আমাদের ছোটোবেলায় বেড়ানো বলতে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি। মামার বাড়ি গ্রামে। তিন মাসির বাড়ি দূরে। এক পিসি কাছেই। বড়দির বাড়িও কাছে। মেজদির বাড়ি দূরে। সেজ মাসি আর মেজদির বাড়ি, ট্রেনে করে যেতে হয়। বিডিআর ট্রেন। ছোটমাসির বাড়ি যেতে তিনটে ট্রেন চড়তে হয়। উত্তর চব্বিশ পরগনার কাঁচড়াপাড়া। তাও সারাজীবনে মাত্র তিনবার গেছি। বড়মাসির বাড়ি পাণ্ডুয়া। সেখানে এক মাস ধরে মেলা হয়। জীবনে প্রথম গেলাম পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে। সঙ্গে ৩৫ টাকা। নিজের রোজগার। ৯০ কেজি ধান সংগ্রহ করেছিলাম শিষ কুড়িয়ে। বাবা বললেন, ১০ কেজি গ্রেস। তখন ধান ৩৫ টাকা কুইন্টাল। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। একটা চপের দাম ৫ পয়সা।
পাণ্ডুয়াতে গিয়ে খেলাম বোমা নামে একটা বস্তু। আমাদের ফুলুরির বড়ো ভাই। ১০ পয়সা দাম।
তবে একটা জিনিস খেলাম আমাকে মোহিত করে দিল---- ক্রিম রোল।
৩০ পয়সা দাম।এখন ১০ টাকা।
দিনে সুযোগ পেলেই খাচ্ছি। আর পাণ্ডুয়ার মিনারে চড়ছি ১০ পয়সা দিয়ে। তখনো চড়া যেত।
কী মজা।
চশমা আংটি বন্দুক তুচ্ছ হয়ে গেল।
আর কিনলাম সিনেমার বই।
চার আনা দাম।
খানিকটা গল্প থাকবে। কিছু গান থাকবে। আর গল্পের শেষে লেখা থাকবে, বাকিটা হলে।
দস্যু মোহন, স্বপনকুমার, গোয়েন্দা দীপকের বই তখন আট আনা করে দাম। কয়েকটি কিনলাম। আর কয়েকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নিলাম। দোকানদারের আমাকে খুব পছন্দ হল। আমারও দোকানদারকে।
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যাত্রা থিয়েটারের বই বেচো না?
বলল, লোকে কেনে না।
জ্যোতিষ কেনে, বশীকরণ কেনে, আর কিছু আছে। মেলায় বেচা মানা।
আমি তখন 'নব কল্লোল' পত্রিকায় পুতুল নাচের দল নিয়ে একটা উপন্যাস পড়েছি।
কার লেখা মনে নেই।
নদীয়ার এক পুতুল নাচের দল নিয়ে লেখা। চমৎকার লেখা।
রূপবান কন্যা, সোনাই দিঘি, সোনাভান কন্যা, নদের নিমাই-- এই সব পালা দেখে ফেললাম।
১৯ পয়সা টিকিট লেখা থাকতো। ২০ পয়সা হলে ট্যাক্সো লাগবে।
তা নিত ২০ পয়সা।
আমি আগে ঠিক করেছিলাম, বইয়ের দোকানদারের সঙ্গে পালাব। মেলা দেখব ঘুরে ঘুরে আর বই পড়ব। অভিজ্ঞতা অর্জন করে ম্যাক্সিম গোর্কি আর নজরুল ইসলামের মতো লেখক হবো।
এবার দেখলাম, পুতুল নাচের দল আরো আকর্ষণীয়।
দলের একজনের সঙ্গে দিনের বেলায় গিয়ে ভাব জমিয়ে ফেললাম।
ঠিক হল, শেষ দিন ওদের সঙ্গে পালাব।
আমার মাসতুতো দাদা ছিল বুদ্ধিমান লোক। এখন জ্যোতিষী হিসেবে মুম্বাইয়ে নাম করেছে। দৈনিক পুতুল নাচের দলের ঘরে দিনের বেলায় ঢুকতে দেখে ১০ দিন পর ফেরৎ দিয়ে গেল। মেলা শেষ হতে তখনও ১৫ দিন বাকি।
এবং লাভের মধ্যে হল এই, আমার পাণ্ডুয়া যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
তবে মেজদি আর সেজমাসির বাড়ি যাওয়া চলল।
