গ্রামের অন্যতম সেরা সুন্দরীর বিয়ে। পাত্র খুব ধনী। জাঁকজমক করে বিয়ে করতে এসেছেন। নাস্তাপানি খাইয়ে দুপুরের খাবারের আগে বিয়ে পড়ানোর নিয়ম।
বিয়ের মজলিসে দু'পক্ষের মানুষ হাজির। সেখানে পাত্রপক্ষের দেওয়া গয়না পাত্রীপক্ষের দেওয়া গয়না সব হাজির করা হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত মুসলিম বিয়েই কিন্তু নিবন্ধীকৃত। মৌখিক নয়। মুসলিম মতে, বিয়ে একটা চুক্তি।
পাত্রীপক্ষকে একটা নির্দিষ্ট অর্থ বা দেনমোহর দিতে হয় পাত্রপক্ষকে।
মানে, লিখিত নিয়মে পাত্রী টাকাটা পাবেন। বিয়ে ভেঙে গেলে বা তালাক দিলেই দেনমোহরের টাকা পাত্রীকে দিতে বাধ্য থাকবেন পাত্রপক্ষ। সেটা লিখিত থাকে। এটা ১৪০০ বছরের পুরনো প্রথা। নতুন নয়। আরেকটি প্রথা, বিয়ের মজলিস থেকে পাত্রপক্ষের একজন, পাত্রীপক্ষের একজন এবং সভা তথা মজলিস থেকে একজন -- মোট তিনজন প্রতিনিধি যাবেন পাত্রীপক্ষের কাছে। তাঁর কবুল শোনার জন্য।
তার আগে পাত্রকেও জিজ্ঞেস করা হবে।
কীভাবে?
ক গ্রাম নিবাসী অমুকের জ্যেষ্ঠ/ মধ্যম/ পুত্র খ-র সঙ্গে গ গ্রাম নিবাসী ঘ-এর কনিষ্ঠা/... কন্যা ঙ- এর ..... টাকা দেনমোহরানার পরিবর্তে বিবাহ স্থির হইয়াছে।
আপনি কি শাদি কবুল করছেন।
পরপর তিনবার জিজ্ঞাসা করা হয় বরকে। বরের সম্মতির পর কনের কাছে যাওয়া।
কনেকে স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে হবে, শাদি কবুল।
সুন্দরী মেয়েটির বাড়িতে আসর থেকে পাত্রপক্ষ গেল, পাত্রীর কাছে, পাত্রী বললেন, না।
মানে, শাদি কবুল নয়।
হইচই পড়ে গেল।
এমন ঘটনা কেউ শোনেনি।
পাত্রীর মা পাত্রীকে নিয়ে ঘরে খিল দিলেন।
শালপ্রাংশু চেহারার নানাজি এসে আমার ছোট্ট খাট্টো চেহারার নানিকে এসে বহু ডাকলেন, সম্মান থাকবে না। এমন করো না, সালমা। চিরকাল বলেন অমুকের মা। মানে বড়মেয়ের মা বলে ডাকেন। আজ স্ত্রীকে সন্তান হওয়ার আগের ডাকে ডাকলেন। দরজা ঈষৎ ফাঁক করে সালমা উত্তর দিলেন, ওঁদের ভালো করে খাইয়ে ফেরৎ পাঠাও। ওই ছেলের সঙ্গে আমার সোনার মেয়ের বিয়ে দেবুনি।
অনড় স্ত্রী। কন্যা। বড় আদরের মেয়ে। সুন্দরী। বিদূষী। ভালো ছড়া লেখে। এমন মেয়েকে ওই পাত্রের হাতে দিতে তাঁরও মন চায় না। দেখতে কালো। কিন্তু পয়সা আছে। পড়ালেখা জানে। ভালো পরিবার। কিন্তু মা মেয়ে অনড়।
অনেক বচসার শেষে পাত্রপক্ষ ফিরে গেল। পাশের গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করে।
আমার বাবা ফুটবল খেলতে গিয়ে পা চোট লাগিয়ে বসেছিলেন, আমার বড়মেসো ও বাবার বন্ধুরা কাঁধে করে তুলে এনে বিয়ে দেন ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে।
এর আগে নাকি আমার বাবার বন্ধুরা নানাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বিয়ের। নানা রাজি হননি।
যাত্রানাটক করে বেড়ায়। খেলাধুলায় মন। ও সংসার করবে কী করে?
