পর্ব ৫২
শীতকালে সকাল সকাল উঠেই পূবদিকের দেওয়ালের গায়ে চাদর দিয়ে বসে পড়তাম। পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও আসতো। কার মুখ থেকে কতটা ভাপ বের হয় তার পরীক্ষা চলতো। শীতের সময় মুখ দিয়ে বাষ্পের মতো বের হতো। এটা তার পরীক্ষা।
এই খেলা বহুদিন চলেছে।
আজকের দিনে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এটা অনুমোদন করবে কি?
আর একটা খেলা ছিল, চুলে চিরুনি দেওয়া। একটা চিরচির করে আওয়াজ হতো শীতের সময়। বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে, বলা হতো মজা করে।
অধিকাংশ গ্রামে তো ১৯৭০ এর দশকে বিদ্যুৎ ছিল না। ছিল বাজারে গঞ্জে শহরে।
আমাদের গ্রামে একটা রেওয়াজ ছিল, ছোটোরা নিজেদের খামারে, মাঝারিরা গোলামহল বলে একটা বড় মাঠে এবং বড়রা পৌনে এক কিমি দূরে আগরাপুরার মাঠে খেলবে। শীতকালে ফুটবল বন্ধ। পায়ে পায়ে লাগলে বড় ব্যথা কনকন করে। এই সময় নুনচিক/ গাদিখেলা, হাডুডু, কবাডি, বুড়ি বসন্তি, মার্বেল, টল ( বড় মার্বেল/ ভাটা) খেলা, সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে তাস খেলা, লুকোচুরি, চু কিৎকিৎ, এলাটিং বেলাটিং, হাত দিয়ে পা দিয়ে উঁচু করে লাফ দেওয়া, এবং অবশ্যই গুলি ডাং খেলা। সঙ্গে আছে লোহার রিং গড়ানো, সাইকেলের টায়ার গড়ানো, লাট্টু ঘোরানো এবং লুকিয়ে লুকিয়ে গুলতি প্রাক্টিস। আর ছিল ক্যাম্বিস বল দিয়ে ক্রিকেট।
আর একটা খেলা ছিল।
ফুঁ খেলা ( নাম মনে পড়ছে না)। এই খেলাটার বৈশিষ্ট্য ছিল, একটা ঘাস একটু ছোট গর্ত করে ধুলো চাপা দিয়ে রাখা হবে। এক এক করে ফুঁ দেবে। আস্তে। সাবধানে। সবাই খেয়াল রাখবে, যার ফুঁতে ঘাস বের হবে, তার তো মুশকিল। সবাই খ্যাপাবে।
এই ফুঁ দেওয়া আজকের দিনে কী বিপজ্জনক হতো!
যে কথা বলতে বলতে আন কথায় চলে এসেছি ফেরা যাক।
বিকেলে খেলার শেষে শীত নামতো গুটি গুটি পায়ে। শীতকালে ছেলে বুড়ো সবাই গোলামহলে খেলতে যেতেন বা খেলা দেখতে। ওখানেই মোতি (প্রামাণিক) দাদুর দোকান। সেখানে বয়স্ক মানুষের আড্ডা। স্কুলের খবরের কাগজ সবাই পড়েন সেখানে। শীতকালে চপ বেগুনি পাঁপড় ভাজা হয়। চা-ও। বাঘের দুধ অর্ডার দিলে মোতিদাদু ও তাঁর ছেলে দুগোদা, এনে দিতে পারতেন বোধহয়।
মোতিদাদুর ছেলে দুগো দাদা হয় কী কোন নিয়মে? হয় হয় জানতি পারেন না। দুগোদা এভারগ্রিন। সবার দুগোদা। তাঁর বাপ সবার মোতিদাদু।
বয়স্ক লোকজন ছোটোদের পাঁচ পয়সার লজেন্সের লোভ দেখিয়ে খিস্তি শুনতে চাইতেন। ১০০ টা খিস্তি দেওয়া হলেই দুটো করে লজেন্স। একটা গালাগাল সংগ্রহ করতে হবে দেখছি। বাবার এক বন্ধু করেছিলেন। ১৯৮০ নাগাদ। যা সব ইনোভেটিভ গালাগাল ছিল গ্রামে। মা বোন তুলে গালাগাল সেখানে প্রায় ছিল না। বোন নিয়ে একটি মাত্র গালাগাল। তাও সেটি যে বহিন সংক্রান্ত, অনেক পরে জেনেছি। মাকে নিয়ে গাল ছিল না কেন? মা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। মাকে নিয়ে কিছু বললে, অতি শান্ত ছেলেও মারপিট করে বসতো। তবে বরাহনন্দন অক্লেশে চলতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবারা নিজের ছেলেদের দিতেন। আমার মা মজা করে বলতেন, কাকে গাল দিচ্ছো?
নিজেকেই।
তোমাকে তো আর বলা যাবে না!
