জ্যোতিবাবু শেষদিন পর্যন্ত নিজের অফিস ঘরে কম্পু ঢুকতে দেননি এটা শুনেছিলাম। ঘরের খবর জানিনা। বাড়িতে নিশ্চয় ছিল ছেলের, অনুমান করি। 
আমরা সেভেনে থাকতে,  মানে ১৯৯১-৯২ স্কুলে বিবিসি কম্পু ঢুকল। সাদা কালো ফ্লপি ঢুকিয়ে বুট করতে হয়, ডস এ চলে। বেসিক, ডিবেস শেখা যায়। অন্য স্কুলে কম্পু কনটেস্ট হল, ফেস্ট মতো। পার্টিসিপেট করেছিলাম স্কুলের দল হিসেবে। কুইজ, প্রোগ্রামিং তাৎক্ষণিক বক্তৃতা ডিবেট ইত্যাদি৷ বেসিক দিয়ে প্রোগ্রামিং করে গান টান বাজানো হয়েছিল সাউন্ডে, ম্যাপ নকশা ডিসপ্লে হচ্ছিল প্রোগ্রাম করে। আমরা জিতে ফিরলাম। কী ফুর্তি!  সেনা দা শেখাত এইসব, হঠাৎ দু বছরের জন্য জয়েন করেছিল স্কুলে। নিশ্চয় ডিগ্রি নিয়ে এসেছিল। তারপর ছেড়ে দিল স্কুল। ভাল চাকরি পেয়ে চলে গেল কোথাও। স্কুলে কম্পু শেখানো বন্ধ হল। মা ও ওই সময় অন্য পাড়ায় একটা কম্পু সেন্টারে গিয়ে ডিবেস শিখত। গানও শিখতে যেত পাশেই। ইলেভেনে বোধয় আবার কিছুদিন ওগুলোতে বসা হল। বোধয় বিবিসি পালটে আইবিএম এল। নাকি গোলাচ্ছি?  সি তে প্রোগ্রাম করতাম সেটা কোন ক্লাস? ১১/১২? বন্ধুরা লেট আস সি নামের বই কিনেছিল। কানিতকার? সেই বিখ্যাত নাইন কুইন প্রবলেম। বোর্ডে গুটি বসিয়েও সাজাতে পারিনি তখন। প্রোগ্রাম লিখে কী করে পারব? অভিযান সলভ করেছিল প্রথম। অভিযান পরে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন করল এপিসি থেকে সায়েন্স কলেজ।  শুনেছি স্কুলের কম্পুগুলো দীর্ঘদিন পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে গেছিল।
 
এসব মনে হচ্ছে ৯১ তে সোভিয়েত ভাঙা আর মনোমোহিনী গ্লোবালাইজেশনের ফলে হয়েছিল। সিপিএম এর কম্পু বিরোধিতার মূল এপিসোডটা তার আগের। পোস্ট গ্লোবালাইজেশন ওই লাইন এর বিরোধিতার মাজা ভেঙে যায়। যদিও ১৯৯৭ থেকে ২০০০ তিন বছর কেমিস্ট্রি অনার্সে কম্পু বলে কিছু জানিনা। মিশনে ছিলও না বোধয়।
 
