ইদের প্রস্তুতি শুরু হতো অন্তত ১৫ দিন আগে। রোজা সেহরি ইফতারি তো চলছেই, তাতে ছোটোদের কী? আসল কথা ইদের দিনের মজা। নতুন জামা জুতো প্যান্ট যদি জোটে আর খাওয়া তো বিশেষ রকমের।
তবে আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান সবার প্রধান আনন্দ ছিল মাঘ মাসের ওলাইচণ্ডী পূজার মেলায়।
দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা আছে-- আছে ইদ বকরিদ মহরম--- কিন্তু মাঘ মাসের মেলাই আসল মিলবার জায়গা। সেটা হলেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ। আত্মীয় স্বজন কুটুম আসার এই তো আসল সময়।
দুর্গাপূজার সময় অনেকের ঘরেই অভাব। ইদ বকরিদ ধান ঝাড়ার সময় কবার আর হয়?
পৌষ মাসে ধান কাটা শেষ। মাঘ মাসের ১৯ তারিখ মেলা। হাতে পয়সাও ম্যালা।
ফলে আনন্দের অর্থই আলাদা। কাঠের নাগরদোলা, পাঁপড় চপ বেগুনি পেঁয়াজি ঘুগনি, জিভে গজা পান্তুয়া লেডিকেনির দোকান বসে মেলায়। দুর্গাপূজা বা ইদে তো সেসব অনুপস্থিত।
বাঁশি কেনা, ঘড়ি কেনা, টিকটক কেনা, লাট্টু কেনা, রঙিন চশমা-- সেতো ইদ বকরিদ দুর্গাপূজায় সবার সম্ভব নয়।
কিন্তু ইদে একটা অন্য আনন্দ ছিল। বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করতে পারতাম। দীনু, জগন্নাথ, দিলীপ, নিখিল, প্রশান্ত, দিবাকর, তাপস, নবদের ইদ নাই। ওঁদের নিমন্ত্রণ সিমুই লাচ্ছা মিষ্টি খেতে।
আচ্ছা বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছি, কোনো বান্ধবীকে তো করিনি।
মেয়েরা মেয়েদের নিমন্ত্রণ করতো--সেটাই ছিল প্রথা।
দুর্গাপূজার সময় উল্টো।
আমি আজম কালাম সিরাজ আলাম নিমন্ত্রণ খেতে যেতাম অষ্টমীর দিনে। লুচি ছোলার ডাল নারকেল নাড়ু ক্ষীরের খোয়া। সে গল্প আরেকসময়।
জগন্নাথ আর নিখিলের মায়ের মতো জিরে দিয়ে ছোলার ডাল আমি আর কখনো খাইনি।
ইদে বকরিদে গ্রামে বিরিয়ানি কোনোদিন হয় নি। এখনো আমাদের গ্রামের বাড়িতে হয় না।
৯৯ ভাগ বাড়িতেই হয় না।
ইদানীং সামাজিক মাধ্যম ও দূরদর্শনের প্রভাবে হয়তো হচ্ছে। বিশেষ করে শহর কলকাতায়। মেটিয়াবুরুজের মতো বিরিয়ানির জায়গাতেও ঘরে ইদ বকরিদে সাদা ভাত বা পোলাও ও হরেক রকম মাংস হতো।
এখন দিন ও রুচি বদলাচ্ছে।
উত্তর ভারতীয় প্রভাব বাড়ছে খাওয়া দাওয়া পোশাক ও চিন্তায়। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েই। চিন্তার বিষয়।
মজার বিষয়, মোগলাই খাবারদাবারের প্রভাব যত সমাজে বাড়ছে বিপরীতে মুসলিম বিদ্বেষ তত বাড়ছে।
সমাজবিজ্ঞানের ভাবার বিষয়। এখন পাড়ায় বিরিয়ানি দোকান।
আশি নব্বই দশকে হাতে গোনা কয়েকটি।
এখন কলকাতায় মোড়ে মোড়ে। রাজ্যের শহরে একাধিক।
বর্ধমান শহরে আশির দশকে বিরিয়ানি একটা হোটেলে হতো। খেতে গেলে আগে অর্ডার দিতে হতো। প্রান্তিক হোটেলে।
