মানুষ ও মানুষের জীবন এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
আমার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা হলো অন্যরকম। আমি ফর্ম বা আবেদনপত্র জমা দিয়ে এসে বাড়িতে এইসব অভিজ্ঞতার কথা কিছুই বলি নি। কিন্তু মায়ের চোখ। ধরা পড়ল, আমি পরদিন বাড়ি ফিরে ভাত খেতে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছি। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগের দিন মা দেখি, একশো টাকা দিয়ে বলছেন, এটা রাখ।
আমি যতো বলি, এতো টাকা লাগবে না। মা শুনবেন না। একশো টাকা তো অনেক টাকা। আমার বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ভর্তি হতে ৬২ না ৭৪ টাকা লেগেছিল। কলেজে ভর্তি হতে লেগেছিল ১২০ টাকা। তাই ১০০ টাকা ১৯৮২-তে অনেক টাকা। বর্ধমানের কার্জন গেটে জনতা হোটেলে পাঁচ সিকেতে (এক টাকা চার আনা) পেট পুরে মাছ ভাত পাওয়া যেতো। চালের কেজি এক টাকা থেকে বড়জোর দেড় টাকা। খেতমজুরদের দিনে দু'টাকা মজুরির দাবিতে এক মাস ধর্মঘট করতে হয়েছে। ছশো টাকা বিঘা জমি। এখন তার দাম বিশ লাখ টাকা। আমি নেবো না, মা-ও ছাড়বেন না। আমার পরের ভাই বলল, পাচ্ছিস নিয়ে নে। কাজে লাগবে। বই কিনবি। আমার তো পকেটে পয়সা থাকতে চায় না। তাই নিতে ভয় পাই।
সব খরচ হয়ে যায়।
সেদিন সেহারাবাজারে পরিবহণ শ্রমিকদের সভায় এসেছিলেন তৎকালীন বিধানসভার অধ্যক্ষ মনসুর হাবিবুল্লাহ। আমার সম্পর্কে অনেক অনেক ভালো কথা বলে আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে দিলেন সৈয়দ মাহবুল্লাহ সাহেব। শিশির দত্ত স্যারের সঙ্গে দেখা বললেন, তুই চলে গেলে খারাপ লাগবে। কিন্তু স্যার (প্রধান শিক্ষক) যখন বলেছেন, যা, ভালো হবে তোর। সৈয়দ মাহবুল্লাহ ব্যবস্থা করে দিলেন - কলকাতায় যাবো। বিধানসভার অধ্যক্ষ সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহর ঘরে দিলখুসা রোডে থাকবো।
রাত ১০ টা নাগাদ মনসুর হাবিবুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে পৌঁছলাম। রাতে চমৎকার খাওয়ার আয়োজন। এত ভালো মাংসের কোপ্তা খাওয়ালেন, আর কখনো এত উপাদেয় তুলতুলে কোপ্তা খাইনি।
পরদিন সকালে নাস্তা করে পরীক্ষা দিতে গেলাম। বাস টাসের ঠিক ঠিকানা নাই, কখন বন্ধ হবে কে জানে! সকাল সকাল চলে গেলুম।
গিয়ে দেখি, কত দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসেছেন ছেলেকে পরীক্ষা দিতে। একটি ছেলের কথা বিশেষ করে মনে আছে। ঝকঝকে চশমা পরা মুখ। সাদা নীল ইউনিফর্ম। মেদিনীপুরের কোনো স্কুলের ছেলে। বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছেন। এবং অ্যাম্বাসাডর চড়ে। চশমা পরা ছেলে মানে বুদ্ধিমান নকশাল নকশাল ভাব বলে আমার তখন ধারণা ছিল। চশমা পাওয়ার জন্য চোখে রেড়ির তেল দিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। চশমা পাই নি, উল্টে তিরস্কার।
এখন বুঝছি চালশে সম্বলিত চারচোখো হওয়া কী খারাপ!
