আসুন, এইবেলা শুনে নিই, বিজ্ঞজনেরা এ ব্যাপারে কি মতামত দিয়েছেন। মাইকেল নিউটন, টেনেসির ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ, বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি সাধারণত দুঃখজনক ত্রুটি বা কিছু দুর্বৃত্ত সৈন্যের কারণে, বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করে সিস্টেমেটিক্যালি আক্রমণ করছে মার্কিন সৈন্যরা, এটা কিন্তু কখনোই নয়। "আমরা নিখুঁত নই", নিউটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছেন, ''কিন্তু আমরা আইন প্রয়োগের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি''। নিউটন একাধিক উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ভুল কাজের জন্য আমেরিকান সৈন্যদের দায়ী করেছে। ভিয়েতনাম যুগে শত শত ট্রায়াল হয়েছিল, ৯৫ জন ইউএস আর্মি কর্মী এবং ২৭ জন ইউএস মেরিন কর্পস কর্মী ভিয়েতনামের হত্যার জন্য কোর্ট মার্শাল দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল।
এই ট্রায়ালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের মাই লাই-এ বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার জন্য দায়ী সৈন্যদের বিচার। একটি সামরিক বিচারে ২২ জনকে হত্যার জন্য প্লাটুন কমান্ডারকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আরও আছে: ২০১৫ সালে যখন আমেরিকা ভুলভাবে আফগানিস্তানের কুন্দুজে একটি হাসপাতালে বোমা মেরেছিল, তখন মার্কিন কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে তদন্ত করে সনির্বন্ধ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল।
সবই তো বোঝা গেল নিউটন সাহেব, কিন্তু এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে যে, ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার সেমুর হার্শ এবং ভিয়েতনাম ভেটেরান রন রিডেনহোরের মতো হুইসেল ব্লোয়ারদের কারণেই মার্কিন সেনাবাহিনীর মাই লাই-এ গণহত্যা জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়েছিল? তা'ও প্রায় দুই বছর গোপন রাখার পর! আর ওই যে চার্লি কোম্পানির মার্কামারা লেফটেন্যান্ট, মাই লাইয়ের হত্যাকাণ্ডের নাটের গুরু-উইলিয়াম ক্যালি, একটু আগেই যাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা আপনি বললেন, তা সে হলো কোথায়? প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তো ঝাঁপিয়ে পড়ে, ক্যালির শাস্তি কমিয়ে মাত্র তিন বছরের জন্য তাঁর গৃহবন্দিত্ব মঞ্জুর করলেন। তবে হ্যাঁ, মাই লাইতে নারী ও শিশুদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার ঘটনায় অনেক আমেরিকান হতবাক ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই আমেরিকানরা পরবর্তীকালে, যুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপে নিজেদেরকে বেশি বেশি করে নিয়োজিত করেছেন; অনেকে আমূল যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন বা ভিয়েতনামে মার্কিন ভূমিকা সম্পর্কে তাদের পূর্ব-মতামত পরিবর্তন করে, সেই প্রথম যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে এটাও লক্ষ করার ব্যাপার: যে মানুষটি আবু ঘ্রাইব কারাগারে যুদ্ধরীতির উল্লঙ্ঘন, ও বন্দী নির্যাতন দুনিয়ার কাছে প্রকাশ করে দেন, আমাদের গর্ব সেই জো ডার্বি কিন্তু আসলে মার্কিন বাহিনীরই একজন রিজার্ভ সৈনিক। ২০০৪ সালের জানুয়ারীতে, ডার্বি’র ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে আসার পরই তো কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ে উঠল! ২০০৫-এ এই যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়, সব মিলিয়ে, ১১ জন মার্কিন সামরিক কর্মীকে ২০০৩ সালের এই অপকর্মের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়; পালের গোদা চার্লস গ্রেনারকে কানসাসের একটি সামরিক কারাগারের ব্যারাকে দশ বছরের হাজতবাসের শাস্তি দেয় মার্কিন মিলিটারি কোর্ট। ভালয়-মন্দয়, সাদায়-কালোয়, মেশানো এই দুনিয়ায়, জো ডার্বি’র মতো নাগরিকেরাই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে, মানবতার পতাকাটি সু-উচ্চে তুলে ধরেন আরও একবার, আমাদের অসীম লজ্জার অনেকখানি লাঘব করেন।
এ কথা সত্যি যে, মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষণ আজ যুদ্ধের আইন এবং অবৈধ আদেশ অমান্য করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়, কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের ঢঙ-ঢাঙ দেখে সময় সময় মনে ধাঁধা লাগে, রাজনৈতিক মনোভাবের কি সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে? আজ যে সব পুতিন পুতিন করে চ্যাঁচাচ্ছে, তা এখন যদি পুতিনমহল থেকে প্রশ্ন উঠে আসে যে, ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের জন্য জবাবদিহিতা আনার জন্য যদি এই জাতীয় ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়, মার্কিন সরকার কি তার বৈধতা স্বীকার করবে?