ঘরে ঘরে হতো সিমুই লাচ্ছা মিষ্টি। ভাত পোলাও নানারকম মাংস। তবে আলু মাংসের ঝোল সব ঘরেই। এবং ওটাই ছিল সেরা।
হিন্দু সম্প্রদায়ে জন্মানো বন্ধু দুপুরে খেলে মানে অন্য গ্রাম থেকে এলে মুরগির মাংস হতো।
এবং আমাদেরও খেতে বসে দাদা বাবার ভয়ে তাই খেতে হতো।
গোরুর মাংস চলবে না বন্ধুদের সামনে।
ইদের প্রস্তুতি শুরু হতো অন্তত ১৫ দিন আগে।
আমাদের বাড়িতে মোট তিনটি সেমাই বা সিমুই কল ছিল। দুটি পেতলের একটি হাল আমলের। স্টিলের। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরিও মিলতো।
সিমুই কেনা হতো না।
ময়দা বা আটা দিয়ে বানানো হতো। সরু মাঝারি মোটা-- নানা ধরনের ঝাঁঝরি থাকতো। সিমুই কলের হাতল হাত দিয়ে ঘোরাতে হতো। সে-কাজ আমাদের মানে ছোটোদের দায়িত্ব। এই ঘোরাতে চাওয়া ও না-চাওয়া নিয়ে ভাই বোনেদের চাপান উতোর চলতো। খেতে সবাই আগ্রহী। কাজে আগ্রহ কম।
তবু মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতাও হতো। কে কত ভালো করে ঘোরাতে পারে। তিনটি কল চলছে। কার বেশি হলো- - দেখি!
লাচ্ছা কেনা হতো। রঙিন লাচ্ছা ছিল ছোটবেলায় পছন্দ।
বাবা তো ঘিয়ে রঙের বা সাদা রঙের লাচ্ছা আনতেন বর্ধমান শহর থেকে। আমাদের চাহিদার বিপরীতে।
এখন বুঝি রঙিন কত খারাপ।
তখন ওটাই ছিল আনন্দ।
মতিলাল দাদু বা দুগোদাদার দোকানে লাচ্ছা, গুঁড়ো দুধ চিনি গুড়-সব পাওয়া যেতো। দু একবার দুগোদা জামাকাপড় শাড়িও এনেছেন।
ইদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটা গল্প বলি।
আমাদের গ্রামের অত্যন্ত সম্মানিত মানুষ ছিলেন শান্তি চক্রবর্তী। বিজ্ঞানের শিক্ষক। পাশের পলাশন বাজারের উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন। শান্ত সুদর্শন বিনয়ী মানুষ।
বাবার বন্ধু।
নাতিকে নিয়ে ইদের নিমন্ত্রণ খেতে এসেছেন।
নিজে খেলেন। নাতিকে দেন নি। বৌমা কীভাবে নেবেন-- বুঝতে পারেন নি। এগাঁয়ে হিন্দু মুসলমান ভেদ নাই। তেমন ছোঁয়া ছুঁয়ি নাই। বৌমাদের ঘরানা যদি আলাদা হয়!
নাতি দাদুর সম্মান রক্ষার জন্য কিছু বলেনি। চুপচাপ দেখেছে দাদুর খাওয়া।
বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর নাতি দাপট, এবং বায়না--আমি লাচ্ছা খাবো।
তো কী করা যায়, দুগোদার দোকান থেকে কিনে আনা।
কিন্তু নাতি খাবে না। একবারও নয়।
তাঁর এক কথা: এনামের লাচ্ছাই খাবো।
শেষে শান্তিবাবু এসে আমাদেরবাড়ি থেকে নিয়ে যেতে গেলেন।
আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়ি আমরা লাচ্ছা সিমুই পৌঁছে দিয়ে আসতাম। প্রণাম করে আসতাম।
আত্মীয় স্বজনের বাড়ি খাবার দেওয়া আসা ছিল দস্তুর।
সুবিধাবঞ্চিত গরিব মানুষদের তো দিতেই হতো।
খাঞ্চা করে উপরে সুন্দর সুতোর কাজ করা কাপড়।
তবে এইদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম বা কদমবুচি করাই ছিল প্রথা।
সিমুই লাচ্ছা মিষ্টি রাখা থাকতো। যাঁরা আসতেন। খেতেন।
