পর্ব ৪৮
'গা সরতো' লোকের। মানে গা ব্যথা করত। ছোটবেলায় ১৯৭০ এর দশকে, ইনফ্লুয়েঞ্জা (কেউ বলতেন ইনফুঞ্জা) নয়, বলত 'গা সরছে', বা গায়ে ব্যথা। সঙ্গে জ্বর। গাঁয়ে ডাক্তার কোথা? সিদ্দিক মাস্টার আছে। আর পলাশনে শশ(ধর) পান। আরেকটু দূরে ধন্বন্তরী ছাতু ডাক্তার। গেলে দেবে মিক্সচার। অমর মিত্র দাদা বস্তুটি কী জানিয়েছেন। সাদা গোল কাটা কাগজ আঁকা বোতলে রোগীর হাতে সমর্পণ। সেটি বানানো থাকত না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। কটা বাড়িতে আর থার্মোমিটার ছিল? আমার মা ছিলেন মিনি ডাক্তার। ভাই সিদ্দিক অ্যালোপ্যাথি। সিদ্দিক চৌধুরী এম এ পাস। দিদির মত ভাইও রূপবান। স্কুলের মাস্টার। সঙ্গে শহরে গিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে থেকে ডাক্তারি শেখা। পরে ভাইপো আজম সেই দায়িত্ব নিয়েছে। নাম ডাকও হয়েছে। আমিও এখনো তাঁর পরামর্শ নিই। আমার মায়ের ছিল হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স। এই একটি মাত্র বিষয়, যাতে আমার বাপ ও মা একমত ছিলেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাই আসল। অ্যালোপ্যাথিতে রোগীও মরে, রোগীর পরিবারও। এই ছিল বাবার বিশ্বাস। মা ১৯৮০ থেকে অ্যালোপ্যাথি। পরে আবার মা বাবা একমত হন, রামদেবের যোগ ক্লাসে। ২০১৩-য় মারা যাওয়ায় বাবা রামদেবের শেষ কীর্তিগুলো দেখে যাননি, না হলে হয়তো মত পরিবর্তন করতেন। শেষ জীবন ছাড়া অসুস্থ হতে দেখিনি। হলেও হোমিওপ্যাথি। ডাক্তার কে? না, ১৯৭২-এর সেই কংগ্রেসি নেতা, যার কারণে গ্রাম ছাড়া হয়েছিলেন। যাই হোক, এহিয়াভাই ওষুধ দেবে। বোঝ ঠেলা। রাজনীতিতে দু-মেরু। চিকিৎসায় তাঁর শরণ। তাঁর একমাত্র ছেলে ও বড় মেয়ের আড্ডা ছিল আমাদের বাড়িতেই। ১৯৭৭-এ পট পরিবর্তনের পর লোকের প্রচণ্ড রাগ। মারবে কংগ্রেসি নেতাকে। ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন বাবা। আমাকে না মেরে ওঁকে কেউ মারতে পারবে না।
১৯৭৭ থেকে তাঁর বৈঠকখানার বারান্দায় বসতে লাগলো দাবার আসর। দুই পাঁড় কংগ্রেসি ও দুই পাঁড় সিপিএম দিনভর দাবা খেলে। আর পরস্পরের পার্টিকে তেড়ে গালমন্দ করে। মত সাফ -দেশের সর্বনাশের কারণ দুটি দল। একদলের মত যা, অনর্থ দু’জনের বিপরীত। আসলে বিপদে পারিবারিক পরামর্শে এই কংগ্রেসিরা বাবার কাছেই আসবেন। এই সামবায়িক জীবন দেখেছি গ্রামে।
হচ্ছিল গা ব্যথার কথা, চলে গেসনু কোথায়? গা ব্যথা হলে কম করে হলেও একটানা পাঁসসিকে দিতেই হয় ডাক্তারকে। কী করে দেবে?
