শ্রাবণের বৃষ্টি দেখছেন? মিনমিনে। প্যানপ্যানে।
এটা শ্রাবণের বৃষ্টি হলো?
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে, তরুণ মজুমদারের 'আলো' ছবিতে অকাল প্রয়াত কুণাল মিত্র যখন রাতে গানটি বাজিয়ে দেন, গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ে। শুনে আসা। দেখতে। মরা প্রিয় বৌটি কি বেঁচে উঠলো। (কুণাল মিত্রের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল শতরূপা সান্যালের এক ধারাবাহিকে কিছুদিন কাজ শেখার বাহানায় যাতায়াত সূত্রে। কুণাল মিত্রের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম)।
শ্রাবণের ধারার মতো বৃষ্টি আর আসে না।
আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত সাংবাদিক দুর্গাদাসদা প্রায়ই ফোনে বিলাপ করেন, মরুভূমির চাষে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। মৌসুমী বায়ু বেশিদিন থাকবে না --এভাবে চললে।
কাল সন্ধ্যায় ভালো লাগছিল, বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ।
কিন্তু সত্যি মিনমিনে, ঝিরঝিরে। এ যেন শীতের বৃষ্টি।
শ্রাবণের ডাকাতিয়া বৃষ্টি নয়।
প্রেমিকার কাছে যাওয়ার জন্য মন উথালপাথাল করবে না।
এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চাষি লাঙ্গল চালাবে, মাটি কাদা হবে।
আমরা ছোটোরা লাঙ্গলে বসার জন্য বায়না জুড়বো।
লাঙ্গল দিয়ে মাটি চষার পর তাকে সমতল করতে হয়।
তাই বাঁশের লম্বা মই দেওয়া। চার থেকে ছটা গোরু টানবে মই।
মই যাতে ঠিক চলে তাতে কৃষাণ মাঝে মাঝে পা দেবে। সব থেকে ভালো দুদিকে দুটো ছোটো ছেলেকে বসিয়ে দেওয়া।
যে বাচ্চা বসার সুযোগ পেল-- তার তো স্বর্গসুখ।
প্যান্টের তলা দিয়ে জল ঢুকতো-- ওহ।
গাড়ি ঘোড়া নয়, মই চড়াই তখন বিনোদন।
তেমন খুশি, ধান কাটার পর বেঁধে ছেঁদে গোরুর গাড়ি করার আনার সময় ধানের গাদার ওপর ভারসাম্য বজায় রাখতে শোয়ার প্রাপ্তি।
সম্রাট আকবরও এই সুখ পান নি।
উঁচুতে বসে শুয়ে ফেলতে দুলতে উপর থেকে গ্রাম রাস্তা মানুষ দেখা।
আর হবে না।
এই বর্ষাকালে আরেকটা আনন্দ ছিল, বাড়ির মুনিষ বা কিষেনদের জন্য জল খাবার/ পানি খাবার নিয়ে যাওয়া।
গরম ভাত, আলু ভর্তা, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, মুসুর ডাল কাপড়ে বেঁধে সেদ্ধ।
সেটা মাঠের ধারে খুলে যখন কাঠের ঘানির সরষে তেল আর নুন লঙ্কা দিয়ে মাখা হবে-- খুশবুই আলাদা।
তখন অনেক মুনিষ/ কিষেন মাঠের জল খেতো।
আমরাও খেয়েছি।
আমাদের জমি যেহেতু একদম গ্রামের গায়ে তাই জল বয়ে নিয়ে যেতাম জগে করে।
কিন্তু সারাদিন এক জগ জলে চলে?
তাই অনেক চাষিই মাঠের জল খেতেন। তখন এতো সার কীটনাশক আসে নি।
ধান জমিতে ভাদ্র আশ্বিন মাসে মাথার উপর চড়া রোদ উঠলে স্বচ্ছ জলে দাঁড়কে আর পুঁটি মাছ হতো দেদার। কীভাবে হতো ওটাই বিস্ময়।
একটা বাঁশের চোঙ করে পাশে একটা গর্ত করে দিলেই খলবল করে লাফিয়ে পড়তো পুঁটি আর দাঁড়কে তথা কুচো মাছের দল।
বাংলাদেশের কাঁচকি মাছের ধরন।
শুধু তেল হলুদ পেঁয়াজ আদা জিরে লঙ্কা দিয়ে সেজে বসিয়ে দিন।
নামানোর আগে একটু কাঁচা সরষে তেল।
আগের পাকা রান্না করা সর্ষে তেল আর নবীনা বসন্ত-- মিলে কী সোয়াদ কী সোয়াদ।
ভেজেছেন কী মরেছেন।
স্বাদও মরা।
আজ শ্রাবণ মরে গেছে।
শীতের বৃষ্টি শাওন রাতে হাজির হচ্ছে মন ভোলাতে।
মন দোলে না।
ভোলেও না।
শুধু আক্ষেপ বাড়ে।
পুনশ্চ: হুগলির খানাকুল এলাকার একটা বড় অংশে চাষিরা বর্ষার চাষ করেন না। বন্যার জন্য। কিন্তু বাকি পশ্চিমবঙ্গে? ধান চাষ হচ্ছেই না। বৃষ্টি নেই। একটি চাল আটা গম মুড়ি সবেতেই জিএসটি। কিন্তু চাষ না হলে? ক্যানেলের জল ভরসা। কিন্তু সেখানেও কি তেমন জল আছে। মালদায় পাট জলের অভাবে শুকিয়ে গেল।