গ্রাম্য মানে অশ্লীলতা-- এই শব্দ যারা অভিধানে ঢুকিয়েছেন এবং রেখেছেন তাদের গবেষণা করা উচিত। মা বোন সংক্রান্ত গালাগাল কোথা থেকে এলো? কীভাবে এলো? মহিলাদের নিয়ে গালাগাল ছিল। খিস্তি বা গালাগালি নয় গ্রামে বলা হতো, বাখান। বাখান করছে স্যার, বলে মনিটর হিসেবে নালিশ ছিল দস্তুর।
পুরুষদের নিয়ে গালাগাল ছিল বেশি। অজস্র। বিশেষ করে পুরুষাঙ্গ নিয়ে কত বাখান যে ছিল। তার যে কত নাম-- ভাবা যায় না!
দু-একজন বলতেন, কী বে, এই গালটা এখনো শিখিস নি।
আয় শিখিয়ে দি।
দিয়ে বলতেন, অমুককে যদি এটা বলতে পারিস, তাহলে চানাচুর আর লজেন্স দুই পাবি।
আমি খিস্তি দিতে চাইতাম না।
ওঁরা ঠাট্টা করে বলতেন, তুই তো আবার স্কুলের ভালো ছেলে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ানোর সময় এক সুদর্শন রূপবান জনপ্রিয় অধ্যাপককে পেয়েছিলাম। শিক্ষক সংসদের এক দীর্ঘ দীর্ঘ বৈঠক। বিরতির সময় দেখি তাঁকে ঘিরে ভিড়। এবং চাপা গলায় কথা চলছে। মাঝেমধ্যেই হাসির হুল্লোড়। বসতে যাচ্ছি।
বললেন, জানিস তো, এটা খিস্তোলজির আড্ডা।
আগে পাস কর। তারপর ঢুকতে পাবি। পরীক্ষা দে।
আমি গ্রামের ছেলে। বয়স্কদের আড্ডায় কিছু কথা শুনেছি।
দেখতে চাইছিলাম, তফাৎ কোথায়?
একটি বিশেষ সমাস জিজ্ঞেস করা হল। বয়স্ক মানুষের আড্ডার আসপাশ থেকে শোনা কথায় পাশ।
তৃতীয় শ্রেণি থেকেই শীতকালে সকাল বিকাল এবং দুপুর গোলামহলে খেলা চলতোই। কেউ না কেউ মাঠে আছেই।
বিকেলে খেলার শেষে, শীতের সন্ধ্যা নামার সময়ে মুখ বন্ধ করে বসা হতো। কার মুখ দিয়ে কতটা ভাপ/ বাষ্প বের হয় তার পরীক্ষা। বামুনপাড়ার দিবাকর, দীনু, নিখিল, সমীর সবাই থাকতো।
আজকের দিনে যে কী হতো!
আর করোনা কালে বাষ্পপরীক্ষা মুখোশ ছাড়া!
তবে আমাদের গ্রামে করোনার সময় যে কবার গেছি মুখোশ দেখেছি খুব কম। আমাকে পড়তে দেখেই অন্যরা হাসি ঠাট্টা করেছে। মুখোশ পরে পরে আমার তো হাঁফ ধরে গেছে।
গত বছর তো মেলাও হলো। এবারও হবে ১৯ মাঘ। ওলাইচণ্ডী দেবীর পূজা উপলক্ষে হিন্দু মুসলমানের যৌথ মেলা এবং যাত্রা নাটক গান।
এবং করোনায় কেউ মারা যান নি। তা বলে জ্বর জ্বালা কি হয় নি? হয়েছে। শীতকালে ঘরে ঘরে হয়। হয়েছে। পরীক্ষা কম। হলে কী হতো জানি না। তবে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
বাকিরা গ্রামের প্রথাগত ডিগ্রিহীন ডাক্তারের চিকিৎসায় সেরে গেছেন। গ্রামে গ্রামে এম বি বি এস কোথায়? স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও সবসময় পর্যাপ্ত ডাক্তার মেলে না। অথচ দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি। উচিত হচ্ছে, ডিগ্রিহীন ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো দক্ষ করে তোলা। গ্রামে গ্রামে স্যালাইন ছোটোখাটো অপারেশন প্ল্যাস্টার ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। এবং বড় অপারেশনের জন্য মোবাইল অপারেশন থিয়েটার।
গ্রামে নাকে শিকনি সর্দি আগে প্রায় সব বাচ্চার থাকতো। এখন হিন্দু মুসলমান আদিবাসী নির্বিশেষে হাম দো হামারো দো/ একের যুগ। এবং অল্প কিছু হলেই ডাক্তারের কাছে ছোটা। তাই শিকনিওলা বাচ্চা গ্রামে, অন্তত আমার গ্রামে খুব কম।
বরং কলকাতায় সুবিধাবঞ্চিত বসতি অঞ্চলে দেখছি।
আরে একটা জিনিস দেখতাম, ঠোঁটের কোনে সাদা ঘা।
হয়তো অপুষ্টির স্মারক!