বাবার অভিভাবক নেই। অভিভাবিকা। দাদি। এবং সৎ মা। মা শান্ত শিষ্ট মানুষ। দাদি প্রবল দাপুটে। গাঁয়ের মহিলা বিচারকর্তা। স্বামীর অবর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বী ছোট জমিদারের (আয়মাদার) হাত থেকে নিজের ছোট জমিদারি তথা আয়মাদারি রক্ষা করার পাশাপাশি গ্রামের বিচার আচার করেন তিনি।
আমাদের গ্রামে এখনও ন' ভাইয়ের বাপ বলে পরিচিত লতিববাবু তিনি দলবল নিয়ে গিয়ে ধরলেন বাপের দাদিকে। পুতার বিয়ে দাও, আজই। ভালো পাত্রী আছে।
নবিসন কানাঘুষোয় সব শুনেছেন।
নাতনি ছোট। আশালতার সঙ্গে খেলছিল। শুনে সেও বায়না জুড়ল, ভায়ের বিয়ে দাও। ভাবি আসবে।
বিয়ে তো দিবি, সে মুখপোড়াকে পাবি কোথায়?
আছে আছে।
কোথায়?
খেলার মাঠে পা মচকে পড়ে আছে খেলতে গিয়ে।
যা তুলে আন।
সবাই মিলে হই হই করে খেলার মাঠ থেকে তুলে এনে জামাকাপড় পরিয়ে বিয়ের আসরে নিয়ে গেল ১৮ বছরের তরুণকে।
আমার বাবার গায়ের রঙও ছিল কালো। ফর্সা নয়।
আমরা মাকে ক্ষেপাতাম, প্রেমের বিয়ে বলে।
আর মা বলতেন, বাবা সম্পর্কে, ঘর জ্বালায়ে পর ভালায়ে।
শেষ কথা: মায়ের সেই বিয়ে না করা ভদ্রলোকের সঙ্গে বাবার ভালো বন্ধুত্ব ছিল।
অবশ্য বাবার সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক কজন রাখতে পেরেছে।
আপদে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ।
এবং অসম্ভব ঠোঁটকাটা।
কাউকে পরোয়া করতেন না। ১৯৫৭ তে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসা। ১৯৮৭ তে ছেড়ে দেন।
বক্তব্য:
আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার যোগ্য নই, কারণ আমি কৃষি জমির মালিক।
আর এই পার্টিটার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ দেওয়ার যোগ্যতা নেই-- কারণ পার্টিটাই কমিউনিস্ট পার্টি নয়।।
বলতেন নষ্টবাদী।
সারা বছর সিপিএমের নিন্দা করতেন, ভোট এলেই তুখোড় সিপিএম।
তো এই বিয়ের জেরে নানার আর্থিক ক্ষতি হয়। ফিরে যাওয়া পাত্র পক্ষ আদালতে সম্মানহানির দায়ে মামলা করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে। দিতে হয়। আমার বাবা ও মা আদালতে যেতে চেয়েছিলেন। মেয়ে আদালতে যাবে? যেতে দেননি নানা।
মামলা হারেন। ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।
আমাদের গ্রামে দুটো পীরের আস্তানা ছিল। একটা মামার বাড়িতে। একটা আমাদের পাশের খামারে। নানা ছিলেন ধার্মিক মানুষ। তবে রেগে গেলে শালা বলে গাল দিতে আটকাতো না। মামার বাড়িতে পীর পুকুর বলে একটা পুকুর আজো আছে। জলে বড্ড গা কুটকুট করতো। সাঁতার কেটে আনন্দ নাই। কলুপুকুরে কলু মেয়েদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করা দেখেছি। তাই সাঁতারে অনাগ্রহ। আমাদের বাড়ি লাগোয়া দু ঘরের যৌথপুকুর তালপুকুর ছিল ভরসা।
মামার বাড়িতে পীরতলায় একটা গাছ ছিল। ছোটো ঘেরা থাকতো। সন্ধ্যেবেলায় ধূপ আলো দেওয়া হতো। আর পাশের খামার মুন্সিদের একটা পীর আস্তানা ছিল। একটা বড়ো পাকা গম্বুজ। বেশ মোটা। এখানেও ধূপ ধুনো ছিল। ছিল একটা কুলগাছ।
নকশাল আমলে বোমা মারা হয়েছিল এর অদূরেই।
পরীক্ষার সময় ছোটো বেলায় ধর্ম প্রীতি বেড়ে যেতো। ছোটো ভাই বিবেকানন্দ সাজতে ভালোবাসতো। ধ্যানট্যান করতো। ওঁকে জিজ্ঞেস করতাম, ঠাকুর, ফার্স্ট হতে পারবো তো। ও পা বাড়িয়ে আশীর্বাদ করতো। তাতে ভক্তি কমে আসে।
বাড়ির সামনেই মসজিদ। সত্তর দশকে গড়ে ওঠে।
নকশাল আন্দোলন, সিআর পি, সিআইডি, মসজিদ সব সত্তরের দশকেই। তাবলিগ জামাতের দলও আসে। যারা পীরপ্রথা তাবিজ কবচ মাদুলির বিরোধিতা করে। তাদের কথা শুনেই হোক, আর নানার প্রতি রাগেই হোক, বাবার নাস্তিক মতবাদের জন্যই হোক, পীরের ভক্তি আমার হয় নি। আমার এক বড়খালু/ মেশোমশাই ছিলেন পীর। তাঁর তিন বিয়ে। বড়খালাকে বোরখা পরতে বাধ্য করা পীর বিরোধী করে আমাদের। পীর তলা আর নেই। মামাবাড়ির মুন্সিখমারারের। দুটোই এখন যৌথ খামার। সেখানে ধান ঝাড়া পেটা হয়। খাবার/ পেট খুব দামি বিষয়।
আমাদের গ্রামের মল্লিকপাড়ার মুসলমানেরা দু কিমি পশ্চিমপাড়া যেতো দূরে পীরতলায় মাটির ঘোড়া নিয়ে। হিন্দুরাও কেউ কেউ যেতেন মোতিদাদুর সব পেয়েছির দোকানে ধূপ আর মাটির ঘোড়া দুই পাওয়া যেতো। গরিব মল্লিকপাড়া যা করে মধ্যবিত্ত মাঝেরপাড়া/ উত্তরপাড়া তা করে না। দু একবার দলে ভিড়ে পশ্চিমপাড়া গেছি। পয়সা দিতে হয় পীরতলায়। দেখে কেমন কেমন লাগে। নামাজে তো পয়সা লাগে না। পীরের কেন?
