#আনারা_কচুচুষি_এবং_কিছু_প্রলাপ
কাজচলুনি ঘাটে পা দেওয়ার ঠিক ডাইনে একটা ঘ্যাঁতা বয়সী কলকে ফুলের গাছ আছে। তুমুল খরখরে, হলদে। পুব পাড়ে আছে ভরা বয়সের শ্বেত করবীর ঝাড়। অবশ্য কেতকী করবী কল্কে সবই এখন ফ্ল্যাটওয়ালা হাফশহুরেদের জ্ঞানের গুঁতোয় বেমালুম একাকার। তাও এর কপাল ভাল। ভাগ্যিস শাদা, লাল নয়, নইলে এরে দোপাটির সঙ্গে নামবন্ধী করে ফেললেও অবাক হতুম না।
হাফ শহুরে লব্জটা পুকুরআলাদের ঘরের দিদিমণির মুখে শোনা। মনে ধরিছিল। আলান্দা না আমান্দা ওই ফুলডারে অলকানন্দা বলতি শুনিছি সেও ওই দিদিমণির মুখিই। দিব্য লেগিছিল। পুরোনো নাম কেটে রবীন্দ ঠাউরে নতুন নাম দে গেছেন। নদীও আছে শুনিছি সেম সেম। অ ল কা ন ন্দা... ভাল লাগাতে কেটে কেটে বলে বলে জবানে তুলে নিইছি। ওই আকান্দার চেয়ে অলকানন্দা ঢের ভাল বাজে কানে।
নদী যে!
জলেই ধরা জলেই গড়া ফের জলেই হারা।
জল বড় আপনার পারা।
যাক গে, রঙের ঠাহরে এ জল তো জল নয় যেন এক পুকুর সাপের বিষ থকথক করছে। তায় আবার... শান্তিপুরী এক আঁশপাড়ে দখিনা বাতাস ঠেলা মারলি কেমন পারা দোলন হয় মালুম? এখন যেমন পারা জলের ঘাই উঠতিছে পাড়ের কিনারে, ঠিক ওরম।
মিচকি মিচকি ফুলো ফুলো ঢেউ গড়তিছে।
চোখে আঁকা হতেই কোমরের ভাঁজে কাঁপন জাগতিছে!
মধ্যে মধ্যে মরাই বাঁধার বিচালি বেণী বাঁধার কালে এলোবিলো প্যাঁচের কায়দায় ঘেঁসো রুইয়ের দঙ্গল উলটিপালটি খাচ্ছে, খাবলা খাবলা খলবল খেলছে পুকুরের এই সেই ওই চত্বরে পাঁক জল।
এটাও চোখে আঁকা হতেই কই মাছের কানকে সরতিছে তলপেটে!
ঝাপটা জুড়তিছে...
ধ্যাত্বেরই!
পুকুরঘাট আগান বাগান শুড়িপথ মায় এই মেয়েলোকের মুণ্ডু অবধি সব ঘুলিয়ে তুলতিছে এ আবাগী চৈতী হাওয়া, এ বাতাসে জানে জান ছোঁয়, জানে জ্বীনও ছোঁয়।
থিতু হয়ে খানিক বসলিই দমে বসি যেতি হয়। ঝিম ধরে। মানে মানে নেয়ে ধুয়ে ঘর চল বিটি।
কটা বাজল? সুয্যি তো দেখি কল্কে ফুলগুলোনরেই মেখে নিলো মুখেচোখে।
অসরের ওয়াক্ত হয়ে এল মনে লয়। ডুব দে ডুব দে, বেলা তো গেল রে দিবানি!
মিলছাপি শাড়িখানা জায়গায় জায়গায় ঘষটে গেছে তা মাস তিনেক হতে চলল। সেই দুই রোজার মাস গেল পরছে নাগাড়ে। একেবারে খাউশটা দেখায়। কিন্তু করবারই বা কী আছে...ওই পরতি হবেনে এখনও দেড় মাস। সবে শবেবরাত গেল।
সবই বরাত আনারা!