যুদ্ধাপরাধের বিশ্ব মানচিত্রে অতি সাম্প্রতিক সংযোজনটি হলো পূর্ব ইউরোপের ইউক্রেন। দ্বিতীয় বিশ্বের এই দেশটি অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানের প্রতিবেশী দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন হঠাৎ চাউর করেছেন যে, পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসের প্রধানত রাশিয়ান-ভাষী অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে কিয়েভের নাৎসি মতাদর্শের শাসক, সামরিক বাহিনী লাগিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালাচ্ছে, অতএব সেখানকার রাশিয়ানদের রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে নাৎসিদের হঠাতে হবে, সামরিক বাহিনীর ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সুতরাং চালাও যুদ্ধ! কিন্তু এটা তো আজকের কথা নয়, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই তো শুরু হয়েছিল পুতিনের এই বিভ্রান্তিকর অভিযোগ। শুনলে অবাক হবেন: ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি একজন ইহুদি এবং হলোকাস্টের সময় তিনি তাঁর পরিবারের তিনজন মানুষকে হারিয়েছেন, সুতরাং `তিনি নাৎসি’ এই অপপ্রচার পাগলেও বিশ্বাস করবে না। আর পূর্ব ইউক্রেনে গণহত্যা? দেখাতে পারবে পুতিনের চ্যালা চামুন্ডারা একটিও কোনো প্রমাণ? না, সে গুড়ে বালি! জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ তো পুতিনবাবুর এই দাবিকে হাস্যকর বলে উড়িয়েই দিয়েছেন। তাহলে বুঝে দেখুন সুধীগণ, কতটা ভিত্তিহীন অজুহাত দেখিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ইউক্রেনকে দখল করার মতলব ভাঁজছেন পুতিন!
২০২২-এর চৌঠা মার্চ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বুচা শহর অধিকার করে রাশিয়ান সৈন্যরা। কিন্তু ৩১-শে মার্চ, ইউক্রেনিয়ান সৈন্যরা বুচা পুনর্দখল করে নেওয়ায় রাশিয়ান সৈন্যরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। শেষমেশ তারা চলে গেল বটে, কিন্তু পিছনে ফেলে রেখে গিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য: রাস্তাঘাট, বাড়ির বেসমেন্ট, উঠোন- সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের মৃতদেহ। মরদেহগুলিতে অজস্র ক্ষত চিহ্ন; কারুর কারুর হাত তাদের পিঠের পিছনে বজ্র -আঁটুনিতে বাঁধা; তাদের হাত-পা ফুঁড়ে গুলি চলে যাওয়ার নিশান রয়েছে; অনেকের মাথায় গুলির ক্ষত রয়েছে; কারো কারো মাথার খুলি ভোঁতা কোনো জিনিস দিয়ে নৃশংসভাবে পাশবিক জিঘাংসায় ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক যাঁরা ৪ থেকে ১০-ই এপ্রিল পর্যন্ত, বুচায় কাজ করেছেন তাঁরা সামারি এক্সিকিউশন, অন্যান্য বেআইনি হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতনের বিস্তৃত প্রমাণ পেয়েছেন, যেগুলি সবই যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত সম্ভাব্য অপরাধের মামলা রুজু করতে সাহায্য করবে। ইউক্রেনিয়ানরা মনে করে, আসলে কিয়েভ দখল করাই রাশিয়ানদের লক্ষ্য ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে তাদের সেই লিপ্সা তৃপ্ত হয়নি। তাই যে পাঁচ সপ্তাহ তারা বুচা দখল করে রেখেছিল, শহরের বেসামরিক জনগণের উপর তারা তাদের চরম হতাশার ঝাল ঝেড়েছিল। বুচায় বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি রাশিয়ানদের নৃশংসতার