মুসলিমদের নানা সিলসিলাহ। হানাফি সালাফি।
দেওবন্দি বেরিলি ফুরফুরা। আমাদের গ্রামে ও আশপাশে এদের অস্তিত্ব ছিল না। সত্য বলতে কী কলকাতায় না এলে এ-সবের কথাও সেভাবে শুনতাম না। শুধু গ্রামে একজন ইদ বকরিদের নামাজ পড়তেন না, তার নাকি পীরের বারণ ছিল। তবে তিনি গ্রামের জামাই। বাইরের লোক। বামপন্থী রাজনীতি করার কারণে সপ্তম শ্রেণি থেকে আমিও ইদের নামাজে যাই নি আর মসজিদে নামাজ ছোটো থেকে বড়ো পড়ি নি। মসজিদ শুরুর পর বেশ কয়েকবছর মসজিদে পাঁচজন নামাজিও হতো না। এখন ১০০ র বেশি নামাজ পরেন। মসজিদ পাকা হয়েছে। পাকা ওলাইচণ্ডী মন্দির হয়েছে। সেখানেই দুর্গাপূজা হতো। এখন সুদৃশ্য দুর্গামন্দির। তবে যে শিবমন্দিরে হিন্দু মুসলমান যেতো-- তা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আর তৈরি হয় নি। প্রসঙ্গত, নাস্তিক হওয়ার আগে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার আগে মসজিদের একটু ধুলো নিয়ে শিবমন্দিরের ধুলো কপালে বেশি ঠেকাতাম। কারণ শিব বেশি কাজ করে বলে ধারণা ছিল আমাদের। উল্টো কাজ করতো দীনু জগন্নাথ। তারা মসজিদের ধুলো বেশি মাখতো। হিন্দুদের বাড়ির ভিত তৈরিতে মৌলভীর লিখে দেওয়া কাগজ সম্মানের সঙ্গে টাঙ্গাতে দেখেছি। বোরখা হিজাব কোনদিন ছিল না। পার্টির হাত ধরে পীর ঢুকলে কী হবে জানি না!
পানি পড়া মসজিদ থেকে এনে বা নানার কাছ থেকে এনে পেট ব্যথা করলে মা খাওয়াতো।
বাবা জানলে তুলকালাম। লোকের মুখের থুতু খাওয়াচ্ছো। আরো অসুখ করবে।
তবে পীর দেখলাম 'আজকাল'এ কাজ করতে এসে। একজন নিজেকে আল্লাহ বলে ঘোষণা করেন। সে নিয়ে খবর। ও মা, এক ট্রাক লোক এসে হাজির আজকাল দপ্তরে।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। পীরস্তানে তাই। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কথা। কে কবে বসবে গদিতে সে নিয়ে দ্বন্দ্ব। দুজনেই দুজনকে বলে ফন্দিবাজ। টাকা কামানোর ফিকির। একাধিকবার তাই।
দেখি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে।
হাজারখানেক।
এসে গদিতে পীরজাদাকে ছুঁচ্ছে আর ১০/২০/৫০ টাকা দিয়ে যাচ্ছে।
সে ১৯৯৫ এর ঘটনা। ব্যাগ ভর্তি করে টাকা সেই প্রথম দর্শন।
এটা কলকাতার এক পীরপাড়ার ঘটনা।
প্রসঙ্গত, আমাদের গ্রামে যখন পীর ছিল, তখন তিনখানা গ্রাম মিলে এম এ/ বিএসসি পাস তিনজন।
এখন ঢিল মারলেই গ্রাজুয়েট।
এম এ।
পাঁচজন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার।