কামিনী এখন তিপ্পান্ন। তবে দেখলে মনে হয় মধ্য চল্লিশ। কামিনীর স্বামী শীতলবাবু এখন ষাট। তবে দেখলে মনে হয় মধ্য ষাট। কামিনী এখনো নিয়মিত শরীর ও রূপচর্চা করেন। হালকা মেজাজে থাকেন। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে হাসি মস্করায় সাবলীল। তাই এখনও শরীরে তরতাজা, মনে ফুরফুরে আছেন। ফলে প্রাকৃতিক নিয়মে এখনও মাঝে মাঝে বিশেষ অন্তরঙ্গতার জন্য তাঁর শরীর, মন জানান দেয়। কিন্তু শীতলবাবুর এখন আর ওসবে তেমন উৎসাহ নেই। তিনি বাগান করা, সাহিত্যচর্চা নিয়ে শান্ত সমাহিত জীবনযাপন করেন।
সেবার দুজনে শীতে এক সপ্তাহের জন্য দেওঘর বেড়াতে গেলেন। উঠলেন এক আশ্রমের অতিথিশালায়। বেশ বড় জমিতে আশ্রম। উপাসনালয়, বাগান, বড় বড় প্রাচীন বৃক্ষ। সুন্দর পরিবেশ। এক প্রান্তে গোশালা। বেড়াতে এসেও শীতলবাবু বাগানে রাখা বেতের চেয়ারে বসে দিনের অধিকাংশ সময় বই পড়েন। মন্দির টন্দিরে যাওয়াতে ওনার কোনো উৎসাহ নেই। আসার পরদিন কামিনীকে নিয়ে সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে ত্রিকুট পাহাড়ে ঘুরে এসেছেন। তারপর আর কোথাও যাননি। ভাবেন এই বয়সে কী হবে অহেতুক দৌড়াদৌড়ি করে স্পট হান্টিং করে। তাই সকাল বিকেল আশ্রম পরিসরের মধ্যে একটু পদচারণা করেন। বাকি সময় বই পড়ে কাটান। বেশ লাগে। পরিচিত পরিবেশ থেকে দুরে কদিনের নিখাদ বিশ্রাম। মনের আরাম।
অনেকদিন আগে একবার এখানে এসে মন্দিরে গিয়ে পাণ্ডাদের হাঁকাহাঁকি, দর্শনার্থীদে ঠেলাঠেলি বিরক্তিকর লেগেছিল। যেকোনো বিখ্যাত মন্দিরেই সময়ের সাথে ভীড় ও বাহুল্য বাড়ে। তাই এবারে আর মন্দিরমুখোই হননি। তবে আশ্রমের উপাসনাগৃহে বাহুল্যবর্জিত আধ ঘন্টার শান্ত গাম্ভীর্যয় সান্ধ্য উপাসনায় গিয়ে ভালো লেগেছে। তাই ওখানে গিয়ে চুপ করে বসে থাকেন।
উপাসনার পরেও আশ্রমবাসীদের অনেকে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকেন। শীতলবাবু উপাসনা সংগীত শেষ হলে ঘরে এসে আবার বই পড়ায় ডুবে যান। কামিনীর বই পড়ার শখ নেই। তবে উনি খুব মিশুকে, মানুষের সাহচর্য ভালোবাসেন। আলাপী কামিনী অন্য যাত্রীদের সাথে মিলেমিশে গল্পগাছা করে সময় কাটান। হাসিখুশী কামিনীর সঙ্গ তাদেরও ভালো লাগে।
স্বামীর সাথে বেড়াতে এসেও তাই কামিনী আশ্রমের অতিথিশালায় বেড়াতে আসা অন্য যাত্রীদের সাথে আলাপ করে তাদের সাথে দুদিন মন্দিরে গেছেন। সদলবলে হৈ হৈ করে নন্দনপাহাড়েও ঘুরে এসেছেন দুবার।
কলকাতার রুটিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে কদিন দেওঘরে বেড়াতে এসে কামিনী ভেবেছিলেন শীতের রাতে হয়তো লেপের তলায় অন্য উষ্ণতার আমেজ পাবেন। নাইটি পরে স্বামীকে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরে তেমন উষ্ণতা বিনিময়ের উস্কানিও দিয়েছেন। কিন্তু শীতলবাবুর এখন অবস্থা শান্টিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বয়লারে কয়লা কমে যাওয়ার স্টিম ইঞ্জিনের মতো। দড়ি টানলে ভোঁ বাজে কিন্তু বগি টানতে গেলে স্টিমে টান পড়ে।
কামিনী ঘন হয়ে কাছে এলে শীতলবাবু তাকে জড়িয়ে একটু আদর টাদর করেন। কথা বলতে বলতে একটু পরে তাঁর কণ্ঠ নীরব হয়ে আসে। ক্রমশ সরব হয় নাসিকা। অন্ধকার ঘরে তৃষ্ণার্ত কামিনী দীর্ঘশাস ফেলে ভাবেন, ভিজে ঘুঁটেয় বারবার দেশলাই জ্বালাই সার। অতীতে শীতলবাবুর উষ্ণতার উৎসাহ মনে পরে। কামিনীর সেই উৎসাহ এখনও মরে যায়নি। তবে শীতলবাবুর উনুনে আঁচ কমে গেছে। তাতে এখন বড়জোর হাত সেঁকা যায়। রুটি সেঁকা মুশকিল।
তবে ঐ একটি ব্যাপারে মৃদু আক্ষেপ ছাড়া শীতলবাবুকে নিয়ে কামিনীর আর কোনো অভাববোধ নেই। শান্ত, সচ্চরিত্র, নির্বিবাদী শীতলবাবুকে স্বামী এবং মানুষ হিসেবে ভালোই বাসেন কামিনী। শ্রদ্ধাও করেন। ভাবেন সবার তো আর ঐ বিশেষ বাসনা সবিশেষ হয় না, কী আর করা যাবে।
সেদিন প্রাতরাশের পর শীতলবাবু যথারীতি বাগানে মিঠে রোদে বেতের আরামকেদারায় বসে বই পড়ছেন। কামিনী ঘুরতে ঘুরতে গোশালায় গেছেন। দেখেন বেশ কিছু নধর যুবতি গাভীর সাথে এক কোনে প্রায় বুড়ো একটা ষাঁড়ও চোখ বুঁজে জাবর কাটছে। কথায় কথায় জানা গেল গোপালকের নামও গোপাল।
কামিনী বলেন, আচ্ছা গোপাল ভাই, ঐ বুড়ো ষাঁড়টা কেন আছে এখানে?
