানা পদ্ধতিতে।
একটা ছিল পাশের বাড়িতে একটা দেওয়াল ঘড়ি ছিল হরিণের শিংয়ের পাশে। কাঠের পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়ি।
সবসময় যেতে ইচ্ছে হতো না।
একটা তো মায়ের ওঠা।
মা কী করে উঠতেন মা-ই জানেন। এছাড়া ভোর চার ১৫ মিনিটে ফজরের আজান। সবসময় শুনতে পেতাম না।
দুই, সকালে গুঁড়ুভাইয়ের হাঁক ডাক করে আসা। ঠিক ছটায়। কই, শাশুড়ি চা কই?
তিন, নোটনমণি ফুলের ফোটা। ঠিক নটায়।
চার, ঝাঁটার কাঠির ছায়া মেপে।
পাঁচ, বালি ঘড়ি করে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমি পড়ার একটা মাপকাঠি ঠিক করি।
তখন পদ্মিনী বলে একটা অসাধারণ ধূপ পাওয়া যেতো। ছোট প্যাকেট। প্যাকেটের গায়ে একটা খোপ। তাতে ধূপ লাগানো যেত। ১০ টা থাকতো ৫০ পয়সা দাম।
একটু জল গায়ে লাগিয়ে দিল ঠিক ৩০ মিনিট জ্বলতো।
আমি অঙ্ক ইংরেজি ৩০ মিনিট করে পড়তাম। একটা ধূপ একটা বিষয়।
পদ্মিনী ধূপ আর দেখি না। বদলে পদ্মাবতী।
পদ্মিনী ধূপ, ক্যালকাটা কেমিক্যালসের মলয় চন্দন সাবান, ওইটুকুই ছিল বিলাসিতা জীবনে।
মলয় চন্দন সাবান যে কী ভালো চন্দন গন্ধের সাবান কল্পনাও করতে পারবেন না।
আমি তো কোনোকালেই একটানা বেশিক্ষণ পড়তে পারতাম না স্কুলের বই।
আমি চারদিকে কাপড় টাঙিয়ে দিতাম। অজুহাত একসঙ্গে পড়লে পড়ার ডিস্টার্ব হচ্ছে।
তারপর টুক করে পালাতাম।
কিন্তু খেলার সঙ্গী তো নাই। সবাই তো পড়ছে।
আজমকে ডাকবো? রাগী বড়োমামা আছে। একদল গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার কার্তিক নন্দীর কাছে পড়ছে।
দূর থেকে টু কি করি, ইশারা করি।
ওরা চঞ্চল হয়ে যায়।
কিন্তু উপায় নাই।
ছোট বাইরের নাম করে এসে একদান মার্বেল খেলে যায় কেউ কেউ।
কী করি, এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে দাদার বই নিয়ে পড়তে বসি। এই করে করে ইতিহাস আমার প্রিয় ছিল, আরো প্রিয় হয়ে গেল। ইতিহাসটাই তো বোঝা যায়।
একজন লেখক ছিলেন মাখনলাল রায়চৌধুরী। পাশে লেখা থাকতো স্বর্ণপদক প্রাপ্ত।
এইটা আমার মধ্যে স্বর্ণপদকের আকাঙ্ক্ষা জাগায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী যশরাজের হাত থেকে কয়েকটি স্বর্ণপদক জোটে।
সময়জ্ঞাপক আরেকটা ছিল, শীতকালে। শীতকালে সেহারাবাজার ও বর্ধমানে সার্কাস আসতো।
সার্কাসের সার্চলাইট ঘুরাতো, ঘন্টায় ঘন্টায়।
অন্ধকার রাতে ২৬ কিলোমিটার দূরে থাকা সার্চলাইট চোখে পড়তো।
তখন তো এত বিদ্যুৎ আসে নি গ্রামে গ্রামে।
বাজারে এলেও থাকতো কতক্ষণ?
জরুরি অবস্থার সময় ট্রেন দেখে লোকে ঘড়ি মেলাতো।
সে সময় মানুষের দুটো বাঁধা কথা ছিল।
একটা , দাদা কটা বাজে?
