পর্ব ৫৬
হিজাব সমাচার
'হিজাব' শব্দটি প্রথম শুনি ১৯৯১-এ। বাংলাদেশে। সে-দেশের এক নেত্রী এক জনসভায় হিজাব পরেছেন, সে-নিয়ে খবর। হিজাব বলতে দেখি, মাথায় একটা কালো কাপড় বাঁধা। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেছি কিছু হিজাব পরা মুখ। এটা অনেকটা বোরখার ধরন। মুখ কেবল খোলা। একটি মেয়েকে হিজাব পরে অনবরত নেচে যেতে দেখে অবাক হই।
- হিজাব মানেই তো জানি, ধর্মীয় অন্ধতা।
- মেয়েটি বলে, তা কেন? আমার যতটুকু অংশ বেশি সুন্দর সে-টুকু দেখাচ্ছি।
- এতে কি বেশি সুন্দর লাগে?
- আমার তো লাগে।
যাই বলুক, একটা মেয়ে কেন হিজাব পরে আমি বুঝতে পারি না। কোরানে হিজাব বোরখা আছে বলে জানা নেই এবং আমি আমাদের গ্রামে কোনোদিন কাউকে হিজাব পরতে দেখিনি। ইদানীং কালে মরা বাড়িতে গায়ে চাদর জড়াতে দেখছি।
বোরখা একজন পরতেন। আমার বড়মাসি। স্বামী পীর। তবে নানার ভয়ে গ্রামে পরতেন না। ব্যাগে পুরে রাখতেন। বর্ধমান স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরার আগে পরে নিতেন। আমার মায়েরাও খেপাতেন। ওই পীর সাহেবের তিন স্ত্রী। কেউ কিন্তু বাড়িতে বোরখা পরতেন না।
মুসলিম হিন্দু আদিবাসী কোন সম্প্রদায়ের মহিলাকেই গ্রামে ব্লাউজ পরতে দেখিনি। বাইরে বা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে আলাদা ব্যাপার। ব্রা বা অন্তর্বাস ১৯৭০-এর পর বিয়েতে দেওয়া শুরু হয়। লোকে বলতো, বডিস। ব্রা নাম ছিল না। বডিস বিয়ের পর ক’দিন ব্যবহার হতো তারপর রান্নার হাঁড়ি মোছার ন্যাকরা।
পুরুষরা নিরানব্বই শতাংশ খালি গায়ে থাকতেন। গ্রামের মধ্যে। বাইরে গেলে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ধুতি পাঞ্জাবি বা চাইনিজ শার্ট। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ধরনের। ঘরে হিন্দু, মুসলমান, বামুন, কায়েত সবাই লুঙ্গি। ব্যতিক্রম ছিলেন দু-একজন। ধুতি সূতি কম মার্সলাইট বেশি। কারণ টিকবে বেশিদিন।
মেয়েরা পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত ছেলেদের মতই খালি গা। আট-দশে টেপ জামা। তেরো-চোদ্দ পর্যন্ত ফ্রক। সালোয়ার কামিজ আমাদের গ্রামে ১৯৮২ র আগে দেখা যায়নি। পনেরো হলেই ঘরেও শাড়ি। বাইরেও। ১৯৭৭ -র পর থেকেই পনেরো-ষোল বছরের মেয়ে ব্লাউজ পরতে লাগল। আগে চোদ্দ-পনেরো তে বিয়ে হয়ে যেত। আমার বড়দি মেজদির বিয়ে ১৯৭৪-র আগে, চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে। এর বেশি বয়স হলেই কথা উঠত। কুড়িতেই বুড়ি- কথা খুব চালু ছিল। আমার সেজদির বিয়ে হল বাইশ বছর বয়সে। ছোটো বোন এম.এ. পাস করে পঁচিশ বছর বয়সে। ভাইঝিরা এখন আঠাশ-ঊনত্রিশ-এ বিয়ে করছে এম.এসসি. পাস করে। ভাগ্নি আঠাশ ঊর্ধ্বে প্রকৌশলী হয়ে।
গ্রামে বাল্যবিবাহ কমেছে। সব মেয়েই সাইকেল চালাতে জানে। ১৯৯০ থেকে গ্রামে ম্যাক্সি ঢুকল। যার পোশাকি নাম নাইটি। হিন্দু মুসলমান সব মহিলাই বাইরে বের হলে ঘোমটা দিতেন। তবে পঞ্চাশ পেরলে নয়।
মুসলমান মেয়েরা কেবল আজানের সময় মাথায় কাপড় টানতেন। বাকি সময় মাথা খোলা। বেগানা পুরুষ ঘরে এলে স্বতন্ত্র কথা। জামাই-ভাশুর-শ্বশুর এলে ঘোমটা ছিল। তবে বেশিদিন নয়। আমার মাকে তো ঘোমটা ছাড়াই জামাইদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি পরে। তবে ইদানীং হিজাব বা বোরখা নয়, মরা বাড়িতে গায়ে চাদর জড়িয়ে আসা বাড়ছে। এটা এখন স্ট্যাটাসের চিহ্ন। আর্থিক কৌলীন্যের। কেউ না পরলে অন্যরা তাকাচ্ছে। এ জিনিস সত্তর আশি নব্বই এমনকি ২০১৫ তেও দেখিনি।
পর্ব ৫৭
গ্রামে মাত্রা হতো খুব। ব্রজেন্দ্রনাথ দে-র 'বাঙালি' পালা একাধিক বার হয়েছে ।
'বাঙালি' যাত্রাপালায় একটি সংলাপ: