পর্ব ৫৪
মানুষের ভয়ের প্রতি এক আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণ থেকেই শিশুরা ভূত বা জুজুবুড়ির গল্প শুনে ভয় পায় এবং বারবার সেই ভূত ও জুজুবুড়ির গল্প শুনতে চায়। বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশের এক বড় বাধা এই ভূত পেত্নী ও জুজুর গল্প। আমি নয়, নেতাজিও এইভাবে ভেবেছিলেন। ভীতু গা বাঁচিয়ে চলা মনোভাবের জন্ম এই ছোটবেলার গল্পগুলো। শৈশব ইস্তক ভীতু। এই ভয়ের প্রতি আকর্ষণ থেকেই সাপের খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল। সাপের খেলা দেখাতে আসত আমাদের গ্রামে। একটি কুলোয় তুলসী সিঁদুর ধান এবং একটি সাপ থাকত। কুলোটি বইতেন মহিলা। সঙ্গী পুরুষের দু’কাঁধে সাপের ঝুড়ি। কি যেন বলত এগুলো কে। নাম মনে পড়ছে না। তাতে হরেক রকম সাপ। মনে পড়েছে, সাপের ঝাঁপি। সেই ঝাঁপি খুলে একটার পর একটা খেলা। পুরুষটি বাঁশি বাজাতেন। মূলত 'নাগিন' ছবির সুর। সাপগুলো হেলে দুলে নাচত। সাপ যে শুনতে পায় না তা তো জানতাম না।
সাপুড়েদের বাঁশি বাজান দেখে আমারও বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে হত। পচা ভাই দারুণ বাঁশি বাজাত। আমি তার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। বলাই বাহুল্য, বাঁশি পেলাম। বাঁশিতে সুর দিতে পারলেম কই!
গোলা-মহলে দেখাত সাপের শঙ্খ লাগানো। এ-সব দেখা নাকি ভারি পুণ্যের কাজ। লোকে পয়সা ছুঁড়ত। দু-পয়সা, তিন-পয়সা, পাঁচ-পয়সা। ভারি উদাররা ১০-পয়সা। সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতেও যেতেন সাপুড়েরা। গিয়ে খেলা দেখিয়ে চাল ডাল আলু তেল নিতেন। তারপর বলতেন, এখানে বিষধর সাপ আছে। সাপ বের করেও আনতেন। নিন্দুকেরা বলতেন, ওরাই সাপ ছেড়ে সাপ ধরছে। সাপের খেলা দেখতে ভয় এবং মজা দুটোই হত।
এই সাপুড়েরা- কোন জাত, কোন ধর্ম, জানি না। সে-কালে এসব জিজ্ঞেস করার মন মানসিকতা তৈরি হয়নি। সাপুড়েরা সম্পন্ন বাড়িতে বলে যেতেন,
- দুপুরে দুটো খাব গো মা-জননী।
- ঠিক আছে এসো।
- বলতেন, গিন্নিরা।
আমাদের বাড়িতেও খেতে দেখেছি। ইয়া বড় কাঁসার থালায় চুড়ো করা ভাত। রোগা শরীরে এতো খেত কি করে এখন ভাবি, তখন ভাবতাম না। কারণ গ্রামে অনেকেই এমন খেতেন। সাপ আর বেজির লড়াই দেখাতেও লোক আসত। পোষা সাপ ও পোষা বেজি। আমরা তো গল্পের বইয়ে পশু ভক্ত বেজি দেখেছি। বেজি পুষবার খুব সাধ হয়েছিল। কারণ সাপের ভয়। সাপকে তো আজও একটু আধটু ভয় পাই।