দুই, নেশারুদের, দেশলাই হবে?
তখন মোবাইল আসে নি। কল্পনাতেও ছিল না।
পেঁপের ডাল দিয়ে কানে কানে কথা বলার সময় তখন। দুটো দেশলাই বাক্সে সুতো জুড়ে একজন মুখে ও অন্যজন কান দিয়ে শোনার সময় সেটা।
আমরা শুনতেও পেতাম!
সে কি সুতোর জন্য নাকি ইচ্ছে শক্তি।
সময় ছিল আমাদের ইচ্ছা শক্তির জোগানদার।
একদিন পোস্ত জামাইয়ের পাতে ঠেকিয়ে দিয়ে শাশুড়ি বলবে, একটু পোস্ত দিলাম। যত্ন করে খেয়ো বাপধন।
বলতেন আমার বাবা।
গ্রামীণ জীবনে তরকারির বৈচিত্র্য খুব ছিল না। কুমড়োর সময় রোজ কুমড়ো, বাঁধাকপি ফুলকপির ঋতুতে দৈনিক তাই, লাউ বরং মাঝে মাঝে হতো। আর আলু ওঠার পর দৈনিক আলুপোস্ত। আমার বাবা আলু ভর্তা আর পোস্ত ভাজা ছাড়া ভাত খেতে পারতেন না। গোটা পোস্ত তেল দিয়ে ভেজে কাঁচা পেঁয়াজ কুচি আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখলে অমৃত। বাবা সেটাই খেতেন। আমাদের মাস্টারমশাই প্রিয়নাথ নন্দী খেতেন এক বাটি পোস্ত বাটা। আমাদের বন্ধু অসিত স্যারের নাম দিয়ে দেয়, বাটি পোস্ত।
তখন পোস্ত ছয় টাকা কেজি। ১৯৮০ তে।
সরষে তেল ২ টাকা ৪০ পয়সা কেজি। চিনিও তাই।
আমার রোজ রোজ পোস্ত খাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি শুনে বাবা বলেছিলেন, একদিন লোকে ইলিশের ছবি টাঙিয়ে দেবে। আর পাতে একটু পোস্ত ছুঁইয়ে, শাশুড়ি বলবে, একটু পোস্ত দিলাম।
পোস্তর দাম আজ শুনলাম, ১৮০০-২০০০ । প্যাকেটে ২৫০০ টাকা। গত বছর সেপ্টেম্বরে তো বিরাট দাম।
২৫০০ টাকা খোলা। আর প্যাকেটে ৩০০০ টাকা।
পুরো লুঠেরা রাজ।
আউশগ্রামে কিছু মানুষ পোস্ত চাষ করছে শুনে প্রশাসন ১৯৯০-এ পুড়িয়ে দেয়। ভুল করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত রাজ্য সরকারের জায়গায় পোস্ত চাষের অনুমতি দেওয়া।
বর্ধমান বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়া জেলার মানুষ পোস্ত খেয়ে প্রাণ জুড়ান।
এখন বহু পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানুষও পোস্তপ্রেমী।
কেউ কেউ পোস্তয় হলুদ দেন। ভুলেও করবেন না।
পোস্ত পোস্তই।
অভিমানিনী প্রেমিকা। কাউকে সহ্য করে না!
পাতলা পায়খানা হচ্ছে?
পোস্ত বাটা গরম ভাত টোটকা।
হাই প্রেসার?
কাঁচা পোস্ত বাটা ওষুধ।
ঘুম হচ্ছে না?
পোস্ত খাও।
আগে মাসে ৩০০--৪০০ পোস্ত কিনতাম। এখন স্বপ্ন। বাংলাদেশ থেকে এক বন্ধু এখানে পোস্তর দাম ১৬০০ টাকা জেনে পাঠান।
আর এক বন্ধু ৩০০ পোস্ত দিয়েছেন মাসখানেক আগে। বইয়ের তাকে সাজিয়ে রেখেছি। দুদিন বমি পায়খানায় কষ্ট পেলাম যখন, পোস্তই শান্তি দিল।
আগে রোজ রোজ আলু পোস্ত বলে রাগ করতাম--সেই সোনার দিন কবে আসবে?