এখন এইসব প্রথা প্রায় অবসিত।
বেশিরভাগ মানুষ নামাজ পড়েই ঘরমুখো। ইদের মাঠেই যা কোলাকুলি।
এই শোন তুই আজ খাওয়াবি। আজ তোদের ইদ না।
'তোদের' কথাটা একটু কানে ঠেকলো। কারণ ধম্মকম্ম করি না।
পরে বুঝেছি, মানুষটি উদার ধর্মনিরপেক্ষ সিংহ হৃদয়।
বক্তা শৌনকদা। যাঁকে লোকে 'বড়দা' বলে।
শুনেই চিত্তির। পকেটে পয়সা নেই। ঢুঁ ঢুঁ। সাড়ে তিন টাকা মাত্র পড়ে আছে।
বাড়ি থেকে পয়সা ১৯৮৩ থেকেই নিই না।
আর এখন তো প্রশ্নই নেই।
১৯৯৫। প্রথম মাস। 'আজকাল'-এ। আর সবাই জানেন, চাকরির প্রথম মাসে কী ঝামেলার। সবাই ভাবে চাকরি, কত পয়সা! এদিকে পকেট গড়ের মাঠ।
আমি তো যত্র আয় তত্র ব্যয় নীতিতে চলি।
ভোরে উঠে কলকাতার মেস থেকে ব্যান্ডেল গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। ফিরছি। একটা বইয়ের স্টলে দুটো বই দেখে লোভ সামলানো গেল না। কিনে ফেললাম। এবার আসার পথে পয়সা নেই, টিকিট কাটতে পারি নি। সাকুল্যে ১০ টাকা পকেটে।
বেলুড়ে নেমে আট আনার টিকিট কাটবো ভেবে উঠেছি। টিটিকে দেখেই লজ্জায় ঝাঁপ চলন্ত ট্রেন থেকে। ভদ্রেশ্বরের আগে।
লোকজন চিৎকার করছিল। ভাবছিল, মরেই গেছে।
আমিও ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার রুমমেট দেবু টিটির হাত থেকে বাঁচতে ট্রেন থেকে পড়ে মরে যায়।
আমিও ভাবলাম, আমার আজ শেষ দিন।
ছোটো বেলায় চলন্ত ট্রেনে খুব উঠেছি, নেমেছি। কিন্তু সে কয়লার ইঞ্জিন। মিটার গেজ।
এ বিদ্যুৎ ট্রেন।
যাক, মরি নি, বেঁচে গেছি। একটু আগে ছেড়েছিল। কিন্তু জোর ছিল খুব।
প্যান্ট ছিঁড়েছে।
হাঁটু রক্তাক্ত।
ঘাস দিয়ে মুছে নিই।
তারপর দু কিলোমিটার খুঁড়িয়ে হেঁটে পরের স্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠি।
আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে 'আজকাল' দপ্তরে পৌঁছাই।
শুক্রবার 'আজকাল'-এর রবিবারের পাতা মেক আপ হবে।
রবিবার একটা আমার বড়ো লেখা যাবে।
শৌনকদা দেখেই স্বভাবসিদ্ধভাবে বলে উঠলেন, এই যে বাবু হাজির! কতক্ষণ বসে আছি জানো!
বলে, কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, চল, মেক আপের আগে একবার দুজনে চোখ বুলাই।
শিশিরের কাছে পাতা দেখে ক্যান্টিনে খেতে যাওয়া।
আদি তখন ক্যান্টিনে বসতো।
গম্ভীর।
খেতে বসে শৌনকদা অর্ডার করলেন মাংস ভাত। তারপর জিরের ঝোল মাছ। ডিমের কষা।
তারপর শেষে মিষ্টি দই। রসগোল্লা।
আমার তো গলা দিয়ে খাবার নামছে না।
কী করে দাম দেবো।
দাম বেশি নয়। 'আজকালে' সস্তার ক্যান্টিন।
কিন্তু অন্তত কুড়ি টাকা তো লাগতে পারে। দুজনের।
ভাবছি, শৌনকদা যখন হাত ধুতে যাবে, আদিকে বলবো, ভাই বাকি রাখো। রাতে দিয়ে দেবো। কী করে দেবো সে-ও যদিও জানি না।
ও মা শৌনকদা ওঠেনই না।
কাগজ দিয়ে হাত মুছে ইদের গল্প শুনতে চান।
তোকে বাড়ি যেতে দিলাম না, বল, আজ কি বাড়িতে বিরিয়ানি?