গ্রামীণ জীবনের অঙ্গ ছিল পাঁচন। ঘরে ঘরে অগ্নীশ্বর। নাড়ি ধাত বোঝায় নয়, পাঁচন তৈরিতে। আমাদের বাড়িতে তৎকালীন চাঁড়ালপাড়া এখন দীঘির পাড়া/দিঘের পাড়া থেকে কাজ করতে আসতেন তরণী মাসি। বাসক পাতা গাছ ছিল দীঘির পাড়ে। বাসক পাতা, গাঁদাল পাতা, গোলমরিচ, বোঁয়াই পাতা, তেজপাতা একসঙ্গে ভাল করে ফুটিয়ে পাতাগুলো ফেলে তার সঙ্গে আদা লবঙ্গ দিয়ে হামানদিস্তা/পাথরের খল নুড়িতে (অভাবে শিলনোড়ায়) বেটে থকথকে পাঁচন তিনদিন খাও, শ্লার জ্বর গা ব্যথা কোথায় যাবে! আর তার সঙ্গে শীতকাল হলে ভাল করে সর্ষে তেল মেখে দুপুর রোদে এগনেয় শুয়ে থাকো দিনি, আর বড়ি পাহারা দাও।
শীত এসছে, বাড়িতে লকলকে পালং, মুলো, শিম দিয়ে ঘন্ট হবে। বর্ষাকাল থেকে জমানো অথবা কেনা কুচো চিংড়ি শুঁটকি ফেলে দাও। তার ওপর ডুমো ডুমো করে ভাজা ঘরের তৈরি মুসুর ডাল বিউলি ডালের বড়ি। গা সারবে না দৌড়াবে।
ছোট ছানাপোনা তো পাঁচন গিলবে না, তারা তো আর ভালমন্দ বোঝে না, (একালে উল্টো, তাঁদের পছন্দেই রান্নিবান্নি) ওদের করে দাও দিকি বোঁয়াই পাতার পিঠে। বোঁয়াই পাতার পিঠে জানেননি। কী যে বলেন।
চালের আটা আর গমের আটা মেশান, তাতে আদা রসুন বেঁটে নতুন ওঠা পেঁয়াজ কলি কুচো কুচো করে ছড়িয়ে পাতলা করে রুটি করে দাও দিকিনি, বলতেন আমার দাদিমা। দাদিমা নয়, দাদিই বলতাম। ছোট বেলায় বলতাম, ও দাদি। দাদির বাড়িই আমাদের বাড়ি। দাদি ছিলেন নিঃসন্তান। বাবার সৎ মা। কিন্তু কোনো নিজের মা-ও ছেলেকে এত ভালবাসেন কী না সন্দেহ। তাঁর নিজের নামে ছিল ১৬ বিঘা জমি। ছেলে কমিশন করে লিখিয়ে নেন। আমার মা প্রচণ্ড আপত্তি করেন। বলেন, ওঁকে লিখে দিচ্ছেন, পার্টি করে ক্লাব করে দান খয়রাত করে উড়িয়ে পুড়িয়ে দেবে। জানেন তো ঘর জ্বালায়ে পর ভালায়ে লোক। দাদির নরম কথা, একটাই তো ছেলে না দিলে যদি কিছু করে বসে। তকদিরে যা আছে হবে। মা সাহাদানের দোয়ায় তোমার ছেলে মেয়ের মাছ ভাতের অভাব হবেনি।
মা সাহাদান মানে মা লক্ষ্মী।
মিশ্র সংস্কৃতি এভাবেই চারিয়েছে আমাদের শিকড়ে।
দাদির চাচি ছিলেন তাঁর পিসশাশুড়ি। মানে ফুফুশাউড়ি। 'ফুফু' পড়ে নাক সিটকবেন না, ফুফু ফুফা, বিশুদ্ধ পালি ভাষার শব্দ। আরবি ফারসি নয়। উর্দু হিন্দি তো এই সেদিনের ভাষা। আমাদের পরিবারে বাইরে ছিল পুরুষের শাসন। ভিতরে নারীর। এই ট্রাডিশন তৈরি করে দিয়ে যান আমার বাবার দাদি, নবিসনবিবি। পুরুষের সামনেই তাঁর গড়গড়া খাওয়ার লোকশ্রুতি। স্বামী ছিলেন বিচারক। আয়মাদার। ৫০০ বিঘা জমির মালিক। নিলামে হারান ২৫০ বিঘা। স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুর পর দাপটে চালিয়েছেন শাসন। লেঠেল পাঠাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। বলতেন, জানিস তো কার রক্ত বইছে আমার গতরে।
