পর্ব ৩২
জীবন বদলে যায়।
কত রঙের ছোঁয়া।
আমাদের ছোটবেলায় বইপত্রে রঙ ছিল না বেশি। পোশাকেও।
যদিও ঢঙ ছিল। 'ঢঙি' বলে শব্দও ছিল। রঙচঙে পোশাক মেয়েলি বলে চিহ্নিত হত। গ্রামের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাবা কাকা চাচা দাদুরা ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। সাদা রঙের ধুতি পাঞ্জাবি। পাজামা পাঞ্জাবি পরত তরুণরা বাইরে গেলে। ঘরে বা গ্রামে লুঙ্গি। সালোয়ার কামিজ ছোটবেলায় কাউকে পরতে দেখিনি। ১৩-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েরা ফ্রক পরত। পরে শাড়ি। ছেলেরাও লুঙ্গি পরত হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে। মেয়েরা শাড়ি। ব্রায়ের ব্যবহার বিয়ের দিন কতক। তারপর বাসন কোসন মাজার কাজে ন্যাতা হয়ে কাজে লাগত। আমি তো একাধিক বাড়িতে কড়াইয়ের কালি তুলতে ব্রার ব্যবহার দেখেছি। আরও পরে স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা ব্রা পরা শুরু করে ১৯৮০ র পর।
গ্রামে টুথপেস্ট ছিল না। টুথব্রাশও। ছিল মাজন। আর নিমের দাঁতন। শীতকালে গুঁড়ো মাজন চলত বেশি। জনপ্রিয় লাভা ব্রান্ড। লাভা মাজন খেতেও ছিল মজা। প্রচুর খেয়েছি। ঝালঝাল স্বাদ। জিভ জ্বলে যেত। কিন্তু দারুণ মজা। দু'একজন গুড়াকু ব্যবহার করত।
তখন তো ব্রান্ড কম। দেশলাই মানে টেক্কা। পরে আর্মি। ব্লেড মানে ভারত। পরে এল অশোক। সেফটিপিন (সেপ্টিপিন বলে ডাকত) জিকেডব্ল্যু, নারকেল তেল মানেই শালিমার (পরে উত্তম/ প্যারাশুট), মোমবাতি মানেই তাজমহল, বিস্কুট ব্রিটানিয়া বা কোলে, পরে লিলি। লিলি বিস্কুট, বিস্কুট বানান ভুল লিখে বাজারে প্রচার পায়।
নুন চিনি চাল ডাল পোস্ত বাদাম আটা কোনো কিছুর প্যাকেট কেউ কল্পনাও করেনি। সবই বস্তা বা বড়ো বয়ামে রাখা থাকত। এমনকি চাও লুজ বিক্রি হত। সাবান শুধু প্যাকেটে মোড়া। লাইফবয় সানলাইট আর শৌখিন বলতে লাক্স বা হামাম। নিরমা তখনো আসেনি। গুঁড়ো সাবান পাওয়া যেত। আর স্থানীয় পণ্য সেহারা বা রায়নায় তৈরি কাপড় কাচার বাটি সাবান ৫৫৫/ ৭৭৭ সাবান। বেকাররা তখন ঋণ চাইত সাবান কারখানা করবে বলে। এই বাটি সাবান গরিব মানুষ গায়েও মাখতেন। চটচট করত। সাবান কারখানার পাশ দিয়ে গন্ধে যাওয়া যেত না। দামটা এখন মনে পড়ছে না।
বিড়ি ছিল, কয়েকটি বিড়ি। কলেজ বিড়ি ছিল অল্প। চটা খেতেন আদিবাসীরা। তামাক খেতেন বয়স্ক মহিলারা। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে। দু'একজন মহিলা মহিলা-মহলে বিড়িও খেতেন। আমার বাবার ঠাকুমা নবিসন বিবি ছিলেন দাপুটে। তিনি পুরুষ মানুষদের সামনেই রূপার গড়াগড়া টানতেন। তাঁকে দেখিনি। গল্প শুনেছি। গড়াগড়াটি দেখেছি। পাত্তা দিতেন না কাউকে। বামুনপাড়ায় তাসের আসর বসত মহিলাদের। পাশে পানের ডিবে। মুসলিম মহিলারা পাড়া বেড়াতে বেরোতেন। এ-বাড়ি সে-বাড়ি। গরিবদের সময় বাঁধা ছিল না। যখন তখন। মধ্যবিত্ত বাড়ির বৌরা ভালো শাড়ি পরে মেয়ে/বৌকে সঙ্গে নিয়ে মাসে একবার পাড়া ঘুরতে বেরতেন। পছন্দের বাড়িগুলো যেতেন। চা খেতেন। গল্প করতেন। সবাই সবাইকে চিনতেন।