তখন বিরিয়ানি ব্যাপারটা এমন জলভাত ছিল না।
খেতে হলে রয়াল, সিরাজ, আমিনিয়া, নয় সাবির।
রাজাবাজারের অপূর্ব বিরিয়ানির সন্ধান পরে দিলেন জ্যোতিপ্রকাশ খান। গৌতম রায়, দেবজ্যোতি ঘোষের সঙ্গে রাজাবাজারে জ্যোতিদার কল্যাণে আমার বিরিয়ানি প্রেম দীক্ষা।
আমি বিরিয়ানি পছন্দ করতাম না তখন।
কষা কষা মাংস আর আলু মাংসের জিরা ঝোল দিয়ে সাদা ভাত ছিল মনপসন্দ।
বললাম, বাড়িতে বিরিয়ানি হয় না। মা জর্দা পোলাও খুব ভালো করেন।
একবার যাবো তোর বাড়ি। নিয়ে যাবি? তোদের কী মজা বল, দেশের বাড়ি আছে?
ঠিক আছে দাদা।
আমি পকেটে হাত দিই। দাম দেবো বলে। নেই তো টাকা। এখন সাড়ে তিন টাকা আছে। জানি।
ভাবি চুপিচুপি গিয়ে তিন টাকা জমা দিয়ে বাকিটা রাতে দেবো বলবো।
কিন্তু রাতেই বা কী করে দেবো?
শৌনকদা কী বোঝেন জানি না, আদিকে ডাকেন।
শোন, এই ছোকরার সাহস কম নয়, ইদের দিন দাম দেবে ভাবছে। আরে বড়দাকে খাওয়ানো এতো সোজা। ইদের খাওয়া এতো কমে হবে না।
আমার চোখ জলে ভিজে ওঠে।
হাত মুখ ধোওয়ার অছিলায় বেসিনে চোখের জল ভাসিয়ে দিই।
এখনো ভিজছে শৌনকদা।
আপনি তো সবার বড়োভাই ছিলেন শৌণকদা।
'রামায়ণ' নিয়ে লিখতে বলেছিলেন।
লিখি নি।
এবার লিখবো বড়দা।
এখন ফেসবুক খুলে দেখি, আপনার আমার প্রিয়জন শঙ্খ ঘোষের শেষযাত্রার লাইভ আপনি শেয়ার করেছেন।
একটাই লাইক সেখানে।
আমার।
শৌনকদা আপনি যেখানে যাবেন, সবাই আপনার ভক্ত হয়ে যাবে।
যাবেই।
মায়েরা মে কেন মা-- অনেকসময় চলে যাওয়ার পর বোঝা যায়। মা থাকতে অনেকেই বোঝেন না। তুমি আমার জন্য কী করেছো -- গোছের কথা বলেননি, এমন বাঙালি কম।
একবার বলেছিলাম।
এখন বুঝি কী ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছিলাম।
মা মানে সবকিছু বুঝে ফেলা।
মা মানে সবকিছু ধরে ফেলা।
এক পলকে।
অভিমান, বেদনা, অনুযোগ, অভিযোগ।
মা মানে বাবার কাছে সওয়াল পেশ করার দূতী।
ইদ এলেই মনে পড়ে মাঝরাতে ঘুমের মাঝে হাঁড়ি খুন্তি কড়াই নাড়ানোর শব্দ।
মা মানে কাছে ডেকে, খেয়ে নে। না খেয়ে পাড়া বেরোস নি।
মা মানে, সব কিছু গুছিয়ে আপ্যায়ণের ব্যবস্থা।
বাবার বন্ধু, দাদার বন্ধু, আমাদের বন্ধু, দিদির বন্ধু, ভাইবোনদের বন্ধু, পার্টির লোক, কাজের লোক-সবর পছন্দ রেখে রান্না।
হিন্দুরা খাবে। অতএব সেই হাঁড়ি কুঁড়িতে যেন গোমাংসের ছোঁয়া কোনোদিন না লাগে গুনাহ হবে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন খেয়ে গেলে তবে গোমাংসের কাজ।
আলাদা রান্নাশালা।
গ্রাম বাংলার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে দেখেছি, অন্য ধর্মের মানুষের দিকে খেয়াল রাখতে।
টীকা টিপ্পনি ছিল, শিক্ষিতদের মধ্যে।
মাকে পাঁচ বছর বয়স থেকেই সাদা শাড়ি পরতে দেখেছি। দিদির বিয়ে হয় ১৯৭১-এ। শাশুড়ি আবার রঙিন কাপড় পড়বে কী? তার মানে তখন মায়ের বয়স মাত্র ৩১।
সবার মা-ই তাঁর চোখে সুন্দর।