তিনিই আবার দেওয়া থোওয়া খাওয়া দাওয়ার এক বিপুল খরুচে ঐতিহ্য তৈরি করে দিয়ে যান। সে থেকেই শীতকালে পৌষের শুরু থেকেই ঝুঝকো ঝুঝকো (ভোর ভোর) পিঠে পুলির আসর বসত।
পোষ সংক্রান্তি। আমরা ছোটবেলায় পৌষ নয় পোষ সংক্রান্তি-ই শুনে এসেছি মা মাসিদের কাছে। আজ স্মৃতি কণ্ডূয়নের ভাবসকাল। ভোর ভোর উঠে মা দিদি এবং বাড়ির সহায়িকাদের মিলে মিশে পিঠে বানানো শুরু। অবশ্য গোটা শীতকাল জুড়েই সকালে পিঠের রেওয়াজ ছিল বাড়িতে। তবে এদিন একটু বিশেষ আয়োজন। বাঁধাকপি দিয়ে মাংস রান্নার গন্ধ চাগিয়ে দিত আমাকে। বাড়িতে খেজুর রসের অভাব ছিল না। খেজুরের গুড় তখনো কেনা শুরু হয়নি। বাড়িতেই হত। বাবা বলতেন, দূর দূর দোকানের কেনা গুড় মানে ভেলিগুড় মেশানো। ও গোরুতে খায়। মানুষ খাবার অযোগ্য। অযোগ্যতে একটু বেশি জোর। অতএব বাড়িতেই রস থেকে গুড়। ভোর চারটেয় উনুন জ্বলত। নিভত বেলা দুটো নাগাদ। চা নয়, সকালে চুমুক দিয়ে এক গ্লাস ধোঁয়া ওঠা খেজুর রস। টগর ভাইয়ের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াতাম আমি আর আমার সেজভাই। ও তো কলসিতে চুমুক দিয়ে চমকের পক্ষপাতী। বালতি ভর্তি দোয়ানো দুধ মেরে দিত চোঁ চোঁ করে।
(ও না পড়লেই মঙ্গল। এখন আবার প্রধান শিক্ষক)।
খেজুর গুড় দিয়ে ধুঁকি আর গোঁজা পিঠে দিয়ে সুরুয়াত। গোঁজা মানে খানিকটা মোমো ধাঁচের। মোমোতে মাংসের পুর থাকে এখানে নারকেলের পুর। ধুঁকি চালের গুঁড়ো হাল্কা ভিজিয়ে একটা বাটিতে টাইট করে বসিয়ে তলা থেকে জলের ভাপ। খুব সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। ইডলি-র বড়ভাই। আকারে বড়, পরিমাণেও। প্রণালী এক। এই পিঠে মুর্শিদাবাদে বিক্রি হতে দেখেছি। ২০১০ এ এক টাকা করে দাম ছিল। খেজুর গুড় দিয়ে বা ফোটান খেজুর রস দিয়ে খেতে হয়। পাটিসাপটা শহুরে ব্যাপার। ওসব গ্রামে ছিল না। তারপর আঁশকে পিঠের সাথে বাঁধাকপি আর হাড় মেশানো মাংস।