পর্দা প্রথা সেভাবে ছিল না। গুরুজনদের সামনে হিন্দু মুসলিম সবাই ঘোমটা টানতেন। বোরখা দেখি নি, বোরখা দূরে থাক, শব্দটাই শুনিনি। আর 'হিজাব' শব্দটাই তো বছর ১৫ শুনছি সেভাবে।
গ্রামে শ্যাম্পু ১৯৮৬ পর্যন্ত দেখি নি। একটা সাবান ছিল মাথায় মাখার। হামাম কোম্পানির। শিকাকাই নাম ছিল। ১৯৮২তে আমার দাদার বিয়ের পর বৌদিকে প্রথম দেখলাম চুলের জন্য আলাদা সাবান কিনতে। শিকাকাই। আমি বর্ধমান গিয়ে কিনি। শুধু রায় ব্রাদার্স বলে নামী দোকানে পাওয়া যেত।
সাঁওতালপাড়ার মেয়েরা মাঠের তালপুকুরের গায়ে একটা মাটি ব্যবহার করত। চুলের জন্য। আমিও ব্যবহার করে দেখেছি। চুল রেশম কোমল হত। লোকে পায়খানা করে মাটি দিয়ে হাত ধুতো। থালাবাসন মাজা হত ছাই বা পুকুরের পাঁক মাটি দিয়ে। ছাই দিয়ে ঘসলে কাঁসা পিতলের বাসন কোসন সোনার বরন।
মেয়েরা সাইকেল চাপত না। আমাদের থানা রায়না বা পাশের খণ্ডঘোষ বা বাঁকুড়ার ইন্দাসেও মেয়েরা সাইকেল চাপত না। ১৯৮০ তে প্রথম মেয়েদের সাইকেল কিনে দিলেন বাবার হরিহর আত্মা বাদশা মুন্সী। গোপীনাথপুরের পার্টি নেতা। আমার বাবার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। বাদশা চাচা এক চলমান ইতিহাস। বাদশা চাচার কথা আলাদা করে লেখার দাবি রাখে।
বাদশা চাচার মেয়ে ডালিয়া ও ভাইঝি ইতি আমাদের সঙ্গে নবম শ্রেণিতে পড়তে শুরু করে সেহারা স্কুলে। সাইকেলে চেপে যেত পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। ওদের সাইকেল চাপার গল্প তখন চারদিকের গ্রামে…কবে পড়ে গেছে। কোথায় পড়ে গেছে--এইসব। আমরা কিন্তু ওদের একদিনও পড়তে দেখিনি। ইতি রীতিমত পাল্লা দিত আমাদের সঙ্গে। ইতি শ্যামলা সুন্দর। ডালিয়ার নাম মমতাজ। মমতাজের মতই সুন্দর। ডালিয়ার নামের সঙ্গে দি যোগ করতাম। আমাদের অল্প বড় ছিল। ছোট থেকে চিনি। ডালিয়াদির চেয়ে সুন্দরী আমি কাশ্মীর ছাড়া কোথাও দেখিনি।
ডালিয়া ইতির সৌজন্যে আস্তে আস্তে অনেক বাড়িতেই মেয়েদের সাইকেল ঢুকল। ৫/৬ কিমি দূর থেকে মেয়েরা পড়তে আসত সেহারাবাজার স্কুলে হেঁটে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হেঁটে। কাদা ছিল বিখ্যাত। সেই কাদা ঘেঁটে ১৪/১৫ বছরের মেয়েরা কি করে যে পরিপাটি হয়ে বিদ্যালয় পৌঁছাত- এ এক রহস্য। নবম শ্রেণিতে মেয়েরা সেহারা স্কুলে প্রবেশাধিকার পেত। তার আগে বালিকা বিদ্যালয়। ওদের প্রথম বছর জেনানা ক্লাসে রাখা হত। নাইন সি। ছেলেদের জল খেতে যাওয়া, বারেবারে, কারণ ছিল নাইন সি। কলতলায় প্রথম কথা যার হত, সে তো হির পুর। পছন্দের মেয়ের ছোঁয়া কলের হাতল ধরতে পারলে তো পুর দিওয়ানা। তাকে পায় কে?