আবিষ্কার এবং ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে হাসপাতাল এবং স্কুলগুলিতে রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা -এ সবই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ সুদৃঢ় করে তোলে। এখানেই শেষ নয়; জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন বলেছে, পুতিন এবং রাশিয়ার শিশু-অধিকার কমিশনার মারিয়া লভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধে অধিকৃত ইউক্রেন থেকে শিশুদের ধরেবেঁধে, রাশিয়ার নিয়ে যাওয়ার প্রমাণও রয়েছে। ইউক্রেন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রুশ আক্রমণের পর থেকে, জোর করে ১৬ হাজার ২২১-টি ইউক্রেনীয় শিশুকে অবৈধভাবে নির্বাসিত করা হয়েছে।
ইউক্রেনে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ নথিভুক্ত করার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা দারুণ আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিচার সংস্থা যেমন ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ, আইসিসি এবং তৃতীয় দেশ যেমন জার্মানি সার্বজনীন এখতিয়ারের নীতি ব্যবহার করে ইউক্রেনে সংঘটিত আপাত যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ইউক্রেনে গুরুতর মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য একটি তদন্ত কমিশনও প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এর কাজ আইসিসি এবং অন্যান্য বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করতে পারে। এগুলো খুবই আশার কথা, কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যুদ্ধপরাধের বিচারকার্য কিন্তু এত সোজা নয়! খোলসা করেই বলা যাক তাহলে। আমরা আগেই জেনেছি, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এসব যে ঘটেছে তা প্রমাণ করতে হলে অপরাধের পরিমাণ এবং অপরাধীর মধ্যে সরাসরি সংযোগ দেখাতে হবে। হ্যাঁ, বেশ কিছু ভয়ঙ্কর ভিডিও ফুটেজ আইসিসির হাতে এসেছে, যেখানে ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার ভালো প্রমাণ মিলেছে, যেমন ধরুন কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে: মাথার উপর হাত তুলে আত্মসমর্পণের জন্য গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মানুষদেরকে রাশিয়ান সৈন্যরা এলোপাথাড়ি গুলি করছে। এই ছবি সেই সৈন্যদেরকে, বড়োজোর তাদের কমান্ডিং অফিসারকে কাঠগড়ায় টেনে আনতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু তা কি আমাদের পুতিন অবধি নিয়ে যেতে পারে? তাহলে হেগ-এ একজন শীর্ষ সারির নেতার বিচারের জন্য আসলে কী লাগে? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের আবার ফিরে দেখতে হবে, সার্বিয়ান নেতা মিলোসেভিচের বিচারের ঘটনাটি। ভাবছেন, পুতিনের কথা বলতে বসে মিলোসেভিচের কথা আসছে কেন? হ্যাঁ, রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধে পুতিনের আর যুগোস্লাভিয়া ভাঙ্গনের যুদ্ধে মিলোসেভিচ-এই দুজনেরই, চিন্তা ভাবনা এবং কর্মপদ্ধতিতে দারুণ মিল আছে - একটা ভয়ঙ্কর, অশুভ মিল! তা মিলোসেভিচকে তো অবশেষে হেগ-এ বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তাহলে পুতিনেরও কি সেই অবস্থাই হতে চলেছে? আশ্চর্য্যের কিছুই নেই, কারণ আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নন!
