অনুভবের উদ্ভব
ঈশু বলে, "জেঠু তুই বলেছিলি তুই যা বলবি তা মূলতঃ তোর ভাবনা চিন্তা জীবনবোধ নির্ভর। তুই যে ভাবে ধাপে ধাপে এগোচ্ছিস ভালো লাগছে।"
সুমন বলে, পাঠ্যবিষয়ের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে আমার আগ্ৰহ আছে কিন্তু তা নিয়ে বিশদে যথেষ্ট পড়াশোনা করার সামর্থ্য, সময় আমার নেই। কিছু বই পড়ে, সিনেমা দেখে, ঋদ্ধজনের কথা শুনে, নানা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বা আত্মবিশ্লেষণ করে কিছু বিষয়ে নানা বিক্ষিপ্ত ভাবনা ক্রমশ একটা আকার পায়। যখন কোনো বিষয়ে কিছু বলতে যাই সেই দানা বাঁধা ভাবনাই কথায় প্রকাশ পায়। তখন কোথায় কী পড়েছি, দেখেছি, শুনেছি মনে থাকে না। আমি যা ভাবছি সেটাই যে সঠিক তেমন দাবিও আমার নেই। সেই প্রসঙ্গে অন্য দৃষ্টিকোন থেকে কেউ কিছু বললে, তা মুক্তমনে ভাবার চেষ্টা করি। যুক্তিগ্ৰাহ্য মনে হলে তাও মনে থেকে যায়। এভাবেই মানুষের ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয় বলে মনে হয়।”
ঈশু বলে, "আমি তোর কথা বুঝতে পারছি। আমরা পড়ছি কলাবিভাগে। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস অর্থাৎ সাহিত্যের নানা শ্রেণীর উদ্ভব, বিবর্তন, প্রকরণ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন, গ্ৰীসিয়ান, ভিক্টোরিয়ান, রোমান্টিক পিরিওড এইসব নিয়ে তাত্বিক আলোচনা আমাদের ক্লাসে শুনতে হয়, পড়তে হয়, লিখতে হয়। তাই কলাবিভাগে মন দিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীর পক্ষে এভাবে আলোচনা করতে পারা প্রত্যাশিত। কিন্তু তুই পড়ছিস সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং যা একটা বিজ্ঞান ভিত্তিক ফলিত বিষয়। তাই তোর থেকে মানুষের মনোবৃত্তি, আচরণগত প্রসঙ্গে এমন সুংসহত বক্তব্য আশা করিনি। বেশ লাগছে। তুই বল - আমরা শুনি"।
সুমন বলে, "এভাবে গ্যাস খাইয়ে তুই আমায় লজ্জায় ফেলে দিলি ঈশু। যাক, এই অবধি আলোচনায় কি আমি বোঝাতে পারলাম যে মানুষ নিজেকে যতই উন্নত, বুদ্ধিমান ভাবুক না কেন, এখনও সে অনেক ক্ষেত্রে পশুর মতোই আচরণ করে, কিছু ক্ষেত্রে নিতান্তই প্রবৃত্তির দাস মানুষ?" ওরা তিনজনে মাথা নেড়ে সায় দেয়।
যৌনতার পর্যালোচনা
সুমন বলে, "বেশ, এবার তাহলে একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি পর্যালোচনা করে দেখা যাক যেটা রয়েছে আমাদের ঈশুমাসী বর্ণিত পুরুষের অবিচারের মূলে - অর্থাৎ যৌনতা। এ বিষয়ে কিছু প্রসঙ্গ কিন্তু অত্যন্ত স্পর্শকাতর লাগতে পারে। ভেবে দ্যাখ তোরা এগোবি কিনা? মুখে মুক্তমনা বলে নাচতে নেমে ঘোমটা টানা আমি পছন্দ করি না।"
ঈশু বলে, "জেঠু মনে হচ্ছে এখন ফুল ফর্মে। এবার ও আমায় তুলোধোনা করবে। এ্যাই, তোরা আছিস তো আমার সাথে?"
