পর্ব ৬৪
মেয়েটি সুন্দরী। বাবার বংশের মত লম্বা, মায়ের মত গায়ের রঙ। বেশ ফর্সা। এমনিতে ভাল তবে কালো লোকদের দেখতে পারে না।
এম্মা কী কালো কী কালো!
সেই মেয়েই প্রেমে পড়ল এক কালো ছেলের। বাড়ির তিন দিদি প্রেম করে নি। কিন্তু শান্তশিষ্ট মেয়েটি প্রেমে পড়ল এক কালো রঙের ছেলের। ছেলেটি ভিন্ন ধর্মের। সবর্ণ নয়। প্রেম এমন যে জানাজানি হল। মেয়ের বয়স মাত্র ১৪। প্রেম থামল না। পড়াশোনা ডকে। শেষে মাধ্যমিক যাতে ভাল ভাবে পাশ করে তার জন্য দাদার কাছে শহরে পাঠানো হল। একদিন সেই মেয়ে পালাল।
কোথায় গেছে? খোঁজ খোঁজ। ছেলেকে পাওয়া গেল। সে মেয়েটির খবর জানে না। পূজার আনন্দে সে বিভোর। অনেক খুঁজে মেয়েটিকে পাওয়া গেল। প্রেমিককে খবর পাঠিয়েছিল। কিন্তু প্রেমিক না আসায় এক বান্ধবীর বাড়ি উঠেছে। গ্রামে ফেরান হল। ছেলেটি বিয়ে করতে সাহস করছে না। বাড়ির লোক বলছে, মুসলমান মেয়ে বিয়ে করলে তোর বোনেদের কেউ বিয়ে করবে না। এদিকে রোজগারপাতিও নেই যে খাওয়াবে। অন্যদিকে মেয়েটির বয়স কম। বাবা দাদারা প্রভাবশালী।
মেয়েটি বাড়ি ফিরেছে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। সে বিয়ে করবেই। ওই ছেলেকেই এবং এখনি। সে একটা মোক্ষম কথা বলে বসল, আমি ন্যায্য বিচার চাই। চাইল বিচারকের কাছে। বিচার করা কঠিন। প্রভাবশালী পরিবার। বিচার বসল। এই মুহূর্তে বিয়ের পক্ষে মেয়েটি ছাড়া তেমন কেউ নেই। দাদা বিয়ের পক্ষে। কিন্তু পড়াশোনার পর। মেয়েটি কিন্তু অনড়। প্রেমিক ছেলেটি চুপ। সে-ও এখন বিয়ে চায় না। সবাই বিচারকের দিকে তাকিয়ে। বিচারক এতক্ষণ কথা বলেননি। তাঁর স্ত্রী এই বিয়ে হলে আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দিয়ে রেখেছেন। বিচারক শেষে মুখ খুললেন।
বললেন, একজন বাবা হিসেবে অল্প বয়সে রোজগারহীন ছেলের সঙ্গে আমি বিয়ের বিপক্ষে।
কিন্তু...
সবাই চুপ।
কী বলবেন? কিন্তু কেন?