সেখানে শাসপুরে একটা টিনের সিনেমা হল ছিল। ৬০ পয়সা টিকিট।
অন্নপূর্ণার মন্দির, বসু পরিবার দেখে ফেললাম।
উত্তমকুমারকে ভালো লেগে গেল। ছেঁড়া গেঞ্জিতে দেখে।
আর দেখলাম, লোকে আমাদের গ্রামের মতোই ইস্ত্রি ধার করতে আসে।
জামা ইস্ত্রি করবে বলে।
১৯৭৭এ লটারি মিলে গেল।
বামফ্রন্ট সরকার এল। পুলিশ আর সি আর পি অত্যাচার নাই। উল্টে ২১ জুন কলকাতায় ব্রিগেড যাওয়ার সুযোগ মিললো।
উত্তেজনায় আমার আর আমার পরের ভাই জইনুল হকের তিন রাত ঘুম হলো না।
কলকাতা দেখব।
সেখানেই দেখলাম ধীরেন কড়াইয়ের বিশাল বিজ্ঞাপন। হাওড়া ঢোকার মুখে।
ধীরেন কড়াইয়ের ধীরেন কে? বহুদিন মনে ছিল এই জিজ্ঞাসা। তবে ১৯৮৯ পর্যন্ত এই ধীরেন কড়াই ছিল আমার হাওড়া স্টেশনে ঢোকার সংকেত চিহ্ন। বাড়িতে কড়াই কিনতে দিলেই আমি ধীরেন কড়াই খুঁজতাম। পরে আমাদের রায়না থানার বিধায়ক হন ধীরেন চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। জনপ্রিয় মানুষ। কিন্তু পরে জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। পার্টি সম্পাদক বিধায়ক দুটোই হওয়ার সুবাদে দোর্দণ্ডপ্রতাপ। প্রাথমিকে বিদ্যালয়ে নিজে যেতেন না, তাঁর হয়ে স্কুল করতো ছোটো ছেলে। এতে অনেক কথা উঠতে থাকে।
ধীরেন বলতে আমার কল্পনায় ছিলেন আরেক মানুষ, ফুটবল মাঠের ধীরেন দে। তিনি ছিলেন দে'জ মেডিক্যালের মালিক।
কল্পনায় এই ধীরেন দে কড়াই কোম্পানির মালিক হয়ে যান।
ভুল না ঠিক আজ আর জানা নেই।
ধীরেন কড়াই ছাড়া আর দুটি শ্লোগান ছিল হাওড়া প্রবেশ স্মারক।
"শৃঙ্খলায় হয় জাতির অভ্যুদয়-- মহাত্মা গান্ধী।"
১৯৯৮ এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে বামফ্রন্ট সরকার, এই সময় এক রসিক একটা অসাধারণ দেওয়াল লেখেন-- "ইংরেজ তুমি ফিরে এসো। স্বাধীনতা এখন শৃঙ্খল।"
তো আমরা হাওড়া এসে পৌঁছালাম। ১৯৭৭এর ২১ জুন। বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার দিনে। ছিলাম ষাট জন মানুষ। রাতভোরে বের হয়েছি সাড়ে ছয় কিলোমিটার হেঁটে সেহারা এসে ফার্স্ট বাস ধরেছি। বাসের নীচে জায়গা হয় নি। সবাই ছাদে। আমরাও। এ ওর কোলে বসে। ট্রেনেও প্রচণ্ড ভিড়।
তখন প্রায় তিন ঘন্টা লাগতো হাওড়া পৌঁছাতে। জায়গা পাই নি। কিন্তু শ্লোগান আর গানে মাতিয়ে রাখলেন বাবা।
গণসঙ্গীত বেসুরো গলায় সেই গাওয়া শুরু।
শ্লোগানে দীক্ষা আগেই হয়েছিল।
এবার হল গানে।
উই শ্যাল ওভার কাম, শহিদের রক্তরাঙা পথে দেখো হায়নার আনাগোনা, মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কমরেড লেনিনের আহ্বান চলে মুক্তি সেনাদল।
আমি তখন ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' পড়ে ফেলেছি। নিজেকে মনে হল, সেনাদলের একজন সদস্য।
ট্রেনে একটা সাদারঙের বাদাম দেওয়া ১০ পয়সা দামের লজেন্স খাই।
প্রথম বলে কিনা জানি না, ওইরকম অসাধারণ লজেন্স আমি আর কখনো খাই নি। তখন হকাররা বয়েমে করে লজেন্স বেচতো।
