পর্ব ৪০
ইমানুল হক
পশ্চিম অর্থাৎ বাঁকুড়া পুরুলিয়া মানভূম থেকে আসা মানুষের দলের কাছে চিঠি যেতো। তখন তো মোবাইল আন্তর্জালের যুগ নয়। ১৯৭০- এর দশকে কেউ ভাবতেও পারতেন না যে, গ্রামে টেলিফোন আসবে। বর্ষায় হাঁটু পর্যন্ত কাদা। আশ্বিন পর্যন্ত চলবে। কার্তিকে শুকোবে। তারপর লোকের পায়ে, সাইকেল ও গোরুর গাড়ির চাকায় ওগুলো ধুলো হবে। গোরুর গাড়ির চাকায় তৈরি হওয়া দাগের নাম দিয়েছে লোকে, আদর করে-- নিক বা লিক। কেন এই নাম জানি না।
সাইকেল তো কম। ছিল মাত্র আটটা। ৬৫ ঘর। ৮ টি সাইকেল। তাঁদের বাড়ির ছেলে সেহারায় পড়ে তাঁদের সাইকেল থাকে আড়াই কিলোমিটার গোপীনাথপুর রেল স্টেশনে। ১৯৭০ এ আমাদের পাশাপাশি তিন থানায় কোনো মহিলা সাইকেল চড়তো না। ১৯৮০ তে প্রথম সাইকেল কেনেন বাদশা মুন্সী রাজা মুন্সি -- দুই ভাই। ইতি ওরফে ইসমোতারা এবং ডালিয়া ওরফে মমতাজের জন্য। সাইকেল বর্ষাকালে নাইলন বা পাটের দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো দেওয়ালের গায়ে। গোরুর গাড়ির চালও তাই থাকতো। বাড়ির পাঁচিলের গায়ে গজাল পুঁতে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। চাকা লাগানো থাকতো পাশেই। দড়ি লাগতো না। চাকা কে নেবে? সবাই সবার চাকা চেনে। গ্রামে কী কী সাইকেল ছিল? আমাদের ছিল ইংল্যান্ডের তৈরি রালে, পরে ফিলিপস, মামার বাড়ির সাইকেলের নাম মনে পড়ছে না। অচেনা। উত্তরপাড়ায় ছিল লালে এবং পরে এলো হিরো, অ্যাভন, অ্যাটলাস। বিএসএ সৌখিন সাইকেল। গ্রামে কারো ছিল না। পাক্কা ৫০ টাকা দাম বেশি। কে কিনবে? বিএসএ তো মাল বইতে পারবে না। সব সাইকেলকেই তো চাল, গম, আটা, খোল, সার, আলু বইতে হবে। গ্রামের একজন বিয়ের পর হারকিউলিস সাইকেল নিয়ে এল। ৫৫০ টাকা দাম। ভিড় করে দেখতে এল সবাই। সাইকেলের স্ট্যান্ডের বদলে বাঁশের স্ট্যান্ড। বাপ তাঁকে আলাদা করে দিয়েছে। দেখবার মতো সুন্দরী বৌ নিয়ে সে আলাদা থাকে। দুজনেই মোষের মতো খাটে। মাঝরাত থেকে ধান সিজোতে বসে। স্বামী স্ত্রীতে খুব মিল মহব্বত। সবাই দুই বা তিন বস্তা চাল বইতে হিমসিম। রহমত চার থেকে পাঁচ বস্তা বয় সাইকেলে। পিছনে তিন বস্তা। রডে এক বস্তা। মাঝখানে চেনের ওপরে এক বস্তা। হাঁই হাঁই করে ছোটে। ওপাড়ার নসু মোল্লা দেখাদেখি চার পাঁচ বস্তা চাল বইতে লাগল। দুজনে প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু খুব ভাব। একসঙ্গে চাল নিয়ে যায় দূরে দূরে। বাজারে। শহরে। লোকের কাছে ধান কেনে। সেদ্ধ শুকুনো করে। চালকলে ভাঙায়। বেচে। খাসকানি চাল বা গোবিন্দভোগ চালে লাভ বেশি। করণকস্যিও বেশি। কাঁকড় থাকা চলবে নি। গাঁ গেরাম কাঁকড় থাকবে নি বললে হবে!
