পর্ব ৩০
কী খেলতাম আমরা ছোটোবেলায়? ভাই-বোন দিদি, পাশের বাড়ির ছেলে মেয়েরা মিলে? রান্নাবাটি খেলা। পুতুল খেলা। লুকোচুরি, চু কিৎকিৎ। নুনচিক বা গাদি বা জাহাজ খেলা। হাডুডু কবাডি। শীতে মার্বেল। ভাঁটা খেলা। গুলিডাং। বড় বাতাবি লেবু দিয়ে বা প্ল্যাস্টিক জড়িয়ে বল বানিয়ে কিংবা একটাকা দিয়ে প্ল্যাস্টিকের ফুটবল কিনে খেলা।
আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় খামার ছিল। বৈঠকখানার দু পাশ জুড়ে। সেখানে ও পাশের বাড়ির খামার মিলে অনেকটা জায়গা। একটু বড় হতে সাঁতার শিখে জলচুরি মানে জলে লুকোচুরি খেলা। ডুব সাঁতার দিয়ে অন্যকে ছোঁয়া। আর ছিল মারাত্মক ঝালঝাপাটি।
ঝালঝাপাটি খেলার বিবরণ একটু দেওয়া যাক। দুটো পক্ষ হবে। একপক্ষ গাছে চড়বে। আরেকপক্ষ নীচে পাহারা দেবে। বিপক্ষের পাহারাদারদের এড়িয়ে মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে নামতে হবে। একজনও ধরা পড়লে দলের সবাইকে পাহারা দিতে হবে। বাহাদুরি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবচেয়ে উঁচু ডাল থেকে ঝাঁপ দিতে গেয়ে পায়ে ব্যাপক চোট। পায়ের পাতা ফুলে ঢোল। কদিন চুন হলুদ লাগিয়ে বসে থাকা, তারপর কে কথা শোনে! এই খেলাটা ছিল গ্রীষ্মের।
দুপুরে পুকুরে হতো গাছের ডাল থেকে ঝাঁপানো। জিজ্ঞেস করা হতো-- কী লিঙ্গা? গাছ লিঙ্গা না জললিঙ্গা?
জলেই মজা বেশি। এখানে স্থলের খেলার নিয়মের উল্টো। ওখানে গাছে মজা বেশি। এখানে জলে যেই ঝাঁপাবে, ধরে চোবাও তাকে।
আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল দুই পরিবারের যৌথ পুকুর তালপুকুর। সেই পুকুরের জল ছিল ভালো। আট দশ বাড়ির এন্ডি গেন্ডির আস্তানা হতো তালপুকুর। শীতে স্নান করতে চাইতাম না আর গ্রীষ্মকালে উঠতে। ঘন্টা দুয়েক কমপক্ষে। মুখে শ্যাওলা দেখা যেত। চোখ লাল। মায়েদের আগমন ঘটতো কঞ্চি হাতে। তবে জল শান্তি পেতো।
ওই জলেই সাঁতার শেখা। প্রথমে ঘাটের কাঠ ধরে লম্ফঝম্প। তারপর কলা গাছের ভেলা ধরে।
মাসখানেক যেতে না যেতেই সবার দশা হতো কে কাকে দেখে!
জলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পাঁক তুলে আনা মাঝপুকুর থেকে। পুকুর বড়ো গভীর। চার থেকে পাঁচ মানুষ মানে ২৫-৩০ ফুট গভীর।
মাত্র একবার কাটাতে দেখেছি পুকুর। সেজন্য খুব ঝামেলার। বড় কষ্ট ও আনন্দের ছিল পাঁক তুলে আনা। ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে মেয়ে একসাথে সাঁতার লুকোচুরি খেলেছি।
মহিলারাও ঘাটে স্নান করতেন। তবে আমাদের ঘাটে তালপাতা দিয়ে একটি আব্রুর ব্যবস্থা ছিল। বাঁশ পুঁতে তালপাতা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হতো।
রান্নাবাটি খেলা মানে একদম ছোটোতে। মাঘমাসের ওলাইচণ্ডী পূজোর মেলা থেকে কেনা খেলনাপাতিতে ধুলো শাকপাতা ছিঁড়ে রান্না বান্না খেলা। ৫-৬ বছর বয়সে দাদির কাছে থেকে লুকিয়ে কড়াই জোগাড় করে রান্নাঘরের ওস্তাদি। আমার সেজদিদি ওস্তাদ রাঁধিয়ে। আর সঙ্গী ছিল সইমা-র ছেলে গেঁড়া। ওই রান্না বান্না খেলতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাক--নুনে শাক। নাকের ছোটো নথের মতো দেখতে। ছোট্ট। মাঝখানে ফোলা। একটু টকটক নোনা স্বাদ। বাড়িতে নিয়ে এলে মা পাত্তা দেয় না। কী না কী এনে হাজির করেছে! আগে ফাঁকা জায়গায় পায়খানা করতো লোকে। ওখানেও করতো। পাত্তা না পাওয়ার কারণ ছিল। একদিন আমরা রান্না করে জোর করে খাওয়াই মাকে।
নুনে শাক দিয়ে ডাল অসাধারণ। শুধু রান্নাও দারুণ। খাসি বা গোরুর মাংসের সঙ্গে খেলে জীবনের শ্রেষ্ঠ দুটি মাংসের পদে রাখতে বাধ্য হবেন। শুনেছি, পার্ক সার্কাস বাজারে পাওয়া যায়। শান্তাভাবির কাছে খেয়েছি বছর পাঁচেক আগে। এই পদটি তার কাছেই শেখা। অপূর্ব।
যাই, ছুটি, পার্ক সার্কাস, দেখি একবার পাই কি না!!
(১০.১০.২০২০)
পর্ব ৩১
একটু বড়ো বেলার গল্প বলতে হচ্ছে। কারণ এই সময়েই জন্মছিলেন এক অসাধারণ শিল্পী। পীযূষকান্তি সরকার। উলুবেড়িয়ায় দেশের বাড়ি। গিয়েছিলাম কদিন আগে। পীযূষকান্তি সরকারের জন্মদিনও কদিন আগেই গেল। তাই বলার ইচ্ছে:
আজ থেকে ২২ বছর আগে। ভাষা ও চেতনা সমিতি থেকে ঠিক করা হলো সারারাত বাংলা ভাষা উৎসব উদযাপন হবে ২০ ফেব্রুয়ারি। একুশের শহিদ স্মরণে। কেউ কেউ বললেন, পাগল। কেউ কেউ বললেন, আছি। বন্ধু সুবীর মণ্ডল চলে এলো বাড়িতে। সারাদিন ফোন ঘোরানো। দুপুরে আলু সেদ্ধ ডবল ডিম ভাত খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই। পরদিন আবার। অবশেষে বিশে ফেব্রুয়ারি এলো। 'আজকাল' ভালো করে খবর করেছে। অশোক দাশগুপ্ত বিনা পয়সায় বিজ্ঞাপন ছেপে দিয়েছেন। উদ্বোধনের আগের দিন বিকেলে ইস্তাহার বিলি করছি। এগিয়ে এলেন পীযূষকান্তি সরকার।
- কাল উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবে কে?
- বললাম, দেবারতি সোম।
- ঠিক আছে দেবারতিকে বলো পীযূষকান্তি সরকার গাইবে। দেবারতিও থাকবে। বাংলাভাষা উৎসব হবে পীযূষকান্তি গাইবে না, হয় না।
আমরা ভয়ে ওঁকে ফোন করি নি। কিছু যদি বলেন। তো পীযূষকান্তি তখন দুবেলা শুনি। হাতে চাঁদ পেলাম।
পরদিন একটু বিভ্রাট হলো। অন্নদাশঙ্কর রায় উদ্বোধন করলেন। অরুণ মিত্র অমিয় বাগচী জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মৃণালিনী দাশগুপ্ত প্রমুখের উপস্থিতিতে। অশোক মিত্রের অন্য একটি সভা ছিল। দেরিতে আসবেন বলেছিলেন। এলেন। বিদ্যুৎ নেই। লাইন কাটা। খালি গলায় ভাষণ দিলেন রবীন্দ্রনাথের মূর্তির সামনে। বললেন সমীর গোস্বামী। ঘোষণা করলেন, একদিন এই উৎসব বাংলায় ছড়িয়ে পড়বে।
