বিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে ( বিশুদ্ধতাবাদীরা রাগ করবেন, সাত ও আটের দশক পড়বেন তাঁরা), গ্রামীণ বর্ধমানে সম্পন্ন কৃষিজীবী মধ্যবিত্ত বাড়িতেও বছরে মূলত দুবার কী তিনবার পোশাক কেনা হতো। সুবিধাবঞ্চিত পরিবারে বছরে বড়জোর একবার। বাকি সময় ছেঁড়া তালি মারা। এক, শীতকালে ধান ওঠার পর। সেটিই প্রধান। জামা জুতো সোয়েটার। একদিকে সার বেঁধে চললো ধানের গাড়ি। অন্যদিকে কুচো কাচার দল। খটিতে ধান বিক্রি হবে। বাঁধা দোকান। যাও। মাপ দাও। জামা প্যান্ট কেনা হলে জুতোর দোকান। সেও নির্দিষ্ট। জীবনে দুবার নিজে পছন্দ করে জামা প্যান্ট কিনতে পেরেছি দশম শ্রেণি পর্যন্ত। একবার সপ্তম শ্রেণিতে মায়ের সঙ্গে গিয়ে একটা গোলাপি স্ট্রাইপ জামা। বগরম ( শক্ত কলার) দেওয়া। সারারাত মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়েছিলাম। পরদিন স্কুলে ছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে নাটক। অগ্রদূত রচিত 'রক্তে বোনা ধান'। আমি নায়ক। সুব্রত মাস্টার। কৃষকদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করছেন নিজের হক বুঝে নিতে। ইচ্ছে ছিল জামাটি পরার।
স্যার বললেন, স্কুলের মাস্টারমশাই, জামা পরেন? দেখেছিস কাউকে? কী পরেন? ধুতি পাঞ্জাবি। পকেটে কলম। তুই তাই পরবি।
ঠিকই স্কুলের সব শিক্ষক হিন্দু মুসলমান সবাই ধুতি পরতেন।
গ্রামের পুরুষেরা সবাই লুঙ্গি।
পোশাকের যে ধম্ম হয়, কলকেতা না এলে শিখতুমনি।
আমার নতুন জামা পরল আরেকজন।
সে বড়লোকের ছেলে।
আরেকবার নিজের পছন্দে একটা প্যান্ট। দলে গিয়েই। আশ্চর্য এক শ্যাওলাটে খয়েরি রঙের ছিল। রঙটা আজো খুঁজি। পাই না।
তাতে আরবি (লোকে বলে ইংরেজি) অক্ষরে ওয়ান লেখা।
বাকি সময় তো বাড়ির কাজের লোক সমেত সবার এক রঙের এক রকম জামা। লোকে বলতো 'হক ব্যাটালিয়ন' বেরিয়েছে।
দ্বিতীয়বার পোশাক হতো ইদ বা বকরিদে বা গাজনে বা মেলায়। গাজনে, কারণ চৈত্র সেল। চৈত্র মাসে সস্তায় নতুন জামা কাপড় পাওয়া যেত বর্ধমান শহরে। লেখা থাকতো, রিবেট/ রিডাকশন সেল।
আশ্বিন কার্তিক অভাবের মাস। তাই দুর্গাপূজায় নতুন পোশাক কিনতে আমি ছোটবেলায় কাউকে দেখিনি।
তৃতীয়বার হতো, যদি নিকটজনের বিয়ে থাকতো। বা বেড়াতে যাওয়ার সময়।
বেড়ানো বলতে, মাসি পিসি মামা বা আত্মীয়ের বাড়ি। কিংবা কোনো বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়ি।
দীঘা দার্জিলিং এ-সব ছিল স্বপ্ন।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সেহারা স্কুল থেকে তারাপীঠ নিয়ে যাওয়া হয়। সে গল্প পরে।
বিয়ে মানে বিরাট মজা। মাইক বাজবেই। ছেলের বিয়ে হলে ব্যান্ড পার্টি আসবে। বুকে নারকেলের স্তন পরে ফিমেল নাচবে 'ফুলকলিরে ফুলকলি'/ 'দম মারো দম'।
'শোলে'র গানের বিরাট কদর। জিনাত আমান আর হেলেনের নাচ কপি করতেন ড্যান্সাররা। তখনো নায়িকারা ভ্যাম্পের ভূমিকায় অশ্লীল পোশাকে শরীর দেখিয়ে নাচতে রাজি ছিলেন না।