ইস! আর লিখতে পারছি না। এর মাঝে সেদ্ধ হত ডিম। অন্তত ৭০-৮০ টি। বড়রা পাবে ৬ টি। আমরা মেজরা অর্থাৎ ১০-১২ র দল ৪ টি। ছোটরা ২ টি। এটিকে ডিম সেদ্ধ বলে অপমান করবেন না। এর নাম ছিল আন্ডা ভোগা। ডিম সিদ্ধ করে ছাড়িয়ে কাঠি দিয়ে ফুটো করে নুন হলুদ মাখিয়ে হাল্কা ভাজা। আহা কী তার সোয়াদ! ভাতের সঙ্গে পরিবেশন। ওইটাই দিনের ইস্পেশাল ব্যাপার। এ পোল্ট্রির ডিমের যুগ নয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি। ডিম জমিয়ে রাখা হত বাড়িতে বাড়িতে পোষ সংক্রান্তির জন্য। চাইলেই তো দোকানে গিয়ে কিনতে পাবেন না, আজকের মত। আমার বড় হতে চাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল, বড়দের মত ছয়টি আন্ডাভোগা খাওয়ার ব্যাকুল বাসনা।
ভাতের সঙ্গে দুপুরে টমেটো (বিলিতি বেগুন বলে ডাকা হত টমেটোকে) দিয়ে ডাল। শেষে হাতায় রসুন তেল দিয়ে কড়াৎ করে ফোড়ন। স্বাদই আলাদা।
প্রয়াত অধ্যাপক নেতা হিমাচল চক্রবর্তীর স্ত্রী মীরা মাসিমা বলেছিলেন, এই ডাল খেয়ে এক মুসলমান ছেলের প্রেমে পড়েছিলেন, তার মায়ের হাতের অপূর্ব ডাল খেতে পারবেন বলে!
ডাল ভাত, নিজেদের খেতের ধনে পাতার চাটনি, আলু মাংসের টুকটুকে ঝোল, বাঁধাকপি মাংস ছিল এদিনের স্পেশাল, শিস পালং, বড়ি মুলো আর শিম দিয়ে। সব্জি (শুধু বাঁধাকপিও হত। পাঁচফোড়ন দিয়ে। তবে এটি বন্ধু জগন্নাথদের বাড়ির মত জম্পেশ হত না: আমি তো শীত এলেই কল্পনায় পাঁচফোড়ন দিয়ে আলু বাঁধাকপির গন্ধ খুঁজে বেড়াই, বেনে পাড়ায়, আহা আর মিলবে কি সেই গন্ধ!); এর সঙ্গে দিনে দুটি আন্ডা ভোগা/ভাজা সেদ্ধ ডিম।
তারপর ওড়া-উড়ি ঘুড়িদের। আমি তেমন চৌকস ছিলাম না। আমার দাদা আর পরের ভাই জইনুল ছিল ঘুড়ির শাসনকর্তা। তাঁদের মাঞ্জা দেওয়ার ধুম ছিল দেখার মত। আমার গম্ভীর ছোটমামাকেও (পরে মাস্টারমশাই) দেখেছি বামুন পাড়ার মাঠে দেদার ঘুড়ি ওড়াতে।
তবে একটা দুঃখ যাওয়ার নয়।
পোষ সংক্রান্তি আর মকরসংক্রান্তির দিন দীঘল গ্রাম আর বর্ধমান পলেমপুরে মেলা/জাত বসত। নদীর ধারে বিশাল নাকি সে মেলা/জাত। ছোটবেলায় কোনো দিন যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। যে বাবা আট বছরের ছেলেকে মাঘের শীতে সাইকেল চাপিয়ে ১৫ কিলোমিটার দূরে 'মাওসেতুঙ' পালা দেখাতে নিয়ে গেছেন, তাঁর কথা- জাতে ছেলেমেয়েদের স্বভাব নষ্ট হয়। চৌধুরী নানা বলতেন, ভাই সদরঘাটের মেলা মানে ঘুড়ি আর ছুঁড়ি। তোমার তো ভাই ছুঁড়ি দেখার বয়স হয়নি।
পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা যখন রাতে গরুর গাড়িতে বাঁশি বাজাতে বাজাতে মেলা/জাত দেখে ফিরত ভাবতাম কবে বড় হব। একা একাই যাব মেলা দেখতে। বড় হয়ে এগার ক্লাসে পড়তে বর্ধমান এলাম। দামোদরের সেই বিশাল চরে ঘুড়ি আর ছুঁড়ির মেলা দেখলাম। কিন্তু মনের আয়েশ মিটল না। কী, সে রঙিন কল্পনা! ছোটবেলার আবেগ বড়বেলায় এমন ভোঁতা হয়ে যেতে আছে!