তবে হ্যাঁ, পুতিনকে কব্জা করার হ্যাপা যে কম নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। প্রথমত, রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই আইসিসির সদস্য নয়, যদিও কিয়েভ তার ভূখণ্ডে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য আইসিসিকে এখতিয়ার দিয়েছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিলিপ্পি স্যান্ডস তো বলেছেন, আইসিসির প্রসিকিউটর, করিম খান, ইউক্রেনের ভূখণ্ডে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার তদন্ত করতে পারেন; কিন্তু তিনি আগ্রাসনের অপরাধের তদন্ত করতে পারবেন না, কারণ রাশিয়া এই আইনটি অনুমোদন করেনি। এই কারণগুলোই চোখে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাখ্যা করে, কেন ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা আগ্রাসনের অপরাধে অপরাধী, উচ্চপদস্থ রাশিয়ান কর্মকর্তাদের বিচার করার জন্য একটি "বিশেষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আহ্বান করছে। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী না থাকায়, অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য সদস্য দেশগুলোর ওপরই আইসিসি ট্রাইব্যুনালকে নির্ভর করতে হয়। ওদিকে, পুতিনকে অষ্টপ্রহর ঘিরে রয়েছে "সিলোভিকি" বা "শক্তিশালীরা" যারা কেজিবিতে পুতিনের প্রাক্তন সহকর্মী ছিল, অথবা বিদেশী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-জি আর ইউ, ফেডারেল প্রোটেক্টিভ সার্ভিস-এফএসও-র হাজার হাজার কর্মী। পুতিনের চারপাশে সুরক্ষার বলয় কার্যত তাঁকে ধরাছোঁয়ার বাইরে করে তুলেছে। সেই অহংকার উপচে পড়ে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের চলন-বলনে। শুনেছেন নিশ্চয়ই যে, পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরই, রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান, সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ আইসিসিকে হুমকি দিয়েছেন; বলেছেন, হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে হেগ-এর যুদ্ধাপরাধ আদালতকে উড়িয়ে দেওয়া হবে। এখানেই শেষ নয়, রাশিয়ার একটি শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থা করিম খান এবং পুতিনের জন্য ওয়ারেন্ট জারি করা আইসিসির বিচারকদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা খোলার মতলব ভেঁজেছে। ধৃষ্টতার নমুনাটা ভাবুন একবার!
না না এইসব হুঙ্কারে মানুষ আদপেই ভয় পায়নি, তবে এটা জলের মতো পরিষ্কার: ক্রেমলিন ভাবতেই পারেনি যে, একটি আন্তর্জাতিক আদালত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের নেতাকে যুদ্ধাপরাধের সন্দেহভাজন হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে, তাই তো তাদের এত লম্ফঝম্প!
ঘটনাক্রম জটিল থেকে জটিলতর হয়ে চলেছে, কিন্তু কথায় আছে না: "আশায় বাঁচে চাষা"। আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্রিকস দেশগুলির (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) আসন্ন ১৪ তম শীর্ষ সম্মেলন। যে কোনো দেশ, যে আইসিসির প্রতিষ্ঠাতা সনদ, রোম সংবিধি অনুমোদন করেছে, সে দেশের এখতিয়ারের মধ্যে আসা একজন অভিযুক্ত যুদ্ধপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য। দক্ষিণ আফ্রিকা, এই বছরের ব্রিকস আয়োজক, সে আবার আইসিসির এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সুতরাং, চেপে বসুন দর্শকবৃন্দ, খেলা চালু হলো বলে! ভয় একটাই: জুমা'দের মতো বিশ্বাসঘতকেরা থাকতে আল-বশির'দের আর নাগাল পায় কে? ভাববেন না, আমি আগে থাকতেই কূ গাইছি, আসলে ঘরপোড়া গরু তো, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরাই!
যাক গিয়ে, মোদ্দা কথা হলো: পুতিনবাহিনী যতই প্যাঁচ-পয়জার মারুক না কেন, যুদ্ধাপরাধ মানে যুদ্ধাপরাধ; সে কেউ চুক্তি স্বাক্ষরকারী হোক বা না হোক; সে ক্ষমতার চূড়ায় বসে থাকুক বা না থাকুক। কাগজেকলমে গুচ্ছের লেখাপড়াই তো সব নয়, মানুষের বুকের রক্ত দিয়ে আঁকা আছে অপরাধীদের বর্বরতা, আর নৃশংসতার চিহ্ণপত্র; মানুষ তা ভোলেনি, ভুলবে না।
যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, ভূগোল এসব নিয়ে তো অনেক কচকচি হলো, এবার একটা কথা বলুন তো: এই সব মারামারি কাটাকাটির জন্য কাকে আপনি দোষী মানেন? ভিডিও ফুটেজে কালাশনিকভ হাতে যে সৈন্যটিকে অস্ত্রহীন নারী শিশুর উপর গুলি ছুঁড়তে দেখা যাচ্ছে, সে, না তার কমান্ডিং অফিসার, না ওই সৈন্যবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনেরাল না সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান?
