ইডিপাস কমপ্লেক্স
তুলি বলে, "জেঠু, আমি কোথাও পড়েছি সোফোক্লেসের মূল নাটকের পাশ্চাত্য অনুবাদ Oedipus Rex থেকেই Oedipus Complex ধারণাটা এসেছে।"
চুনি বলে, "Oedipus Complex কথাটা শুনেছি কিন্তু জেঠু আর একটু আলোকপাত করলে ভালো হয়। তবে তোর যদি মনে হয় এসব পার্শ্বপ্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে তুই যা বলবি ভেবেছিস তার থেকে সরে যাবি, তাহলে কাটিয়ে দিতে পারিস।"
সুমন বলে, "সাইড টপিক হবে কেন? তোদের জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমি যা বলবো ভেবেছি আলোচনা সেদিকেই যাচ্ছে। ইডিপাস কমপ্লেক্স সিগমণ্ড ফ্রয়েড প্রস্তাবিত সবথেকে বিতর্কিত তত্ত্ব। তাঁর এই তত্ত্বের বিরোধীদের মতে ফ্রয়েড কিছু মানুষের ব্যক্তিগত বিচ্যুতিমূলক প্রবণতা দেখে তা সমষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে দেগে দিয়েছেন।"
"ইডিপাস কমপ্লেক্সের প্রভাবে একটি ছেলে প্রাককৈশরে, মানে যে বয়সে মনে প্রথম যৌনতাবোধের উন্মেষ হয়, কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে তার মায়ের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারে। এটা প্রচলিত ধারণায় মনোবিকার। কিন্তু মনোবৈজ্ঞানিকের কাছে স্বাভাবিক প্রবণতার থেকে আলাদা তাই জটিলতা বা কমপ্লেক্স। এই জটিলতা পরে সামাজিক নীতিবোধের বিকাশে, সমবয়সী বান্ধবীদের প্রতি আকর্ষণের ফলে কেটেও যেতে পারে। তবে এর প্রভাবে এই ধরণের সন্তান ভবিষ্যতে প্রেমিকা বা স্ত্রীর মধ্যে তার মায়ের কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে বেড়াবে। যদি পায়, সে সম্পর্কের পরিণতি হতে পারে মধুর, অন্যথায় সুক্ষ্ম অতৃপ্তিবোধ থেকে যেতে পারে। মায়ের পরিমন্ডলে থাকাকালীন ইডিপাস কমপ্লেক্সের পরিণতি যে মায়ের সাথে যৌনমিলন অবধি গড়াবেই তার কোনো মানে নেই। কারণ সেই আকর্ষণ হয়তো একতরফা ও অনুক্ত। মা সেটা অনুভব করে ছেলেকে অপ্রস্তুতে না ফেলে, উপেক্ষা না করে, দুরে সরে না গিয়ে সংবেদনশীলতার সাথে হ্যান্ডল করতে পারেন।"
- "একতরফা মানে? মায়েরও কি ছেলের প্রতি আকর্ষণ তৈরী হতে পারে?" চুনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
- "মানবমনের জটিলতার তল পাওয়া অসম্ভব। যে দেশে ঢাকঢাক গুড়গুড় বেশি সেখানে এমন কিছু ঘটলেও তা প্রকাশ্যে আসে না। পাশ্চাত্ত্য পরিমন্ডল খোলা-মেলা। সংস্কার কম। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসুতায় অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা বেশি। মনোবৈজ্ঞানিক সার্ভেতে তাই অনেকে স্বেচ্ছায় অংশ নেয়। লিপিবদ্ধ হয় কেস স্টাডি। তৈরী হয় ডাটা বেস। ফলে জানা গেছে অজাচার সম্পর্ক বা incestuous relationship এর সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলি হতে পারে ১) বোন বা দিদির প্রতি দাদার বা ভাইয়ের আকর্ষণ। ২) ভাই বা দাদার প্রতি বোন বা দিদির আকর্ষণ। ৩) কন্যার প্রতি পিতার আকর্ষণ। ৪) পিতার প্রতি কন্যার আকর্ষণ। ৫) মায়ের প্রতি পুত্রের - তবে বাস্তবে এমন উদাহরণ তুলনামূলক ভাবে কম। এবং ৬) পুত্রের প্রতি মায়ের - বাস্তবে এর উদাহরণ সবথেকে কম।”
“অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ অগ্ৰণী ভূমিকা নেয়, নারীর অনিচ্ছা ও উপায় থাকলে সরে যেতে, প্রতিবাদ করতে পারে - না হলে পরিস্থিতির শিকার হয়ে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। একে বলে প্যাসিভ সাবমিশন। এবারে এই জটিলতাগুলির পরিভাষা জেনে নেওয়া যাক। ১) সিস্টার কমপ্লেক্স। ২) ব্রাদার কমপ্লেক্স। ৩) এর কোনো পরিভাষা থাকলেও জানা নেই তবে ১ এবং ২ অনুসারে ডটার কমপ্লেক্স ভাবা যেতে পারে। ৪) ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স। ৫) ইডিপাস কমপ্লেক্স এবং ৬) যোকাস্তা কমপ্লেক্স।
সুমন চুনির দিকে তাকিয়ে বলে, “ঐ ৬ নম্বর কমপ্লেক্সটি তোর বিষ্মিত জিজ্ঞাসার জবাব। এটা কী একটু বিশদে জানতে চাস?”