লাল শাড়িটা জলকেচে ধুয়ে ঝুপ করে থুয়ে দিল হলুদ কল্কের কোমর লাগোয়া ডালখানায়। ভাব যেন ওই হল হুকুমতামিলের হাজিরবান্দা আশিক।
চৈত্রের নিঝঝুম দুপুরটাকেই আড় আবডাল মেনে অজস্র রিফু মাখা শায়াটা বুকের উপরে বেঁধে জলে নেমে নিচের দিকের এক পইঠায় বসল।
পা ঘষবে। গা ঘষবে।
জল ঝরবে।
আচমকা অন্যপানে চোখ রাখে সহজাত বোধ।
অমন নড়ে কেন দুধ কচুর ঝাড়?
বাম পাড়ের ঝোপে উবুত শরীরখানা ঘষটায়, ও কে!
খচমচিয়ে উঠে দাঁড়ায় মাঝবয়সী এক বউ।
হলদে কালো ছোপ ছোপ শাড়ি পেঁচানো হিলহিলে শরীরটা দেখা যাচ্ছে, ভরাগতরের এক জল-ঢোঁড়া তিড়িং খাড়া দাঁড়িয়েছে যেন, কিন্তু সাপিনীর মুখটা দুধমানের চ্যাটানো সবুজ পাতার আড়ালে, দেখা যাচ্ছে না। বসা অবস্থাতেই কোমরের উপরটা এগিয়ে ঝুঁকি দেয় আনার। তাতে তার কী দেখা গেল এবং কতটা সে দিকে মন নেই, বউটার মুখ দেখাই উদ্দেশ্য। তক্ষুণি পাতাটা সরিয়ে ঘাটের দিকে হুঁশহুশিয়ে এগিয়ে আসে বউটা। হিসহিস গলায় বুলি তুলে, "চুপ মার চুপ মার!"
মুখটা দেখতে থাকে আনার, ছুটে আসার ওই হাফ থেকে এক মিনিট।
সাপিনীই বটে! কাটা কাটা গালের হাড়, ছুঁচলো ঠোঁট, চেরা চোখ। জোর পায়ে আসছে বটে কিন্তু চলনে বাঁকের ভাঁজটা দিব্য আছে।
...আয় দেখি বউ, নাম শুধোই...।
জলে ডোবানো পা দুটো টানটান করে ধাপে হেলান দিয়ে বসে আনার। নীল শিরা কালো পশম লাল আঁচিল জল মেখে ধপধপে পাদুটিকে আরও চোখটানা করে নেয়।
একই পইঠায় ধাপ করে বসে পড়ে বউটা।
- চেঁচিয়ো না দিদি, পশ্চিম পাড়ের জঙ্গলে ঢুকেছি শুনতে পেলে গুষ্ঠি উদ্ধার করবে ও বাড়ির ছোট বউ। জিভ তো নয়, বিষের সরাত।
- আর তুই, গোটাটাই তো বিষ-জিভ...
- কী বিড়বিড়ালে গো? সত্যিই বলছি। শেতলার দিব্যি।
- নানা, ও কিছু লয়। হ্যাঁ, বিশ্যেস যাচ্ছি তো। আমি চিনি তো ও বাড়ির সব বৌদেরই।
- সবগুলো তবু একরকম, ছোটটি রূপের খাপরা কি না, বররে এই বেচে এই কেনে, সে দেমাগে আমাদের মানুষ নয়, চামউকুন ভাবে গো। কী ব্যভার!
- আচ্ছা! তোর বুক জ্বলে বুঝি? হা হা হা, তা তুই মরতে ওখানে এসেছিলিই বা কেন লা? ও পাড়ের জঙ্গলে পুরুষও কেউ পা দেয় না। কাজেও না অকাজেও না। তুই কেন...লুককে ছেল না কি কেউ? গোপন আশিক তোর? শুয়ে আছে বুঝি এখনও? দেখি দেখি।
ফের ঝুঁক মারে আনার। উল্টে ঝুঁকে ওর ভেজা বুকেই নিজের চেটো দিয়ে আলতো ঠেলা দেয় বউটি।
- রঙ্গ কোরো না তো বাপু, শুয়ে আছে না ছাই, ওসব ভাগ্যে নেই। মাঝ রাতে গলা অব্দি গিলে ঘরে এসে আমারে ধামসায় তো ওই এক ফেনীর বাপ, স্বামী আমার, সারাদিনের হাড়মাস পেষা খাটনির ভারে চোখ তখন আমার উপর পাতা নীচের পাতা আঠামাখা হয়ে থাকে, কী হয় কী রয় ওসব বোঝার ক্ষমতাও থাকে না, ইচ্ছেও যায় না। নিজেরে খুলে দিতে হয়, স্বামী বলে কথা তাই...প্রেম পিরিতি নাই। সে যাক গে, এসেছিলাম তলপেটের ভার নামাতে গো। সময়ে না নামালে ভিজে যাবে সববসও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই।
- মানে? তুই...
- হ্যাঁ, পেচ্ছাপ করতে এসেছিলাম। ওই ছোট বউ ওঁদের বাদরুমে ঢুকতে দেয় না গো। নোংরা করে দেব এই ভয়। এদিকে আমার গভ্যে ফেনীর জন্মের পর পরই আরেকটা ফুল এসেছিল তো, সেটা পেটখালাস হওয়ার পর থেকেই বারে বারে পায় আর একটুও ধরে রাখতে পারিনা বেগ এলে। তাই বেছেবুছে রেখেছি ওই কচুঝোপ। দুপুরে তাঁদের পাতের কাঁটাছিবড়ে পুকুরে ফেলবার নাম করে ছুট্টে এসে সেরে যাই। হি হি হি।
- বাহ! ভারী বুদ্ধি করিছিস তো!
- সে বুদ্ধি আমার একটু বেশিই। এই ধরো না কেন, আজ জল খরচে একটু বেশি নড়েছি তাই ঠাহর পেলে আমায়, নইলে আমি যে রোজ এসময় কাজ সারতে এসে তোমার নাওয়া দেখি সে কি উমান পাও তুমি?
এবারে সত্যি অবাক হয় আনার। বলে কী মেয়েটা!
- আমার নাওয়া দেখিস! তুই! কেন?
- ভালো লাগে। তাই। জল কেটে এগোও, দাবনা ভারে ডুবে থাকে, গোছের উপরের পা থেকে একেবারে পাতার আঙুল অবধি ঘাই মারে ভারী জলে, কিন্তু চলকে ওঠে না জল, গুম গুম ডাক ছাড়ে কেবল। নতুন বউ পায়জোর পরে বুকে ঠোন মারলে অমন ঘাই ডাক ছাড়ে পুরুষে। আমি জানি।...মানে শুনেছিলাম...
তুমি জলে উল্টে চল যেন রাজহাঁস এগোয়, ডুব দিয়ে মুখ জাগলে পানকৌড়ির চিকন গলা জেগে ওঠে। চিৎ সাঁতার দিলে মনে হয় আড়াইমনি গতরে পাকা রুই ভাসছে।
লাজ নেই। শরম নেই। কী ঢাকা কী আঢাকা খেয়াল নেই। আসলে এসময় হয়তো কাউকে দেখতেও চাও না এসব কাউকে দেখাতেও চাও না। নিজের খেয়ালে চান কর। আমার কেবল মনে হয় তুমি নিজেরেই আদর কর।
ভাল লাগে দেখতে। ভরাভরা লাগে আমার মাথাটা, গলাটা, বুকটাও।
এমন পারা আমার হাল, তবু তো দুয়োজনাই মেয়েছেলে, জলের হাল মনে ভাবি আরও খারাপ! জল যেন তোমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ায়ে ধরতে চায়, খুব চেষ্টাও পায়, কিন্তু ধরতে পায় না, তুমি জাহাজের মত এই ভাসও এই ডোবও, পুরো ডুবে যাও না। কী আর করা, চোখটাটানি জমে জমে তার গা সবুজ হয়ে যায়। জলের গা হিংসে সবুজ।
হি হি হি।
নেশা হয়ে গেছিল দেখতে দেখতে। আজ ধরা পড়ে গেলাম।
- বউ, তুই তো বেশ ভাবের কথা বলতি পারিস! একটু সরে আয়... আরেকটু আয়...নাম কী রে তোর?
- রাসু আমার নাম গো। রসময়ী মণ্ডল। আমার ঠাকমা রেখেছিল নামখানা। তা এ গোটা নাম ধরে আর কে এখন ডাকে বল, শউর ঘরে সবই ঐ হারাণের ছোট বউ নয়তো ফেণীর মা।
- ছোট বউ? বড় বউ আছে?