দেহাতি মানুষের শহুরে সহবৎ জ্ঞান কম, তাছাড়া প্রশ্নটা যখন কামিনীই করেছেন, তাই সরল ভাবে সে বলে, আইজ্ঞ্যা বৌদিমণি গাইদের পাল খাওয়াতে।
চোখ কপালে ওঠে কামিনীর। এই মেঠো বাক্যবন্ধটা আগে কোনো প্রসঙ্গে শুনেছেন, পরিশীলিত ভাষায় তার নির্গলিতার্থ যে Breeding farm animal সেটাও জানেন। তবু ঠিক বিশ্বাস হয় না। তাই আবার বলেন, কিন্তু গোপাল ভাই, ওকে দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ বয়স হয়েছে, চোখ বুঁজে একমনে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে জাবর কাটছে, ও কী, ইয়ে মানে, এখনও ইন্টুমিন্টু করতে পারে?
গোপাল আবার ইন্টুমিন্টুর অর্থ জানে না কিন্তু বলার ভঙ্গিতে বুঝে যায় কামিনী কী বলতে চাইছেন। তাই একগাল সরল হেসে বলে, তা আপনে ঠিকই ধরসেন বৌদিমণি, বয়েস ওর হয়েছে, ভালোই বয়েস। তবে এখনো গাই কে কাছে আনলি তখন দেখতি হয় ওনার ত্যাজ!
কামিনী বলেন, গোপালভাই এক কাজ করবে, এই নাও পঞ্চাশ টাকা, চা মিষ্টি খেও। যাও তো বাগানের ধারে চেয়ারে বসে ঐ যে লাল চাদর গায়ে ভদ্রলোক বই পড়ছেন, ওনাকে গিয়ে এই কথাটা বলে এসো তো।
গোলা গোপাল একটু ভেবলে গিয়ে বলে, কোন কথাটা বৌদিমণি?
কামিনী ভাবেন, আচ্ছা আকাট তো, এতো সরলও হয় নাকি কেউ? তবু, উষ্মা চেপে বলেন, আরে বাবা, এই যা বললে এখন, গিয়ে বাবুকে বলো তোমাদের ঐ বুড়ো ষাঁড়বাবাজী এখনও ঐসব করতে পারে, মানে ...।
গোপাল বলে, বুয়েচি, বুয়েচি বৌদিমণি, আর বলতি হবেনিকো, এখুনি গিয়ে বলছি ওনাকে।
কামিনী ভাবেন, আমার ছলাকলায় তো কিছু হয় না, যদি এই গেঁয়ো লোকটার কথায় মানে লেগে মনে কিছু হেলদোল হয় ...।
গোপাল এসে বলে, আমি জেঠুকে বলে এয়েচি বৌদিমণি।
কামিনী মনে মনে বিব্রত বোধ করেন, জেঠু! আ মোলো যা! উনি যে আমার স্বামী রে, মোটে সাত বছরের বড়। তবে কামিনী তো আর গোপালকে বলেন নি ঐ লাল চাদর গায়ে বাবুটি কে। তাই অন্তরের বিরম্বনা অন্তরালে চেপে বলেন, তো কী বললেন উনি?
গোপাল বলে, আইজ্ঞ্যা, উনি বললেন, তা একথা আমায় বলতে এসেছ কেন? তাতে আমি বললেম, হুই যে গোশালার কাছে সবুজ চাদর গায়ে বৌদিমণি ডেঁইরে আছেন, উনি বললেন এটা আপনারে এসে বলতি।
কামিনী সাগ্ৰহে বলেন, তারপর কী হোলো?
গোপাল বলে, আইজ্ঞ্যা বৌদিমণি, উনি জানতে চাইলেন, তো তোমাদের ঐ বুড়ো ষাঁড়বাবু কী বিশেষ কোনো গাইয়ের সাথেই … টুনটুন মুনটুন... মানে ঐ যে আপনে তখন কী বললেন না … উনিও অমন ধারাই কী একটা বলে বললেন - করে?
চাপা উত্তেজনার মাঝেই আচমকা যেন খটকা লাগে কামিনীর।
কিন্তু গোপাল বিনদাস বলে চলে, আমি বললেম, না জেঠু, তা নয়, আমি যখন যে গাইকে পাল খাওয়াতে নে যাই ওনার কাছে, তাকেই করে। শুনে উনি বললেন, যাও, বৌদিমণিকে এটা বলো গিয়ে। এই দেখুন বৌদিমণি, জেঠু কী ভালো, আমারে একশোটা টাকাও দিলেন এই টুকুর তরে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।