রাতে বিরাট চিন্তা। ১০ টা থেকে শুরু হবে। এদিকে বিদ্যুতের লাইন কাটা। কী হবে। দৌড়াদৌড়ি করছি। বাংলা একাডেমির সচিব সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায় চেষ্টা করলেন।
নন্দন ছুটলাম। সেখানে দেখি একজন বসে খুব চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে বিদ্যুৎ না পাই। শেষে উদ্ধার করলেন বিদ্যুৎ দপ্তরের এক ঠিকা কর্মী ইন্দ্রজিৎ।
তিনি বললেন, ওঁরা চলে গেলে ঠিক ১০ টায় আমি লাইন জুড়ে দেব। জ্যোতিবাবু এলেও কাটতে পারবেন না। চাবি নিয়ে আমি ধাঁ। এই লাইন পিজির সঙ্গে জোড়া। কাটলেই মুশকিল
কিছু টাকা দিতে গেলাম। নিলেন না। বললেন, ভালো কাজ করছেন বাংলা ভাষার জন্য। আপনাকে চিনি। যান।
এদিকে মঞ্চের কাছে ফিরে স্বল্প পথ আলোয় দেখি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদীপ ঘোষ ঘোরাঘুরি করছেন। ওঁরাও সমব্যথী। এবং চিন্তিত বিদ্যুৎ যদি না আসে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রদীপদা বললেন, আমরা একটু আগেই চলে যাবো। কবিতা বলে। রাতে ফেরার ট্যাক্সি পাবো না। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। তারপর প্রদীপ ঘোষ। দেবতার গ্রাস শোনালেন। পড়া শেষে বললেন, মাইক ভালো নয় বুঝলে। দর্শকরাও এক কথা বললেন।
জানা গেল, হাসি পাঞ্চালের অনুষ্ঠান আছে শিশির মঞ্চে। সবাই বললেন, ওঁকে চাই। শ্রোতা দর্শকদের কয়েকজন সঙ্গে গেলেন। তাঁদের বলা হলো। দু হাজার টাকা চায়। রাজি হলাম। নতুন শব্দ যন্ত্র লাগলো।
রাত ১১টা নাগাদ এক শিল্পীর বক্তব্য ঘিরে একটু উত্তেজনা তৈরি হল। শিল্পী এবং সঞ্চালক দুই মতের। একটু হাতাহাতিও হয়ে গেল দর্শক মহলে।
এ-সব দেখে প্রদীপদা বললেন, আমি থাকছি বুঝলে। সারারাত রয়ে গেলেন।
প্রদীপদা আপনি থাকবেন। আপনারা থাকবেন। বাংলা বাচিকশিল্প যতদিন থাকবে।
সেবারের শিল্পী তালিকা: যতদূর মনে পড়ছে -
আবৃত্তি:
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদীপ ঘোষ জগন্নাথ বসু ঊর্মিমালা বসু শুভ দাশগুপ্ত দেবাশিস বসু সতীনাথ মুখোপাধ্যায় রিচা সরকার শোভনসুন্দর বসু ঐশ্বর্যা বসু কাজল সুর পরিচয় বসু
সঞ্চালনায়: সুবীর মণ্ডল মধুবন্তী চট্টোপাধ্যায়
সঙ্গীত: পীযূষ কান্তি সরকার, সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত অজিত পাণ্ডে শুভেন্দু মাইতি দেবারতি সোম বিপুল অনুশ্রী চন্দ্রাবলী রুদ্র দত্ত পল্লব কীর্তনিয়া নাজমুল হক দেব চৌধুরী রাঘব চট্টোপাধ্যায় অনসূয়া চৌধুরী শ্রাবণী সেন রাজশ্রী ভট্টাচার্য নীপা ভট্টাচার্য সুপান্থ বসু সুপ্রিয় চক্রবর্তী শৈবাল দে তাপসী রায়চৌধুরী অমিত দাশগুপ্ত বর্ণালী দাস সুতপা শৌভনিক
সেদিন দর্শক হিসেবে ছিলেন বহু গুণী মানুষ।
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী হাসপাতাল থেকে কিছুদিন আগে বের হয়েছেন। তিনিও থেকে গেলেন। সুমিত চৌধুরী বাসুদেব বসুরা ছিলেন দীর্ঘসময়। ওই রাত ছিল ঐতিহাসিক। কারণ এই প্রথম এই বাংলায় সারারাত একুশে উদযাপন। রাত ১২ টায় মশাল মিছিল। বহু মানুষ তখন একুশে ফেব্রুয়ারির কথা সেভাবে জানতেন না। ওই মঞ্চেই সম্ভবত প্রথম সুমন চট্টোপাধ্যায় নচিকেতা একসঙ্গে। দুজনকে নিয়ে তখন শ্রোতার দল আড়াআড়ি বিভক্ত।
বাকি পরে।