আত্মগ্লানি
শ তিনেক মিটারও নামেনি সুমন, দ্যাখে চিতা আর চুনি উঠে আসছে নীচে থেকে। তখন খেয়াল হয় সুমনের, তাইতো, ওদের তো ওপরে দেখেনি! চিতার হাতে একটা পাঁচ লিটারের জ্যারিক্যান। চুনির দু কাঁধ থেকে ঝুলছে দুটো ওয়াটার বটল। জল শেষ হয়ে আসছে দেখে ওরা কাউকে কিছু না বলে প্র্যাক্টিস ছেড়ে নীচে চলে যায় বলাইদাকে বলতে বাবলুকে একটু তাড়াতাড়ি পাঠাতে। যখন শোনে বাবলু আসবে না, চুনি বাংলো থেকে বরুণ আর গৌরবের বটল দুটো নেয়। চিতা নেয় বলাইদার থেকে জ্যারিক্যান। ঝর্ণা থেকে জল নিয়ে ওপরে এসে ওরা ভেবেছিল সবাইকে একটা সুইট সারপ্রাইজ দেবে।
সুমন স্থাণু হয়ে যায়। চুনির মাথায় টুপি নেই। মুখটা রোদে পুড়ে তামাটে লাগছে। কানের পাশে, গালে ঘামে লেপটে আছে কিছু চুল। দেখলেই বোঝা যায় পরিশ্রম হয়েছে বেশ। অতোটা নামা আবার জল নিয়ে উঠে আসা। তবু চুনির বাঙময় চোখ উৎসাহে চকচক করছে অন্যের খুশি দেখার আনন্দে। পরিশ্রমে দৃশ্যত একটু ক্লান্ত চিতার মুখেও সেই অমলিন হাসি। ওদের সামনে নিজের ক্ষুদ্রতায় নিজের মনেই কেন্নোর মতো গুটিয়ে যায় সুমন।
চিতা বলে, "কী রে, তুই একা একা কোথায় যাচ্ছিস?" সুমনের মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বেরোয় না। "আসলে …মানে … জল শেষ হয়ে গেছে, খুব তেষ্টা পাচ্ছিল … ভালো লাগছিল না … তাই নীচে নেমে যাচ্ছি।" বিড়বিড় করে কোনোমতে বলে ও।
চুনি একটা বোতল বাড়িয়ে বলে, "এই নে, জল খা। আমরা ঝর্ণায় আশ মিটিয়ে খেয়ে এসেছি। আমাদের এখন তেষ্টা নেই।"
অমিয়দার বাড়ানো বোতল একটু আগে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে সুমন। কিন্তু চুনির হাতে বাড়ানো জল দেখে তেষ্টা রুখতে পারে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। কয়েক ঢোঁক খেয়ে ফেরৎ দিয়ে দেয়। ওপরে নজন তৃষ্ণার্ত রয়েছে। তবু তাতেই যেন ধড়ে প্রাণ আসে। জল পেলে ওরা পাঁচটার পরেও ওখানে আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারে।
চুনি বোতলটা ফেরৎ নিয়ে বলে, "তেষ্টা মিটেছে তো? চল তাহলে ওপরে।"
সুমন তবু গোঁজ হয়ে বলে, "না রে, আমি নেমেই যাই। তোরা যা।" ওদের বিহ্বল দৃষ্টির সামনে দিয়ে ও হনহন করে নামতে থাকে।
আত্মসঙ্গে কিছুক্ষণ
নীচে এসে ঝর্ণায় আশ মিটিয়ে জল খেয়ে, চান করে তৃপ্তি হয় সুমনের। বেলা হয়ে গেছে। ক্ষিধেয় পেট জ্বলছে। বলাইদার দোকানে গিয়ে দেখে কেবল ভাত আর একটু ডাল পড়ে আছে। তরকারি নেই। বলাইদা ডালটা গরম করে দেন। ঠান্ডা ভাত, গরম ডাল আর কাঁচা পেঁয়াজ। তাই অমৃতের মতো লাগে। Hunger is the best sauce প্রবাদটা হাড়ে হাড়ে টের পায় সুমন।
খাওয়ার পর বাংলোর বারান্দায় গিয়ে বসে সুমন। সবার মালপত্র বারান্দার দেওয়াল সেঁটে রাখা আছে। ঈশুর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা স্বভাব। তাই ভোরের আগে ঝর্নায় গিয়ে স্নান করে গত কালের পরা সালোয়ার কামিজ কেচে বারান্দার কোনে দড়িতে মেলে দিয়ে গেছে। শুকিয়ে হাওয়ায় দুলছে ওগুলো। চুনি, তুলি এক্সট্রা সেট এনেছে হয়তো। তাই কাচাকাচির ঝামেলায় যায় নি।