আগে আমাদের রান্নার জায়গাকে বলে বলা হতো 'চুলোশাল'। অনুজ অধ্যাপক তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে কথায় 'চুলোশাল' রান্নাশাল কথাটি এলো।
এই চুলোশালে পোস্তর কড়াই বা হাঁড়ির তলা বিকেল বেলায় আবার গরম করার সময় একটু ধরে যেত।
সেটা চেঁচে খেতে খুব ভালো লাগত। লোকে বলতো, হাঁড়ি চেঁচে খাচ্ছিস, বিয়ের সময় পানি হবে।
ভাতঘর তখন ডাইনিং হয় নি। বলা হতো, ভাতশাল।
এখনো আমাদের দেশের বাড়িতে চেয়ার টেবিলে খাওয়া হয় না। দাওয়ায় বসে খাওয়া হতো্। দাওয়া নয় আগে বলতাম, উসারা। এখন একতলা হলে দাওয়া, দোতলাকে বারান্দা।
শীতকালে একটা খাবার গরিব মধ্যবিত্ত বড়োলোক--সবার বাড়িতে হতো বেগুন ভর্তা আর ধনেপাতার চাটনি।
গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বছরে একবার মাংস খেতেন নবমীর দিন।
মুসলমানদের ক্ষেত্রে ছিল মাসে একবার।
তবে জামাই কুটুম এলে মুরগি হাঁস তো জবাই হতোই।
কিন্তু পোস্ত গরিব বড়লোক সবাই খেতেন কম বা বেশি।
২০ পয়সায় এক দু চামচ পোস্ত হতো। তাই ৫০০ আলুর সঙ্গে দিয়ে দিতেন সুবিধাবঞ্চিতরা।
পোস্ত কী দিয়ে খাওয়া হতো না?
আলু পোস্ত।
পেঁয়াজ পোস্ত। এটি আমার মেজদির শাশুড়ি অসাধারণ বানাতেন।
শিম পোস্ত। বিশেষ করে মাঘ মাসে। অসাধারণ। এ নিয়েও একটা ঝুমুর গান শুনেছি।
"মাঘের শিম ফাগুনের নিম।"
ঝিঙে পোস্ত আলু দিয়ে বা আলুছাড়া দুটোই জব্বর।
আজকাল তো কলকাতায় লাউ পটল এ-সব দিয়েও পোস্ত খাচ্ছি।
কিন্তু গ্রামে পোস্ত আলু, ঝিঙে, আর লাউ শাক ছাড়া জাত খোয়াতে রাজি ছিল না।
লাউ শাক দিয়ে একবার পোস্ত খেয়ে দেখবেন-- স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা আপনার জিহ্বায় থুড়ি রসনায়।
মাংসে পোস্ত দেওয়া শহরে এসে শিখেছি।
আমড়ার টকে পোস্ত। গোটা গোটা।
এক বন্ধু খাইয়েছেন আলু ভর্তার সঙ্গে কাঁচা পোস্ত মাখা। একটু কুচো পেঁয়াজ। পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
মুড়ির সঙ্গে বাদাম--পোস্ত দিয়ে ভাজা।
পুরুলিয়ায় করে ডিম পোস্ত।
একটা চমৎকার ঝুমুর গান শুনেছিলাম, কবি নির্মল হালদারের আমন্ত্রণে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে এক কবি ও সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে।
গোটা পোস্ত ভাজা সরু করে কাটা ছোট পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে মেখে।
কাঁচা পোস্ত বাটা। পেঁয়াজ দিয়ে বা পেঁয়াজ ছাড়া।
পোস্তর বড়া।
নাহ, আর লেখা যাবে না।
মাঝেমধ্যে পেট খারাপে পোস্ত বাটাই তো বাঁচিয়ে রাখে। জানে প্রাণ আনে।
(ক্রমশঃ)