মেঘের নেশা বড়ো নেশা। বলা ভালো, মেঘ দেখার নেশা। নবম শ্রেণিতে পড়তে যেতেই হলো বাইরে। সেহারাবাজারে। গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। এখন নবম দশম খুলেছে। তখন প্রতিবার শুনতাম, এইবার হবে। হতো না।
ভাগ্যিস হয় নি। তেমন কিছু শিখতাম না সেহারাবাজার না গেলে। জুনিয়র হাইস্কুলের মাস্টারমশাইরা অর্গানাইজড শিক্ষক। স্কুলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মানুষ খুব ভালো। কিন্তু দু'একজন ছাড়া বিষয়ে দখল ছিল না। ফলে বই সম্বল পড়াশোনা। বিশেষ করে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিভাগ এক বেশ দুর্বল।
মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনা।
ভিত ভিতরে ভিতরে দুর্বল।
প্রাথমিক বিদ্যালয় যতোটা ভালো জুনিয়র হাইস্কুল ততোটাই কাঁচা।
সেহারা স্কুলে এসে পড়তে হলো অসম প্রতিযোগিতায়।
ইংরেজি অঙ্কে ওরা অনেক এগিয়ে।
বহু খাটতে হয়েছে।
কিন্তু দেখিয়ে দেওয়ার লোক গ্রামে একজনও নাই।
তিন থেকে ছয় কিলোমিটার দৌড়াতে হবে একটা পড়া আটকালে।
কী ভয়ঙ্কর দিন যে গেছে।
তা আমি তো ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই ছাত্ররাজনীতি করি।
সেহারা গিয়ে বাড়লো কমলো না।
২২০০ ছেলে মেয়ে কে চিনতে চেনাতে প্রাণপণ পরিশ্রম।
নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক পরীক্ষার পর পরেশনাথ চক্রবর্তী ও শিশির দত্তের দৌলতে স্কুল আমাকে চিনে গেল।
সমাজসেবা কুইজ বিতর্ক তাৎক্ষণিকে স্কুলে সেরা হয়ে জেলায় গেলাম। শিশির দত্ত নিয়ে গেলেন।
আর ইংরেজিতে পরেশ চক্রবর্তী নাকি এতো নম্বর কাউকে দেন নি আগে।
আজকালকার ছেলেমেয়েরা সে নম্বর শুনলে হাসবে।
কিন্তু আমাদের সময় স্কুলের পরীক্ষায় ইংরেজিতে ৬০ পাওয়া মানে চাঁদ পাওয়া।
তো, আমি সেই রাজনীতির কারণে দেরি করে বাড়ি ফিরি।
প্রতি শুক্রবার এক ঘন্টা টিফিন।
তাতে চালু করে দেওয়া হলো সাপ্তাহিক বিতর্ক ও তাৎক্ষণিক সভা।
কিছু অনুগামী জুটলো। দেওয়াল পত্রিকা করলাম সবাই মিলে।
শহরে 'কিশোর জগৎ' পত্রিকায় লিখছি। সাহিত্য সভায় যাচ্ছি।
বিশ্বনাথবাবু কবিতা পড়ে খুব উৎসাহ দেন।
কবি হতে খুব ইচ্ছে।
বাড়ি ফিরি সাড়ে ছয় কিলোমিটার হেঁটে দামোদর উপত্যকা নিগমের ক্যানেল বা খালের বাঁধ ধরে।
সাপের ভয় আছে, এবড়োখোবড়ো রাস্তা।
ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক মাসে আকাশ রাঙিয়ে দিতো, সূর্য ডোবার আগে।
আকাশ দেখা নেশা হয়ে গেল।
আকাশ দেখার লোভেই সন্ধ্যায় সাপের ভয় উপেক্ষা করে ক্যানেলের বাঁধ দিয়ে একা একা ফিরতাম।
দলে মিশলে মেঘ কথা বলে না।
আকাশের গায়ে রঙ দেখে মনে হতো একটা নদীর ঘাটে জল ভরতে এসেছে কোনো নতুন বৌ।
আর তার যাওয়ার রাস্তা লাল রাঙা মোরাম বিছানো।
তখনো শান্তিনিকেতন দেখিনি।
আমার কল্পনার গ্রাম ও রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন মিলতো আকাশের রঙিন নিত্য কল্পনায়।
এটা খানিকটা পেয়েছি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে পড়ানোর সময়।
সন্ধ্যার আকাশকে দেখাতো ট্রেন থেকে।
একবার রাঁচিতেও ওই আকাশ দেখেছি।
দেখেছি ম্যাকলাক্সিগঞ্জে।
কিন্তু গ্রামের নবম শ্রেণির আকাশ আজো দূরতর দ্বীপ হয়ে আঁকা আছে মনের আকাশে।
কিন্তু শ্রাবণ মাসে শরতের মেঘের ছবি আনন্দের নয়, ভয়ের বিপদের, ভয়াল আশঙ্কার।
লন্ডন কলকাতা হয়ে গেছে, গ্রীষ্মের কলকাতা।
এটাও সুখের নয়।
বর্ষাকাল। বর্ষা নেই।
ধান চাষ জরুরি। সঙ্গে গাছ লাগানোও। আম জাম জামরুল কুল পেয়ারা লিচু কাঁঠাল সবেদায় ভরে উঠুক রাস্তার চারপাশ।