পরীক্ষা দিতে বসলুম। তখন আমি প্রশ্ন পেলেই উত্তর করতে বসে যেতাম। বাকি সব হয়ে গেল। অঙ্ক? ২৫ নম্বরের অঙ্ক পরীক্ষা। ২১ নম্বর পারলাম। চার নম্বর ধরতেই পারলাম না। চশমা পরা বুদ্ধিমান ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, বললেন, পেরেছি।
এত শ্রদ্ধা হলো।
বাকি পরীক্ষাগুলো ভালো করায় বেঁচে গেলাম।
সুযোগ মিললো। কিন্তু পড়া হলো না।
এর মধ্যে শিশির মহারাজের সঙ্গে দেখা করে এসেছি, ভর্তির দিন বাড়ানোর জন্য।
উনি জানতে চাইলেন, আমার প্রার্থনা ইত্যাদিতে কোনো অসুবিধা হবে কি না?
আমি জবাব দিয়েছিলাম, আমি নাস্তিক, ধরে নেবো কিছু ভালো ভালো কথা বলা হচ্ছে। আমি কথাগুলো ঈশ্বরের উদ্দেশে নয় প্রকৃতিকে বলা হচ্ছে ধরে নেবো।
বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছিল কিছুটা বাধ্য হয়ে। নিজের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের স্কুলে আবেদন করতে না করেছিলেন। বলেছিলেন ইমান, তোর ডিসিপ্লিন দরকার। এখানে থাকলে রাতদিন রাজনীতি করে গোল্লায় যাবি। তোরও সর্বনাশ। স্কুলেরও। নরেন্দ্রপুর যা। এই যাওয়াতে আরেকজনের অবদান ছিল বললাম । তখন বিধানসভার অধ্যক্ষ মনসুর হবিবুল্লাহের ভাই সৈয়দ মাহবুবাউল্লাহের। তিনি বিলেত ফেরৎ কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেনের সদস্য। এখানে এসে পরিবহণ শ্রমিক আর নির্মাণকর্মীদের নিয়ে সংগঠন গড়েন। অসংগঠিত শ্রমিকদের এ-রাজ্যে সংগঠিত করার প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব তাঁর। ১৯৮০ তে শুরু করেন। বিশ্বকর্মা পূজা উপলক্ষে মাংসভাত খাওয়াতো তাঁর সংগঠন। সিপিএমকে ১৯৮০তেই বলতেন, সংশোধনবাদী। তাঁদের অফিসের সাইনবোর্ড লিখতে গিয়ে আলাপ।
আমাদের প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অসাধারণ মানুষ। কালীসাধক। পূজা করতেন লাল রক্তাম্বর পোশাক পরে। ধবধবে ফর্সা রঙ। লাল পোশাকে একেবারেই অন্যরকম দেখালেও বিদ্যালয়ে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চাইনিজ পাঞ্জাবি। হাতে জামার মতো বোতাম এবং পকেট। তাতে একটা উইঙসাঙ কলম।
ভূগোল পড়াতেন। বহুবার তাঁর বাড়ি গিয়ে দুধ মুড়ি খেয়েছি।
মাঝেমাঝেই হুমকি দিতেন, টেস্ট পরীক্ষার ১০ দিন আগে দেওয়াল লিখতে দেখে বলেছিলেন, আর যদি দেখি পার্টি অফিসে যাব।
তিনি আর মাহবুল্লাহ সাহেবের ঠেলায় আমার নরেন্দ্রপুর মিশনে ফর্মপূরণ।
না হলে কোনোদিন ভাবিই নি ওখানে পড়তে যাওয়ার কথা।