গ্রামের বাড়তি আয় বলতে চাল ব্যবসা। জোয়ান ছেলেরা তাতেই লেগে পড়ল। চাল ব্যবসায় ঝামেলা অনেক। কর্ডন আছে। পুলিশ আছে। তখন চাল ব্যবসায় অনেক ঝামেলা। এছাড়া তো আর ব্যবসা নাই। কেউ তো বিএ এমএ পাস করে নি, যে চাকরি দেবে। পাস করলেও দিচ্ছে কে? টাকা লাগে ইস্কুলে ঢুকতে নয় পার্টির চিঠি।
কথায় ছিল, কারো পৌষ মাস, কারো সব্বনাশ। পৌষ মাসে গ্রামে ঝগড়া ঝাঁটি কমে যেত। বৌ পেটানোও বন্ধ। নতুন ধান উঠছে। বসে থাকা খেতমজুররাও কাজ পাচ্ছে। ঘরের মেয়েরাও বসে নেই সেদ্ধ শুকনো ঝাড়াইয়ে লাগছে। এরসঙ্গে ঢেঁকিতে চাল ছাঁটা, মুড়ি ভাজা, চালের আটা তৈরি। কাজ কি কম? সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েরাও খুশি। বাড়িতে যা আছে চাদর বা কাঁথা তাই গায়ে দিয়ে চলো ধানের মাঠে।
পর্ব ৪১
ধানের মাঠে ধান কাটা হয়েছে। এঁটুনো বা আঁটি বাঁধা হয়েছে। এরপর কেউ পালুই করবে গুণে গেঁথে। ক পণ বা ক কাহন ধান হল--হিসেব কষবে। চার আটিতে এক গণ্ডা। ২০ গণ্ডায় এক পণ। ষোল পণে এক কাহন। বিঘে পিছু কারো তিন কাহন কারো চার কাহন ধান। ছেলেমেয়েরা শিষ কুড়োতে ছোটে। বাবুদের বাড়ির নিজের ছেলেমেয়েরাও শিষ কুড়োয়। শিশিরে ধানের আটির মাথায় থাকা শিষ ভেঙে পড়ে। সেসব কুড়ানো। বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা আপত্তি করে। এই আমাদের জমিতে শিষ কুড়োবি না। তখন সবাই ছোটে ইঁদুরের গর্তে। সেখানে তো সাপের ভয়ে বাবুদের ছেলেমেয়েরা হাত ঢোকাবে না। গর্ত ঠিকমতো খুঁড়লেই দেখা যায়, ইঁদুরের দল কত বড় শিল্পী। থাকে থাক সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। ইঁদুরের দল সোম বচ্ছর খাবে কী? ধান না জমালে?
আদি বাসিন্দাদের ছেলে মেয়েরা ইঁদুরও ধরে। ইঁদুর পুড়িয়ে খাবে।
ইঁদুরের মাংস দিয়ে ভাত আমিও খেয়েছি। লালু কাকা ছিল আমাদের মাহিন্দার। মাহিন্দার মানে মাস মাইনের লোক। আসলে সারা বছরই থাকতো। লালু সরেনের ছেলে অনিল আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। টু পর্যন্ত পড়ে। ইংরেজি ঢুকত টু-তে। স্কুলের ছেলে চার ভাগের এক ভাগ হয়ে যেত। হিন্দু মুসলমান সাঁওতাল--সব ঘরের এক চিত্র। যাদের টিউশনির মাস্টার দেওয়ার ক্ষ্যামতা থাকত, বা বাড়িতে দেখিয়ে দেওয়ার লোক -- তারা টিকতো। চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে দেখা যেতো শিশু শ্রেণি তথা ইনফিন বা ইনফ্যানটের ১৫৭ জন ছাত্র ছাত্রী ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে ওটা হতো ১০/১২। নবম শ্রেণির পর মেয়েদের পড়া বন্ধ। গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল। ওই এইট পর্যন্ত। তাই সই। আমাদের ব্যাচ প্রথম যে ব্যাচে আটজন ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়তে যায় এবং ছয় জন বিএ পাস করে। তার মধ্যে একজন ছিল মেয়ে। সে অবশ্য দুলাভাইয়ের ঘরে থেকে পড়াশোনা করেছিল। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। খুব সুন্দরীও। নিজেকে নিজে শেষ করে দেয়, পরে। নিজের মতে বিয়ে করতে পারবে না জেনে।
লালু সরেনের ছেলে অনিল আমার জীবনের পাঠশালায় একজন বড় শিক্ষক। সাপ ধরতে ওস্তাদ। সাপের লেজ ধরে পাঁই পাঁই করে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিত। কোমর যেত ভেঙে। নির্বিষ হলে খাওয়া। বিষধর হলে অন্য কথা। ইঁদুরের মাংস খুব ভালো।তরুণাস্থির কারণে আরো ভালো। কুচকুচে। পোড়ালে ভালো লাগে। খেয়েছি। সাপের মাংসও। অনিল খাওয়াতে চায় নি। আমি জোর করে খাই। খেয়েছি জেনে,লালু কাকার বকুনি, অনিলকে। কেন খাওয়ালি?
যত বলি, আমি বলেছি দিতে, লালুকাকা শোনেন না।
আর এমন করোনি খোকা। তাহলে মাথায় চড়িয়ে ভুবন দেখাবোনি। লালু কাকা মাথায় চড়িয়ে বনবন করে ঘোরাতো।
যা মজা লাগতো।
বালকের ভুবন দর্শন।