পর্ব ৪৪
হাইকোর্ট প্রান্ত বলতে কী বোঝায় বুঝতাম না। কিন্তু মনে মনে ভাবতাম পশ্চিম দিক হবে বোধহয়। কারণ, আমাদের খেলার দুটো মাঠ ছিল, দুটোই পুব-পশ্চিমে লম্বা। তবে ১৯৭৬--৭৭ এ যখন টনি গ্রেগের সফরের সময় বেশ উন্মাদনা আমাদের গ্রামে নুরুল আমিন (মুকুল) আর তাপস চক্রবর্তীর উদ্যোগে পুরাদস্তুর ক্রিকেট খেলা শুরু হতে ক্রিকেট মাঠ হল উত্তর-দক্ষিণে। ক্লাব হাউস আর হাইকোর্ট প্রান্ত বোঝাতেই বোধহয়। ওদের দু’জনের বাবাই শিক্ষক। এবং দু’জনেই একমাত্র ছেলে। বাকিরা দিদি/বোন। ওদের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। তবে দু’জনেই খুব মিষ্টভাষী। মিশুকে। দেখতে সুন্দর। আবার এবং দু’জনে হরিহর আত্মা বন্ধু। দেমাকি নয়। ক্রিকেট ব্যাট এল বিডিএম লেখা। বিডিএম ব্যাটের দাম ৭৫ টাকা। চাঁদার কথা উঠল। যে যেমন পারল দিল, কিন্তু তাতে ওরা কিছুই বলল না। আমার বাবাও চিরকাল রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা। আমাদের সঙ্গে গেল জুটে। এতে আমার হল মুশকিল। আব্বা এমনিতে ভাল কিন্তু খেলাধুলায় যাত্রা নাটকে সিরিয়াস। চড় থাপ্পড় চালিয়ে দেয়। ক্যারম খেলায় একবার চড় খেয়েছি। আর বসিনি। বাবা এক দানেই নটা গুটি ফেলে দেন, আমার 'সিওর শট'ও এঁকে বেঁকে চলে। এক চাইনিজ চেকার আর দাবা এই দুটোতেই দারুণ, বাকি সব খেলায় চলনসই। ফুটবলের পোকা। কিন্তু আমার চেয়েও ভাল 'খেলি' গাঁয়ে কম নেই। তো সেবার টনি গ্রেগের খেলার ধারাবিবরণী চলছে। মুকুল তাপস আব্বা ইংরেজিতে শুনছে। আমরা ছাইপাঁশ তেমন কিছুই বুঝছি না। শুধু রান আর আউট ইত্যাদি ছাড়া। আমাদের গ্রামে কংগ্রেসের দুই নেতা ছিলেন। আদি এবং নব। তাঁরা দু’জনে দুটি খবরের কাগজ নিতেন। ৭৬-এ এক নেতা নিতেন যুগান্তর, অন্যজন আনন্দবাজার। ১৯৭৮ এর পর দু’জনের কাগজ বদলায়।
১৯৭৬-৭৭ টেস্ট সিরিজের কথা মনে আছে। 'যুগান্তর' কাগজ নিতেন আমার বড়মামা। মামা ভাত খেতে খেতে কাগজ পড়তেন। সে দেখে আমারও ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ঘন মুসুর ডাল, ডিমের নিংড়ি (পোচ), আলু ভর্তা গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেতে। 'যুগান্তর' ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলের খাবারের মেনু ছাপত। মেনু শব্দ তখন সত্যি বলতে কী শুনিনি। খাদ্য তালিকা শব্দটিই লেখা হত। বাংলা কাগজে তখনো এত ইঞ্জিরি আদিখ্যেতা বাড়েনি। সেইসময় স্যান্ডুইচ, সসেজ, স্টু, বিফ স্টেক, অমলেট ইত্যাদি প্রথম পড়ি। গ্র্যান্ড হোটেলে বোধহয় ছিলেন ক্রিকেটাররা। গোপন সংবাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে প্রতিবেদক লিখতেন। আমি ভাবতাম এগুলো কী না কী খাবার। অমলেট, স্টু ইত্যাদি আমরাও খাই ভিন্ন নামে। অমলেটের নাম ডিম ভাজি, স্টুর নাম মাংসের সুরুয়া। টাইফয়েড হলে পরে পথ্য হিসেবে দিত। পেঁপে মাংসের পাতলা ঝোলকে বলত, মাংসের সুরুয়া।
