২৮
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যত্র চাকরির উমেদারি বা কসরৎ না করে মানিকতলা খালপাড়ের ২৩১ জন শিশুর মাস্টারমশাই হয়েছি-- এটা আমার গর্বের। অধিকার/ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভাষায় 'বড়ো স্যার' । (ওই নামেই আমাকে ডাকেন ওঁরা। ওঁদের নামকরণের ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। একটি উদাহরণ যথেষ্ট আপাতত, একজনকে বলে ইস্টাইল স্যার, একজনকে চুইংগাম স্যার)। ওদের মাস্টার মশাই হতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছি, তার বড়ো কারণ, ওই সন্ন্যাসী বা পানিফলওয়ালার সাথে চলে যাওয়ার ইচ্ছে।
আমি যদি সত্যি সত্যি পানিফলওয়ালার সঙ্গে চলে যেতে পারতাম, তাহলে আমার পড়াশোনা হতো না। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে বাংলার বিভাগীয় প্রধান বা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক না হয়ে পৃথিবীর একমাত্র এক প্ল্যাটফর্ম বিশিষ্ট জংশন কালীনগর স্টেশনের পাশের নয়ানজুলি থেকে পানিফল তুলে ট্রেনে ট্রেনে বেচে বেড়াতাম। কৃষ্ণনগর রাণাঘাট গেদে লোকালে ।
মেধা।
একটি বানানো শব্দ।
পেটে ভাত, বাবা মা-র সামর্থ্য একটি বড়ো বিষয়। ব্যতিক্রম নেই? আছে। ব্যতিক্রম তো নিয়মকেই সিদ্ধ করে। অ্যাকাডেমিক কচকচি আমিও একটু আধটু জানি। তন্বিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে। কিন্তু জার্গন ঝাড়া পছন্দ করি না, পাঁচজন মানুষের প্রভাবে। মহম্মদ, লেনিন, মাওসেতুঙ, রামকৃষ্ণ এবং লালন। কত কঠিন কঠিন কথা কত সহজে বলেছেন ওঁরা।
সহজ কথা যায় না বলা সহজে। কাঁচড়াপাড়া স্টেশনে নেমে চলেছি পানিফলওয়ালার পিছু পিছু। এক ভদ্রলোক খেয়াল করেন, নতুন প্যান্ট জামা পরা ছেলেটি পানিফলওয়ালার সঙ্গে কেন? তখন তো কথায় কথায় লোকে নতুন চকচকে জামাপ্যান্ট পরে বের হতো না। পূজা/ উৎসব বা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বিয়েতে গেলে তবে নতুন পোশাক। অস্বাভাবিক ঠেকে তার। হাঁকডাক করায় বাকিদের খেয়াল হয়, আমিই সেই বালক। পালিয়ে যাচ্ছি। পালানোর ইচ্ছে ষোলআনা। কত গল্প ভেবেছি, মনে মনে। কী কী করব, কী কী দেখব।
হারিয়ে যাওয়া কি এতো সোজা?
বর্ধমানে শীতকাল মানেই মোটামুটি ফাঁকা মাঠ। আলু পেঁয়াজ আছে। কিন্তু সে আর কতটুকু। শীতকালে ফাঁকা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম। কাচ গুঁড়ো করে মাঞ্জা করা আর ঘুড়ির পিছু পিছু দৌড়। তা পায়ের আঙ্গুলের নখ উপড়ে গেলেও পরোয়া নেই, ঘুড়ি আগে।
তা, নদিয়ায় দেখি সবুজে সবুজ মাঠ। এই প্রথম তামাক গাছ আর পটল গাছ দেখলাম। শুনলাম, পটল গাছের শিকড় নাকি বিষ। খেলেই মরে যায়। শুনে ইচ্ছে হয়েছিল সাহস হয় নি।
আমাদের ওখানে পুকুর দিঘি। এখানে বলে বিলি মানে বিল। তাতে বড়ো বড়ো চিংড়ি মাছ। ওঁরা বলেন, চ্যাংড়া। নারকেল দিয়ে চিংড়ি মাছ খাওয়া হল। নদিয়ায় নারকেল গাছ প্রচুর । আমাদের তাল খেজুর। অন্যরকম লাগলো চিংড়ি রান্না। একটু মিষ্টি মিষ্টি। আমাদের ছোট বা কুচো চিংড়ির দেশ। কুচো চিংড়ির পেঁয়াজ বাটা আর তেঁতুল মিশিয়ে টক অমৃত। এছাড়া চিঁড়ি আলু পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি দিয়ে ঝালঝাল ছিল পছন্দ। চিংড়ি শুঁটকির ভর্তাও ছিল বর্ধমানে অসাধারণ। কাঁচা পেঁয়াজ তেল নুন কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে। শুধু চিংড়ি শুঁটকি একটু কড়ায় ভেজে নিতে হবে শুকনো মাটির খোলায়। এখন তো মাটি নয়, লোহাও নয়। অ্যালুমিনিয়াম নয় স্টিল।
