কথায় কথায় শুনি পিছনের দিকে যেতে দেবো না। মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা। ওইসব ইউরোপিয় চশমা পরে ইউরোপের মধ্যযুগের মারামারি হানাহানি পশ্চাদপদতাকে আমাদের ওপর জোর করে আরোপ করা বা চাপিয়ে দেওয়া।
আমাদের গ্রামের আগের ইতিহাস বাড়ি বিন্যাস মেলামেশা খাওয়া-দাওয়া কথাবার্তা প্রবাদ প্রবচন ব্যবহার ধর্মীয় আচার আচরণ দেখে আমি বুঝেছি, একুশ শতকের আগে মানুষের বেঁচে থাকাই ছিল ধর্ম। ধর্মের নামে যাবতীয় অসভ্যতা গত তিন দশকের ফল। কে কী খাবে কী পরবে লোকে তেমন মাথা ঘামাত না। কাউকে একঘরে করতে ছোটবেলায় শুনিনি। কারো হেঁসেলে ঢুঁ মারতে দেখিনি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'লালসালু' পড়লেও বোঝা যায়, মানুষের আসল ধর্ম বেঁচে থাকা। ধর্মব্যবসায়ীরা তাকে বদলে ধর্মান্ধ করে তুলতে চায় ধান্দায়।
গ্রামে ধর্ম ছিল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না।
১৯৭০ এ গ্রামে কোনো মসজিদ ছিল না।
২০২০র আগে গ্রামে আলাদা করে কোনো স্থায়ী দুর্গামন্দির ছিল না।
গ্রামে একটা ছোট্ট শিবমন্দির ছিল। গাজন বা চড়কে হিন্দু মুসলমান সবাই অংশ নিত। বারোয়ারি পুজো একটা ছিল। দুর্গা নয় ওলাইচণ্ডী পূজা। তাকে ঘিরে মেলা যাত্রা হতো। হিন্দু মুসলমানের মিলিত উৎসব।
তালবড়া, তালের ফুলুরি জেলার খাওয়া হতো তার সঙ্গে কৃষ্ণের কোনো সম্পর্ক আছে কলকাতা না এলে জানতে পারতাম না। গরিব মানুষ তো ভাদর আশ্বিন মাসে তাল খেয়েই বেঁচে থাকতেন। তাল আর শাকপাতা। ভাত, আলু ডাল তো দূরের কথা জুটতো কতজনের? সামান্য জাও বা ফ্যানভাত জুটলেই তাকে উৎসব বলে মনে হতো অনেকের। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানোয় খাওয়ার কষ্ট পাইনি। কিন্তু অনেকের তো দেখেছি।
গ্রামে কেবল নয় , চারপাশেই আবহাওয়া ছিল এমন -- খাওয়া খাওয়া, তার আবার ধর্ম কী?
মুসলমানদের কেউ কেউ শুয়োর খেতেন, কেউ তার জন্য তাকে পতিত করেনি। আমার ঠাকুরদাই তো জমিয়ে খেতেন মদ মাংস। ঠাকুমা বলতেন, হারাম খেয়ে মরেছে। শুয়োরের মাংস তালের তাড়ির চাট হিসেবে ভালোই জমতো। কিন্তু সে-নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস বা বিরক্তি -- কোনোটাই দেখিনি। খায় খায়। গোরুর মাংস খাওয়ার জন্য এক ব্রাহ্মণ সন্তান সমেত কয়েকজন বিখ্যাত ছিলেন। কেউ বারণ করেননি। সে-নিয়ে আগে লিখেছি।
মুচি ও সাঁওতালরা মরা গোরু খেতেন। কাঁচা কিনে খাওয়ার পয়সা তখন কোথায়? যদিও একটাকা করে কেজি ছিল । আর খাসির মাংস ১০ টাকা কেজি। তখন ওজনে নয় ভাগা হিসেবে বিক্রি হতো।
মাংসের ভাগা। মুসলমানদের মাসে বড়জোর একবার গোরু হতো। তাও ভাদ্র আশ্বিন মাসে পরব না থাকলে হতো কী না সন্দেহ।
হিন্দুদের কেবল বছরে একবার খাসির মাংস। নবমীর দিন। সেও ওজনে নয় ভাগা হিসেবে।
এই যে সবাই ডোল ডোল খয়রাতি বলে চেল্লামেল্লি করছেন, ডোল বা খয়রাতি না থাকলে মুরগির মাংস খেতে পেতেন?
ভাবছেন, ধান ভানতে শিবের গীত?