ডালিয়ার সঙ্গে ছিল আরেক সুন্দরী কৃষ্ণা তা। সংক্ষেপে কেটি। কতজন যে মরল কৃষ্ণার প্রেমে। কৃষ্ণা শান্ত শীতল। তাপ উত্তাপ নেই। রেগে মেগে বিফলরা এক নবাগত স্যারের সঙ্গে তার নাম জুড়ে বাথরুম ভরিয়ে ফেলল। কিছু বাইরেও এল। আমরা তখন বিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ আন্দোলনের অংশীদার। আমাদের আন্দোলনে ছাত্রসংসদ ধাঁচের সাবকমিটি গড়ল স্কুল। রাজ্যে মেদিনীপুরের দাঁতন আর আমাদের স্কুল দু'জায়গায় মাত্র ছাত্রসংসদ গড়ার স্বপ্ন সাকার হয়েছিল। আমি সম্পাদক। আমাদের উদ্যোগে দুষ্টুদের চিহ্নিত করা হল। সহজও ছিল। চিরকুটপ্রেরকদের কাণ্ড।
বলতে চেয়েছিলাম রঙের কথা। চলে এসেছি অনেকদূর। রঙ বেশি ছিল না। বই সব সাদাকালো। 'প্রসাদ' আর 'নব কল্লোল' পত্রিকায় সেপিয়া টোনে ছবি ছাপা হত। নীলচে আর লালচে। আমরা রঙ মিলান্তি খেলতাম। ঘুড়ি ছিল রঙিন। মার্বেলও। আর রঙিন ছিল তাস। আমরা সিগারেটের প্যাকেটকে তাস বলতাম। তাস খেলা হত। অ্যাসবেস্টসের টুকর ছুঁড়ে। নির্দিষ্ট জায়গা ছুঁতে হত। সে সব তাস বিক্রিও হত। হায়দরাবাদের চারমিনারের সিগারেটহীন খালি প্যাকেটের মূল্য ছিল পাঁচ পয়সা। ক্যাপস্টান পনেরো। উইলস ৫০ পয়সা। কারণ গ্রামে চারমিনার বেশি মিলত। বড়মামা খুব সিগারেট খেতেন। চারমিনার। বেশিরভাগ লোক বিড়ি খেতেন। অল্পকজন চারমিনার। ওটা কড়া। এবং সস্তা। ৫০ পয়সা প্যাকেট। ক্যাপস্টান ৭৫ পয়সা। উইলস এক টাকা। ফিল্টার হলে আরেকটু বেশি। ছেলেছোকরারা মায়েদের সাহায্যে বাপেদের পকেট মেরে ক্যাপস্টান বা উইলস খেত। শীতকালে সবার হাতে পয়সা থাকত। ধান বেচার গরম পয়সা। ফলে সিগারেট বিক্রি বাড়ত। এবং আমাদের অভিনব তাস খেলা। প্যাকেট কুড়িয়ে পাওয়া ছিল লটারি জেতার সামিল। দোকানেও খালি প্যাকেট কিনতে পাওয়া যেত। অনেকেই একটা আধটা কিনতেন। গোটা প্যাকেট হাতে গোনা কয়েকজন।
আর ছিল মার্বেল খেলা। ও তার কী ধুম। সকাল থেকে দুপুর। বিকেল। চলছে তো চলছেই। আমার ভাই জইনুল ছিল মার্বেলে ওস্তাদ। আর বেনেপাড়ার শ্যামল। বাবলু মাঝারি। আমি আজম মোটামুটি। খুব গরিব হয়ে যাই না। ভাই প্রতিদিন আমাদের মার্বেল দেখাত ফলাও করে। আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে ঝনঝন করে বাজায়। শাসায় সবাইকে, কেউ মার্বেলে হাত দিবি না। ভাইয়ের