তো টনি গ্রেগ আর গাভাস্কার (তখনো গাওস্কর হননি) বিশ্বনাথরা যাই খান, আমরা শীতকালে খেতাম গরম ভাত, বাঁধাকপি/ফুলকপির তরকারি, মাঝে মাঝে মাংস দিয়ে বাঁধাকপি ফুলকপির তরকারিও হত, বেগুন ভর্তা, টমেটো পোড়া। পুকুরে মাছ ধরলে মাছ, চুনো মাছের ঝাল, এমনিতে ঝাল হত না, কিন্তু চুনো মাছ একটু ঝাল ঝাল হত। বর্ধমানের গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে আমাদের দক্ষিণ দামোদর এলাকায় টক বা চাটনি সবাই খেতেন। হিন্দু মুসলমান ধনী দরিদ্র সব্বাই। বিশেষ করে ধনে পাতার চাটনি অবশ্য অবশ্য। ধনে পাতা তো অঢেল। আলু গাছের দাঁড়ে হচ্ছে। শাক বাড়িতেও। অল্প নুন সামান্য চিনি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে এক সঙ্গে শিলে বেঁটে একটু লেবু দিয়ে ধনে পাতার চাটনি। এই চিনি দেওয়া নিয়ে খোঁটা দেবেন না। সবাই কিন্তু মাংসের ঝোলে চিনি দিই না।
এইসব খেয়ে আগরাপুরার মাঠে যাওয়া। আগে ওটা ছিল মুসলমান আর হিন্দুদের ছেলে পোঁতার জায়গা। ছোট ছেলে মেয়ে মারা গেলে পোড়ান নয়, পোঁতা হত। মুসলমানরা দিত কবর। পরে গ্রামে ছোট ছেলে মেয়েদের মৃত্যু কমে আসে। গ্রামে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারি শুরু হয়। কোয়াক ডাক্তার এম এ পাস। ইংরেজি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ.। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। শহরে বড় ডাক্তারদের কাছে রোগী নিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে থাকেন। সুফল ফলে। রোগী মৃত্যু কমে।
শিশু মৃত্যু কমে যাওয়ায় এবং সত্তর দশকে নব জাগ্রত চেতনায় হিন্দু মুসলমান সিপিএম কংগ্রেস মিলে ক্লাব গড়ে। তরুণরাই পাণ্ডা। পেছনে আছেন দু’জন। আমার বড়মামা গ্রামের নব কংগ্রেস নেতা এবং আমার সিপিএম নেতা বাবা। ১৯৭২-এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক হওয়া লোকজন ক্লাবে মুক্তি পায়। ক্লাব কিন্তু গ্রামে মুক্তির দিশারী ছিল। একটা নতুন আলো হাওয়া।
আমাদের গ্রাম অচিরেই ফুটবলে দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। রাম দত্ত গোলকি (গোলরক্ষক/গোলকিপার), ব্যাকে মনোভাই, আমার বাবা ও বড়ভাই, মিডফিল্ডার ফজলুল, স্ট্রাইকার মদন দত্ত, তপন সরকার, গ্রামের নতুন মাস্টার শম্ভুনাথ থান্দার। সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিজেরাই লড়ে পৌঁছে যেত। আর সেমিফাইনালে গিয়েই খোঁজ পড়ত হায়ারের। বাইরে থেকে ফুটবলার ভাড়া করে আনা হত। বিপক্ষও তাই করত। সেমিফাইনালে বর্ধমান শহর ও অন্য জায়গা 'হায়ারি' প্লেয়ার আসত। এদের মধ্যে জিন্নার খুব নাম ছিল। আর ছিল আরামবাগ কালীপুরের গির্জার নাম। ম্যাচ পিছু ৫০ টাকা নিতে ১৯৭৪-৭৫এ। জিন্না যেমন দেখতে তেমন তাঁর কোঁকড়ানো চুলের বাহার। গির্জা ছিল শৌখিন খেলি। পাস দেওয়ার ও নেওয়ার কায়দা ছিল অসাধারণ। আর গির্জাকে সবাই বলত জুম্মা খান। চীনের প্রাচীর। গির্জার খেলা থাকলে কোনো মাঠেই জায়গা পাওয়া কঠিন ছিল, মানুষ আর মানুষ। বাপ ব্যাটা সবাই ছুটত গির্জার দলের খেলা দেখতে। জিন্নাও দর্শক টানত। কিন্তু আমাদের গ্রাম প্রতিবার সেমিফাইনালে বিদায় নিত। আর পরে গ্রামে কদিন শোকের ছায়া। এর আগে তো হিপ হিপ হুররে, থ্রি চিয়ার্স ফর আউশাড়া ব্রাদার্স ক্লাব বলে ফাটিয়ে দিয়েছি সবাই- এরপর সবার মুখ চুন। আর আফসোস, হোম টিম হলেই ভাল খেলত। হায়ারি রা পা বাঁচিয়ে খেলে, মান বাঁচাতে নয়।
এরপর একবার নিজেরাই খেলে ফাইনালে দিতে গেল আমাদের গ্রাম। কদিন কেউ আনন্দে আর ছেলে বউ পেটাল না।
পর্ব ৪৫
