বর্ষা কাল এসেছে। মাছ নিয়ে একটু কথা হবে না, হয়। ইলিশ মাছ পাওয়া যাবে অঢেল (পকেট সামলে), ডিম ভরা কাতলা, বাটা, রুই, মৃগেল, কালবোশ। আক্ষেপ একটা আছে--
কত কত মাছ হারিয়ে গেল জীবন থেকে। বাংলাদেশের মাছ ধরার ভিডিও দেখেছিলাম, তাতে দেখি-- লাল ময়না মাছ।
'প্রাকৃতপৈঙ্গল' কাব্যে পড়া -
ওগগর ভত্তা
রম্ভঅ পত্তা।
গায়িক ঘিত্তা
দুগ্ধ সজুত্তা।
মইণি মচ্ছা
নালিচ গচ্ছা।
দিজ্জই কন্তা
খাই পুনবন্তা”।
সুকুমার সেন লিখেছিলেন, মানিকতলা বাজারে নাকি একসময় মৈনি বা ময়না মাছ পাওয়া যেতো।
আমি দেখি নি।
গ্রামে কী কী মাছ দেখেছি?
কুচো চিংড়ি, মাঝারি চিংড়ি, বাঁকা বলে এক আশ্চর্য পুকুরের সৌজন্যে গলদা চিংড়িও পেয়েছি। তাকে আমরা বলতাম, চ্যাংড়া। এটাই যে গলদা তা প্রথমে বই পড়ে, পরে খেয়ে এবং কিনে জেনেছি। এই গলদা চিংড়ি একবার অঢেল খাওয়ার একটা গল্প আছে, কলকাতায়, আরেক পর্বে বলা যাবে।
ছিল মৌরলা মাছ। মৌরলা ছিপেও উঠতো খুব। পুঁটি আর মৌরলা। জুনিয়র হাইস্কুলের গায়ে বাঁকা পুকুরের ওপর একটা কালভার্ট ছিল, আমরা বলতাম, পাকা বিরিজ, তার উপর আড্ডা বসত ধাপে ধাপে। মানে একবার বড় মেজ ছোটো -- এইভাবে নানা বয়সের মানুষ দখল নিত ওই বাঁকা ব্রিজের।
সেখানে ভাদ্র আশ্বিন মাসে একটা মজার খেলা ছিল, থুতু ফেলা। ফেললেই লাফিয়ে লাফিয়ে খেতে আসত ছুই মাছ। একটু নরম খেতে। কেউ কেউ মৌরলাও বলত। মৌরলা আসলে আরেকটা মাছ। তার সঙ্গে জুটতো আরো কিছু কুচো মাছ। লোকে বলতে, চুনো মাছ। তাদের নামকরণ হতো না। পুকুরে জাল দিলে ভিড় করে আসতো, গ্রামের মানুষ। গরিবদের দিয়ে দেওয়া হতো চুনো মাছ। অল্প রাখা হতো বাড়ির জন্য। তখন তো ফ্রিজ নেই, বিক্রি করাও খুব অসম্মানজনক বলে মনে করা হতো।
তাই ছোটো চারাপোনা ইত্যাদি ও চুনো মাছ দান করা হতো। চুনো মাছ পাঁচমেশালি। কুচো চিংড়ি, পুঁটি, ছোট মৌরলা, চাঁদা,ছোট ভোলা ইত্যাদি মিলে চুনোমাছ।
সেটা ছিল সামাজিকতাও।
একা একা খাওয়া যায় না।
লোকে বাড়ির লাউ কুমড়ো পুঁই উচ্ছে অন্যদের না দিয়ে খেতো না।
চুনো মাছের মধ্যে থাকতো ভোলা বা বেলে মাছ ফেলে দেওয়া হতো। কেউ খেতে চাইতো না।
আর ছিল চাঁদা মাছ। মাথায় পাথর থাকতো। থাকতো তারার চিহ্ন। আর ছিল পুঁটি। নানা রকম আকারের। বড় বা মাঝারিগুলো পদোন্নতি পেয়ে আলাদা হতো চুনোমাছ থেকে। পুঁটি মাছ ভাজা, চচ্চড়ি, ঝাল, টক--সব ভাবেই খাওয়া হতো। আর দেদার হতো পুঁটি শুঁটকি। সেগুলো ক্যানেলের ধারে ক্যানেলের পাড়ে বেশি হতো। আশ্বিন কার্তিক মাস জুড়ে। সারা রাত ধরে লোকে ক্যানেলের পাড়ে সাপের ভয় এড়িয়ে আড়া বসাতো। রাতে আড়া পাহারা দিত। তাতে শোল, চ্যাং, ল্যাঠা মাছও পড়তো্। চ্যাং বোড়া বলে একটা সাপ ছিল বিষাক্ত। চ্যাং মাছের মতোই দেখতে। আমি ভয়ে কোনোদিন খাই নি। সাপের মতো দেখতে ভেবে ল্যাঠা মাছও খেতাম না। শোল মাছ দেখি শহরে খুব দামি। আমাকে টানে নি।
