পর্ব ৫৮
সহজে পেলে সহজে হারায়।
কত সস্তায় আসতো 'সোভিয়েত দেশ' 'সোভিয়েত নারী' পত্রিকা। মাত্র ১০ পয়সা করে দাম ছিল। ওজন দরে বেচলে এর চেয়ে বেশি পাওয়া যেতো। আর বিক্রি হতো ১০ পয়সা করে দুটি পাতা। মলাট দেওয়ার জন্য কিনতো। একবার 'সোভিয়েত দেশ' বা 'সোভিয়েত নারী ' দিয়ে মলাট দিলে সে-বই ছেঁড়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কী সব অমূল্য লেখা থাকতো এই সব পত্রিকায়। 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকা যতদূর মনে পড়ে সাপ্তাহিক ছিল। প্রতি শনিবার ডাকে আসতো। আমার বড়মামা রাখতেন পত্রিকা দুটো। বড় মামা কংগ্রেস। 'হিন্দি রুশি ভাই ভাই' তত্ত্বে বিশ্বাসী। আমার বাবা সিপিএম। তাই ইন্দিরা গান্ধী আর ব্রেজনেভের ভাব ছিল না-পসন্দ। রুশ চিরায়ত সাহিত্য আসতো। কিন্তু কংগ্রেসের জুটি বলে 'সোভিয়েত দেশ' ও 'সোভিয়েত নারী' -- নয়।
আমার মামার বাড়ি গ্রামে। মামাতো ভাই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। শনিবার স্কুল টিফিনের পর ছুটি হলেই ঘরে বই খাতা রেখে ছুট। মামার বাড়ি গিয়ে অনেক সময় আমিই প্রথম খুলতাম বইটা। মাঝখানে পিন আঁটা। চওড়া পত্রিকা। খুব দামি পাতা। আজকের দামি জাপানি আর্ট পেপারও তার সমতূল্য নয়। রঙিন ছবি তখন দেখা যেতো না। সত্তর দশকের শুরুতে। 'নব কল্লোল' 'প্রসাদ' সেপিয়া টোনে এক রঙে ছবি ছাপতো। 'শুকতারা'র প্রচ্ছদ বাঁটুল দি গ্রেট ও দ্বিতীয় পাতা পার্লে পপিন্সের সৌজন্যে রঙিন। কিন্তু সোভিয়েত দেশ বা সোভিয়েত নারীর তুলনায় কেউ ধারে কাছে আসে না। আমরা গন্ধ শুঁকতাম রঙের। কী সুন্দর গন্ধ। মাঝখানের পাতার ছবি দুটো পাতা জুড়ে। 'ডেবোনেয়ার' পরে ওটাকে নকল করে। সমাজতান্ত্রিক দেশের পত্রিকাকে নকল করছে ভোগবাদি সমাজের প্রতিনিধি। 'ডেবোনেয়ার' নগ্ন নারীর ছবি। সৌন্দর্যমণ্ডিত যৌনতা। এ-সব দেখেছি ১৯৮৫-র পর। কিন্তু সোভিয়েত পত্র পত্রিকায় যৌনতার লেশমাত্র নেই।
সুন্দর ছবি জনজাতির মহিলাদের। খুশি সৌন্দর্য আর পোশাকে রঙিন ঐশ্বর্য মন ভরিয়ে দিত। ইউক্রেনের নাম প্রথম পড়ি 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকায়। তখনো তো জানি না, আমার প্রিয় লেখক নিকোলাই গোগল ইউক্রেনের ভূমিপুত্র। ১৯ বছর পর্যন্ত ইউক্রেনে পরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। ইউক্রেনিয় ভাষায় নয়, রুশ ভাষায় লিখে তাঁর খ্যাতি। 'তারাস বুলবা'য় ভাস্করের মতো কুঁদে কুঁদে নির্মাণ করবেন, কসাক জাতির বৈশিষ্ট্য। গম যে এতো সুন্দর তা দেখতে শেখায় 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকা। ভোগবাদি পত্রিকা ছাপতো দুপাতা জুড়ে নারীর নগ্ন ভঙ্গিমা। আর 'সোভিয়েত দেশ' সোনালী গমের খেতের পাশে সোনালী চুলের মেয়েরা রঙিন বাহারি পোশাক পরে ফসল তুলছে। 'সোভিয়েত নারী' পত্রিকা মহিলাদের স্বনির্ভর হতে শেখাতো। সেলাই, উলের সোয়েটার বোনা, ক্রুশের ব্যবহার, এমব্রয়ডারি শেখানো হতো। শেখাতো পুতুল তৈরি, খেলনা তৈরি। শুধু খাওয়া দাওয়া রান্না আর সাজগোজ বেড়ানোর দীক্ষা নয় স্বাবলম্বী হতে শেখাতো।
পর্ব ৫৯