পড়ায় মন ছিল না। রাতদিন মার্বেল গুলি ডাং। সে গরু দোওয়ার সময় পেতলের তিনসেরি বালতির কাঁচা দুধ চোঁ চোঁ করে মেরে দেয়। কাঁচা ডিম খায়। কুকুর একবার কামড়ালে তাকেও কামড়ে দেয় জোরে। ভয়ে ভয়ে থাকি। গায়ে প্রচণ্ড জোর। মারপিট হয় খুব। যেমন মারপিট তেমন ভাব। সে তো ওয়ানে পড়লই না। আমরা উঠে গেছি টু-তে। সে টুইয়েই পড়বে। পড়লও। পরে বড়মামা প্রধানশিক্ষক কি করে ওকে ম্যানেজ করে নীচের ক্লাসে কবে পাঠালেন মনে নেই। তবে ও ওয়ানে পড়েনি।
আমাদের এক বৈঠকখানা ছিল। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, তার বৈশিষ্ট্য। কাছারি ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ হেকিম সাহেবের আমলে। বেতের কাজ ছিল খড়ের চালের আগে বাঁশে। প্রতিটি খুঁটি কাঠের। কারুকার্য করা। ঝাড়বাতি ঝোলানোর বন্দোবস্ত ছিল। আর দেওয়াল ছিল চারফুটের বেশি চওড়া। পাট খড় আর কাদা মিশিয়ে। গা ছিল সিমেন্টের মত মসৃণ। ডিমের লালা নাকি মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন বোন মিস্ত্রি। মিস্ত্রির নাম আর সাল লেখা ছিল। বাংলা সাল ১২৭৬ বা ওই সময়ের। ১৪০৫ নাগাদ ভাঙে। ভেঙ্গে পড়ে। আমাদের দোষে। অযত্নে।
দরজাগুলো সেকালের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কারুকার্যমণ্ডিত। পুরানো বনেদি কিছু বাড়িতে আমি সে-রকম দরজা দেখেছি। আর শিল্পী মিঠু সেন ২০১২ তে দিল্লিতে আমাকে সংগ্রহালয়ে নিয়ে যায়। পুরাতন দরজা জানালা গরুর গাড়ির চাকা পালকি পাখা এ-সব দেখি। আর আফশোস করি। কড়ি বরগা আর খুঁটি বা জানালা তো আমরাও দান করতে পারতাম। পড়ে থেকে উইয়ের কবলে নষ্ট হত না।
আমার ভাইয়ের গল্পে ফিরি।
সম্ভবত ১৯৭৩। আমাদের বৈঠকখানায় থাকতে এলেন দু’জন মানুষ। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। কুর্চিগড়ের মাস্টারমশাই আর কাষ্ঠকুড়ুম্বার মাস্টারমশাই। কুর্চিগড়ের মাস্টারমশাইয়ের নাম মনে নেই। নাম তো বলা হত না। গ্রামের নামে মাস্টারমশাইয়ের নাম। পরের মাস্টারমশাইয়ের নাম জানি। শম্ভুনাথ থান্দার। আমার জীবনে তাঁর অবদান অনেকখানি। তাঁর স্নেহের পরশে আমি বদলে যাই। আমি ছিলাম কালো। কাল্টা বলে ডাকা হত। গল্পের বইয়ের পোকা। কিন্তু পড়ার বইয়ে মন নেই।
- বাড়ির সবাই ফার্স্ট হয় আর তুই?