জানি, জানি, বলবেন ছবির ওই সৈন্যটাই আসলে একটা স্যাডিস্ট, তা নইলে এরকম কাজ কেউ করতে পারে? হ্যাঁ, আমাদের অনেকেরই আঙ্গুল নির্দিষ্ট হবে ওরই দিকে, কিন্তু শুনলে অবাক হবেন যে, বেশিরভাগ সময়, এইসব সৈন্যরা যারা অত্যাচার করে, তারা কিন্তু আমার আপনার মতোই স্বাভাবিক মানুষ, তফাৎ একটাই: টুঁ শব্দটি না করে, উপরওয়ালার আদেশ মেনে চলার কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ওদের।
জেরুজালেমে নাৎসি যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইচম্যানের বিচার শুরু হওয়ার তিন মাস পর, ৭ আগস্ট, ১৯৬১, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিনসলি-চিটেনডেন হলের বেসমেন্টে সামাজিক মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলগ্রাম তাঁর বিখ্যাত "ওবিডিয়েন্স এক্সপেরিমেন্ট" (আনুগত্যের পরীক্ষা) শুরু করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল, গণহত্যার একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া। যে কাজ করতে বিবেক সায় দেয় না, উপরওয়ালার কথামতো তেমনই কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের; তাদের বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে, তারা একটি সম্পর্কহীন পরীক্ষায় সহায়তা করছে, যেখানে তাদেরই মধ্যে থেকে একজন "শিক্ষার্থী" কে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হবে। এই নকল বৈদ্যুতিক শকগুলি ধীরে ধীরে এমন মাত্রায় বাড়ানো হয়েছিল যে বাস্তবে তেমনটি হলে তার ফল দাঁড়াত মারাত্মক। পরীক্ষায় দেখা গেছে, অপ্রত্যাশিতভাবে, অংশগ্রহণকারীদের খুব বড়ো একটা অংশ নির্দেশাবলী হুবহু মেনে চলেছে, যেখানে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী ৩০০ ভোল্ট পর্যন্ত গেছে এবং ৬৫ শতাংশ চূড়ান্ত মাত্রা মানে ৪৫০ ভোল্টে পৌঁছেছে। চমকপ্রদ এই প্রামাণ্য: সাধারণ মানুষ, যারা কেবল তাদের কাজটি করে এবং তাদের পক্ষ থেকে কোন বিশেষ শত্রুতা ছাড়াই, একটি ভয়ানক ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে। তদুপরি, যখন তাদের কাজের ধ্বংসাত্মক প্রভাবগুলি সুস্পষ্ট হয়ে যায়, এবং যে কাজ তাদের করতে বলা হয়, তার সাথে তাদের নৈতিকতার মৌলিক মানের কোনো সঙ্গতি থাকে না, তবুও খুব কম লোকের কাছেই কর্তৃত্ব প্রতিরোধ করার কোনো উপায় থাকে। আনুগত্যের সারমর্মটি এই সত্যের মধ্যে রয়েছে যে, একজন ব্যক্তি নিজেকে অন্য ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণের উপকরণ হিসাবে দেখে, এবং তাই অন্য ব্যক্তিটির ক্রিয়াকলাপের জন্য, নিজেকে তারা আর দায়ী বলে মনে করে না। একবার একজন মানুষের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন ঘটে গেলে, আনুগত্যের সমস্ত অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যই তখন তারা অনুসরণ করে।