কী অন্যায়টাই না আমরা করেছি, এই সব পত্রিকা মলাট দিয়ে, ওজন দরে বেচে ঠোঙা বানানোর সামগ্রী করে। অনেকে উনুন ধরাতে কাজে লাগাতেন। আর বইয়ের মলাট দেওয়ার কথা তো আগেই বলেছি। আজ এই সব পত্রিকা খুঁজেই পাওয়া দুষ্কর। বছর পাঁচেক আগে প্রসেনজিৎ, সোমনাথ প্রমুখ যোগাযোগ করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্রিকা, বই সংরক্ষণের কাজ করতে চেয়ে। অধ্যাপক তরুণ সান্যালের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিই তাঁদের। তাঁরা একটা চমৎকার সংগ্রহ করেছেন প্রচুর পরিশ্রম করে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব খানিকটা মেলে ধরেন এইসব 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো' যুবক যুবতীর দল। সোভিয়েতের মর্মবাণী এঁদের অন্তরে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্রিকা বই খুব কম পয়সায় পাওয়া যেতো বলে কৃষক পরিবারের সন্তান হয়ে বিশ্বসাহিত্যের একটা বড় অংশের সঙ্গে আমাদের মতো অনেকের পরিচয় ঘটেছে। মার্কসিয় সাহিত্যের দাম শুরু হতো ১৫ পয়সা থেকে। সবচেয়ে বেশি দাম ১৫ টাকা। লেনিন রচনাবলী তিন খণ্ডে ১৫ টাকা। পুঁজি ১৫ টাকা দুখণ্ড। চেখভ, পুশকিন, তুর্গেনেভ, তলস্তয়, গোগোল, মায়াকোভস্কি, গোর্কি, সদরুদ্দিন আইনি, এস জলিল, লুনাচারস্কি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান শিক্ষা সমাজ ও রাজনীতির বহু বই পড়েছি জলের দামে কিনে। বিয়ে শাদি জন্মদিনে এই সব বই উপহার দিয়েছি। জীবনে প্রথম উপহার পেয়েছি সোভিয়েত বই।
পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার আর্কাদি গাইদারের ইশকুল। এখন ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সির অনিরুদ্ধদারা এগুলো আবার ছাপছেন। বইমেলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বই পাওয়া যেতো মনীষা, ভস্তক আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। বর্ধমান শহরে কার্জন গেটের কাছে যুগসাহিত্য ভবনে এইসব বই কিনেছি। কিস্তিতে কিস্তিতে দাম দিয়েছি। সস্তার বই তবু মধ্যবিত্ত কৃষক সন্তানের হাতে তো এক টাকা দুই টাকা চাইতেও বাড়িতে লজ্জা হতো। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম এক টাকা করে হাত খরচ মেলে। এর মধ্যে ৩৫ পয়সা ৩৫ পয়সা ৭০ পয়সা বাস ভাড়া। আসলে বাস ভাড়া ছিল এক টাকা। ছাত্র বলে কনসেশন এক তৃতীয়াংশ। এই ৩০ পয়সা বাঁচিয়ে লোভনীয় ফুচকা, কারেন্ট নুন, কুল আচার, সিঙ্গারা বাদ দিয়ে খবরের কাগজ বা পত্রিকা বা বই কিনতাম। তখন 'পশ্চিমবঙ্গ' পত্রিকার দাম ছিল ৫ পয়সা। হ্যাঁ পাঁচ পয়সা। 'যুবমানস' পত্রিকা ৪৮ পাতা রয়াল সাইজ ২৫ পয়সা। পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা অসাধারণ সব বিশেষ সংখ্যা করতো। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংখ্যা। নজরুল সংখ্যা? মনে পড়ছে না। বিশেষ সংখ্যা ভালো কাগজে ছাপা হতো। দাম মাত্র আট আনা। এগুলো এখনো আমার সঙ্গে আছে। উই বা আগুন গিলে খেতে পারেনি। আমার মতো বহু ছেলেমেয়েই রাশিয়ান ভাষায় নাম লিখতে শিখেছিলাম, 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকায় রুশ ভাষা শিক্ষার ক্লাস পড়ে।
আমি তো যাই পড়ি তাই হতে চাই। পঞ্চম শ্রেণিতে ইশকুল পড়ে রুশ বিপ্লবী হওয়ার আগেই গ্রুপ থিয়েটার অভিনয় গণনাট্য পত্রিকা পড়ে ফেলতে শিখেছি। বুঝে বা না বুঝে। দুজন খুব দাগ কাটেন। একজন চে গুয়েভারা আরেকজন নেপোলিয়ন। চে হতে চেয়েছি। কিন্তু তাঁর নেপোলিয়নের মতো ঘোড়া চাই। এখনো তো একটা ঘোড়া কেনার স্বপ্ন দেখি।
স্বপ্ন তো মরে না।
স্বপ্ন ন হন্যতে।