মায়ের প্রশ্নের জবাব দিই, কত ছেলে যে ফেল করে। আমি তো পাস করেছি।
শিশুশ্রেণিতে ছিল ১৫০ জন। প্রথম শ্রেণিতে শতাধিক। টু-তে ইংরেজি ঢুকতেই মাত্র ৪২ জন। আমার রোল নম্বর ৩৭।
মহাত্মা গান্ধীর মায়ের নাম পুতলী বাঈ না কস্তুরী বাঈ গুলিয়ে যায়। তো শম্ভুবাবু আমাকে বুঝিয়ে ছাড়লেন, পড়ার বই আর গল্পের বইয়ে বিরোধ নেই। আমি তৃতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হলাম। চতুর্থ শ্রেণিতে প্রথম। সেই শুরু। তারপর তো জানেন ফার্স্ট হওয়ার কি ঝামেলা। থামতে জানতে নেই।
তা, শম্ভুবাবু আমাকে বশ মানিয়ে ভাইয়ের পিছনে পড়লেন। ভাই তো আসেই না। বরং পড়তে বসলেই দূর থেকে মার্বেল ঝনঝন করে আমার পড়ার বারোটা বাজিয়ে দেয়। তো স্যার ঠিক করলেন ওর সঙ্গে মার্বেল খেলবেন। প্রথমে দু-একবার ইচ্ছে করে হারলেন। তারপর জেতেন আর জিজ্ঞেস করেন,
- কটা মার্বেল রইল?
আবার হারেন।
- কটা মার্বেল হল?
ভাই বুঝল ব্যাপারটা। তারপর বলল, এই শোন এই শ্লা মাস্টার খেলার নামে অঙ্ক শেখাতে চায় বে।
পালা পালা পালা।
সেই ভাই পরে মাধ্যমিকে অঙ্কে ১০০ পেল। এখন প্রধান শিক্ষক।
আজমের কাছে শুনেছি, কুর্চিগড়ের মাস্টারমশাইয়ের নাম ছিল পরেশনাথ দত্ত।
পর্ব ৩৩
আমাদের ছোটবেলায় সবচেয়ে প্রিয় ছিল চাঁদ। 'আয় আয় চাঁদ মামা/টি দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ/টি দিয়ে যা' বলে আমার কপালে বড়দি একটা বড় কাজলের টিপ পরিয়ে দিত। আঁদাড়ে পাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ায় কাল্টা।
কাল্টা মানে আমি। কোনো পেত্নি বা জিনের নজরে যেন না পড়ে। আমাদের ঘরের দু’দিকে চারটি পুকুর। তিন ঘর লাগোয়া। বড় উঠোন। পাঁচিলও অনেকটা জায়গা জুড়ে। এখনও আছে। তবে কমেছে। ছোটোবেলায় অনেকটা বেশি ছিল। উত্তর পশ্চিমে তালপুকুর। পশ্চিমে প্রায় ৫০০ মিটার লম্বা বাঁকা। ক্যানেলের জল বয়ে যায় এর মাঝ দিয়ে। রেখে যায় অঢেল মাছ। বড় বড় আড়, বোয়াল, বড় গলদা চিংড়ি, পাঁকাল, বাণ আর মৌরলা-ট্যাংরা অজস্র। তালপুকুরে পোনা মাছের আদর্শ জায়গা। মিঠা পানি। তিনটা ঘাট। থালাবাসন ধোয়া জল। গোটা ২৫-৩০ জন স্নান করে। পুকুরে রুই কাতলা মৃগেল চুনো মাছ আর পুঁটি। এবং কুচো চিংড়ি। খান চারেক বড় কাতলা ছিল। দুই বাড়ির বিয়েতে লাগবে বলে। শরৎ চাটুজ্জে অনুপ্রাণিত বোধহয়, দুটির নাম মনে আছে, কার্তিক আর গণেশ। জালে ধরা পড়ত। ছেড়ে দেওয়া হত। কানে চিহ্ন দেওয়া ছিল। একটি আমাদের বাড়ির বড় মেয়ে বড়দি আলিয়া আর একটি মুন্সীদের বড় মেয়ে বেলা ফুফুর বিয়ের জন্য সংরক্ষিত। জামাইয়ের পাতে বড় মুড়ো দেবে। গোটা ছাগলের রোস্টের মুড়োর সঙ্গে মাছের মাথার মুড়ো দেওয়া দস্তুর।