বললেন, একজন বিচারক হিসেবে আমি মেয়েটির মতকে সম্মান করি। সে যদি বিয়ে করতে চায়, তাকে করতে দেওয়া উচিত।
বিয়ে হয়ে গেল। বিচারক ছিলেন আমার বাবা। মেয়েটি আমার বোন। আমার বাবাকে সেদিন থেকে আরো বড় চোখে দেখি। এমন মানুষ হওয়া বড় কঠিন। আমাদের গ্রামে মারামারি কাটাকাটি না হওয়ার বড় কারণ এই ধরনের ন্যায্য বিচার।
পর্ব ৬৫
বাবা চলে গেলেন ২০১৩-এর ৯ অক্টোবর পঞ্চমীর দিন। বাবা চলে যাওয়ার পর আমাদের এক প্রতিবেশী বললেন, এই গ্রামে গত ৬০ বছর পারস্পরিক বিবাদে মামলা হতে দেন নি। এবার গ্রামে মামলা ঢুকে যাবে। কারো সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে পরদিন সকালে তাঁর বাড়ি চলে যেতেন। কিছু মনে করিস না, তোরও মাথা গরম ছিল, আমারও। চা খাই চল।
ছোট বড় সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। গরিব বড়লোক - সবার সঙ্গে এক ব্যবহার। দেখনদারি আত্মীয়তায় অবিশ্বাসী। পার্টির বড় নেতা বা সাধারণ কর্মী এক ব্যবহার। আলাদা খাতির নাই। পার্টির বড় নেতা এলে মুরগি করতেন না। আর বলতেন, কেউ যেন না খেয়ে ফিরে না যায়। তবে দোকান থেকে মিষ্টি মাংস কিনে নয়। যা আছে তাই খাওয়াবি। গরিব বড়লোক ভিখারি কাজের লোক - সবার এক খাবার। তবে মা জামাই ননদাই এলে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাচ্ছেন।
মুরগি মোরগ হতো।
আমার মা বলতেন, ঘর জ্বালায়ে পর ভালায়ে।
আর উনুন হচ্ছে রাবণের চিতা, নেভে আর না।
১৯৭৩ বেলা ১২ টা প্রচণ্ড গরম। মা কাজ করছিলেন। বাবা এসে বললেন, এখুনি পরোটা বানাতে হবে। পার্টির সাইকেল মিছিল আসছে। পরোটা মানে মোটা মোটা পরোটা। পরোটা আলু ভাজা আর চিনির সিরা। ঘণ্টা খানেক ধরে চলল বানানো। ১০০ টার মত পরোটা। ৩০ জন মানুষ। বহুদিন পর লাল পতাকা দেখছি। সামনে পাশের গ্রামে মতিন মাস্টার। বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। মতিন মাস্টার রশিদ ভাই - এই মানুষরা পরে পার্টিতে গুরুত্ব পাননি তেমন। বহু কমরেড তখন এলাকা ছাড়া। বাবাকে মেতে হবে ১৯৭৪এ।
অতো তাড়াতাড়ি ভাত তরকারি সম্ভব নয়, তাই পরোটাই সই। কোথায় খাবে কমরেডরা? এমন কোনো দিন নেই যেদিন বাইরের কেউ খাচ্ছেন না। লেখালেখি করতেন নানা ছদ্মনামে। অনুভব কারিগর, কাকু ইত্যাদি নামে। চটজলদি ছড়া লিখে দিলেন পত্রিকায় ছাপার জন্য। তার কপি রইল না। 