পুকুরে হতো বাটা, চারাপোনা, মৃগেল, রুই, কাতলা, বোয়াল, গুলে, প্যাঁকাল।
কই মাছ শিঙি মাছ মাগুর মাছ সব পুকুরে হতো না।
ছোট এঁদো পুকুর, পাঁকে ভর্তি সেখানে কই শিঙি মাগুর জন্মাতো।
ফলুই মাছ মিলতো মাঝে মাঝে। আমার বড়দিদি ফলুই মাছকে শিলনোড়া দিয়ে হালকা করে থেতো করে ছাল ছাড়িয়ে কাঁটা মাংস বের করে কাঁটা ফেলে মাংসে মশলা মাখিয়ে সেলাই করে ভাজতেন।
এটা আমিও করতে শিখেছি।
মায়ের কাছে নাকি বড়দি শিখেছিল। কিন্তু আমি মায়ের কাছে এটা খাই নি।
অপূর্ব খেতে।
ফলুই মাছের রোস্ট।
চিতল আড় --- এ-সব কোনো পুকুরে হতো না।
আমাদের এক আশ্চর্য পুকুর আছে -বাঁকা। তিনশো মিটারের বেশি লম্বা। চওড়া ষাট মিটার। তার মধ্যে দিয়ে ডিভিসি বা দামোদর উপত্যকা নিগমের ক্যানেলের জল দক্ষিণ দিকের মাঠে যায়।
ওই পুকুরে কখনো মাছ ছাড়া হতো না।
অথচ চার ফুট লম্বা বোয়াল, দুফুটি আড় মাছ, বড় গলদা চিংড়ি মিলতো। আর পাওয়া যেতো বাণ মাছ। আমি সাপের মত দেখতে ভেবে খেতাম না। আর খেতাম না প্যাঁকাল মাছ। দাদা বলত, মরা গোরুর পেটে হয়। বোকার মত বিশ্বাস করে অন্যদের দিয়ে দিতাম প্যাঁকাল মাছের চচ্চড়ি।
এখন প্যাঁকালে মানুষ দেখি, মাছ দেখি কম। প্যাঁকাল মাছের ভারি দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কিলো।
এখন রাসায়নিক সার বেড়ে যাওয়ায় মাছ মাঠে কিছুই তেমন মেলে না।
১৯৯১-এ বাংলাদেশ গিয়ে একটা মাছের খুব সুনাম শুনি। কাঁচকি।
খাই।
খেয়ে বুঝি এ হচ্ছে আমাদের দাঁড়কে মাছের সমগোত্রীয়।
দাঁড়কে মাছ ধান জমির অল্প জলে রোদের খেলায় পুঁটি মাছের সঙ্গে জন্মাতো।
কৃত্রিম সার কীটনাশক ব্যবহারে তা লুপ্ত।
কৃত্রিমতা কত কী শেষ করে দিল!
আরেকটা মাছ ছিল। লম্বা বকের মতো লম্বা মুখ। কেউ বলতেন বক মাছ, কেউ বগা মাছ, কোথাও এটার নাম কাঁকাল বা কাঁকই। আরো নাম থাকতে পারে।
মঙ্গল কাব্যে এই মাছগুলোর কথা আছে।
চিতল ভেকুট রুই কাতল মৃগেল।
বানি লাঠা গড়ই উল্কা শউল শাল।।
পাঁকাল খয়রা চেলা তেচক্ষা এলেঙ্গা।
গুঁতিয়া ভাঙন রাগি ভোলা ভোলাচেঙ্গা।।
মাগুড় গাগড় অরি বাটা বাচা কই।
কালবসু বাঁশপাতা শঙ্কর ফলুই।।
শিঙ্গি ময়া পাবদা বোয়ালি ডানিকোণা।
চিংড়ি ট্যাংরা পুঁটি চান্দা গুড়া লোনা।।
গাঙ্গদারা ভেঙ্গা চেঙ্গ কুড়িশা খলিশা।
খরশুলা তপসীয়া পাঙ্গাশ ইলিশা”।।
এর মধ্যে গ্রামে কাতলা, মৃগেল, রাখা, শোল, তেচোখো, গুঁতে/ গুঁতিয়া, ভোলা, মাগুর, বাটা, বাঁচা, কই, কালবোশ, বাঁশপাতা, ফলুই, শিঙ্গি, বোয়াল, চিংড়ি, ট্যাংরা, পুঁটি, চান্দা, চ্যাঙ/ চেঙ্গ/ পাঙ্গাস দেখেছি।
এসব মাছের মধ্যে কালবোশের স্বাদ মনে রাখার মতো।
মাছ থাকবে আর মাছের কাঁটা থাকবে না!