দক্ষিণ পশ্চিমে ধোবাগড়। একসময় ধোবা থাকত বোধহয়। এতে ভাল মাছ হত না। বাড়ত না। তার চারপাশে ঘন জঙ্গল। আশশ্যাওড়া গাছে। তাতে নাকি পেত্নি থাকে। দিনের বেলায়ই ভয় করে। রাতে তো কহতব্য নয়। তার পাড়ে আমগাছ। দু’টো আমগাছ ছিল অদ্ভুত। একটা কাশি আমগাছ। খেলেই কাশি অনিবার্য। আর একটা কেরোসিন আমগাছ। পুরো কেরোসিন গন্ধ। বড় আমগাছ ভারি মিষ্টি। বাগুইআটি জোড়ামন্দির ছাড়া অত ভাল আম আজ-ও খাইনি। সেটি ছিল আমাদের খেলার সঙ্গী। বড় বড় ডাল। লুকোচুরি খেলা যেত। আর পুরো দক্ষিণে তাঁতিগড়। পাড়ে আগে তাঁতিরা থাকত। ছোট ডোবা। তাতে পাঁক খুব। শিঙ্গি মাগুর কই মিলত কেবল। তবে দেদার। গা কুটকুট করত এর জলে। কেরোসিন মেখে তবে শান্তি। তালপুকুর বাঁকা ধোবাগড় তাঁতিগড়ে পাড় আমাদের বাড়ির সীমানা নির্দেশ করত। ধোবাগড়ের পাড়ে একটা গাছ ছিল। আঠা হিসেবে ব্যবহার হত তার ফল। নাম মন নেই। (মনে পড়েছে নেহারা)। খেতেও ছিল খুব মিষ্টি। চুষে চুষে খুব খেয়েছি। গ্রীষ্মকালে প্রাথমিক বিদ্যালয় যাওয়ার শর্টকাট ছিল ধোবাগড়ের পাড়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা আমাদের ঠাকুর্দাদের দেওয়া। পাশেই ছিল কন্ট্রোল বা সমবায়। সেটা চৌধুরী ও ফনু সেখদের দেওয়া।
ঘর, ধোবাগড়ের পাড় আর মাঝে ক্যানেল পেরোলেই প্রাইমারি। স্কুলে দারুণ মজা। শিশু শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণি বারান্দায় ক্লাস। চাটা বা চট নিজেকে নিয়ে আসতে হবে। টু বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে ঘরে পদোন্নতি। সেখানে বেঞ্চ মিলবে। তবে অর্ধেক বেঞ্চে। অর্ধেক মাটিতে। তৃতীয় শ্রেণিতে বেঞ্চে।
মাস্টার মশাইরা ছিলেন একজন বাদে খুব প্রিয়। শাস্তি ছিল অদ্ভুত। মুখের জিভ বার করতে বলে কালি ঢেলে দিয়ে মা কালী সাজানো। গাঁট্টা। হাতের আঙ্গুলের মাঝে পেন্সিল চেপে ধরা। ডাস্টার ছোঁড়া। মাথায় ডাস্টার মারা। বেত বা কঞ্চি তো ছিলই। কঞ্চি আবার যার শাস্তি তাকেই আমাদের বাঁশ ঝাড় থেকে কেটে আনতে হত। এক মাস্টারমশাইয়ের অভিভাবক মহলে খুব নাম ছিল পেটাতেন বলে। ইংরেজির মাস্টার। কিচ্ছু শিখিনি। 'টি টা খানা খানি' ছাড়া। আর শাস্তি ছিল- মেয়েদের দিয়ে মুখে বাঁ হাত বোলানো। আমি এই শেষ শাস্তি একবার পেয়েছিলাম। তাতেই আমার পড়াশোনায় মন…
- মহাত্মা গান্ধীর মায়ের নাম কী?