মাথা নেড়ে সায় দেয় চুনি।
সুমন বলে, "আমরা আগে আলোচনা করেছি প্রবৃত্তির তাড়নায় পশুদের মধ্যে যৌনক্রিয়ায় পুরুষের ভুমিকার কথা। তার 'পেলে'র বা তাগিদ সচরাচর বেশি হয়। ক্রিয়াটি করে নারীর গর্ভধারণের মতো কোনো কষ্টকর পরিণতি পুরুষকে ভোগ করতে হয়না। 'পাওয়া'র জন্যেও নারীর সম্মতির প্রয়োজন নেই। নারী তীব্র প্রতিরোধ না করলেই হোলো। তাই পুরুষ-পশু ক্রিয়াটি একতরফা তাড়নাতেই করতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রে চলে প্রবৃত্তিগত তাড়নার সাথে সামাজিক সংস্কারের টাগ অফ ওয়ার। সংস্কার কম হলে প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দেবে। নীতিবোধ প্রবল হলে এ জাতীয় চিন্তা অঙ্কুরিতই হবে না।"
"পুত্রের প্রতি মায়ের যৌন আকর্ষণ ইডিপাস কমপ্লেক্সের বিপরীত। তাই একে বলা হয় যোকাস্তা কমপ্লেক্স। এই পরিভাষাটির উদ্ভাবক সুইস মনোবিশ্লেষক রেমণ্ড দ্য সোস্যুর। কারণ যোকাস্তাই ছিলেন অয়দিপাউসের জন্মদাত্রী যাকে অয়দিপাউস অজান্তেই বিবাহ করেন। অয়দিপাউসের রূপ, যৌবনের প্রতি বয়স্কা কিন্তু তখনও যৌবনবতী রাণী যোকাস্তা আকর্ষিত হন। ফলস্বরূপ - পুত্র তথা স্বামী অয়দিপাউস মাতা তথা পত্নী যোকাস্তার গর্ভে উৎপাদন করেন চারটি সন্তানের - যার একজনের নাম বহুলপরিচিত - কন্যা আন্তিগোনে।”
“কিন্তু সোফোক্লেসের নাটকে অয়দিপাউস ও যোকাস্তার সম্পর্ক ছিল নিয়তি নির্ধারিত কিছু দূর্ভাগ্যজনক ঘটনাচক্র। কিন্তু বাস্তবে ইডিপাস এবং যোকাস্তা কমপ্লেক্স জনিত আকর্ষণের উন্মেষ হয় সজ্ঞানে। কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ঘটতে পারে ছয় নম্বর সম্ভাবনা। যেমন, মা ও ছেলের বয়সের কম ব্যবধান, ছেলের দ্রুত যৌবনপ্রাপ্তি ও মার তখনও যৌবনের জোয়ার অব্যাহত। মায়ের লিবিডো বেশী এবং ইনহিবিশন কম। মায়ের রয়েছে যৌন অতৃপ্তি যা স্বামীর মাধ্যমে বা পরকীয়া সম্পর্কেও পূরণ হয় নি। ছেলেটি খুব খোলামেলা স্বভাবের ও মা তার সাথে বন্ধুর মতো মেশে। মা হলেও সে তো একটি মানুষও। তাই এমতাবস্থায় মায়ের তীব্র যৌন অতৃপ্তি ছেলের প্রতি তাকে শারীরিক ভাবে আকৃষ্ট করতে পারে।"
"পুরুষের পক্ষে নারীর সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়াই মিলিত হওয়া সম্ভব বা যদি না সে হাত পা ছুঁড়ে তীব্র প্রতিরোধ করে। তখন তা জোরপূর্বক মিলন বা ধর্ষণ। কিন্তু পুরুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারীর পক্ষে তার সাথে সঙ্গম করা সম্ভব নয়। ফলে এই অজাচারে মায়ের পক্ষে ছেলের সাথে মিলন তখনই সম্ভব যদি ছেলেটি সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তারও যদি কামেচ্ছা বেশি ও সংস্কার কম হয় তাহলে তার পদস্খলন হতে পারে। প্রাকসভ্যতাকালে স্বাভাবিকভাবে পালিত অজাচারের জিনবাহিত সুপ্ত প্রবণতা ও মায়ের প্ররোচনার প্রভাবে প্রাথমিক জড়তা কেটে গেলে আর ফিরে তাকানোর প্রশ্ন নেই। কারণ যার সাথে তার মিলন হচ্ছে সে তার প্রিয়, পরিচিত, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।”
তুলি বলে, “কিন্তু যদি ছেলেটির সংস্কার ও অপরাধবোধ প্রবল হয়?”
সুমন বলে, “তাহলে সে কোনোভাবেই অগ্ৰসর হবে না। বরং মায়ের একতরফা প্ররোচনায় সে প্রবলভাবে বিচলিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে, তার মনোবিকলন হতে পারে, সে আত্মহত্যাও করতে পারে। তবে অজাচারের ক্ষেত্রে যোকাস্তা কমপ্লেক্সজনিত আকর্ষণের সম্ভাবনা অত্যন্ত কম - কারণ সেক্ষেত্রে বাৎসল্যবোধ বা অপত্যস্নেহ মাকে তার গর্ভজাত পূত্রের সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হতে প্রতিহত করে।”
সুমনের ব্যাখ্যা শুনে চুনি আস্তে আস্তে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে বটে তবে ওর চিন্তান্বিত মুখভাব বলে দেয় এই ব্যাখ্যা স্বীকার করতে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। হওয়ারই কথা। এহেন প্রবৃত্তি আমাদের প্রচলিত ধারণার সাথে মেলে না। অথচ সত্য যতই রূঢ় বা অস্বস্তিকর হোক তা অস্বীকারও করা যায় না। তাই তো বলে Truth is stranger than fiction.
তুলি বলে, "আচ্ছা ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স নিয়েও কিছু বল না, শুনি।”
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।