দর্শকরুচিও নিত না।
বিয়েতে ছেলে ছোকরারাও নাচবে বড়দের চোখ এড়িয়ে।
বিয়েতে মদ ছিল না। এখন শুনি জলভাত।
আদিবাসী বা বাগ্দি পাড়ায় এসব মানে মদ ছিল।
সেখানে আসতো তাসা পার্টি।
বিয়ে করতে যাওয়ার সময় ব্যান্ড পার্টি যেতো হেঁটে হেঁটে। ফিরতোও হেঁটে। রাত হয়ে গেলে হ্যাজাক বা পেট্রোম্যাক্স জ্বলতো।
কনের গ্রামে ঢোকার আগে কোনো পুকুর পাড়ে থেমে খুব বাজনা আর নাচ হতো। অন্তত আধঘন্টা ধরে। এতেই কনেপক্ষ বুঝতো আসছেন তেনারা।
দেদার বাজি বোমা ফাটত। দু দমা তিন দমা। আওয়াজ দিয়ে জানান দেওয়া, বর আসছে।
লুচি ভাজতে শুরু করো। লুচি কেন গরম নয়, কালকের লুচি দিয়েছ নাকি, এতো জুতোর শুকতলা -- বলে নাকাল করার চেষ্টা বেদম ছিল।
গ্রামে বর ঢোকার পর গেট করে গেট আটকানো হতো।
গ্রামের রাস্তা তৈরি করতে হবে, চাঁদা দাও।
যেমন পণ, তেমন চাঁদা।
একজায়গায় পাঁচ হাজার টাকা (ভাবুন সত্তর দশকে ৫০০০) চেয়েছিল।
রেগে বর পালকি থেকে নেমে পড়ে।
শেষে ৫০০ টাকায় রফা হয়।
সেই বিয়েতে মারপিট হয় নি।
তবে বরপক্ষ কনেপক্ষে মারপিটের উপক্রম ছিল প্রায় বাঁধা ঘটনা। বড়রা হস্তক্ষেপ করে ছেলে ছোকরাদের থামাতেন।
এক বিয়ে বাড়ি গেছি।
কনের দাদা, এলাকার নামকরা ফুটবলার। আমাদের হিরো। কোঁকড়া চুলে বল নিয়ে যখন দৌড়াতো লোকে বলতো জুম্মা খান।
তো সেই হিরোর সঙ্গে আমাদের গ্রামের হিরোদের লেগে গেল ঝামেলা।
অনেক গোরুর গাড়ি গিয়েছিল।
একজন বলল, বার করতো ল্যাদনাটা। ল্যাদনা মানে গাড়ির চাকা আর গোরুর পেছনের সংঘর্ষ এড়াতে একটা মোটা বাঁশ।
সেই ল্যাদনা খুলে ধুন্দুমার।
শেষে আমার বাবা গিয়ে থামালেন।
ওই বিয়েতে প্রথম পান খাওয়ার অধিকার পেয়েছিলাম। বড়দের সামনে চা বা পান খাওয়া যেতো না, বাইরে।
পান খেয়ে ঠোঁট লাল করার আনন্দের চেয়েও গ্রামের হিরোদের বীরত্বে আরো লাল।
একদিন পর, কনেপক্ষ আসবে।
বৌভাত।
গ্রামের ছেলে ছোকরারা কনেপক্ষকে আটকে দিল। বললো, ওই হিরো না এলে ছাড়া হবে না। ওঁকে এসে ক্ষমা চাইতে হবে।
শেষপর্যন্ত আসতে হয় নি। তবে দু চারটে বাসি টকো রসগোল্লা গিলতে হয়েছিল, কনেযাত্রীদের।
কনের বাবার মতো শান্ত ভদ্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
কনে এখন ভাবি।
খুব ভালো ও ভদ্র।
তো কনের দাদা হিরোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব মেটে। একটাও পয়সা না নিয়ে সে ফুটবল ম্যাচ খেলে আমাদের ফাইনালে তুলে দেয়।
সে-সময় তাঁর ফি ছিল ম্যাচ পিছু ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
৫০ টাকা মানে এক কুইন্টাল চাল।
৪০০ ডিম।
২৫ কেজি পোনা মাছ।
৫০ কেজি মাংস।
বিয়েতে ছড়ার কাগজ ছাপানোর প্রথা ছিল।
বিয়েতে তিন ধরনের পদ্যের কাগজ ছাপানো হতো।
গোলাপী ছোটোদের।
বন্ধুদের রঙ হলুদ। তাতে আদিরসের ছড়াছড়ি।