দুটি মাত্র জায়গাতে আবেদন করেছিলাম। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তির তারিখ পার হয়ে গেল। ভর্তির ৫৪০+ টাকা বাবা দিলেন না। ওখানে পড়লে নাকি 'বহিষ্কৃত' হয়ে যেতে পারি রাজনীতি করি বলে। তখন বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের এক অধ্যাপকের চাকরি গিয়েছিল রাজনীতি করায়। যতদূর মনে পড়ে অধ্যাপক আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা মৃন্ময় ভট্টাচার্য। সে-বছর ছিল শুখার বছর। সেটাও একটা কারণ। বাড়িতে বিয়েও ছিল। খরচ হয়েছে টাকা। তো, আমি খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। খেতে খুব ভালোবাসি। তাও বন্ধ। কিডনি বেচার কথাও ভেবেছি। বোধহয় 'সাহেব' ছবির প্রভাব। শেষে বাবা একজনদের কথা বলে বললেন, যা তোর যখন এতো ইচ্ছে, এক বিঘা জমি বেচব বলেছি। ৬০০ টাকা কলকাতায় দেবে। তুই যা। পরে ৪০০ টাকা নিস। হোস্টেল খরচ তো লাগবে।
জমি বেচে পড়তে যাব? আমি কিছু বেচার খুব বিরোধী। পুরানো খবরের কাগজ বিক্রি করতেই কতো কষ্ট হয়। চোখের সামনে পালন করা খাসি বিক্রি হতে দেখে কতো কেঁদেছি। বহু বছর আমি খাসির মাংস খেতে পারি নি। কলকাতা সব গিলে নয়। শোকও। এখন খেতে পারি।
মিউনিসিপ্যাল স্কুলে গেলাম চোখের জল মুছে। অফিস বলল, দিন পার হয়ে গেছে। এতদিন কী করছিলে? তোমার তো ডাইরেক্ট অ্যাডমিশন ছিল। প্রধানশিক্ষকের কাছে গেলাম।
অমলেন্দু চক্রবর্তী। পরে বুঝেছি অসাধারণ মানুষ। দারুণ পড়াতেন। তিনিও বললেন, এতদিন কোথায় ছিলে?
বললাম, নরেন্দ্রপুরে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। সে-জন্য।
পাশে বসেছিলেন, এক ছোটোখাটো মানুষ, পরে জেনেছি, দুর্গাশিব রায়, বললেন, মাস্টারমশাই ভর্তি করে নিন।
হয়ে গেলাম। লাগলো মাত্র ৬২ টাকা। গবেষণাগার ফি ধরে। না হলে ৫০ টাকা লাগতো, কলা বিভাগে পড়লে।
আমার জীবনের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কত কত প্রতিভাবান ভালো ছেলে যে দেখেছি এখানে ইয়ত্তা নেই। বন্ধু অনুজরা যেমন, তেমন তাঁদের বাবারাও। সে-কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, প্রকৌশলীদের ছেলেমেয়েরা হ্যাংলার মতো ইংরেজি মাধ্যমে ছুটতো না।
মিউনিসিপ্যাল স্কুলের একজনকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। কৌশিক ভট্টাচার্য। আমি তখন নবম শ্রেণি, সে অষ্টম। এত ভালো বলেছিল তাৎক্ষণিক বক্তৃতায়। সেটা আমার জীবনে প্রথম প্রতিযোগিতা। শ্রদ্ধেয় স্যার শিশির দত্ত নিয়ে গিয়েছিলেন রেডক্রসের জেলা প্রতিযোগিতায়। কৌশিক বেতার নিয়ে বলেছিল। সঙ্গে ছিলেন ওঁর কাকিমা। আমাদের প্রিয় অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের স্ত্রী। গ্রামের এক কিশোরের সঙ্গে এত মিষ্টি ব্যবহার করেন। আজো ভুলতে পারি না।