কুকুর মানুষ ঘেঁষা প্রাণী। ওদের মালপত্র দেখে বুঝেছে কেউ এসেছে। তাই কোত্থেকে একটা মাদী কুকুর এসে এক কোনে বসে আছে। বিনে পয়সার প্রহরী। মুখটা খুব মিষ্টি আর করুণ। ওকে কয়েকটা বিস্কুট দেয় সুমন। কৃতজ্ঞতা মাখা চোখে তাকায়। বিস্কুট খেয়ে একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। সুমনও প্লাস্টিকের ওপর ম্যাট বিছিয়ে একটু গড়ায়।
ভাবে ওপরে তখন দলের বাকিরা নিশ্চয়ই পাথরে খুব ধস্তাধস্তি করছে। ঈশুর অবুঝ ক্লাইম্বিং পার্টনার তো নেমে এলো। ঈশু কী করছে এখন ওখানে? হয়তো গৌরবের সাথে মিলে প্র্যাক্টিস করছে। সুমনের মনে হয় ও যেন শৈলারোহণ প্র্যাক্টিসে নয়, এমনিই বেড়াতে এসেছে শুশুনিয়ায়। কিন্তু সেজন্য কোনো খারাপ লাগার অনুভূতিও হয় না ওর।
আসলে জীবনে কোনো ব্যাপারেই ওর বেশী উচ্চাশা নেই। কিছু হাসিল করার উদ্যমও নেই। ও অল্পেই সন্তুষ্ট। তবে নতুন জায়গা দেখার, নতুন বিষয়ে জানার আগ্ৰহ আছে। ডিসেম্বরে যে মাঠায় বেসিক রক ক্লাইম্বিং কোর্সে গেছিল তাও সেই কৌতূহলেই, ব্যাপারটা কী জানতে। গিয়ে ভালোই লেগেছে। মৈনাকদার মাউন্টেন ম্যানার্সের ওপর প্যাশনেট বক্তব্য খুব নাড়া দিয়েছে ওকে। তাছাড়া চিতা, বরুণ, ঈশু, তুলি, চুনির মতো কয়েকজন সুন্দর মনের ছেলেমেয়েদের সাথে যে আলাপ হলো, এসব কী কিছু কম পাওয়া? চারটে দিন বেশ হৈহৈ করে কেটেছে সেবার।
তবে কোর্স করে এও বুঝেছে সুমন, ভালো ক্লাইম্বার হতে গেলে শারীরিক সক্ষমতার সাথে যেরকম মানসিক সাহসের প্রয়োজন তা ওর নেই। তাই ও ভবিষ্যতে পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে না। তবে পাহাড় ভালো লাগে। কলকাতার ভীড়ভাট্টা ছেড়ে কদিন বাইরে এলে মন ভালো হয়ে যায়। এই যে এখন ও নির্জন বাংলোর বারান্দায় একাকী চুপ করে শুয়ে আছে, এতেও খুব ভালো লাগছে। প্রতিটা মানুষের কিছু সময় একা থাকা খুব প্রয়োজন বলে মনে হয় ওর। আবার গতকাল রাতে যখন ওদের সাথে নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হচ্ছিল, ঈশুর পেছনে লাগছিল, ওদেরকে আরো কাছ থেকে জানলো, সেটাও ভালো লাগছিলো। সুমন এমন সব সামান্য প্রাপ্তিতেও খুব আনন্দ পায়। ওর চাহিদা খুব সীমিত।
ওরা আসার আগে পৌনে পাঁচটা নাগাদ সুমন উঠে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় গ্ৰামের দিকে। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যেহীনভাবে। আসলে বাংলোয় ফিরে সবার মুখোমুখি হতে অস্বস্তি হচ্ছে ওর। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে বাংলোয় ফিরে একটু দুরে একটা বড় পাথরে একা বসে থাকে ও।
বন্ধুত্বের মায়া