তা কি হয়। একটা গান ছিল, ট্যাংরা তবু কাটন যায়, মাগুর মাছে ক্যাঁটক্যাঁটায়/ শিঙি মাছটা ধরছো...
ট্যাংরা মাগুরের কাঁটা হাতে ঢুকে গেল খুব ব্যথা করতো। টোটকা ছিল পেঁয়াজের রস আর মাঝেসাঝে মায়ের হোমিওপ্যাথি বাক্সের ওষুধ। একটু তরল দিয়ে হোমিওপ্যাথির গুলি খেতে ভারি মজা।
মাছের কাঁটা গলায় ঢুকলে প্রথম খকখক তারপর ভাতের গোল্লা পাকিয়ে গিলে ফেলা।
তাতেও না হলে আঙ্গুল দিয়ে চেষ্টা। পাকা কলাতেও নাকি কাজ হয়। আমার ছিল বই পড়তে পড়তে খাওয়ার অভ্যাস। এখনো আছে। ফলে মাছের কাঁটার কষ্ট গলাকে পেতে হয়।
মাছের ছাড়াও ছিল গাছের কাঁটা। কুল গাছের কাঁটা। ছোট ছোট। টের পাওয়া যায় না। ফুটে যাওয়ার পর জানান দেবে হাঁটার সময়।খেজুর গাছের কাঁটা ছিল ভয়ানক। দেখা যেত না। তারপর একসময় পেকে উঠতো পা। সেফটিপিন বা ছুঁচ ফুটিয়ে বের করতে হতো। বাবলা কাঁটা ফোটা মাত্র টের পাওয়া যেত। এমন তার মহিমা। জান বের করে দেবে। বেল গাছের কাঁটা পায়ের চেয়ে গায়ে বেশি ফুটতো বেল পাড়তে যাওয়ার সময়। বেঞ্চি বলে একটা ফল ছিল, তার গায়েও কাঁটা। কসরত করে পাড়তে হতো। ছোট গাছ বেঞ্চি। তিন চারফুটের বেশি নয়। কাঁটা হতো বেগুন গাছেও। বেগুন তুলতে গিয়ে হাতে একটু আধটু কাঁটা ফোঁটে। তবে সে সামান্য।
গরমকালে লোকে পুকুর কাটাত। পুকুরের জল দুনি তথা এক ধরনের টিনের লম্বা দেশীয় ছিঁচযন্ত্র দিয়ে মাথার উপর বাঁশ টাঙিয়ে দুনি বেঁধে জল ছেঁচা। পরে এল ছিঁচ কল বা ডিজেল চালিত শ্যালো। জল তুলে ফেলো অন্যপুকুরে। এক পুকুরের গায়ে আরেক পুকুর। মানুষ তবু আলাদা থাকে, আমাদের গাঁয়ে সব পুকুরের প্রতিবেশী ছিল।
চৈত্র বৈশাখ মাসে পাঁক শুকিয়ে যেত। ছোট ছাগল বা গোরু জলের খোঁজে নেমে ওই কাদায় আটকে পড়ত। সে এক বিড়ম্বনা। তাকে তোলা পাশের পুকুরে নিয়ে গিয়ে স্নান করানো। অনেক ঝক্কি। সব পুকুরে আবার গোরু নামানো যেত না।
পুকুরের পাড় বাঁধানো হতো পাঁক দিয়ে। তাকে রক্ষা করার জন্য কাঁটা দেওয়া হতো। বাবলা কাঁটার ডাল, খেজুর পাতার ডাল, কুল গাছের ডাল-- কত কী? লাগানো হতো পাহাড়ি কলমি আর বাঁশ।
বাঁশ লিকলিকে।
কিন্তু শিকড় তো বহুদূর ছড়ানো।
আমাদের লড়াকু অগ্নিপথী তরুণদের মতো।