চুনি মাথা নেড়ে সায় দেয়। তুলি বাইসেপ দেখিয়ে জানায় যে সেও আছে ঈশুর সাথে।
সুমন বলে, "ঘাবড়াস না ঈশু। আমি তোর সব কথা খোলামনে শুনেছি। যা যৌক্তিক মনে হয়েছে নির্বিবাদে মেনে নিয়েছি। এখন আমি যা বলতে যাচ্ছি তা পুরুষজাতের প্রতিনিধি হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রচেষ্টা বলে মনে করিস না। আমি যা বলবো তা মানুষের কিছু প্রাকৃতিক, প্রবৃত্তিগত আচরণ অনুধাবনের প্রচেষ্টা। দ্যাখ নারী পুরুষের সম্পর্কে জৈবিক ও প্লেটোনিক প্রবণতা নিয়ে বিগত বহু শতাব্দী ধরে কোটি কোটি শব্দ খরচ হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। নারী পুরুষের সম্পর্ক একটা ক্যানভাসে আঁকা ছবির সাথে তুলনা করলে তাতে কিছু নির্দিষ্ট রঙের সাথে কিছু ধূসরের শেডও দেখা যাবে। কিছু রঙ অনায়াসেই চেনা যায়। ধাঁধা লাগে ধূসরে। তেমনই মানব জীবনে যৌনতা। এও এক ধূসর মেশানো রঙিন ছবি। আয়, আমরা খোলা মনে চেষ্টা করি ছবিতে ধূসর জায়গাগুলো অনুধাবন করতে।”
সুমন ওদের মুখের দিকে ভালো করে তাকায়। না কোনো অস্বস্তির চিহ্ন নেই। সুমন বলে, "প্রকৃতির নিয়মে যৌন ক্রিয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য বংশরক্ষা। সেই স্বাভাবিক ক্রিয়াটিকে বিনোদনে (Recreational Sex) পরিণত করে পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যের প্রসার মানুষের সৃজনশীলতা ও উদ্যমের পরিচয়। পশুদের মধ্যে ক্ষিদে বা ঘুমের মতো যৌনতাও একটি স্বাভাবিক চাহিদা। পশু ঘুম 'পেলে' ঘুমোয়। ঘুমিয়ে উঠে এনার্জি 'পায়'। ক্ষিদে 'পেলে' খায়। পেট ভরলে তৃপ্তি 'পায়'। এক্ষেত্রে 'পেলে' হচ্ছে উদ্দীপক বা Stimulant যার জন্য পশু ঐ ক্রিয়াটি করে এবং 'পায়' হচ্ছে তার Outcome বা পরিণতি যা সুখকর হলে সেই স্মৃতি 'পেলে'র ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বোঝা গেল?”
ওরা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
- "বেশ, যৌন ক্রিয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ পশুটি তো ক্রিয়াটি করেই খালাস কিন্তু নারী পশুটিকে তার প্রতিক্রিয়ায় গর্ভধারণ ও প্রসব করতে হয়। দুটি অভিজ্ঞতাই মোটেও সুখকর নয়। প্রথমটি দীর্ঘ অসুবিধার, দ্বিতীয়টি রীতিমতো কষ্টকর। আবার পুরুষ পশুটি যদি ঐ ক্রিয়াটি করে কোনো কষ্ট না পাক, বিশেষ কোনো আনন্দও না পায় তাহলে সে খামোখা ঐ কর্মটি নিছক দাঁত মাজার অভ্যাসে নিয়ত করতেই বা যাবে কেন? পশুরা অবশ্য দাঁতও মাজে না। এটা কথার কথা। আবার ধর একবার ভুল করে বেলতলায় গিয়ে নারী পশুটির যদি গর্ভধারণের অসুবিধা ও প্রসবযন্ত্রনার অভিজ্ঞতা হয়ে যায় তাহলে পুরুষ পশুটি পুনর্বার ক্রিয়াটি করতে গেলে সে তো খ্যাঁক করে তেড়ে উঠবে।"
এ কথায় ভ্যাক করে হেসে ফেলে তুলি বলে, "তুই বেশ মজা করে বলছিস কিন্তু।"
সুমন বলে, "এ তো আমি নিজের চোখে দেখেছি। একটা কুক্কুরির পিছনে একটা কুকুর খুব আগ্ৰহ নিয়ে গেছিল কিন্তু সে হঠাৎ এমন তেড়ে উঠলো যে কুকুরটা ল্যাজ গুটিয়ে পালালো। হয়তো কুক্কুরিটার তখন মুড ছিল না ওসবে। যাই হোক, যা বলছিলাম, এই নীল গ্ৰহে বংশবিস্তার প্রকল্পের নিয়ামক প্রকৃতিমাকে ক্ষিদে বা ঘুমের মতো যৌন ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও 'পেলে' এবং 'পায়' গোছের কিছু ভাবতে হোলো। পুরুষ পশুদের ক্ষেত্রে এ নিয়ে ম্যাডামকে বিশেষ ভাবতে হোলো না কারণ পুরুষ জাতটাই সোজাসাপ্টা। তাই কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগের মতো জীবনচক্রেও ম্যাডাম এই গুরুদায়িত্ব ভাগ করে দিলেন দুটি বিভাগে। HR Dept এর কাজ যেমন লোকের যোগান বজায় রাখা সেরকম শরীরের অন্তক্ষরা গ্ৰন্থীর ওপর দায়িত্ব বর্তালো হরমোনের মাধ্যমে 'পেলে' বা Libidoর যোগান বজায় রাখা। সে ঐ দায়িত্ব পালনে বড়দার সাহায্য চাইলো"।