চুনি দেখতে পেয়ে পাশে এসে বসে। নরম গলায় বলে, "জেঠু, আমি ওপরে গিয়ে সব শুনেছি। তুই চলে আসাতে আমাদের প্র্যাক্টিসও আর ঠিক জমেনি না। কেমন যেন ছানা কেটে গেছিল। ঈশুতো বলেই দিল, ক্লাইম্বিং পার্টনার ছাড়া দড়ি দড়া নিয়ে ও আর কিছু করবে না। কয়েকটা ফ্রী বোল্ডারিং করলো। তুই ওভাবে চলে আসতে সবার খুব খারাপ লেগেছে। অমিয়দা বলেলেন, জেঠু হয়তো একটু হাইপার সেনসিটিভ। তাই এই প্রসঙ্গে তোমরা ওকে ঠেস দিয়ে কোনো কথা না বললেই ভালো হয়। নীচে গিয়ে স্বাভাবিক ব্যবহার করবে। ইয়ারকী ঠাট্টা করে ব্যাপারটা হালকাও করে দিতে পারো। ওর ভালো লাগেনি, নেমে গেছে, মামলা খতম। যেন এটা কোনো ব্যাপারই নয়। দেখবে একটু বাদেই ও ঠিক হয়ে যাবে।”
সুমন নীরবে ওর দিকে তাকায়।
“তাহলে বল, সবাই তোকে কতো ভালোবাসে। তুই হৈ হৈ করিস, ইয়ারকী মারিস, সবার পেছনে লাগিস সেগুলোই আমরা এনজয় করি। মাত্র তিনদিনের জন্য এসেছি। ফিরে গিয়ে আবার যে যার জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। কদিনের এই হৈচৈটাই মনে থেকে যাবে বহুদিন। আমরা সবাই মিলে এসেছি আনন্দ করতে আর তুই সবার থেকে আলাদা হয়ে এখানে গুম হয়ে বসে আছিস, দেখলে ভালো লাগে?"
চুনি সুমনের থেকে বছর তিনেকের ছোট। কাল নানা আলোচনার মাঝে ও কথা বিশেষ বলেই নি। ও মনযোগী শ্রোতা। তবে এখন ওর কথা বলার ধরণ শুনে সুমনের মনে হয়, যেন সমবয়সী বন্ধু নয়, দিদির মতো কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে। ভেতরটা হু হু করে ওঠে। বাস্প জমে চোখে। একটা কথাও বলতে পারে না।
তুলিও ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে, "জেঠু, তোর কী হয়েছে বলতো? কাল দেখলাম ঈশুর সাথে হুইশপারিং গেম খেলছিলি। এখন চুনির সাথে ফুসুর ফুসুর করছিস। তোর কী আমার সাথে কখনো একা কথা বলতে ইচ্ছে হয় না?
যতই মুড অফ থাকুক, কেউ লুজ বল দিলে ছক্কা মারার জন্য সুমনের মন নিশপিশ করে। ভাবলেশহীন মুখে বলে, "তোর সাথে একা গল্প করতে আমার ভয় করে।"
কোমরে দু হাত দিয়ে তুলি লড়াকু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলে, "ভয় করে! কেন? আমি কী কামড়ে দেবো তোকে?"
সুমন বলে, "তুই গালে টোল ফেলে হাসলে আমার কথা হারিয়ে যায়। অন্য কিছু মাথায় আসে।"
তুলি সুমনের ঝাঁকড়া চুল দুহাতে মুঠো করে ধরে জোরে ঝাঁকিয়ে বলে "পাজি! শয়তান! তোর পেটে পেটে এই?"
চুনি হাততালি দিয়ে বলে, "এ্যাই তো! জেঠু এসে গেছে ফর্মে। তুলি তুই ক্লীন বোল্ড।
ঈশুও সেখানে হাজির হয়ে বলে, "কী রে জেঠু, তুই কোথায় হাওয়া হয়ে গেছিলি? আমি নীচে এসে কত খুঁজলাম তোকে।"
সুমন সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে বলে, "নে, ধর, খুব হয়েছে, আর ভণিতা করতে হবে না। আমায় খুঁজছিলি না হাতি। চায়ের পর নিকোটিন নক করেছে তাই আমার কথা মনে পড়েছে। তখনই বলেছিলাম একটা প্যাকেট রাখ।"
ঈশু একটা সিগারেট নিয়ে লাজুক হেসে বলে, "তা অবশ্য ঠিক, চায়ের পর মনটা উশখুশ করছিল। তবে তুই অতো আগে নেমে এসে এতক্ষণ ধরে গায়েব। ভাবছিলাম মনের দুঃখে বিবাগী টিবাগী হয়ে কোথাও চলে গেলি কি না। তাছাড়া তুই ছেলে হয়েও কালকে আলোচনায় পুরুষ জাতটাকে যেভাবে ধুলি, এও ভাবছিলাম পরে আবার তোর কোনো আত্মগ্লানি হয়নি তো?"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।