- নেই, দিদি ভাগ্যিমান্যি, মানে মানে সোগ্গে গেছে। জ্বলতে টেনে এনে থুয়ে গেছে আমারে। তিন বছরের সংসার ছিল মাত্ৰ, বিয়োইনি একটাও। একটু রুগ্ন মতোই ছিল বলতে পারো, মরে গেল। অবশ্য অমন এক কুড়লী চড় খেলে আমিও তক্ষুণি ফট করে সোগ্গে চলে যাব। তা আমার বাপু বাঁচার বড় শখ। হুট বলে মরতে রাজি নই আমি। ওই যে বললাম, জ্বালা তো ষোল আনাই আছে, কিন্তু ঐরই মধ্যে সরে সরে থাকি, চুপ থাকি, যতটা পারি। মারধোর খেয়ে অকালে প্রাণ খোয়াব কেন? বরং সুযোগ মিললে আমিও হাঁটা দেব।
- হাঁটা দিবি?
- নয়তো কী? বাপ নেই, কাকা এক বউ খুনী জুটিয়ে ঘাড় থেকে নামিয়েছিল বলে এই দেড় কুড়িরও বড় রাক্ষুসে চণ্ডাল বরের ঘর করব না কি চিরকাল??? মানুষ তো নয়, মাস-খেকো জানোয়ার।
- আর ফেণী?
- ও মা রে! ওরে ফেলে যাব ভাবলে? যেখানেই যাই, কোলে বাঁধিয়ে নিয়ে যাব। কিচ্ছু বিশ্বাস নেই, যা জানোয়ার বাপ, প্যাকেটের ঘোরে কোন সময় মেয়েটারেই ছিঁড়ে খেয়ে রাখবে। আমারে একটা সাঁঝও রেহাই দেয় না তা জানো তুমি?
- তোর নাগর তোরে নেবে, কাঁখেরটারে নেবে জানলি কী করি?
- ওমা আমি ক'নে যাব! তুমি কী ভাবলে আমি আশনাই করে ঘর ছাড়ব? মর মর। সাপকে বিশ্বাস যাবে তবু তেলো ঘষা সম্পক্কের মদ্দামানুষকে বিশ্বাস যাবে না। এই বলে দিলাম। অনেক ঠেকে শিখেছি দিদি। সরাসরি যে শরীরের দিকে চোখ রাখে সে তবু মন্দের ভাল। মনকে চোখ ঠারিয়ে কাজ নেই, এ একরকম ধরো তোমারও কাজের তারও কাজের সম্পক্ক, কিন্তু যে মনের গুণ গেয়ে ঘুরপথে সিঁধোবে, আসল ঘুণপোকা সেইইইই।
- আল্লাহ্! এই ছুঁড়ি তো আলেম একসের। নানীমা আমার। কয়জন এসিছিল সিধে? ঘুরপথেই বা এসিছিল কয়জনা?
- হি হি হি। তবে এ এ এ? সে তো এক ঝুড়ি কেত্তন। যাক, তোমার গল্প বলা হবে তো এইবার, না কি?
- সেই থিকি নিজির বকবকানি চলল, এখন আবার আমারটা শুনতি চাস, বলি তোকে আটকে রেখে তাদের কাজের ক্ষেতি করছি বলে দত্তদের ছোট বউ আঁশ বটি নে আমারে কাটতি আসুক, এই কি খোয়ায়শ তোর?
- ইশ রে, কাটতে আসুক দেখি, থোতা মুখ ভোঁতা করে দেব না! সব কাজ সেরে, তবে নিজের কাজ সারতে এসেছি, বুঝলে? হাওয়াই মেঠাই গতরে সে কাজের সিকি আনা করে নিক তো বুঝি। কেবল যত নিজের আনাচ কানাচ ভাঁজ খুলে ঘুরে চড়ে ভাজেদের চোরা ঘাই দিতে জানে ও। অবাক হয়ো না। মুখ খুললে রাসু রেয়াত করেনা, হ্যাঁ!
তোমায় বলে আমি কতদিন দেখি লুকিয়ে লুকিয়ে, কারণ শুধিয়ে লাভ নেই, বলতে পারিনা, আজ আলাপ যখন হয়েই গেল, তোমারে ছাড়ছিনা। শুনবই গল্প।
- লুকিয়ে লুকিয়ে...হা হা হা! এলেন যেন আমার আশিক, মাশুকা আমি তোর! মরণ।
ছাড়ান দে বুইন, আমি তোর মত ময়না হয়ি তো আর জন্মাইনি যে ঘণ্টাভর বকরবকর করব, সে ভিন্ন জীবনে আমার গল্পও সেরম কিছু নেই রে।
ফেণীর মা...ও ফেণীর মা...