আর একটি লাল বা হাল্কা গোলাপী। বাড়ির বড়দের আশীর্বাণী।
হলুদ কাগজের চাহিদা ছিল বেজায়।
ছোটোদের দিতো না।
দিলেও লুকিয়ে পড়তে হতো।
না হলে লোকে বলতো, পেকে গেছে গো। তবে এই বিয়ের কাগজে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা থাকা অবশ্যম্ভাবী।
নজরুলের এই কথাগুলো থাকতোই:
কোন কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।
এটাও লেখা থাকতো:
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
এবং
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,/
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।
আর রবীন্দ্রনাথের 'ঊর্বশী' কবিতা:
নহ মাতা নহ কন্যা ঊর্বশী রূপসী।
কারা যেন রটাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ছবি গান ছিল মুসলিম সমাজে অস্পৃশ্য।
এটা একটা পরিকল্পিত শয়তানি।
তা আরেকটা কথা লিখে রাখি। কুঁড়ে মানুষ। (লেখায়, পড়ায় বা কাজে নই)। ভুলে যাব।
গ্রামে বিয়েতে পাল্কি হতো। অ্যাম্বাসাডর চড়ে বিয়ে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু। ১৯৮৬ তে আমার সেজদির বিয়ের বর এসেছিল অ্যাম্বাসাডরে।
দিদিকে নিয়ে বৌভাতের পর ফেরার সময়, সে আরেককাণ্ড। জমির নিকের আলে অ্যাম্বাসাডর আটকে যায়। কওসেরভাই ছিল সঙ্গে । করিৎকর্মা। একটা টাঙনা জোগাড় করে আল কেটে উদ্ধার। সন্দীপ লাহাও বোধহয় ছিল সঙ্গে।
আশির দশকের শুরু পর্যন্ত পাল্কি করে নতুন বৌকে গ্রাম ঘোরানো হতো। কয়েকটা ঘর অন্তর ঘরের সামনে দাঁড়াত পাল্কি। মহিলারা বৌয়ের মুখে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে টাকা বা পয়সা দিয়ে মুখ দেখতেন।
একটা বাড়ি ছিল অবশ্য গন্তব্য, রামমামার বাড়ি।
অন্নপূর্ণা দিদিমার কাছে।
উনি এক গ্লাস সরবত খাইয়ে টাকা পয়সা দিয়ে আশীর্বাদ করতেন।
অ্যাম্বাসাডর এসে এটা বন্ধ হলো।
মন্টু ভাই ছিল আমাদের ফুটবলের নায়ক। এক শটে মাঠ পার করে দিতো।
ছোটো বড়ো সবার প্রিয়।
একবার শট মেরে বল ফাটিয়ে দিয়েছিল।
তাঁর পাল্কির সঙ্গে আমিও গোটা গ্রাম ঘুরি।
বিয়ের পরদিন এ-পাড়া সে-পাড়া থেকে বৌ বা জামাই দেখতে আসতো।
এসে মিষ্টি খেয়ে যেতো। খাইয়েও। আত্মীয়রা নিমন্ত্রণ বাড়ি আসার সময় নিজের ঘরে তৈরি মিষ্টি আনতো। পাকান, আন্দোরসা।
ঘরেও তৈরি হতো।
আর বিয়েতে যে-সব আত্মীয় স্বজন আসতো তাঁদের জন্য তৈরি হতো, বাবুইঝাঁক নামে এক ধরনের রসের মিষ্টি। আর হতো পাকান। সঙ্গে থাকতো ডিম খাবার সোডা ময়দা মাখিয়ে একটা কুচো নিমকি ধরনের খাবার। নাম মনে পড়ছে না।
বাবুই ঝাঁক বলতে আমি যা বুঝি, সরু কল বা ঝাঁঝড়ি দিয়ে চালের আটার গুঁড়ো তপ্ত গুড় বা চিনির সিরায় পড়তো।
বাবুইঝাঁকের বিকল্প মিষ্টি আজো দেখিনি।
মুড়ি দিয়ে খেতে অমৃত।
কোথায় খেতে দেওয়া হতো? বরযাত্রীরা হিন্দুদের বিয়েতে ছাদনাতলাতেই খেতেন। মাথায় শামিয়ানা টাঙানো হতো। চারদিক সমান মাথা। সেখানে।
