ও আমার ন্যাংটো বেলার বন্ধু। এ-রকম কথা বলার মানুষ ক্রমেই কমে আসছে। অথচ আমাদের, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে, সবার, 'ন্যাংটো বেলা' ছিল। শহরে হয়তো আলাদা। শহরে ধনী উচ্চমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত স্বল্পবিত্তদের ক্ষেত্রে আলাদা হতেও পারে, কিন্তু সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনে এখনো গ্রাম বেঁচে আছে। খেলায়, মেলামেশায়-- অভ্যাসে।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কাউকে কাউকে ঘুরতে আসতে দেখেছি প্যান্ট না পরেই। পুকুরে স্নান করার সময় ছোটদের পোশাকের কোনো বালাই নাই। বর্ষাকালে যত খুশি কাদা ঘাঁটার জল মাখামাখি করার কাদায় গড়িয়ে ফুটবল খেলার প্রভৃতি আজো জমজমাট।
আমার ৩৫ বছরের বন্ধু আরিল এঙ্গেলসেন রুড নরওয়ের ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি। ইতিহাসবিদ। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসের পিএইচডি।
১৩টি ভাষা জানেন। বাংলাটা জানেন, বলেন, অনেক তথাকথিত বাঙালির চেয়ে ভালো। একটাও ইংরেজি শব্দ না মিশিয়ে কথা কথা বলেন। আমার গ্রামে একবার বছরখানেক টানা ছিলেন। আরিল এসেছেন এখন এ-দেশে। গবেষণার কাজে। দুবেলা আড্ডা হচ্ছে। কাল কথা হচ্ছিল, গ্রাম নিয়ে। আরিল বললেন, নরওয়েতে ওঁদেরও ন্যাংটো বেলা ছিল।
স্কুলে গিয়ে জিম করে গা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেলে চান করতেন স্কুলে একসঙ্গে পোশাক খুলেই। ১২-১৩ বছর পর্যন্ত চলতো। কোনো লজ্জা করতো না। ছেলেমেয়ে আলাদা আলাদা জায়গায় কিন্তু ওঁর ছেলে মেয়েরা আর এটা করেন না। ঘামে ভেজা পোশাক নিয়েই বাড়ি ফেরেন। কারণ বন্ধুদের সামনে নগ্ন হতে পারেন না। লজ্জা করে।
আরিল এক অসাধারণ মানুষ। ১৯৮৮ তে আলাপ। একসঙ্গে এক বিছানায় বহুদিন কাটিয়েছি পাশাপাশি। চিরগবেষক। দেখার দৃষ্টি আলাদা। নাস্তিক। সমাজগণতন্ত্রী। আমার বাবা শেষ জীবন পর্যন্ত খালি গায়েই ঘুরতেন আমাদের তিনখানা গ্রামে। আমরাও মাধ্যমিক পর্যন্ত তাই করেছি। এখন সবাই বাড়ির বাইরে বেরোলেই জামা।
বাবাকে একটু অনুযোগ করায় করিল বলেছিলেন, ওঁদের কাছে গোটা গ্রামটাই নিজের ঘর। তাই খালি গায়ে যেতে পারেন।
এখন দু-একজন এমন মানুষ আছেন।
সবাই এখন পোশাক পরা। ভদ্রলোক।
আরিল গ্রামে যখন ১৯৮৯-এ আমার সঙ্গে বেড়াতে গেলেন চারপাশে ভিড় জমে গেল। ছয় ফুটের বেশি লম্বা। টকটকে লাল ফর্সা রঙ। তার উপর সাহেব বাংলা বলে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের গ্রামে থাকে গবেষণার জন্য। ভদ্রলোকরা কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টির দখল নিচ্ছে এই ছিল তার অন্যতম ভাবনা।
আরিল গ্রামে ঘুরতো লুঙ্গি পরে খালি গায়ে।
লোকের ঝগড়া শুনতো মন দিয়ে।