ঘটিরাও প্রচুর শুঁটকি খায়, অবাক হবেন না।
জীবনের কতটুকু আমরা জানি।
২৯
গ্রামে কতগুলো কথা খুব চালু ছিল গুন্ডার, সি আই ডি, নকশাল, লালপার্টি। ইন্দিরা গান্ধী, জ্যোতি বসুর নাম সবাই জানতেন। ডাকাবুকো এক মহিলাকে বলা হতো ইন্দিরা গান্ধী। একজনের নাম ছিল জ্যোতি বসু। এগুলো ছিল বিশুদ্ধ মজা। কিন্তু প্রাণান্তক টিপ্পনি বা টিজিং ছিল। যদিও ইভ-টিজিং নয়। কিন্তু ছোটদের তো নানা নামে খেপানো ছিলই। দিদিমারা যদি সেই ছোটটিকেই তার বরের নামে ডাকতো, তবে আরেক কাণ্ড। বলতেন, কত্তা গো। তাঁর তো আরো ঝামেলা।
গুন্ডাকে গুন্ডার বলা হতো। আর শিবু নামে এক মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ কোথা থেকে এসে হাজির হন। ধুলোবালি মাখতেন। ময়লা পোশাক। তেলচিটে জটার মতো চুল। উস্কোখুস্কো দাড়ি। আমাদের বৈঠকখানায় আশ্রয় ছিল। কিন্তু ঘুমোতে যেতো ছানিশালে। ছানি মানে গোরুকে খাওয়ানোর জন্য কাটা খড়। এ-কারণেই লোকের ধারণা ছিল সি আই ডি। ও কোনো গোপন খবর নিতে এ-রকম ভেক নিয়ে আছে। আসলে যাত্রাপালাতে তো এ-রকম ছদ্মবেশী সিআইডি থাকতো। অপরাধী ধরতো। লোকের সিআইডি-র ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল। সিআইএ-র চর পরে শুনেছি।
শিবু দুপুরে রাতে আমাদের বাড়িতে খেতেন। আর লেলো ভাইয়ের মায়ের কাছে। গ্রামে তিনজন মহীয়সী মহিলা আমি দেখেছি। যাঁরা একটা জালায় গরিব দুঃখীর জন্য চাল জমাতেন। আমার মা বাবার দানধ্যানে বিরক্ত হলেও নিজেও প্রচুর দান করতেন। মায়ের মৃত্যুর পর ভিড় হয়েছিল বাবার মৃত্যুর চেয়ে কম নয়। অনেকের মুখেই শুনি মায়ের দানের কথা।
তিনজন মহিলা হলেন একজন লেলো ভাইয়ের মা, আরেকজন সাইফুল চাচার নানি আরেকজন পচা মোড়লের মা। এঁরা কাউকে ফেরাতেন না। শিবু সিআইডি লেলোভাইয়ের মায়ের কাছেও মাঝেসাঝে খেতো। শিবুকে সন্দেহ করার কারণ ছিল বিশেষ বিশেষ ঘটনার সময় তার আবির্ভাব ও নিষ্ক্রমণ ঘটতো।
একবার গ্রামে নকশালরা বোমা মারলো। গ্রামে সেটাই প্রথম ও শেষবোমা।
পরদিন সকালে সুতলি দড়ির সঙ্গে কাচের টুকরো দেখা গেল। এক কংগ্রেসি নেতার অত্যাচারের বিরোধিতা করে বাইরে থেকে নকশালরা এসে বোমা মারে। বোমমারা ব্যক্তিটিকে গ্রামের অনেকেই চিনতেন। কেউ নাম বলেন নি। খুব সাহসী আর অকপট ছিলেন মানুষটি। পরে বাস শ্রমিক সংগঠনে পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। তা এই বোমা মারার পর শিবু সিআইডি অন্তর্হিত হলো এবং একদল বললো, শিবু সিআইডি না ছাই, আসলে নকশাল আর একদল পুরাতন তত্ত্ব আঁকড়ে ধরার যুক্তিসঙ্গত কারণ পেল, যখন গ্রামে সি আর পি তথা কেন্দ্রীয় বাহিনীর আবির্ভাব হলো। প্রচণ্ড অত্যাচারী ছিল তারা। আমাদের বাড়িতে প্রায় দিন বুকে মাটির উনুন ভেঙে দিয়ে যেতো বোমা খোঁজার নামে। আমার ঠাকুরদার মদের পাত্রের সংগ্রহ ছিল অসাধারণ। আমাদের বলা হয়েছিল, ওগুলো শরবত খাওয়ার গ্লাস। কিন্তু কাউকে ওই গ্লাসে শরবত দিতে দেখি নি। সিআরপি সার্চ মানেই দু একটি গ্লাসের অন্তর্ধান।
আজ লোকে কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী চায় জানি না।