তখন তো কৌশিক নামের ছড়াছড়ি। একাদশে এই বিদ্যালয়ে এসে পেলাম কৌশিক লাহিড়ীকে। এখন সে নামী চিকিৎসক ও লেখক। আমরা দুজনেই বিজ্ঞানের ছাত্র। বাংলা লেখায় আমার তখন খ্যাতি জুটেছে। পত্রপত্রিকায় লিখি। বিজ্ঞান প্রবন্ধও। বহু পুরস্কার জোটে। আমি আর কৌশিক বাংলায় সমান নম্বর পেতাম। কৌশিকের বাবা ভবেশ লাহিড়ী ছিলেন প্রখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। বি সি লাহিড়ী নামে খ্যাত। কৌশিকের মা-ই প্রথম মাসিমা যিনি তাঁর বাড়িতে ভিসিআরে 'অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুঁসসা কিউ আতা হ্যায়' দেখতে গেলে আলু ডিম আর বাদাম দিয়ে চাউমিন বানিয়ে খাওয়ান ও লেখা নিয়ে আলোচনা করেন। সুরঞ্জন, সায়ন, কৌস্তভ, সুপ্রতীক আর কে কে ছিল মনে পড়ছে না।
'বিজ্ঞান মানস' পত্রিকায় পরমাণু নিয়ে আমার লেখার প্রশংসা করেন। ফলত আপ্লুত। মায়েরা লেখা নিয়ে আলোচনা করেন, তাও বিজ্ঞান প্রবন্ধ-- একটু অবাক হই। কৌশিক ছাড়াও আরেক কৌশিক ছিল। মুখার্জি। একটা নাটক করার সুবাদে আলাপ হলো ওঁর বাবার সঙ্গে । মেধাবী ঝকঝকে একদল মুখ মিউনিসিপ্যাল স্কুলে সবসময় ঘোরাফেরা করতো। কৌশিকও একজন।
১৯৮৩-তে সরস্বতী পূজার সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। কয়েকজন অনুজ ধরল, ইমানুলদা এবার তুমি নাটক লিখবে। নো বাইরের লোক। লিখে ফেললাম, চারজন যুবকের গল্প। দুদিনেই। মাঠে বসে পড়া হলো। অভিনেতাদের নামেই চরিত্রদের নাম। সৌম্য চট্টোপাধ্যায়। এখন আই আর এস। আদবানির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রাক্তন মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে। ফেসবুকের প্রাক্তন কর্ত্রী আঁখি দাসের স্বামী। সৌম্য মেধাবী ছাত্র। পরে প্রেসিডেন্সি ও জেএনইউতে পড়ে। সৌমেন্দ্যু সাহাশিকদার। তখন কংগ্রেস নেতা সন্তোষ সাহাশিকদারের ছেলে। বিখ্যাত ডাক্তার। কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্র পরিষদ নেতা ছিল। সম্ভবত সাধারণ সম্পাদকও হয়। এখন বর্ধমানের সুখ্যাত শরণ্যা নার্সিংহোমের মালিক। প্রথম দ্বিতীয় হওয়া নিয়ে সৌম্য সৌমেন সজল রাজা কৌশিক মুখোপাধ্যায়/ ভট্টাচার্যদের লড়াই চলত। সৌম্যর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক। পরে মন্ত্রীও হন। তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সৌম্য সৌমেন ছাড়া আর দুই অভিনেতা ছিল আভাস রায়চৌধুরী ও নিলয়। আভাস এখন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। স্কুলে চুপচাপ থাকতো। নিলয়ের বন্ধু আর আমার বন্ধু স্বরূপের প্রিয় হিসেবে সে-ও আমার কাছের হলো। আমাদের মধ্যে নিলয় ছিল দক্ষ অভিনেতা। এখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান আধিকারিক।