কেম ইঞ্জ বিটেকে সায়েন্স কলেজে ঢুকে দেখি সিডি/ ডিভিডি তে বুট হওয়া উইন্ডো। রঙিন। একটা না দুটো কম্পুতে বোধয় হার্ডডিস্কে ও ইন্সটল করা ছিল। সিডি লাগত না। মাউস প্রথমবার। ২০০০, বন্ধুদের দু একজন সেসব আগে ব্যবহারও করেছে।  ঘাবড়ে গিয়ে যুব কম্পু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হলাম ওয়ার্ড এক্সেল পাওয়ারপয়েন্ট ফক্সপ্রো বেসিক ইত্যাদি শিখতে। CITA DITA ছমাস ছমাস করে এক বছরের কোর্স। সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট পাথ। দ্বিতীয়টায় ভিজুয়াল সি প্লাস প্লাস, ভিজুয়াল বেসিক ভিজুয়াল ফক্সপ্রো এসব ছিল। এসব করে কলেজে ফরট্রান করতে সুবিধে হল যত না তার থেকে বেশি ওয়ার্ড এক্সেল দিয়ে প্রজেক্ট প্লান্ট ট্রেনিং ইকুইপমেন্ট ডিজাইন ফিজিবিলিটি সব রিপোর্ট বানানো হল কলেজের কম্পুতে বসেই।
তারপর তো বাকি জীবন কম্পুতেই কাজকর্ম রুটিরুজি। কোর-এই চাকরি পেলাম। আঙ্কলেশ্বর। প্রথম মাইনে মাসে ন হাজার। সঙ্গীতা বোধয় পাঁচ হাজারেই ব্যাঙ্গালোর চলে গেল একা। আমরা বিশাল অবাক হয়েছিলাম। শ্যামা মানে সৌমিক বিশ্বাস এইচপিএল পেল। হলদিয়া। আঠেরো দিত মনে হয়। অমিত দেবলিনা শিবরাম গেল বাঙ্গালোর এইচএলএল। ওরা বেশি পেত আরো খানিক। দুবছর পর মাস্টার্স করে ঝুমা বিওসি কলকাতায় গেল। তখনও পাঁচ না সাত হাজার। ডেনড্রাইটে পেল একজন, সেও ওই পাঁচ সাত।
 চাকরি জীবন প্রথম তিন বছর গুজরাট তারপর কলকাতা, মাঝে তিন বছর ওমান, বাকি পুরোটা কলকাতাই তো। ব্রেন ড্রেন জিনিসটা সরাসরি দেখলাম যেমন কাঞ্চন বিটেকে ফার্স্ট হয়ে কানপুর আইয়াইটি হয়ে ইউএস চলে গেল। আবার সঞ্জয় ওর পাশের রুমে থেকে এম আতেক করে কলকাতা আইবিএম এ থেকে গেল। ওখানেই আছে। অমিত দেবলিনাও চলে গেল ইউ এস। তনুশ্রী পারমিতাও ছিল বাইরে। তবে এখন তো ভার্চুয়াল ব্রেন ড্রেন। ঘরে বসে বিদেশের জন্য রোজগার করে দেওয়া। তাদের ব্যাক অফিস হয়ে কাজ করা।
কম্পু বিরোধিতার সরাসরি ভুক্তভোগী বোধয় নই। সেটা আগের চার পাঁচ বছরের সিনিয়াররা হতে পারে। 
প্রাইমারি থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়াও ফেস করেছি। প্রথমেই পাশের পাড়ায় হঠাৎ গজানো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের কেজি ওয়ানে ভর্তি। চিল্ড্রেন্স হ্যাপি হোম। কৃষ্ণা মিস (পাড়ার পিসি) মা বাবাকে কনভিন্স করে ভর্তি করালো। নইলে পাড়ায় ছিল চিল্ড্রেন্স কোজি নুক। সেটায় বেশিরভাগ পাড়ার বন্ধুরা পড়ত। ছাত্রছাত্রী বেশি ছিল। আমার স্কুলে প্রথম বছরেই যা স্টুডেন্ট। ক্লাসে বোধয় ১৫/১৬ জন। ওয়ান এ তিনজন। টু তে উঠে আমি একা। ওয়ান এর ক্লাসের পাশে বসিয়ে আমার ক্লাস হতো। থ্রি তে গান্ধী স্কুলে ভর্তি হলাম, সরকারী। জবা দিদিমণি ক্লাস টিচার। বাইরে থেকে পরের ক্লাসে ভর্তি হওয়া ছেলেদের খুব অপছন্দ করতেন। আমার  রোল হল ৩০। সব নাম মনে নেই।  কিছুকাল আগেও অনেকটা মনে ছিল।
সুমন নাগ চৌধুরী ১, 
সৈকত বসু ২
সুরজিৎ সুর ৩
চন্দন সাহা ৪
৫ কে ছিল? 
জয় ৬
ঋতম জানা কি ৭ না ৮? 
৯ কি অনুপম?
অভিজিৎ দাশগুপ্ত ১১? 
রাজীব ১০ না ১২? 
রণজয় ভৌমিক কোন ক্লাসে ভর্তি হল ৪ না ৫? 
 