'খণ্ডঘোষ সমাচার' পত্রিকায় নিয়মিত বের হতো বাবার ছড়া। বই করতে দেন নি। কোনো প্রকাশকের দরবারে কোনোদিন যান নি। আমি বই ছাপার কথা বললে বলতেন, লেখা ভাল হলে প্রকাশক বলবে, নিজের পয়সায় কবিতার বই ছাপান পছন্দ করি না। নিজের জামাকাপড় সাজপোশাক নিয়ে উদাসীন। খালি গায়ে ঘুরতেন তিন খানা গাঁ। পরে একটু অনুযোগ করাতে আমার ঐতিহাসিক বন্ধু ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য প্রফেসর আরিল এঙ্গেলসেন রুড বলেন, ওঁর কাছে নিজের বাড়িটাই শুধু ঘর নয়, তিন খানা গাঁই ঘর। আরিল আমাদের বাড়িতে ১১ মাস টানা ছিল। ইবসেন ন্যুট হামসুন নিয়ে আড্ডা হতো দু’জনের। পরে নরওয়ের এক বিখ্যাত পত্রিকা ভারতের এক কৃষকের ইবসেন চর্চা নিয়ে লেখে।
মৃত্যুর এক বছর আগেও হয়তো বাজার যাচ্ছেন, ছেলেরা নানা জায়গায় ক্রিকেট খেলছে উনি সব মাঠেই একটু করে খেলে গেলেন। তখন বয়স ৭৬। সাইকেল ছাড়া চলতেন না। ২৬ কিমি দূরে বর্ধমান শহরে যেতেন সাইকেল নিয়ে। পরে দাদার বর্ধমানের চেয়ারম্যান হওয়ায় বাড়িতে অনুযোগ শুনে বললেন, বাসে যেতে পারি, কিন্তু ছাদে। ভেতরে বদ্ধ লাগে।
দাবা তাস ক্যারমে ছিলেন দক্ষ। দান পেলে ক্যারমের গুটি শেষ। ফুটবল ক্রিকেট সব খেলেছেন। যাত্রা নাটক গান - নেশা।
বাবার একটা কাজ আমি মনে করি সারা রাজ্যে একক ও দৃষ্টান্তমূলক। একবার বাড়ি গেছি, বাবা বললেন, তোমাকে একটা কথা দিতে হবে। এমনিতে তুই বলতেন, বিশেষ বিশেষ সময়ে তুমি। রাগের মাথায় তুমি বলতেন, আপনিও। তবে এদিন বলার সুরে বুঝলাম, এই তুমি রাগের তুমি নয়। দেখলাম কয়েকজন বসে আছেন। আমি ভাবলাম, কোনো সামাজিক কাজে কিছু দিতে হবে।
বললেন, ওঁরা বসে আছেন একটা প্রতিশ্রুতির জন্য।
কী বিষয়?
গ্রামে কেউ মারা গেলে মুসলিম বাড়িতে প্রচুর আত্মীয় স্বজন আসে। খুব গরিব বাড়িতেও কম করে তিন চারশো। মুসলিম বাড়িতে মারা গেলে দূরের আত্মীয় স্বজন এলে খাওয়াতে হয়। অশৌচ ছোঁয়াছুঁয়ি ধারণাটাই মুসলিম সমাজে নেই। এতো আত্মীয় স্বজনকে খাওয়াবে কীভাবে? বাড়ির লোক শোক সামলাবে না খাওয়ানোর আয়োজন করবে? মধ্যবিত্ত বড়লোক আত্মীয়ের মৃত্যুতে সাত আটশো জন আসেন। সমস্যা হয় না। আমার বাবার মৃত্যুর পর ১৫০০ র বেশি মানুষ ছিলেন জানাজায়। এছাড়া অগণিত মানুষ বিশেষ করে মহিলারা এসেছিলেন দল বেঁধে। যে মহিলারা গ্রামে অন্য কোনো বাড়ি যান না সেই সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মহিলারাও এসেছিলেন।
তো, বাবা ঠিক করলেন একটা সংগঠন করবেন। যেখানে কেউ মারা গেলে ২০ টাকা করে সংগঠনে নাম লেখান পরিবারগুলো চাঁদা দেবে। সবার এক চাঁদা। বড়লোক বলে বেশি দিতে পারবে না। এ থেকেই মাছ ভাত ডাল তরকারি হবে। সবার ক্ষেত্রে এক নিয়ম গরিব ধনী সবাই। মাংস হবে না।
আমি বললাম, সবার সঙ্গে কথা না বলে কথা দেওয়া মুশকিল। বাবা বললেন, তুমি রাজি হলে বাকি ভাই-বোনদের তুমি রাজি করাতে পারবে - এ বিশ্বাস আছে। এখন মুখে মার্কসবাদী কথা বলা আর বাস্তব জীবনে তা পালন করা কঠিন।