গ্রামের মানুষদের বাড়ির দাওয়া বা আঙিনায়। কেউ কেউ গোয়াল ঘর পরিষ্কার করেও খাওয়াতেন। হিন্দু মুসলমান আলাদা বসানোর রীতি তেমন ছিল না, কিন্তু জাতপাত মানা হতে দেখেছি। শ্রাদ্ধ বাড়িতে বামুন তো আগে খেতোই, বিয়ে বাড়িতে শেষে খেতে দেওয়া হতো তফশিলি জাতির মানুষদের। বিশেষ করে বাগদি মুচিদের। আমাদের গ্রামের প্রশান্ত মজুমদার নামে ব্রাহ্মণ সন্তানের বিয়েতে এই ভেদ উঠে যায়।
সবাই একসঙ্গে খায়।
তার আগে হিন্দু মুসলমান, জাতি নির্বিশেষে বাগদি মুচি সাঁওতাল একসঙ্গে প্রথম বসে খায় আমার দাদার বিয়েতে ১৯৮২ র ২ জুলাই।
১৩০০ মতো নিমন্ত্রিত ছিলেন। এই প্রথম গ্রামে হিন্দু মুসলমান বিয়ের অনুষ্ঠান।
কোনো মন্ত্রপাঠ বা সম্প্রদান নেই। মালাবদলও দেখিনি।
আগেই রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল। এবার শুধু খাওয়া দাওয়া।
কী হবে? পার্টির লোকজন এসে বললেন, আমাদের ছেলের বিয়ে। ঘটা করে করতে হবে। অনেকদিন পর বাড়িতে উৎসব। ১৯৭৬-এ মেজদির মৃত্যুর পর সবার মন খারাপ ছিল। দাদার বিয়ে উপলক্ষে সাজো সাজো রব।
জমি বিক্রির ব্যবস্থা হলো।
খাদ্যতালিকা ঠিক হল বিশ ত্রিশ জন মিলে। সে এক দেখার ব্যাপার। বাঙালি খাবার। ভাত ডাল আলুভাজা সবজি ছ্যাঁচড়া মাছ মিষ্টি চাটনি পাঁপড়।
মাংস নয়। তখন মুরগি সহজলভ্য নয়। আর পার্টি কমরেডের বিয়ে তাতে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা বেশি জরুরি। ১০০-১২৫ জন কাজ করতে লাগলেন বিয়ের জোগাড়ে। চার জায়গায় খাওয়ার ব্যবস্থা। একসঙ্গে। শুধু স্কুলের মাস্টারমশাইদের জায়গা নির্ধারণ করা ছিল। বাকি যে যেখানে ফাঁকা পাবেন, বসবেন। সেই প্রথম হিন্দু মুসলমান নারী-পুরুষ একসঙ্গে বসে খাওয়া।
আগে মেয়েদের খাওয়ার জায়গা হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েই আলাদা হতো।
আশির দশকের শেষে ডেকোরেটর এলো, ব্রয়লার মুরগি এলো।
গোরুর মাংস বিদায় নিল মুসলিম পরিবার থেকেও। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরাও মাছ ছেড়ে মুরগি ধরলেন। ছুঁৎমার্গ গেল। আগে মুরগি খেতে হতো লুকিয়ে। বিয়েতে খাসির মাংস করার সামর্থ্য শতকরা ৯৯ জনের ছিল না।
১৯৭০ এর শুরুতে আমার বড়দির বিয়ে থেকে শুরু করে ডেকোরেটর বা ক্যাটারিং পরিবেশন ব্যবস্থা না আসা পর্যন্ত দেখেছি, মুসলিম বিয়েতে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা রান্না করা হতো। আলাদা জায়গায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদেরই দায়িত্ব দেওয়া হতো কেনাকাটার। আমার বড়দি ও মেজদির বিয়েতে মনে আছে, দূরে সিরাজদের বৈঠকখানায় খাওয়ার ব্যবস্থা। সেখানেই বাবার বন্ধু শঙ্কর ধাউড়ে ও তাঁর পাড়ার মোহন ধাউড়ের তত্ত্বাবধানে খাসি কেটে রান্নার আয়োজন।
রবীন্দ্রনাথের পরিবারের গল্প নিশ্চিত মনে আছে।
মাংসের গন্ধে কী হয়েছিল?
ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং।
দাদার বিয়ে ছিল ব্যতিক্রম।
তারপর আস্তে আস্তে পট পরিবর্তন হলো।
একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া অল্প অল্প শুরু হল।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে মূলত কলাপাতা বা পদ্মপাতায় খেতে দেওয়া হতো। কোথাও কোথাও শালপাতার থালা। মাটির গ্লাস।
মুসলিম পরিবারে তামচিনির বাসন থাকতো ষোলোআনার। ষোলোআনা মানে সমাজ। সবাই আছেন তাই ষোলোআনা।
আমাদের বাড়িতে একসময় দুশোর বেশি তামচিনির (কলাইয়ের) বাসন ছিল। এছাড়া ছিল শামিয়ানা। সেটা মাঝে একটা বাঁশ দিয়ে উঁচু করে দেওয়া হতো। তারপর চারদিকে নেমে আসতো তাঁবুর মতো। তার তলায় বসতো বর ও বরযাত্রীরা। মাটির গ্লাসে জল দেওয়া হতো হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের বিয়েতেই। এছাড়া মুসলমান বিয়েতে কিছু মানুষ পাওয়া যেতো যাঁরা গোরুর মাংস খেতেন না। তাঁদের জন্য মাছের কালিয়া হতো। খাসির মাংসও হতো তাঁদের জন্য। একে বলা হতো পরিজি। মাটির বাটিতে দেওয়া হতো।
এঁদের খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখা হতো। বাব্বা গোরুর মাংস খায় না।
আমি ভাবতাম, আমি কবে বড় হয়ে পরিজি খেতে পাবো! মাটির বাটিতে এত সুন্দর করে দিত।
খাওয়ার কথা উঠলোই যখন কয়েকটি গল্প বলি।
এক,
আমার এক আত্মীয়ের বিয়ে। ষাটের দশকের শেষে। এক ভদ্রলোককে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে, আর কিছু দিই।
না না না।
বলছেন এবং কিছু নিচ্ছেন না।
প্রথমে হাত দিয়ে পরে জিভ দিয়ে থালা চেটে পরিষ্কার করে ফেললেন।
পরিবেশক রেগে গিয়ে বললেন, আমাদের বদনাম করার চেষ্টা। থালা চেটে খাওয়ার কী দরকার?
ভদ্রলোক যত বলেন, সুন্নত আদায় করছি। নবিজি বলেছেন।
পরিবেশক: ছাড়ুন তো মশাই, সুন্নত, থালা চেটে খেয়ে ঠিক করলেন না।
ভদ্রলোক ইদানীং নামাজ পড়ে সহি মুসলিম হতে থালা পরিষ্কার করে খাওয়া শিখেছেন, তিনি আর কথা বাড়ালেন না। পরিবেশকরা কিন্তু গজগজ করেই চলেছেন, থালা চেটে খাচ্ছে কনেপক্ষের লোক। আর কিছু নয় শ্লার বদনাম করার ষড়যন্ত্র। লোককে দেখানো, থালা চেটে খেতে হচ্ছে!
দুই,
এক নিমন্ত্রিত ষাটের দশকের ওই বিয়েতে খেয়েই যাচ্ছেন খেয়েই যাচ্ছেন। কোমরের কষি খুলে ফেলেছেন। খেয়ে আর উঠতে পারেন না।
লোকে বলল, ভাই আপনার এই অবস্থা না বলতে পারলেন না।
ভাই, আমি যে না বলতে পারি না। এত আদর করে দিচ্ছে, না বললে, দুঃখ পাবে না।
তিন,
এক লোকের বিয়ে হয়েছে। নতুন বিয়ে। লোকটি খেতে ভালোবাসেন। বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে, একটু লজ্জা করে খাবি। একবারের বেশি নিবি না। দিতে এলে বলবি, না না না।
তো নতুন জামাই শ্বশুরবাড়িতে তাই করেছেন। রাতে দারুণ খিদে পেয়েছে। কী করেন। গিয়ে ঢুকেছেন ভাঁড়ার ঘরে। মোয়ার বয়ামে হাত ঢুকিয়েছেন। মুঠো করে মোয়া ধরেছেন। আর বের করতে পারছেন না।
এদিকে নতুন বৌ খানিকক্ষণ পর দেখে বর নেই।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খোঁজ খোঁজ।
এদিক সেদিক।
শেষে ভাঁড়ার ঘরের দিকে আওয়াজ পেয়ে গিয়ে দেখে জামাইয়ের হাত বয়ামে আটকে। জামাইয়ের মাথায় আসেনি, হাত খুলে মোয়া ছাড়লেই হাত বের হয়ে আসবে।
এখন চারদিকে এমন লোক দেখি প্রচুর।