তাও আজকাল দেখি না। সুখের কথা।
জিভে ঘার বড়ির খুব কদর ছিল গ্রামে। হলুদ রঙের বড়ি। পাঁচ পয়সা দাম। চুষে চুষে খেতে হতো। তাও কমেছে। তবে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় শহর নগরে বাজারে দেদার ভিটামিন সি বিক্রি হয়েছে। গ্রাম আর শহরের বিক্রির পরিসংখ্যান আলাদা করে নেওয়া উচিত।
গ্রাম শহরের পার্থক্য ধরা পড়বে। সমাজবিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থেও এটা দরকার।
গ্রামে সিপিএমের আমল ছাড়া বন্ধ দেখি নি। বন্ধ হয় না দোকান। পার্ক সার্কাসের ভেতর দিকেও কোনোদিন বন্ধ হয় না। হলে খাবে কি? অনেক ঘরেই তো রান্নার জায়গা পর্যন্ত নেই। রিজওয়ানুর মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন ওই এলাকায় আন্দোলনের কাজে ছিলাম। দেখেছি হোটেল সর্বক্ষণ খোলা। শুনলাম, এখানে কোনো পার্টির বন্ধ হয় না।
এখন গ্রামে খামার আছে। খামারে মাঠে খেলার ছেলে নাই। মেয়েও।
গুলি ডাং, মার্বেল, ভাটা ইত্যাদিরা নিজেরাই লুকোচুরি খেলে।
পর্ব ৫৩
শীতকাল মানেই ছুটি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষা শেষ। তারপর ক্লাসের পড়া নেই। এই ছুটি অনন্ত সম্ভাবনাময়। সরস্বতী পূজার আগে পড়াশোনা তেমন হতো না।
গরমের ছুটি বর্ষার ছুটি পূজার ছুটিও ছুটি। কিন্তু শেষ দিকে এসে মনে পড়তো একগাদা হোম টাস্ক আছে। হোম টাস্ক নয় বলতেন, ঘরের পড়া। এতো ইঞ্জিরি আদিখ্যেতা তখন আসে নি। ঘরের পড়া মানে হাতের লেখা। ইংরেজি বাংলা। এছাড়াও অঙ্ক কষা। ছুটির আগে শেষ দুদিন ওইসব হিজিবিজি করে সারা। কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা হতো-- যদিও হাতের লেখা রোজ লিখে সুন্দর ছবির মতো হাতের লেখা করার জন্যই সে-সব দেওয়ার প্রথা।
তখন খাতা ছিল মূলত দুটি। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র সমেত বঙ্গলিপি তাম্রলিপি। এছাড়া ছিল দিস্তে খাতা। গুণছুঁচ আর মোটা সুতো দিয়ে হাফ দিস্তা বা এক দিস্তা কাগজ দিয়ে খাতা বানানো হতো। খাতার কাগজের মান খুব ভালো ছিল না। ২০ পয়সা দিস্তে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে ৪০ পয়সা দিস্তে দরে সবুজ রঙের কাগজ পাই। তবে বর্ধমান শহরে এসে ভালো মানের কাগজ দেখেছি। গ্রামে ভালো কাগজ কেনার লোক তখন কোথায়? তবে আমাদের প্র্যাক্টিক্যাল খাতার পাতা ছিল অতীব সুন্দর। অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ নাম। এতো সুন্দর কাগজ। বারেবারে হাত বুলাতে ইচ্ছে করতো। হাতের লেখা আর কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হতো না।
ভালো প্রেক্ষাপট পেলে মানুষ বোধহয় ভালো হয়ে যায়।
শীতকালে হরেক ফেরিওয়ালার দল আসতো। সাইকেলে করে আসতো পাঁউরুটি, লেড়ো, কেকের বিক্রেতা। হাতি বিস্কুট, ঘোড়া বিস্কুট পাওয়া যেতো। আর ছিল নারকেল বিস্কুট। কী অপূর্ব তাঁর স্বাদ।
আরামবাগের পপুলার বেকারির একটা মিষ্টি বান রুটি খেতাম। কেকের দাম ২০ পয়সা। ১৯৮০ তে। বানরুটির দাম ২৫ পয়সা। ভিতরে একটা কিসমিস জাতীয় থাকতো। লাল রঙের। পরে জেনেছি। লাউয়ের মোরব্বা।
না জানলেই বোধহয় ভালো হতো!
পুনশ্চ:
ফুঁ দিয়ে খেলাটির ছড়া আজম পাঠাল। খেলার নাম ওরও মনে নেই
ডাব ডাব ডাব
ডাবরা মুচি,
...গে তোর
গালে মুছি।
খেলার নাম মনে করতে পারছি না।