তা এই নাটক নিয়ে লেগে গেল গণ্ডগোল। তখন সিপিএমের পরিচালন সমিতি পরাজিত। কংগ্রেস ও আর এস এস জোট জিতেছে। স্কুল চালান কার্যত আর এস এস নেতা জগজ্জ্যোতি মিত্র। তিনি ১৯৮৩তেই পুরস্কার হিসেবে বাছাই করতেন-- 'তাজমহল কি হিন্দু মন্দির' গোছের বই। বাংলায় প্রথম হলে এই বই বাঁধা পুরস্কার।
তা জগজ্জ্যোতি বাবু বললেন এই নাটক রাষ্ট্রবিরোধী। করা যাবে না। সৌম্য সৌমেন ওরা কংগ্রেসি পরিবারের ছেলে। ওঁরা জেদ ধরল, এই নাটকই হবে। নাটকটা খারাপ কিনা বলুন। সৌমেন সৌম্য দুজনের বাবাই পরিচালন সমিতির সদস্য। তাঁরা পড়লেন ফাঁপড়ে। ছেলে বড় না কমিটি? শেষে প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু চক্রবর্তী আসরে নামলেন। বললেন, নাটক হবে। তবে কিছু অংশ বাদ দিতে হবে। উনি বললেন, তুই এইগুলো কেটে দে। অমলেন্দুবাবুর বাংলা ক্লাস আমরা দুই পিরিয়ড ধরে করতাম। ছুটি হয়ে গেছে কখন। আমরা উঠছি না। উনিও থামতেন না। আমি বললাম, স্যার, আপনি কেটে দিন।
বললেন, কী সমস্যায় ফেললি।
তবু কাটলেন কিছু চোখা চোখা সংলাপ।
স্যার আড়ালে বললেন, ঠিকই লিখেছিস। কিন্তু কী করি বল।
তো নাটকের দিন হলো এক কাণ্ড। আর এস এসের ছেলেরা রটিয়ে দিল, আমি নাস্তিক, আমি নাকি সরস্বতীর ঘট ভেঙে দিয়েছি। অতএব ওই নাটক হবে না। ঘট খুঁজে টুজে যথারীতি পাওয়া গেল। আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। সামনে মাধ্যমিক তাই বোধহয় ভাঙতে পারে নি।
আগরওয়াল বলে এক ছাত্র ছিল সপ্তম শ্রেণির। আমার খুব ভক্ত। সে খবর দিল, নাটকের সময় অন্ধকার হলেই তোমাকে মারবে ওরা।
কৌশিক আর কৌস্তভ ছিল। কৌস্তভ পড়াশোনা ছাড়া খেলাতেও ছিল খুব চৌকস। সে আর কৌশিক লাহিড়ী বলল, উইংস লাগাতে হবে না। রডগুলো ঠিক করে রাখছি। ঝামেলা করতে এলে বুঝবে মজা।
এই স্কুলে একটু আধটু এস এফ আই আগে যাঁরা করেছে-- তাঁরাও হাজির। গিম্পাদা দেবাশিস অধিকারী। দেবাশিস অধিকারী ছিল বিখ্যাত উকিলের ছেলে। কংগ্রেসি বাড়ির। ভালো ছাত্র। বলপন্থী। এখন দেবাশিস পূর্বাশ্রম ভুলে নানা পাহাড় পর্বত হিমালয়ে নিভৃতবাস ও সাধনা করে প্রভাবশালী সন্ন্যাসী। মোদিদের সম্মানের মানুষ।
দেবাশিসদা গিটার নিয়ে হাজির। সঙ্গে অন্য কিছুও ছিল। দেবাশিসদা বলল, ভাবিস না মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব। চেনে না আমাকে।
নাটক দেখতে শহর ভেঙে পড়ল। থই থই করছে মাঠ। কয়েক হাজার দর্শক। অশান্তির আশঙ্কায় পুলিশও কম নেই।
নাটকের আগে সৌম্য সৌমেন বলল, আমরা সবাই কেটে দেওয়া সংলাপ বলব, তুমি খালি বলবে না। আর যদি বাবা মা বা স্যার জিজ্ঞেস করে বলবে, ওরা উত্তেজনায় ভুলে বলে ফেলেছে।
যথারীতি তাই হলো। সৌমেনের মা নাটকের মাঝেই মঞ্চের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী হচ্ছে? কেটে দেওয়া ডায়ালগ কেন বলছে?