চুনি বলে, "বড়দাটা আবার কে রে বাবা? জেঠু, তুই তো দেখছি ঠাকুরদার ঝুলির মতো গল্প ফেঁদে বসেছিস। মজা আ গ্যায়া ইয়ার"।
সুমন হাসতে হাসতে বলে, "বড়দা মানে মগজ। বড়দা অন্তক্ষরা গ্ৰন্থীসমূহকে বললো, ভাবিস না ছোটু, আমার একটা খুব চালু চ্যালা আছে, নয়ন। অধিকাংশ কাজ সেই করবে। আর শোনাশুনি, শোঁকাশুঁকি, ছোঁয়াছুঁয়ি, চাখাচাখির জন্য আছে আরো চারজন - কানু, নাকু, হাতু আর জিভু। আমি পাঁচজনকেই লাগিয়ে দেবো ডিউটিতে। তাছাড়া আমাদের সবার ওপরে তো মনদাদু আছেনই। তুই তোর ডিপার্টমেন্টের স্টাফেদের, মানে টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, অক্সিটোসিন, ডোপামিন - সবাইকে লাগিয়ে দে কাজে। সাথে থাকবে আমার পাঁচটা চ্যালা। তবে ওরা সবাই মিলে বাস্তবে যা করবে তার ঢের বেশি মনদাদু একাই ফ্যানটাসীর ফানুস উড়িয়ে তোর কাজ আসান করে দেবে। তো মা ষষ্ঠীর কৃপায় মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের পারফরম্যান্স যে এ্যাতো ভালো হবে, তা হয়তো প্রকৃতি ম্যাডাম নিজেও ভাবেন নি। ফলে তাবৎ জীবজগতের নাভিশ্বাস উঠিয়ে, অনেকের জীবনদীপ নিভিয়ে পৃথিবী ক্রমশ মানুষময় হয়ে উঠলো।"
সুমনের বলার ভঙ্গিতে ওরা সবাই হেসে ফেলে। তুলি বলে, "ওঃ, তোর মাথাতেও আসে বটে"।
সুমন বলে, "আমি বাপু ঈশুর মতো সিরিয়াসলি কথা বলতে পারি না। তাই একটু মজা করে বলি। তো বাকি রইলো 'পাওয়া'? অফিসে এটা সরল পদ্ধতি। কাজ করো, মাইনে নাও। অর্থাৎ Salary Section. ম্যাডাম ঠিক করলেন শরীরও যৌনক্রিয়া অন্তে পাবে একটি দিলখুশ 'পাওয়া' অর্থাৎ চরমসুখ বা Orgasm. পাবে তো বটে, কিন্তু দেবে কে? Pelvic floor muscle এর কুঞ্চন? G-spot এর শিহরণ? নাকি সর্বঘটে কাঁঠালি কলা মস্তিষ্ক? তার মধ্যে আবার সেটা Septal region নাকি hypothalamus - কোথা থেকে আসছে এসব নিয়ে পশুদের কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রকৃতি ম্যাডামের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী কর্ম করো, আনন্দ পাও ফুরিয়ে গেল। সে আনন্দ কীভাবে আসছে, কোথা থেকে আসছে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ।"
"অবশ্য ঘামানোর মতো মাথাও ওদের নেই। সেই মহান কর্মটির ঠিকা একমাত্র মানুষই নিয়ে রেখেছে। যেহেতু সে বুদ্ধিমান প্রাণী। তাই সে ঘামাতে শুরু করলো তার উর্বর মস্তিষ্ক। তবে অনেক ঘামিয়েও এর সঠিক হদিশ আজ অবধি পাওয়া গেল না। নানা মুনির নানা মত। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দীর্ঘদেহী এক বাঙালি চিত্র পরিচালক একবার বলেছিলেন, Orgasm বা চরম যৌনসুখ প্রকৃতির এমনই এক বিচিত্র লীলা যে সাধক সম্প্রদায়ের মুষ্টিমেয় মানুষ ব্যতীত সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এর অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করা অসম্ভব।"
তুলি বলে, "তুই কিন্তু খাসা বলছিস জেঠু। ডাক্তাররা যেমন নির্বিকার ভাবে রোগলক্ষণ আলোচনা করে, সেরকম। তাই ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে যেমন লজ্জা করে না, তোর কথা শুনেও করছে না। তবে ডাক্তাররা বলে টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহার করে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে। তুই বলছিস ডালভাতের মতো সহজ ভাবে। সাথে আবার রসিকতার আচার মিশিয়ে স্বাদু ভঙ্গিতে। দারুণ লাগছে। একটু দাঁড়া জল খেয়ে আসি। ঈশু বলে, "একটা বোতল নিয়ে আসিস, আমারও তেষ্টা পাচ্ছে।"
সুমন বলে, "সে কী রে! সবে তো কলির সন্ধ্যে! তোদের এর মধ্যেই গলা শুকিয়ে গেল? আমার তো আরো অনেক কিছু বলার ছিল?" তুলি যেতে যেতে বলে, "দাঁড়া, তোর একটা গাঁট্টা পাওনা রইলো।"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।