ভাবুন, আপনার বাবা বা মা মারা গেছেন লোকের বাড়ি বাড়ি ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে লোক খাওয়াতে, মানতে পারবেন? ইগোতে লাগবে। একজন বললেন, ভাই তোমার বাপ আর আমি ছাড়া কোনো সম্পন্ন লোক এই সংগঠনের যোগ দেয় নি। সবাই বলেছে, আমরা যা লাগে খরচ পুরো দেব। তোমরা করবে। ২০ টাকা করে চাঁদা বাড়ি বাড়ি তুলতে পারবে না। কিন্তু তোমার বাপ নিয়ম করেছে, সবার জন্য এক নিয়ম। এক খাবার। এক নাস্তা। কোনো তফাৎ করা যাবে না।
এবার তুমি বলো কী করবে, প্রফেসার মানুষ। ভেবে বলো।
বাবা জীবনে কিছু চাওয়ার লোক নন। আমিও কোনোদিন চাই নি, বাবার কাছে। খাতা শেষ হয়ে গেলেও বলি নি। ভাই জইনুল বলত আমার হয়ে। বাবা মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সম্মোহিতের মত হ্যাঁ বলে দিলাম। বলে দিয়েই খেয়াল হল, বাকিরা মানবে? কিংবা আমিই কি পারব? সেই সময়? ইগোতে লাগবে না? বাবা মারা গেছেন বলে লোক খাওয়াতে বাড়ি বাড়ি ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে - এটা শুনতে বা দেখতে।
কিন্তু ২০১৩-র রাতে যখন বাবা মারা গেলেন হাসপাতালে মাঝরাতে ভাবছি, আমরা তো কেউ গ্রামে থাকি না। মাও এখানে। কী হবে?
মনে পড়ল বাবার সংগঠন আছে। একটা ফোন করতেই বলল, চিন্তা করো না। সব হয়ে যাবে।
পরদিন গিয়ে দেখি ৫০০ লোকের নাস্তা/ জলখাবার এবং ১২০০ লোকের দুপুরের খাবার আয়োজন তৈরি। একজন বললেন, আরো চাল তৈরি লোক বুঝে বসিয়ে দেব। আমি বললাম, এতো লোকের মাছ ভাত সবজি ডালের আয়োজন। কী করে করবে? টাকা নাও।
ওঁরা বললেন, সবার জন্য নিয়ম এক।
তখন মনে পড়লো, আমি বলেছিলাম, কেউ বাসন, রান্নার সরঞ্জাম, গ্যাস ইত্যাদি ভবিষ্যতে কেনার জন্য কিছু দিতে পারে যদি। সেটা দিতে দাও। বললেন, সেটা স্বাগত।
কিন্তু এ-জন্য নয়। একসময় ১২০ বিঘা জমির মালিক তখনো সম্পন্ন চাষি বিঘে খানেক জায়গা জুড়ে বাড়ির মালিক, ছেলে মেয়েরা চাকরি করে তিনি ২০ টাকা চাঁদায় নিজের মৃত্যু দিনের খাওয়ানোর আয়োজন মেনে নিচ্ছেন - এটা ভাবা যায় না।
বাবার সাফল্য এটাই, সম্পন্ন মধ্যবিত্তরাও পরে এমন একটা সংগঠন গড়লেন। এই সংগঠনের সাফল্য দেখে। যাঁরা একসময় কেউ কেউ এটার বিরোধী ছিলেন, কেউ হাসিঠাট্টাও করেছেন।
লোকের কাছে চাঁদা নিয়ে মা বাপের মরণে খাওয়াচ্ছে!
বাবা কিন্তু উত্তরপাড়ার সুবিধা বঞ্চিতদের সংগঠন ছেড়ে আসেন নি। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে রয়ে গেছেন।
সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের পাশে থাক, সংখ্যালঘুর পাশে থাক - এটাই শিক্ষা। শত অবিচার অত্যাচারেও মাথা নত করো না। সাহসী ও নির্ভীক হও দাম্ভিক আত্মম্ভরি নয়।