থ্রিতে রচনা লেখার ব্যাপার ছিল। সেসব নাকি টুতেই শেখানো হয়ে গেছে। আমি তো শিখিনি। পারিওনি। কোত্থেকে সব গাধা গরু এসে ভর্তি হয় এরকম কিছু বলেছিলেন। প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই। দোতলায় ক্লাস হচ্ছিল। জানলার পাশে বসেছিলাম। এখনও মনে আছে ভেবেছিলাম জানলার গ্রিল না থাকলে নিচে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাই।  ফোর এ উঠতে রোল হল ৫।   ফাইভে স্কুলে থাকতে পাবো কিনা টেনশনে আরও একটা স্কুলে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হয়েছিল। সেটায় বন্দেমাতরম রচয়িতার নাম বঙ্কিমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলাম মনে আছে। শেষে স্কুলেই থেকে গেছিলাম। টুয়েলভ অবধি। টু এর পরে আবার ইংরেজি সিক্স এ। লার্নিং ইংলিশ। মনে আছে পাড়ার দোকানে বই কিনতে গেলে মানেবই কেনা বাধ্যতামূলক ছিল। একসাথেই দাম নিত। ইংরেজি পারতাম না তা নয় তবে পছন্দ করতে পারিনি কখনো। এখনো ইংরেজি গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে করে না। মেয়ের প্রবল চাপেও হ্যারি পটার বা রোয়াল্ড ঢাল পড়ে উঠতে পারিনি। ইংরেজি টিনটিন অ্যাস্টেরিক্স ও পড়ে আছে। মেয়ে গিলেছে, আমি পারিনি। তবে ওকে পড়া ধরাতেই ইজনোগুড অ্যাস্টেরিক্স একসাথে পড়া শুরু করেছিলাম। একটা বই পুরো দ্বিতীয় বই অর্ধেক তৃতীয়টা কয়েক পাতা এরকম একসাথে পড়ে বাকিটা ওর নিজে পড়ার জন্য রেখে আর পরে পড়া হয়নি। মিশনে দুটো সেমিনার সায়েন্স কলেজে একটা খুব ধেরিয়েছিলাম মনে আছে। বলেছিলাম সবই কিন্তু ফ্লুয়েন্ট ছিল না বলা। শুনতে খুবই খারাপ লাগছে বুঝতে পারছিলাম। সেটা পাবলিক স্পিকিং এর সমস্যাও হতে পারে, যেজন্য পাড়ার নাটকে পার্ট ভুলে গিয়ে ডুবিয়েছিলাম। চিচিঙ্গে অ্যান্ড কোং ছিল সেই নাটক। কিন্তু ইন্টারভিউ বা এই এতবছর চাকরি জীবন বিদেশি ক্লায়েন্ট কলিগ,  ইউকে ইউএসের অফিসের সাথে মিটিং কোথাও সমস্যা হয়নি কখনও। টেকনিকাল ডিসকাশন বলেই হয়তো। 
 
রাজ্য সরকার যে রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রাইমারি থেকে ইংরেজি তুলে দিল সেই গাব্দা বাঁধানো রিপোর্ট হাতে নিয়ে দেখেছি। এক সদস্যের কমিটি রিপোর্ট। কমিটি মেম্বারের নাম পবিত্র সরকার। এত অবাক লেগেছিল ভাবা যায় না। বাড়িতেই ছিল বইটা। টাইপ করা রিপোর্ট জেরক্স করে বাঁধানো বা ওইরকম ফন্টে ছাপা। যাঁর সংগ্রহের তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মারা যাওয়ার অনেকদিন পর সমস্ত বই আগলে রেখে রেখে যখন পোকা লেগে নষ্ট হতে শুরু করল তখন প্রাণে ধরে বেচতে না পেরে মেয়ে দিয়ে দিল আমায়।  টেম্পো ভাড়া দিয়ে পাঠিয়ে দিল আমার বাড়ি। মূলত প্রচুর সোভিয়েত বই ছিল বলে। সেই বই রাখতে লোহার ৫×৮ ফুটের র্যাক বানালাম। সেই দুশোর বেশি দড়ি বাঁধা বইয়ের স্ট্যাক খুলে খুলে বই গোছাতে গিয়ে হাতে পেয়েছিলাম সেই রিপোর্ট।  স্ক্যান করব ভেবেওছিলাম। পাঁচ ছ বছর পর আমার পছন্দের বইগুলো রেখে বাকি সব আবার দড়ি বেঁধে বেঁধে র্যাকশুদ্ধু ইন্দ্রদাকে দিয়ে এলাম আরেক টেম্পো ভাড়া দিয়ে। সেও তিন চার বছরের বেশি হল। এখন বাড়িতে যেটুকু আছে তাতে আর সে রিপোর্ট দেখছি না। ইন্দ্রদা এখনও সব প্যাকেট খুলে উঠতে পারেনি। খুললে, আর সে রিপোর্ট পেলে এখনও স্ক্যান করার ইচ্ছে আছে যদি না কোনো আর্কাইভে অলরেডি সেটা পাবলিক করা থাকে। 
 
বাম সরকারের কম্পু আর প্রাইমারিতে ইংরেজি বিরোধিতার এটুকুই ব্যক্তিগত এক্সপি।