আমার মা স্মৃতিতে কী অতীব সুন্দরী।
এই আজকাল লোকে শুনতে পছন্দ করছে, মুসলমান বাড়িতে নাকি ছবি নিষিদ্ধ ছিল। এইসব আজগুবি আজাইরা কথা লিখলে ছদ্ম সূক্ষ্ম সুপ্ত সাম্প্রদায়িকদের প্রকাশ্য স্তুতি শোনা যাবে। রবীন্দ্রনাথ নজরুল ক্যলেন্ডারে দিব্যি থাকতেন। ক্যালেন্ডারের নিয়ম ছিল, গ্রাহক বা খদ্দের নিজে বেছে নিতেন। যেটা পছন্দ সেটা নেবেন। অপছন্দের শাড়ি ঘরে যেমন আসবে না, ক্যালেন্ডারও।
মুসলমানরা কত্ত গোঁড়া, তার মাঝে আমি বা আমার পরিবার মুসলিম হয়েও কত প্রগতিশীল তা দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হল বলে।
ইদের দিন নতুন জামাই নিয়ে সদলবলে সেহারাবাজারে টিনের হল অথবা পয়সা বেশি থাকলে বর্ধমানে সিনেমা দেখতে যাওয়ার দস্তুর ছিল।
উত্তম সুচিত্রা সবার প্রিয়।
আমার বাবার মতো কিছু মানুষ দিলীপ কুমারের নীচে নামতেন না।
কিন্তু উত্তম সুচিত্রার ছবি আমরাও বাবা মায়ের সঙ্গে হলে গিয়ে দেখে এসেছি। সে গল্প আরেক দিন।
আমাদের গ্রামে ১৯৭৩ থেকে স্কুলে রবীন্দ্র নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে দুদিন ধরে নাটক হতো। ছেলেদের একদিন। মেয়েদের একদিন।
রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর' অভিনয়ের কথা মাস্টারমশাইরা সেরা মনে করতেন। বড়দা অমল, মেজদি সুধা।
আমাদের সব ভাই-বোন স্কুলে নাটক করেছি।
আমাদের গ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত।
মেয়েদের নাটকে ৯৯% ছিল জন্মসূত্রে মুসলিম মেয়ে।
১৯৮৭-র পর থেকে কমে এল এই প্রবণতা। তবে মাঘ মাসে ওলাইচণ্ডী পূজা উপলক্ষে যাত্রার সময় ধূম লেগে যেতো। এখন টিভির দাপটে অ্যামেচার মাত্রা কমেছে। তবে একদিন এখনো হয়। এবং তার ৯৫% অভিনেতা মুসলিম।
আর ছবি রবীন্দ্রনাথ নজরুল ক্যালেন্ডরে থাকতেন।
কারো বাড়িতে বাঁধানো।
তবে কংগ্রেস হলে গান্ধী এবং সিপিএম হলে মার্কসের ছবি অনেক বাড়িতেই ঝোলানো থাকতো। ব্রিগেডের মাঠে আট আনা এক টাকা দামে সাদা কালো ছবি বিক্রি হতো মার্কস লেনিন স্তালিনের ছবি। তবে মাও সে তুং ছিলেন না। গান্ধীও না। ২৬ জানুয়ারি আর ১৫ আগস্টে গান্ধী নেতাজির ছবি মিলতো।
স্কুলে পড়েছেন, অথচ বাড়াতে প্ল্যাস্টার অফ প্যারিসে নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ নজরুল শরৎচন্দ্রের ছবি লাগাননি হতে পারে না।
শরৎচন্দ্র কর্মশিক্ষার প্ল্যাস্টার অফ প্যারিসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
একমাত্র নেতাজি তাঁর সঙ্গে লড়র ক্ষমতা রাখতেন।
কথায় কথায় দূরে চলে এসেছি।
আরেকটি মিথ ভাঙতে হবে।
ইদে গ্রামে সত্তর আশি নব্বই দশকে বিরিয়ানি। হতো না। সাদা ভাত খুব বেশি হলে পোলাও। আর নানা ধরনের মাংস।
তবে সবচেয়ে ভালো লাগতো আলু দিয়ে মাঝপাতারি মাংসের ঝোল।
এখন যা ঝোলাঝুলি শুরু হয়েছে, ঝোলের দাম থাকে না।
অবশ্য দম থাকলেই হলো।
দমটাই জরুরি।