আর গ্রামে আসত হাতি। হাতির পিঠে চড়লে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। এই বিশ্বাসে এক টাকা দিলে হাতির পিঠে চড়া যেত। হাতির মাথায় সিঁদুর লেপা। হাতি শুঁড় দিয়ে আশীর্বাদ করত। আট আনা দাম আশীর্বাদের। হাতির সামনে কুলো করে চাল ধরতেন মা। খামারবাড়িতে এসে দাঁড়াত। কী ভালই লাগত। শুঁড় দিয়ে জল ছুঁড়ত হাতি। যেটা পরে সার্কাসেও দেখব। হাতি গোটা কলাগাছ খেয়ে নিত। মুলো বাঁধাকপি নিমেষে সাবাড়। চালটা সঙ্গের বস্তায় ঢেলে নিতেন মাহুত। হাতি এলেই সঙ্গে সঙ্গে চলত ছেলেপিলের দল। আমরাও সেই দলের অংশ।
একবার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি, যেতে যেতে মাহুতকে বলেছি, মাহুত মহারাজ, হাতির নাম কী? (মহারাজ এটা কোনো গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম, ঝেড়ে দিলাম।) মাহুত সাহেব বহুত খুশি হয়ে বললেন, বেটা সামনে আও। আমি বললাম, পয়সা নিয়ে আসিনি। পয়সা লাগবে না- চড়।
ওরে বাবা হাতির পিঠে চড়া। হাতি তো হাঁটু মুড়ে দিয়েছে। এদিকে আমার সঙ্গে বন্ধুর দল। আমি চড়লে ওদের মন খারাপ হবে। আমি বললাম, থাক। ওঁরাও তো আছে। মাহুত খুশি হয়ে বললেন, হাতি সব কো আশীর্বাদ দে দো। আর আমাকে বললেন, বহুত দিলদার ও দিগগজ হোগা তুম।
সেই থেকে তর্কে আমার খুব মন, চৈতন্যের মত দিগ্বিজয়ী তার্কিক হওয়ার ইচ্ছে। হলাম কি?
পর্ব ৫৫
সার্কাসে হাতি আসত। তিন চারটি হাতি থাকত। ২৬ কিমি দূরের বর্ধমান শহর। সেখানে সার্কাস এলে সার্চলাইট চালাত রাত ১১ টার পর। এতদূর থেকেও আমরা সেই আলো দেখতে পেতাম। তখন তো গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যে হলেই পথঘাট আঁধার।
তার ফলে সার্চ লাইটের আলো আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হত। ওইটা ছিল বিনি-পয়সার আনন্দ ও সার্কাসের বিজ্ঞাপন। সেই দেখে গ্রামে ধূম পড়ে যেত দল বেঁধে সার্কাস যাওয়ার।
বর্ধমান শহরে এখন যেখানে স্টেডিয়াম সেই ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড, সেখানে আসত সার্কাস। দু'একবার বর্ধমান শহরে গিয়ে দেখেছি। ১-টা ৪-টা ও ৭.৩০-এর শো ছিল।
অলিম্পিক সার্কাস, জাম্বো সার্কাস, রাশিয়ান সার্কাস এই সব নাম ছিল। আর বাকি নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। দূর দূরান্তে বিশাল রঙিন পোস্টার পড়ত। তখন জীবনে রঙ কম। পোস্টারগুলো চোখ টানত।
পরে সেহারা বাজারেও সার্কাস আস্তে লাগল। বর্ধমান শহরে সার্কাস দেখতে হত দিনের বেলায়। বেলা একটার শো। ম্যাটিনি। না হলে গ্রাম বাংলার লোক বাড়ি ফিরবে কী করে? দিনের বেলায় আলোর খেলা একরকম সুন্দর, রাতে না জানি কত ভাল।
সে শখ মিটল বাড়ি থেকে মাত্র ছয়-সাত কিমি দূরে সেহারা বাজার গোরুর হাটের উল্টোদিকে সার্কাস আসতে আরম্ভ করায়। সার্কাসে নানা মজার খেলা ছিল। বেশ কিছু খেলা ছিল বিপজ্জনক।