সারা বিশ্বে বহুবার মিলগ্রামের এই পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করানো হয়েছে, এবং প্রতিবারই মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ফলাফল লক্ষিত হয়েছে। আশা করি, এবার একটা ব্যাপারে আমরা একমত হব, ভিডিওর ছবিতে দেখা আদেশপালনকারী সৈন্যটির অপরাধের দায় যদি দশভাগের একভাগ হয়, তবে বাকি নয় ভাগের জন্য দায়ী তাদের কমান্ডাররা, যারা দুর্বল প্রশিক্ষিত সৈন্যদের জেনেবুঝে এমন পরিস্থিতিতে পাঠায়, যেখানে যুদ্ধবন্দী বা নিরপরাধ লোকদের হত্যা বা অপব্যবহারের ঝুঁকির মুখোমুখি হয় তারা। দোষ সেইসব উপরতলার কর্মকর্তাদের, যারা ক্রমাগত প্রাইভেট আর সার্জেন্টদের ক্ষেপিয়ে তোলে, উস্কানি দেয় এই বলে যে, শত্রুপক্ষ মনুষ্যেতর কোনো জন্তু, যার মৃগয়াতেই পৌরুষের সার্থকতা, বীরপুঙ্গবের সফলতা।
শেষমেশ, একটাই কথা আসে, যুদ্ধ কারো কাম্য নয়; তবুও কোন কারণে যুদ্ধ সংঘটিত হলে, যুদ্ধের নিয়ম মেনে যুদ্ধ করতে হয়, আর সেই রীতিনীতির ‘রুল অফ থাম্ব’ জেনেভা কনভেনশন। যারা তা না মেনে যুদ্ধ করে, পরবর্তীতে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।
প্রতিটি সামরিক নেতার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এমন এক সেনাবাহিনীর গঠন ও প্রতিপালন, যারা পেশাদার, শৃঙ্খলাবদ্ধ, এবং অত্যাচার অথবা সন্ত্রাসের মতো অপরাধমূলক আচরণ থেকে বিরত। যুদ্ধের রীতিনীতি লঙ্ঘনকারী সৈন্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার জন্য সর্বপ্রথম সেনাধক্ষ্যকেই বদ্ধপরিকর হয়ে অগ্রণী হতে হবে; আর তাহলেই যুদ্ধাপরাধের মহীরুহকে অনেকখানি ছেঁটে ফেলা সম্ভব, ঘরের সমস্যা ঘরেই মেটানো ভালো, আইসিসি অবধি গড়ানোর কী দরকার?
রাজনৈতিক নেতারা সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী পরিবৃত হয়ে, ঠান্ডা ঘরে পান চিবোতে চিবোতে, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলবার মতলব ভাঁজতে পারেন, ইচ্ছামতো খেলা চালু করতে পারেন, আবার খেলতে নেমে খেলার নিয়ম ভেঙে ফাউলের মদতও দিতে পারেন। সেই অমানুষদের কিছু পোষ্য ক্রীড়নক নিরপরাধ মানুষকে বলির যূপকাষ্ঠে চড়ায়; বসুন্ধরার বুকে অযথা রক্তের ফোয়ারা ছোটায়। কিন্তু, এই জহ্লাদদের পতন অনিবার্য! সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষ, যাঁরা মানবতা, ব্যক্তিসত্ত্বা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, অহেতুক হিংসাকে ঘৃণা করেন, এবং যুদ্ধকালে জেনেভা কনভেনশনকে পূর্ণ মান্যতা দেন, তাঁরাই আমাদের আশা-ভরসা, শক্তি’র আসল উৎস। তাঁরাই দলে দলে চিহ্নিত করতে পারেন এই ক্ষমতালিপ্সু যুদ্ধাপরাধীদের, চরম অসহযোগিতায় বানচাল করে দিতে পারেন হত্যাকারীদের নৃশংস পরিকল্পনা, প্রজ্জলিত রাখতে পারেন মনুষ্যত্বের অমর জ্যোতিকে।
আমরা আশাবাদী। ১৯৪৫ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালসকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্ব যেমন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এক হয়েছিল, আবারও তেমনই একটা বিপ্লবী মুহূর্ত এখন আমাদের দরজা খটখটাচ্ছে। সম্মিলিতভাবে শক্তিশালী যুদ্ধপরাধীর মোকাবিলা করতে হবে; একটাও সুযোগ নষ্ট করা চলবে না, তা নাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে আমরা কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াব? আসুন, হাতে হাত রেখে কবির সাথে উদাত্ত কণ্ঠে আমরাও বলে উঠি,
"এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।"