পর্ব ৪৯
আগে ধান ঝাড়া, ধানের কুটি মারা, ধান ঠিকভাবে রাখার জন্য মড়াই বাঁধা, ধান খড় গুছিয়ে রাখার জন্য পালুই দেওয়া হতে হতে সংক্রান্তি চলে আসত। পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে সব হিসেব নিকেশ সারা। পৌষ সংক্রান্তির দিন বিশ্রাম। সেদিন বাইরে থেকে অর্থাৎ পুরুলিয়া মানভূম বাঁকুড়া থেকে আসা সাঁওতাল/বাউড়িরা রান্নাবান্না করবে না। সব বাবুর বাড়িতে নেমন্তন্ন। সেজন্য ভোর থেকেই প্রস্তুতি। আড়াই কিলোমিটার দূরে পলাশন থেকে মদন জেলে ছেলে সাধন ও ভাই-ভাইপোদের নিয়ে হাজির। মাছ ধরতে হবে। আজ মাছের হরেক পদ হবে। চুনোমাছের ঝাল, কুচো চিংড়ি / বোয়াল/ পুঁটি মাছের টক। টক দু-তিন রকম। একটু টক টক, একটু মিষ্টি, একটু ঝাল মিষ্টি।
দুপুরে মাছ ডিম মাংস সব হবে। সকালে পিঠে সরু চাকলি। সরু চাকলি মানে সাদা ধোসা। পিঠের মধ্যে থাকবে ধুকি। মানে দক্ষিণ ভারতীয় ইডলির বড় ভাই। সঙ্গে থাকবে খেজুর রস এবং খেজুর গুড়। যাঁরা বড় খাসির মাংস খান তাঁদের বসার জায়গা হবে আলাদা। সেখানে সদ্য ধোঁয়া ওঠা নেহারি। ধনে পাতা আর লেবুর রস দিয়ে। নেহারি মানে 'বড় খাসি'র পায়ের জুস। কী সব মশলার করণকস্যিতে ঘন্টাখানেক থাকবে কাঠের বা কয়লার আঁচের উনুনে। সত্তর আশির দশকে ঘরে ঘরে প্রেসার কুকার গ্যাস ইনডাকশন হিটার বিদ্যুৎ ছিল না। কী করে যে মা দিদি বোনেরা সামলাতেন কে জানে? কখন খেতেন, কখন শুতেন ঠিক নাই। আমাদের পৌষ সংক্রান্তির রোমান্টিকতা গড়তে তাঁদের কী অবর্ণনীয় শ্রমই না করতে হয়েছে। নানা অতিথি আসবেন ঘরে। এলেই পিঠে।
তখন দুধ পাওয়া যেত না সহজে। আগে থেকে বলে রাখতে হত। দুধ দিয়ে ক্ষীর হবে। হবে দুধ পিঠে। একেক জনের একেক পছন্দ। ছেলেপুলের দল খেয়ে কেউ গেল ঘুড়ি ওড়াতে কেউ মার্বেল গুলি ডাং খেলতে। আমাদের ঘরে ছিল উল্টো নিয়ম। ওইদিন সব সাইকেল ধোয়া মোছা রঙ হবে। বাবা খুলবেন সাইকেলগুলো। আমাদের সহকারী হতে হবে। এবং বাবার ওইটা দে বুঝে ঠিকমত সেলাই রেঞ্জ বা রেঞ্জ দিতে না পারলে দুর্গতি। সংক্রান্তির দিন বলে মারধোর বাদ যেত। এমনিতে মুসলিম বাড়িগুলোতে খাওয়া দাওয়া পোশাক যাতায়াতের কোনো সংস্কার ছিল না। বেগুন পুড়িয়ে বেগুন ভর্তা/ বেগুন ছানা/ টমেটো পোড়া সারা সপ্তাহেই খাওয়া যেত। আজ ওর জন্মবার কাল তার এইসব বালাই ছিল না। শনি মঙ্গলবারের কোনো নিয়ম ছিল না। আসলে জন্মদিন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, নেতাজী ছাড়া কারো পালন করা যায়- এটাই লোকে ভাবতে পারত না। এ নিয়ে কথা আরেকদিন।