- সব্বনাশ করেছে! দত্ত গিন্নি ডাক পাড়ছে শুনতে পাচ্ছ? ঝাঁপান জোড়ো, ঝাঁপান জোড়ো। ও বুড়ি ছিনে ঝোঁক একেবারে। চিলের মত খুবলে নেবে এক্ষুণি আমারে। কোনও ওজর কানে নেয় না। ঝাড়া দুই ঘণ্টা মাজা ডলো রে পিঠ ডলো রে গোছ ডলো রে চলবে। বলি অতই যখন বেদনা... আরে হাসছ কী! আগে ঝাঁপাও। কোনও অসভ্য কথা বলছি না। ডাক্তার বৈদ্যি দেখানোর কথাই বলতে গেছিলাম।
মাছ খায় সব ডেনো, দোষ পায় মাছরেঙও।
- পারিসও বটে! বেশ, তা জলে পড়ব কেন রে?
- আরে ভিজে গায়ে তো আর ঘরে বসাবে না আমায়। রেহাই পাব। ভাসতে ভাসতে বাকি গল্প। নামো তো...
ঝাঁপান জোড়ে রুয়েতে-কাতলে। জোড়া ঘাই ওঠে থিতিয়ে আসা জলে। খলবল করে জেগে ওঠে চাপা পড়া তেষ্টা।
এক পুকুর জলের এক সমুদ্দুর তিয়াস।
...
ওরা খানিক ঝাঁপাঝাঁপি করে নিক এই ফাঁকে আমি সেই দু কথা কয়ে নিই দত্তদের ছোট বৌয়ের মনের গহীনে যাদের চোরাবাস। অদ্ভুতুড়ে নারী এই দত্তদের ছোট বৌ। চূড়ান্ত তীক্ষ্ম অত্যন্ত ঝাঁঝ, দিবারাত্র গমকে ঠমকে গর্জে চলেছে ধারালো এক নিরুচ্চার বলনে, কিন্তু বিবাহ বার্ষিকীর রাত ঘন হলে গজরার জুঁই নাকে মুখে চেপে ধরে কাপড় পরার ঘরে সেই দিনভরের গজরানো কতখানি ডুকরে ওঠা হয়ে ভেঙে হাজার টুকরোয় চুরমার হয় সে খবর কাকপক্ষীতেও মালুম পায় না। চিলেকোঠায় প্রতিদিন কাঠ দুপুরের আলো আঁধারীতে উপুড় শুয়ে তার গুমরে ওঠা জানতে পারে না পরিবারের একজনও। তারা জানে এটাই যে নির্দিষ্ট সময়ে ছোট বৌকে ঢুকতে ও বেশ কয়েকটি ঘণ্টা থাকতে হয় সে ঘরে। সে শিল্পী, ওটা তার আঁকার ঘর। যে ঢোকে আর যে বেরোয় তার সঙ্গে যে থাকে, সময় কাটায়, সে মেয়ের হাজার যোজন তীব্র ফারাক বহিরঙ্গে। অন্তর কথা বলব, কিছু পরে। আপাততঃ সেও দেখছে কি না এদের, চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে। দুই উচ্ছ্বল নারীর অবগাহনের উচ্ছ্বাস কী ব্যক্তিক ঢেউয়ে ভাসাল তাকে শুনে নিই পাঁজরে মন ছুঁইয়ে!