আশ্বিন কার্তিক মাসে খুব অভাব। বহু ঘরে ঝগড়া ঝাঁটি বউ পেটানি। সালিশি বিচার। ওই যে বললাম, ফুটবলে গ্রাম জিতলে সব উধাও। লোকে বলত, আউশাড়ার ম্যাচ থাকলে দিনে ডাকাতি হতে পারে গাঁয়ে। পাঁচ থেকে ষাট সব পুরুষ হাজির হয়ে যেত আশপাশের এলাকায় ক্লাবের ম্যাচ থাকলে। তখন তো এত ভাল রাস্তা নয়। কাঁচা মাটির রাস্তা অবশ্য ছিল। সে পথে যেতে গেলে একঘন্টার বেশি লাগবে। ঘুরে ঘুরে যাওয়া। তাই লোকে হুমটো মেরে দিত। ধানের জমির আল দিয়ে সাপ খোপের তোয়াক্কা না করে। যাওয়ার সময় তো দিন। তিনটা থেকে খেলা শুরু হত। দুপুর থেকেই তোড়জোড়। গ্রামের মানুষ পাঁচ বেলা খেত। খেত, মানে, যাদের জুটত। সকালে চা মুড়ি, বেলা ১০টায় পানি খাবার/জলখাবার ভাত আলু সেদ্ধ/ভর্তা, গরমকালে ভাতে জল বা পানি শীতকালে গরম ভাত আলু সেদ্ধ/শুঁটকি ছানা। শুঁটকি ছানা মানে মাখা। আমরা আলু ভর্তা বলতাম, কম, বেশি বলতাম আলু ছানা, বেগুন ছানা, টমেটো ছানা, মুসুর ডাল ছানা। দুপুরে যার যেমন সাধ্য। বিকেলে মুড়ি। পেঁয়াজ বা চিনি বা ঘি বা চানাচুর বা শুধুই। রাতে ভাত সাধ্য অনুযায়ী। ফুটবল খেলার দিন বিকেলে খাওয়ার কথা লোকে ভুলে যেত। তখন খেলার মাঠে দোকানও বসত না। ১৯৮০ র পর বারোভাজার দোকান দেখেছি। আর ঘুগনির। ১৯৮৩-৮৪ থেকে ফুটবলটাই উঠে যেতে লাগল। মাঠগুলোয় মারামারি শুরু হল। কেন? সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচনা জরুরি।
ফুটবল খেলার শেষে ফেরা। অন্ধকারে। ধান জমির আল দিয়ে। দু-একজন শয়তান থাকত, দু'পাশের জমির ধান বেঁধে দিত। পরের লোকে ছিটকে পড়ত। আর দু-একজন চেঁচাত, হাতি নেমেছে, হাতি নেমেছে। হাতি মানে মেঘের দৃশ্য। মেঘে হাতি নামা মানে প্রবল বৃষ্টি। হত-ও তেড়ে। বৃষ্টিতে ভিজে একশা হয়ে ফেরা। জিতলে চিন্তা ছিল না, হিপ হিপ হুররে-র আওয়াজে গা গরম মন চাঙ্গা। হারলে, কাঁপুনি পেত। আশ্বিন কার্তিকের হালকা ঠান্ডা লাগত। কিন্তু জ্বর আসত না। এলেও কেউ পাত্তা দিত না। গোটা শীতকাল জুড়েই তো ছোটদের কারো না কারো নাকে শিকনি।
সর্দি ঘর্ঘর আওয়াজ তো ঘরে ঘরে। একজন মানুষ ছিলেন তাঁকে লোকে জ্যোতি বসু বলে ডাকত। ধুতি পরতেন। চোখে চশমা। খেলা দেখা রাজনীতি সবেতেই দারুণ উৎসাহ। খেলা দেখতে যাবেনই। ষাটের ওপর বয়স। তত ছুটতে পারেন না।
লোকে এড়াতে চাইত। তিনি বলতেন, আমাকে না নিয়ে গেলে হারবি রে ব্যাটারা। আমার মত গলার আওয়াজ আছে তোদের?
পুনশ্চ: আজ একটু দেরিতে মৌরলা মাছ এল। লিখতে লিখতে নোলা সকসকিয়ে উঠল। তাই মৌরলার আগমন। এত বেলায় কে করণকস্যি করে। নিজেকেই বাছতে হল। বাছতে গিয়ে মনে আমাদের মা ঠাকুমা দিদি বোনেরা এতদিন আমাদের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখবেন বলে কী পরিশ্রমই না করেছেন। আধ ঝুড়ি চুনো মাছ জুটত নিজেদের পুকুরে মাছ ধরলে। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীদের দিয়েও তো কম থাকত না। পাতি খানেক তো হবেই। সেগুলো বেছে বুছে তোলা কম ঝক্কি। শীতকাল আর রোমান্টিক থাকল না ততটা, চুনোমাছের ঝাল, ধনেপাতার চাটনি, মাছের টক, বাগার দেওয়া ডাল, মাছের ঝাল, ঝোল, টক ইত্যাদি বানাতে কী খাটানই না খাটতে হয়েছে, তাঁদের।
গৃহস্থ শ্রমের মূল্যমান নির্ধারিত হবে কবে?
পুনশ্চ: আমাদের পয়লা জানুয়ারি ছিল না। ছিল নবান্ন পৌষ সংক্রান্তি মকর সংক্রান্তি পিঠে ঘুড়ি ওড়ানো মাসি পিসির বাড়ি বেড়ানো। যাত্রা দেখা। সে গল্প পরের সপ্তাহে।