একদম তাই। শিবের গীত সবসময় জরুরি।
বামফ্রন্ট সরকার আসার পর বেকার যুবকদের ৫০ টাকা পরে ৬০ টাকা বেকার ভাতা দিত। যেটা একজন খেতমজুরের কার্যত দু মাসের বেতন। মাসে মাসে পেতেন না। বছরে এক থোকে মিলত। একসঙ্গে ৬০০ টাকা অনেক টাকা।
মনে রাখবেন গাঁয়ে তখন চালের কেজি ৫০ পয়সা। মুরগির ডিম ৮ পয়সা। খেতমজুরদের ২ টাকা চেয়ে দিনে একটাকা বেতন পেতে ভুখা পেটে ২ মাস ধর্মঘট করতে হয়েছিল।
বেকারদের শুধু মাসে ৫০ টাকা নয়, এককালীন ৫০ হাজার টাকা দেয়। এর মধ্যে হাতে পায় ৩৫ হাজার টাকা। বাকি ১৫ হাজার টাকা ঋণের সুদ হিসেবে বা অন্য কারণে কেটে রাখা হতো।
আমাদের গ্রামের তিনজন এই ঋণ পান। তিনজনই কংগ্রেসি।
সেই টাকায় তাঁরা পোল্ট্রি করেন। ব্রয়লার মুরগি পোল্ট্রি মুরগি কথাটা সেই শোনা গেল।
গ্রামে মফস্বলে এক ঘটনা ঘটে।
মনে রাখবেন ১৯৭৭ -৭৮ এ মুরগির মাংসের দাম খাসির মাংসের দ্বিগুণ ছিল।
মুরগি ২০ টাকা। খাসি অর্ধেক ১০ টাকা। আর পাঁঠা ৮ টাকা কিলো।
যারা ডোলের বিরুদ্ধে তারা সত্তর দশকে এইসব বললে লোকে কিলোত তাদের।
বারটা ভুল হতে পারে, বৃহস্পতিবার, তারিখটা মনে আছে। এমনিতে আমার দিনক্ষণ তারিখ ভালোই মনে থাকে। খালি কাউকে লেখা দেওয়ার কথা থাকলে বা বিয়ের নিমন্ত্রণ থাকলে ভুলে যাই। আর একটা জিনিস ভুলে যাই, কারো সঙ্গে ঝগড়া হলে মনে থাকে না। কথা বলে ফেলি।
বলেই মনে পড়ে, এই রে কথা বলবো না ঠিক করেছিলাম যে।
তা সেদিন স্কুল ছুটি।
কাজ নেই। হাতে কোনো গল্পের বইও নেই।
তালপুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরছি।
আমি খুব একটা ভালো মাছুড়ে বা ছিপুড়ে নই।
আমাদের ভাগের পুকুর।
মাছ ধরার যম এক সহপাঠীও সুবিধা নিচ্ছে।
হঠাৎ দেখি ছিপের ফৎনা ডুবে যাচ্ছে। ছিপে টান পড়ছে। মানে ভালো মাছ।
এক ঝটকায় তুলি।
একটা বড় মৃগেল ( আসলে বলতাম, মিরগেল) মাছ। মৃগেল মাছ আমার সে-কারণেই বোধহয় খুব পছন্দের। খুব মিষ্টি। দেখতেও খুব স্মার্ট।
আমার জীবনে সেটাই সবচেয়ে বড় মাছ ধরা।
মাছ বড়শির কাঁটা থেকে ছাড়ানো যাচ্ছে না।
ছাড়াতে গিয়ে বন্ধুর হাতে কাঁটা গেঁথে একসা।
রক্তারক্তি কাণ্ড।
বন্ধুর তাতে ভ্রূক্ষেপ নাই।
বলল, চল, আজ তোদের ঘরে খাব।
চল।
না দাঁড়া, আজ মনে হচ্ছে মাছ ভালোই হবে। তোর হাতে বড় মাছ উঠেছে। এতো হয় না। বসে যাই।
বসলাম ।
এমন সময় খবর এল নজরুল ইসলাম ঢাকায় মারা গেছেন।
মন খারাপ হয়ে গেল।
বন্ধুর ভালো নাম ছিল নজরুলের নামে। সেও ছিপ গুটিয়ে ফেলল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রেডিও র খবর সবাই জেনে গেছে।
সবার মনে সত্যকার শোক।
যেন নিজেদের আপনার জন মারা গেছে।
দিনটি ছিল ২৯ আগস্ট ১৯৭৬।
তখন নজরুলের গান না শিখলে তাঁকে গায়ক মনে করা হতো না।
নজরুলের মতো জনপ্রিয় তখন গ্রামাঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল না।
বাউল আধুনিক আর নজরুল সঙ্গীত। রবীন্দ্র সঙ্গীত খালি বাজতো সকালে রেডিওতে। তারপরই নজরুল সঙ্গীত।
পঙ্কজকুমার মল্লিক তখন রেডিওতে বোধহয় গান শেখাতেন। দিদিমণির ঘরে বাজতো। বাইরে দাঁড়িয়ে শুনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত হলাম।
তার চেয়েও বেশি হলাম সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা পড়ে।
আমরা তো তখন সুকান্ত ভট্টাচার্য হওয়ার স্বপ্ন দেখি।
আর এখন নজরুলের গান তো শোনাই যায় না। রেডিও/ এফ এম/ দূরদর্শন/ বেসরকারি চ্যানেল/ মাইক/ অনুষ্ঠান-- নজরুল প্রায় উধাও।
(ক্রমশঃ)