– জলের সাথে আমার ভারী ভাব।
সে হ্যান্ডপাম্প বা মিউনিসিপালিটির কল থেকেই পড়ুক আর ডোবা পুকুর নদী খাল বিল সমুদ্দুর জুড়েই থাকুক।
খলখল ছলছল চলনটা বেশ লাগে আমার। ঘোর লাগে ছন্দে।
প্রতি অনুপলে প্রমাণ করে আছাড় পিছাড় যাইই খাক, খুব একটা যেন জম্পেশ রকমে বেঁচেবর্তে আছে সে সর্বদাই।
আমাকেও ওসকায়। ওরে বাঁচ, কেবল বাঁচ। মৃত্যুময় ঘোলাটে পরিপার্শ্বে স্রেফ বেঁচে আছি এইটাই দারুণ এক বাম্পার লটারী জেতা প্রত্যেক পলে দাঁড়িয়ে।
নুনে মরিচে তিতায় মিঠাসে আপাদমস্তক জড়িয়ে জারিয়ে জীবনকে সাপটে বাঁচার ফুসমন্তর দেয় জল।
এত্তো ভালোবাসি তাই জলকে।
সেজন্যই হয়তো জলের গতিপ্রকৃতি ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার রকমসকম নিয়ে পর্যবেক্ষণে আমি নিরন্তর ক্লান্তিহীন।
এই যেমন ধরো না কেন, নলের মুখের তলায় বালতি রেখে কলের চাবি ঘড়ির কাঁটার চলনে ঘোরালেই এক্কেবারে প্রথমে ছ্যন ছ্যন ছ্যন ছ্যন করে আওয়াজ হয়। আমার কেবলই মনে হয় ওটা অন্যথায় অপারগ অথচ পরেচ্ছাধীন সমর্পণের বিরক্তিজাত অভিব্যক্তি। দজ্জাল মায়েরা নিমবেগুন মাখা ভাত মুখে ঠুসে দিলে তা চেবানোর আগে ও ফাঁকে খোকাদের মুখেচোখে যে আওয়াজ ছিটকিয়ে গোঁঙায়, এক্কেবারে সেইরকম।
আবার যদি প্রেক্ষিত পাল্টাই তবে কেমনভাবে বদলায় সে ভাবা যাক? পুকুরে বা নদীতে ঘটি বা কলসী ডোবালে কেমন গুবগুব গুবগুব শব্দ হয়, সবারই কমবেশি চেনা। কলসী ঘটিরাম টানে এই সাড়া কেমন যেন সেই বেশ শরতবাবুর সতীসাধ্বী অমুক অঙ্গনাদের দ্বারা নবকাত্তিক ন্যাকাচৈতন দেবদাসদের পাখার বাতাস সহযোগে আকণ্ঠ খাইয়ে নিজেদের গলা বেয়ে উঠে আসা তৃপ্তিসূচক "পেট ভরালো? আরেকটু মাছ দি?" রকমের ভরন্ত ভরন্ত লাগে। যেন জলের মাথার ভিতরটা পুরে পুরে আসে, ভরে ভরে ওঠে, শূন্যতাকে পূর্ণতা দেওয়ার প্রক্রিয়ায়।
এইসব পৌনে-ছিটেল ভাবনা-জঞ্জাল শোনানোর সাহস একমাত্র জল ছাড়া আর কারোকেই নেই আমার। ...
...সেই আনতাবড়ি আলাপসালাপ জুড়তে, মনপরাণের খানকতক ইচ্ছে খুশি সাধের কিস্যা বলতে মাঝেমধ্যেই জল সময় সুযোগ দিলে গিয়ে বসি আমার চৌহদ্দির মাঝে তার ডেরায়।
এইবার প্রশ্ন উঠতে পারে জল কেমনে সুযোগ দেয়?
কেমনে বুঝি তার গল্প করার মন?
ঠারেঠোরে ইশারায় জানান দেয়।
কখনো কখনো পুকুরে জলের দিকে চাইলে দেখবে সে জমাট থকথকে পিত্তিসবুজ ঘিলুহলুদ মতো থমথমে চেহারাটা নিয়ে ঘাড়মোড় গুঁজে পড়ে আছে। সেসময় খবরদার তার সাথে খেজুরে জুড়তে যেয়ো না। ঘাড় ধরে বিদেয় দেবে। বেশী খেপে থাকলে দুই এক ডুবচুবুনিও দিতে পারে কিন্তু, সাবধান।
আসল কথা বলি, সে চুবুনি দেবে না, তুমি কিনা নিজেই নিজেকে চুবোবে ধরে ধরে। ডিপ্রেশনের আখড়ার দোর খুলে ভিতরে সেঁধোলে ডিপ্রেশনের আগ্রাসী থাবা তোমাকে কেন ছাড়বে বলো দেখি গো ভালোমানুষের বিটি-ছ্যল?