তরুণীদের স্বল্প পোশাকে হেঁটে যাওয়া ছিল দড়ির উপর। সেখানেই সাইকেল চালান। চালাতে চালাতে কাঁধের ওপর একজনকে তুলে নেওয়া ভয় পেয়ে যেতাম। পড়ে যাবে তো। শূন্যে লাফিয়ে হাত ধরে আরেক দড়ির প্রান্তে যাওয়া ছিল জল ভাত। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলেন জোকাররা। ওই খেলাগুলো ওঁরা করে দেখাতেন। পড়ে যেতেন। লোকে বলত ইচ্ছে করে পড়ছে। ওঁরাই নাকি আসল ট্রেনার। চার্লি চ্যাপলিনের 'সার্কাস' তখন দেখিনি ভাগ্যিস।
ছিল ছুরির খেলা। অতি ভয়ের। চোখ বাঁধা অবস্থায় একজন পুরুষ পিছন ফিরে একটার পর একটা বড়ো ছুরি/ড্যাগার ছুঁড়ে যেতেন দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীর চারপাশে। নিখুঁত নিশানা। সামান্য ভুল চুক হলেই একটি প্রাণ চলে যাবে। মনে মনে বলতাম, ওই খেলাটা যেন না দেখায়।
আরেকটা খেলা ছিল অনেকগুলো ভারি ড্যাগারওলা একটা চাকতি উপর দিকে ছুঁড়ে শুয়ে পড়তেন এক তরুণী। তরুণীর দু’পাশে এসে পড়তো ওই চাকতিটি। একটু ভুলেই জীবন শেষ। টিয়াপাখি সাইকেল চালাত। ভারি মজার ব্যাপার।
মানুষের বুকের ওপর দিয়ে হাতি হেঁটে যেত। বাঘ আর সিংহের গুহায় ঢুকে মানুষের লড়াই। সবচেয়ে ভয় লাগত, একটা গ্লোবের মধ্যে ঢুকে প্রথমে একটা তারপর দুটো তারপর তিনটে মোটরসাইকেল বোঁ বোঁ করে ঘুরত। ধাক্কা লাগলেই জীবন শেষ। ভালুকের খেলায় ভালুকের জ্বর হত। জোকাররা তাকে নিয়ে মজা করত।
হাতিরা ফুটবল খেলত। শট মারত। সেই শট যার গায়ে লাগত তার নিজেকে মহাভাগ্যবান মনে হত। এই শটগুলো প্রশিক্ষকরা বুঝে বুঝে মারাতেন। সব দিকে। সব গ্যালারিতে। দর্শকরাও চেঁচাতেন এই দিকে এই দিকে।
একবার মারাদোনা কলকাতায় এসে মোহনবাগান মাঠে বল মেরে আমাদের দিকে পাঠানোয় আমাদের সে কি উত্তেজনা। বল ছুঁতে কাড়াকাড়ি। বলই যেন মারাদোনা।
এই খেলায় দর্শক হাতি আর প্রশিক্ষকে একাত্মতা তৈরি হত। আর হাসির হুল্লোড় বইয়ে দেওয়ার জন্য জোকাররা তো ছিলেনই।
একটা হাতি ছিল, রামু। রামু খুব জনপ্রিয়। সত্য মিথ্যা যাচাই করিনি আজও, রামু নাকি 'হাতি মেরা সাথী'র সেই হাতি। রামু এলেই হাততালির ঝড়। রামু মারা যান সেহারা বাজারেই। রামু মারা যাওয়ার সার্কাসের শিল্পী এবং মালিকের সে কি কান্না। আশপাশের এলাকা থেকেও হাজার হাজার মানুষ এসেছিলেন রামুকে শেষ দেখা দেখতে।
কাতারে কাতারে মানুষ। একসঙ্গে এত মানুষ আগে কখনো আমাদের এলাকায় দেখিনি। সারিবদ্ধ ভাবে হাজার হাজার নারী পুরুষ শিশু রামুতে দেখেছিল। গোরুর গাড়ি করে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছিলেন।
সার্কাসের মালিক জায়গা কিনে রামুকে সমাধিস্থ করেন।
রামুর কবর বহু বছর ছিল এলাকার অতি দ্রষ্টব্য স্থান। সার্কাস থেকে বাঘ সিংহ হাতি ভালুকের বিদায় কতটা ভাল হয়েছে, প্রণেতারা যদি আরেকবার বিচার করে দেখতেন!