তবে পৌষ সংক্রান্তির দিন পরনের ছাড়া অন্য জামাকাপড় কাচা-কুচি হত না। আমার মায়ের বাড়ির পাশেই ছিল দত্ত দাদুদের বাড়ি। মা অনেক হিন্দুয়ানীর বাড়িতে এনেছিলেন। বাবাও। তাই পৌষ সংক্রান্তির দিন পরনের ছাড়া কাচাকুচি নিষেধ।
আরেকটা দিন ছিল, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই মানতো লক্ষ্মীবারে ধান চাল বেচা নেই। আমাদের এলাকার সব দোকান লক্ষ্মীবার তথা বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকত। খালি ওষুধের দোকান ও গাঁয়ের মুদি দোকান খোলা। শহর তখনো গ্রামে রাজত্ব কায়েম করতে শুরু করেনি। রবিবার মানে ছুটি চালু হয়নি। ধান চাল গম নিয়ে কারবার জীবন, তা লক্ষ্মী নির্ভর। লক্ষ্মীই তাই ছুটির দেবী।
পুনশ্চ:
শুধু বাঁধাকপি নয়, হাড় প্রধান লাল মাংস দিয়ে কুমড়োর তরকারি ছেলের বিয়েতে গ্রাম খাওয়ানোর আবশ্যিক উপাদান। মাংসের এত ভাল পদ আর নেই। এছাড়া বাড়িতে কদু/ লাউ মাংস, কচু দিয়ে মাংস, পালং শাক মাংস, শুনে শাক মাংস- খুব ভাল পদ। পুঁইশাক দিয়ে মাংসের পদ ভাল হয় শুনেছি। খাইনি। পূর্ববঙ্গীয় সহায়িকার কাছে পুঁই শাক মাছের তরকারি খেয়েছি। তত ভাল লাগেনি। তবে মাছের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া তো লা জবাব।
আরেকবার পুনশ্চ:
পোষ সংক্রান্তির খাদ্যতালিকা
সকালে।
১. খেজুর রস
২. আসঁকে/চিতই পিঠে
৩. গোঁজা
৪. দুধ পিঠে
৫. ধুঁকি (ইডলির বড় ভাই)
৬. সরুচাকলি (সাদা/প্লেন ধোসার বাঙালি সংস্করণ, নরম সরম)
৫. নেহারি/পায়া/পাঁয়চা
সকাল ১০ টায়-
চুনোমাছের ঝাল আলু ভর্তা দিয়ে এক থালা গরম ভাত। সঙ্গে বাগার দেওয়া মুসুর ডাল
বেলা দেড়টা থেকে দুটো-
এদিন একটু বেলায় খাওয়া। পিঠে রোদ নিয়ে।
১. ভাত
২. ডাল
৩. সজনে শাক ছানা/মাখা। ছোট পেঁয়াজ এবং কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে
৪. সজনে ফুল
৫. বড়ি দিয়ে শিস পালং বেগুন শিমের ঘন্ট। অতি রসিকরা এতে চিংড়ি শুঁটকিও দিতেন। পৌষ সংক্রান্তির দিন আমি খাই।
৫. মাছ ভাজা
৬. মাছের ঝাল
৭. চুনোমাছের টমেটো দিয়ে হালকা ঝোল। সেজে বসানো। সরু আলু পেঁয়াজ কুচি টমেটো কাঁচা লঙ্কা চিরে বসিয়ে দাও। তেলে একটু কালোজিরে না দিলে কি চলে?
৮. মাংস
৯. বাঁধাকপি মাংস
১০. ধনে পাতার চাটনি
১১. মাছের টক
না মিষ্টি দই পাঁপড় থাকত না। মাছের তিন রকম টক আছে। মুখের স্বাদ মরে যাবে না হাবিজাবি খেলে!