আমি টুক করে প্রণাম করে বললাম, মাসিমা আমি কি কিছু বলেছি? ওরা ছোট, উত্তেজনায় ভুলে বলে ফেলছে।
পাশে সৌম্যর বাবা রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় মিটিমিটি হাসলেন। প্রশ্রয়সূচক সে হাসি।
নাটকের শেষ সংলাপ আমার। সেখানে শেখানো কথা বলতেই হলো-- সমাধান আপনারাই বলেন। নাটক শেষ। শ্রোতারা ওঠেন না। শ্রোতার আসনে ছিলেন শহরের পুরপতি সুধাংশু রায়। বললেন, নাট্যকার কেন পথ দেখাবেন না।
চুপ করে রইলাম। আরো কয়েকজন একই কথা বললেন।
একজন মানুষ এসে দাঁড়ালেন সব শেষে। বললেন, খুব ভালো করেছো তোমরা। কৌশিকের কাছে তোমার কথা শুনেছি। লায়ন্স ক্লাবের প্রতিযোগিতাতেও দেখেছি একদিন এসো।
তিনি ডা: অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। বর্ধমানের খুব নামী শল্যচিকিৎসক।
লায়ন্স ক্লাবে আরেকজন মানুষ ছিলে। অধ্যাপক নৃপেন মিত্র। পরে বাঙ্গালোর আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান উপাচার্য হন। বিতর্ক তাৎক্ষণিক কুইজ করা ও প্রবন্ধ লেখার সুবাদে তাঁর প্রশ্রয়ও পেয়েছি খুব। যদিও তিনি বামপন্থী ছিলেন না ঘোষিতভাবে।
শহরের বেশিরভাগ ডাক্তার তখন কিন্তু বামপন্থীদের সমর্থন করতেন না। বর্ধমান শহর খুব রক্ষণশীল। বর্ধমান শহরে কোনদিন বিনয় চৌধুরী জেতেন নি। গ্রামের ভোটে জিততেন।
অপূর্ব বাবু সুদর্শন সদা হাসি মুখ মানুষ। চিকিৎসার পাশাপাশি জনসেবা নিয়ে থাকতেন রক্তদান চক্ষু পরীক্ষা শিবির ছানি অপারেশন-- সারা বছর ধরে চালিয়ে যেতেন।
অপারেশন করতে রোগী এলে গরিব হলে ছাড় দিতেন। বিনা পয়সায় ওষুধ দিতেন। আমরা বহু রোগী ভর্তি করিয়েছি তাঁর অধীনে হাসপাতালে। তখনকার দিনে পার্টিকে চাঁদা দিতেন ২০০-২৫০ টাকা।
বলতেন, কত দিতে হবে।
আপনাকে বলতে হবে?
কী এতে চলবে না আরো লাগবে?
চাইবো কী, কত রোগীকে চেম্বারে দেখে দেন একটু লিখে দিলে।
ডাক্তার বিসি লাহিড়ী, ডা: তুষারকান্তি বটব্যাল, ডা: কানাই ব্যানার্জি, ডা: গৌতম চট্টোপাধ্যায়
ডা: সনৎ মণ্ডল, ডা: সিদ্ধেশ্বর রায়, ডাঃ ডিপি মুখার্জি, ডা: ডি পি দে-রা বহু মানুষকে দেখে দিয়েছেন আমাদের অনুরোধে। পার্টির কাছের লোক আরো একজন ছিলেন। ডা: এন সি দত্ত। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাঁর ততো যোগাযোগ ছিল না।
পরে তো একঝাঁক তরুণ ডাক্তার পেয়েছি। ডা: অমিতাভ চক্রবর্তী ঝুনুদা নাসিমাদি অর্কদা আদিত্য মণ্ডল সুমনদা অমিতদা সুদীপদা ওমপ্রকাশদা শুভেন্দুদা মুখার্জিদা, হরিমোহনদা, বিজন কুণ্ডুদা।
এছাড়াও ধন্বন্তরী অনুপ সাহা মইনুল হাসানদের মতো নামী শল্য চিকিৎসকরাও ছিলেন।
কেদার ভট্টাচার্য বলে কংগ্রেস করা এক ডাক্তারের কথা মনে আছে। ছাত্রসংসদে চলে এসে বাইরে থেকে ডাকতেন, এই খুব তো নেতা হয়েছিস, চার বোতল রক্ত চাই এক্ষুনি। পারবি? সিরিয়াস পেশেন্ট। অপারেশন করতে পারছি না।
হয়ে যেতো। কত রক্ত দিয়েছে রাজ কলেজের ছেলেমেয়েরা।
এদের কথা আলাদা করে লেখার ইচ্ছে।
কৌশিক কৌস্তভরা ডাক্তারি পড়ায় আরো অনেক দাদা বন্ধু ভাই জুটে গেল। অনিরুদ্ধ গাঙ্গুলি রউফ কৌশিক, ভানু, মানসী, শুভেন্দু, শিপ্রা, অরিন্দম চক্রবর্তী, রক্ষিত, উত্তমদা-- কত কত নাম। উত্তমদা এখন শুনি বিজেপি হয়েছে।