লজেন্স বিক্রেতা জানালেন, তিনিও ব্রিগেড যাচ্ছেন।
না গেলে হয়, এবার রেল পুলিশ আর জারিজুরি করতে পারবে না, লালপার্টির সরকার আসছে।
বয়েম ফাঁকা হয়ে গেল নিমেষে।
সবাই সবাইকে কমরেড বলছেন।
লজেন্স বিক্রেতাও কমরেড হয়ে গেলেন।
হাওড়াতে নেমে হেঁটে মিছিল করে হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে মোহনবাগান মাঠ হয়ে ব্রিগেড যাওয়া।
মোহনবাগান মাঠে বসা হল গোল করে।
গ্রামের নানা সম্পন্ন বাড়ির মহিলারা রাত জেগে রুটি বানিয়ে দিয়েছেন বাবার কথায়। রুটি গুড় আর জিরে পোস্ত দিয়ে আলু ভাজা। আমাদের বাড়িতেই তৈরি হয়েছে শত খানেক রুটি। পাঁজা করে রাখা হল।
ওদিকে দেখি অনেক ক্যাম্প। সেখান থেকে ডাকছে, আসুন কমরেড। কোথাও কোথাও রুটি গুড় কাগজে মোড়া কোথাও লুচি আলুর দম। কড়াই ভর্তি আলুর দম। আমি দেখছি কড়াইয়ের নাম। দেখি, ও মা, ধীরেন।
কড়াইকেও মনে হল, কমরেড কড়াই।
আমরা ছোটো। জল তেষ্টা পেয়েছে।
একজন স্বেচ্ছাসেবক বললেন, কমরেড খোকা, ওইদিকে জলের ট্যাঙ্ক আছে।
আমাকেও কমরেড বলেছে।
মনে হল, অনেক বড় হয়ে গেছি।
আনন্দে জল এসে গেল চোখে।
কেউ আমাকে কমরেড বলেছে।
ব্রিগেডে গিয়ে দেখি, শুধু মাথা আর মাথা।
যেখানে ট্যাঙ্ক আছে ওইখান পর্যন্ত পৌঁছানো গেল।
কেউ একজন আমাদের মাথায় তুলে দেখালেন, মঞ্চ। জ্যোতি বসুর ভাষণের সময় আবার তুলে ধরল মাথায়।
দুই ভাই মাথায় চেপেই জ্যোতি বসু আর প্রমোদ দাশগুপ্তকে দেখলাম।
এরপর আমি সব ব্রিগেড গেছি। ১৯৯২ ছাড়া এতো ভিড় আর কখনো দেখি নি আমি।
ফেরার সময় মেট্রোর গর্ত খোঁড়া দেখলাম। পার হতে হল অতি সাবধানে।
রাতের ট্রেন ধরে ফেরা।
বর্ধমান স্টেশনের সামনে কোহিনুর বলে একটা মুসলিম হোটেল ছিল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল খাবার শেষ। পাশে হিন্দু হোটেল, সেখানেও খাবার নেই। শেষে একটা দোকান পাওয়া গেল, ঘুগনি আর পাঁউরুটি। দু প্লেট করে ঘুগনি আর হাফ পাউন্ড রুটি খেয়েছিলাম মনে আছে। ঘুগনি ২০ পয়সা প্লেট। রুটি ৩০ পয়সা।
ওই প্রথম ও শেষবার সারাদিন ভাত না খেয়ে থাকা।
কিন্তু ভাতপ্রেমী আমার কিছুই মনে হল না।
সবকিছু একটা ঘোরের মধ্যে।
রাতে কোথায় ঘুমিয়ে ছিলাম আজ মনে পড়ছে না। বোধহয় স্টেশনে।
তিনদিন ঘুম ছিল না, কলকাতা দেখার আনন্দে, আর এখন দেখার পর আনন্দ। ঘুমের কী জায়গা লাগে।
আমরা ভিক্টোরিয়া চিড়িয়াখানা কিছুই দেখতে যাই নি।
শুধু মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল মাঠ দেখেছি পাশ দিয়ে হেঁটে আর দেখেছি শহিদ মিনার এবং দূর থেকে টাটা সেন্টার।
কে জানত ওই টাটার জন্যই একদিন পার্টিকে চলে যেতে হবে ৩৪ বছর পর।
কড়াই ঠিক ছিল।
ভুল রাঁধুনি আর ভুল মেনু।
ভুল রাঁধুনি আর খারাপ পাত্র হলে ভালো খাবার বিষাক্ত হয়ে যায় শেখাচ্ছে হাওড়ার ঘটনা।
এক মৌলবাদ আরেক মৌলবাদের সেবা করছে। বিরোধী সাজার ভান করে চরম বিপদ থেকে বাঁচাচ্ছে, নিজেদের ধর্মের মানুষকে ও দেশকে বিপদে ফেলে।