সেদিন জাহ্নবীবাবুর ক্লাস নাই। অঙ্ক করাতেন। শোনা গেল রাঘববাবু পরপর দুটি ক্লাস নেবেন। অঙ্ক এবং জীবন বিজ্ঞানের। রাঘববাবুর মুখে প্রথম পঞ্চভুজ শুনে আমার মনে হয়েছিল, এই স্যার কি ইয়ার্কি করছেন? রাঘববাবু ছিলেন নিবিষ্ট শিক্ষক। একমনে অঙ্ক করাতেন। আমাকে কী পছন্দ ছিল তাঁর। সবেতেই বলতেন, তুমি বলো।
আমি ভয় পেতাম, অঙ্ক ছাড়া আর সব বিষয়ে ঠিক আছে।
অঙ্ক?
ওরে বাবা।
আসলে অঙ্কে কাঁচা ছিলাম এতো। পাটিগণিতে পুরো নম্বর। ৩৫ নম্বরই পেতাম। আর নম্বর নাই। বীজ গণিতে উত্তর মিলছে। মাঝে মাইনাস দিতে ভুল করেছি। ফলে শূন্য। নবম শ্রেণিতে অনেক শিখতে হলো।।
যাক, আজম বললো, এই শোন না, আজ ডুব মারি, জাহ্নবীবাবু এইগুলো আবার করাবেন, সিনেমা যাবি?
সিনেমা?
স্কুল পালিয়ে?
পালাবো কেন? একজন বললো, তুই হেড স্যারকে গিয়ে বলবি একটু জরুরি কাজ আছে। যেতে হবে। তুই বললে হেড মাস্টারমশাই না করবেন না।
সে-জন্যই তো মিথ্যা বলা আরো মুশকিল।
কাজ?
আরে, ভালো সিনেমা দেখাও তো কাজ নাকি?
তা ঠিক তা ঠিক।
অশ্বত্থামা হত ইতি গজ মার্কা ব্যাপার হলো কাজটা। তখন আজম আর কালাম ঘোর দোস্তি।
ওঁরাই পরিকল্পক।
বাকিরা?
রাঘববাবুকে ম্যানেজ করে রেখেছে। বলেছে, পেট ব্যথা।
সবার একসঙ্গে?
ওরে রাঘববাবু এতো প্যাঁচ পোঁচ বোঝেন না। সরল মানুষ। রাজি হয়ে গেছেন।
ক্লাস টেনের আজ খেলার পিরিয়ড। না করলেও চলবে। ওরা তিনজন। নবম শ্রেণির চারজন।
তা সাতজন চললাম সিনেমা দেখতে।
২৫ পয়সা বাস ভাড়া।
সেহারাতে টিনের সিনেমা ঘর বন্ধ। থাকলেও যাওয়া যেতো না। হেড মাস্টারের কাছে খবর চলে যাবে।
তো ১৭ কিমি দূরের এক ঘন্টা বাসে করে বর্ধমান।
১ টাকা বাস ভাড়া। আমরা স্টুডেন্ট তাই ২৫ পয়সা।
তখন হিন্দি সিনেমা দেখার ঘোর বিরোধী।
'বাঞ্ছারামের বাগান' চলছিল রূপমহলে। সব টিকিট একটাকা। করছাড়।
ফলে পয়সার সমস্যা নাই।
একটাকা সবার আছে।
কার্জন গেটে নেমে গিয়ে দেখা গেল, সেদিন শুক্রবার, সিনেমা বদলে গেছে, একটা হিন্দি সিনেমা।
হিন্দি সিনেমা তো আমি দেখবো না। আমি না দেখলে বাকিরাও কী করে দেখে!
ছোট ছোট বিচিত্রা।
গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ৭৫ পয়সার তৃতীয় শ্রেণি শেষ। দ্বিতীয় শ্রেণি সবার আগে শেষ হতো। তারপর তৃতীয় শ্রেণি।
বাকি আছে শুধু ব্যালকনি।
ব্যালকনির টিকিট অনেক দাম ।
তিন টাকা ৭৫ পয়সা। আটজন আছি। ২৩ টাকা ৭৫ পয়সা। আমরা দেড়টাকা করে দিলাম। কী হবে বাকিটা?
কালাম, গোলাম রসুল আর মন্টু বললো, আমরা দিয়ে দিচ্ছি। পরে শোধ দিলেই হবে।
না হয় আরেকদিন দেখিয়ে দিবি। কালাম বললো।
তো ঢুকলাম দেখতে।
দেখলাম 'দাদার কীর্তি'।
মহুয়া রায়চৌধুরীকে আগেই ভালো লাগতো, এবারে একেবারে ফিদা হয়ে গেলাম।
কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম তাপসের জন্য।
তরুণ মজুমদার ভালো লাগার ছিলেন। আরো হলেন। তবে সত্যি বলতে কী, পরিচালক নয়, নায়ক নায়িকার নামেই ছবি চলতো সাধারণ্যে।
সিনেমা দেখে প্রেম বিরোধী আমি আমার মনেও প্রেমের কুসুম জাগলো।
মনের কথা মনেই রাখার সময় সেটা।
এক ব্ল্যাক ডায়মন্ড চোখ মেলল।
মনে।
আশ্চর্য সমাপতন, মহুয়া রায়চৌধুরী আর কালামের চলে যাওয়ার দিন এক। ২৫ জুলাই।
রাঘববাবু নেই। অতি সজ্জন নির্বিরোধী মানুষ। নিজেই নিজেকে শেষ করে দেন।
কেন? কে জানে? বায়োলজির বাঘ ছিলেন স্যার। একই সঙ্গে অঙ্কে তুখোড়।
বয়স বাড়ে, বেদনাও।