যাঁরা ঝগড়া করছিলেন মন দিয়ে, তাঁরা হঠাৎ খেয়াল করতেন, একজন সাহেব হা হা করে আসছেন গাল শুনে।
ইতিমধ্যে দু'একজন দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে গাল শেখাতে লাগল।
আরিল একটা গানও শিখে গেল। খুব মনপ্রাণ দিয়ে গাইত, কালও গাইল,
বড় আশা করে এসেছি,
জননী গো কাছে ডেকে লও
ফিরায়ো না।
তাঁকে এই গান শিখিয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম। সাইফুল চাচা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোঁড়া ভক্ত। আমাদের বিভূতিভূষণ ভক্ত করাতে তাঁর অবদান আছে।
আমাদের গ্রামে ১৭ জন কবি ছিলেন। দু তিনজন ১৯৭৮-৮০ এই পর্বেই কামু কাফকা, বোর্হেস এইসব আলোচনা করতেন।
গোপীনাথপুরের বাদশা চাচা, উদগড়ার নজির চাচা ও আমার বাবা তিনজন, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে আড্ডায় বসতেন আমাদের বৈঠকখানায়। তাঁদের আড্ডা শুনতে ভিড় জমতো। ধাপ বুঝে ঘুরে ঘুরে বসতেন মানুষ।
আর মাঝেমধ্যেই হো হো করে আওয়াজ। এমনিতেই আমাদের এলাকার মানুষ বেশ রসিক ও আমুদে।
কথায় ভাষার মারপ্যাঁচ খুব। তবে সেটা কৌতুক বেশি ব্যঙ্গ কম।
তাতেও কম ছিল না।
বাদশা চাচা অধিক ধনী ঘরের ছেলে। বাপ কংগ্রেসি।
বিরাট ধানকল।
ছেলে চালায়। রাতের আঁধারে আমার বাবা আর নজির চাচা হাজির হন।
বাদশা চাচার বাপ দাপুটে নেতা ও বড় জোতজমির মালিক। লুকিয়ে তো যেতেই হয়।
বাদশা চাচা দারুণ জমাটি গল্প করতে জানেন। তিন বন্ধুর মধ্যে তিনিই বেঁচে। বলছিলেন, আমার তখন কাঁচা বয়স। হাতে কাঁচা পয়সা। এখনই এমন তখন তাহলে দেখতে কেমন ছিলুম, বুঝেছো!
অসাধারণ সুপুরুষ বাদশা চাচা।
বলেছিলেন, রাতের আঁধারে দুই বন্ধু হাজির।
ওঁরা আমাকে কমিউনিস্ট পার্টিতে ভেড়াতে চায়। আমার আমোদ ফূর্তির মন। বয়সও তাই। ওইসব শ্রেণিসংগ্রাম বিপ্লব ভালো লাগে?
তা ধন্যি ওদের অধ্যবসায়। লেগে রইল। তাস খেলতে লাগল। কিছুদিন এমন করল, তাস খেলাই ওদের লক্ষ্য। ও বাবা কিছুদিন পর দেখি ম্যাক্সিম গোর্কির মা শোনাচ্ছে। তারপর কমিউনিস্ট ইস্তেহার। দাস ক্যাপিটাল। আমারও বারোটা বাজল।বাপের কানে গেল জোতদারের ব্যাটা কমুনিস হয়েছে।
ওদের ধরল একদিন তক্কে তক্কে থেকে।
তারপর ওদের কথা শুনে বললেন, তোমাদের মত পথ আমাদের চেয়ে আলাদা। তবে তাস পাশা জুয়ো মদ মেয়েছেলের নেশার চেয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেশা ভালো। বাপের জমিজমা যায় দুটোতেই। তবে সম্মান থাকে।
বাপ সারাজীবন কংগ্রেস করলেন। কিন্তু দুই বন্ধু এনাম নজির এলেই মুরগি জবাইয়ের হুকুম হলো।
আর তিনজনে মিলে চলল বাপের সঙ্গে কংগ্রেস ভালো না কমিউনিস্ট পার্টি ভালো। রাত কাবার হয়ে যেতো।
সেই যে তর্কে আড্ডায় রাত কাবারের নেশা ধরল নতুন বউদের আকর্ষণও তুচ্ছ হয়ে গেল।
(ক্রমশঃ)