পুতলিবাঈ না কস্তুরীবাঈ ভাবতে না ভাবতেই পুতলিবাঈ পছন্দ হল।
অমনি উচালনের মাস্টারমশাই সুনীলবাবু ক্লাসে দ্বিতীয় হওয়া কুলসুমাকে আদেশ দিলেন, দে তো কুলু ওর মুখে বাঁ হাত বুলিয়ে। রাতদিন শুধু 'নব কল্লোল' আর মার্বেল গুলি ড্যাং টো টো- দেখ।
কুলু এল। আমি শুধু কানে কানে বললাম, স্যার চলে গেলে তোর কী হয় দেখবি। ভয়ে কুলু পিছিয়ে গেল। স্যার বললেন, এত সম্মানের চিন্তা তো পড়াশোনা করলেই হয়। সম্মানে খুব লাগল। পড়ায় মন দিলাম।
এর সঙ্গে সঙ্গত দিল শম্ভু মাস্টারমশাইয়ের প্রেরণা। আমাদের বাড়ির সামনে পূর্ব উত্তর দক্ষিণ জুড়ে বড় খামার। মাঝে বিরাট বৈঠকখানা। সেখানে দুই মাস্টারমশাই থাকতেন।
ঘরের দেওয়ালের সামনে ছিল গরুর গাড়ি। তাতে শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে আর দূরাগত বাঁশি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে পুতলিবাঈয়ের সঙ্গে পুতুল খেললাম। ইতিহাস হয়ে উঠল আমার প্রিয় বিষয়।
আর সেদিন রাতেই বিষ খেয়ে মারা গেল ম...দা। গ্রামের এক মুসলিম তরুণীর প্রেমে পড়েছিল সে। অপূর্ব বাঁশি বাজাত। বাড়িতে রাজি হয়নি। মেয়েটির বিয়ের আগের দিন বিষ খেলো গ্রামের সেই সুদর্শন তপশিলি যুবক।
তারপর চাঁদনি রাতে দূর মাঠ থেকে অনেকেই শুনত বাঁশি। আমি তো পেতামই। চাঁদনি রাত আর বাঁশি আমার কাছে সমার্থক।
টীকা:
খাসির রোস্ট কীভাবে হত? গোটা খাসিটা মশলা ইত্যাদি দিয়ে সঞ্জীবিত করে ভাজা হত ডালডা ঘি বা সর্ষের তেলে। সেঁকা হত হয়ত পরে। আমি বড়দির বিয়েতে দেখেছি। ১৯৭১এ।
১৯৮৮ নাগাদ এক বন্ধুর বিয়েতেও দেখেছি। বরের থালে/ থালায় যেত। বলা হত থাল। বরের থালে বন্ধুবান্ধব ও তাঁর ভগ্নিপতি অধিকার পেতেন। মজলিসে একটা বিরাট থালা ঘিরে বসতেন ১০-১২ জন। এক এক করে আসত নানা খাবার। খাসির রোস্ট তার একটি। পরে এটা জোড়া মুরগিতে দাঁড়ায়।