তাই বলছি, ওই ঘ্যানঘ্যানে ঘনালো সময়ে যেয়ো না তার কাছে।
যখন দেখবে ছিলিক ছিলিক কাঁচ-ফেরা আলো চলছে ফিরছে তার দীঘল শরীরে, গুমসুম ঘাই দিচ্ছে মাছের মন্ডল, কচি কচি ঢেউতোলা হয়ে ডাক আসছে ছলাত্ ছল ছলাত্ ছল ওলো সই গল্প বল, তখন যাবে। বুঝলে?
দেখেছো তো কেমনপারা অভিজ্ঞ লোক আমি জলের ছলাময় ভাবসাব বোঝায়? আরে একি এক দুইদিনের দোস্তি নাকি হে? সেই হামাগুড়ি বেলার আগে থেকেই না সখ্যতা।
এই যেমন তেলে মশলায় জারিয়ে আচার বড়ি আমচুর রোদে দেয়, আমাদের ছোটোবেলায় বাচ্চাদের অমন তেলে দলেমলে রোদে দিতো। বারান্দা ছোঁয়া উঠোনে শোয়াতো ছেঁচতলায় মুখচোখ ছায়ায় রেখে।
একপাশে রোদ্দুরে বসে থাকতো দুব্বো দেওয়া এক গামলা জল, স্নানের জল। আরেকপাশে টগর আর কাঁঠাল গাছে গোড়ার খানিকটা নিচে দিয়েই ভরাভারা গতরের এক পুকুর জল। সেই তখন থেকেই আলাপচারিতায় মজে থাকা দুজনের।
সেতো আজকে নয়।
এই হচ্ছে আমার বদভ্যাস। ধান ভাঙতে বসে বীজতালা তৈয়ের গল্পঝুলি খুলি।
যা বলেছিলাম, অভ্যেসমতো আমি তো গিয়ে বসলাম সেইদিন তার কাছটিতে।
দেখি রাজ্যের সেগুন কাঁঠাল জারুল পাতারা চার পাড় থেকেই হুড়মুড়িয়ে সাঁতারে নামছে আর ভেজা হাওয়ার ছিটে লাগা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুপসে যাচ্ছে।
কারা মনে হয় ঘাটকাজ করে গেছে, কালো কাঠ মালসা কলাপাতা চাল কলা ইত্যাদি শ্রাদ্ধানুষঙ্গ ছিটিয়ে আছে ডানহাতে দুহাত ব্যাসের এলাকায়।
বাঁ দিকের কোণে মেশা পাড়ে আবার পরিবারে বিয়ের পরে ঘাটকালী পুজো সেরেছে কেউ। পান সুপুরী কলা বাতাসা প্যাড়া আধডোবা মিশছে জলে।
কেমন যেন ছমছম করে উঠলো পিঠের পেশীগুলো।
একদিকে নিকটজনের যৌথ যাপনের শুরুয়াৎ এ ঈশ্বরের আশীষ প্রার্থনা আরেকদিকে আত্মজনের জীবনান্তে তার একাকী অজানা অচেনা পথ চলায় কিছু পাথেয় কিছু সুরাহার প্রার্থনা, ওই ঈশ্বরেরই কাছে।
এই দুই মেরুফারাক ভবিষ্যৎ আকাঙ্খার মাঝে খেজুর কান্ডের সিঁড়িতে বসা আমি যেন ভূতগ্রস্থ বর্তমান। আমার সামনে জলের অবয়বে শুয়ে আছে অনাদি অনন্ত অতীত।
ডুব ডুব ডুব কতো ডুববে তুমি?
তল মেলে না।
যন্ত্রণা মেলে কেবল।
ভয় করছে জল। বড্ড ভয়। নিজেকে অজানা অন্যতর আগামীর পাথারে একলা বড়ো একলা বেহাল বেভুল পথহারা ঠাহর হচ্ছে। কি ছিল এ পথের শুরুতে? কী আছে এ পথের শেষে? কে আছে? কারা আছে? আমি এতো একলা!!!
– কী গো, এতো কী ভাবছো? মনে আছে তোমার সেই প্রথমবারে সমুদ্রসৈকতে দাঁড়াবার আগে তুমি চঞ্চলা পায়ে ও মনে আমায় এসে শুধিয়েছিলে, "সমুদ্র কেমন গো জল? সেখেনে কতো জল? এই পুকুরের কয়শো গুণ মোটা সে?" আমি উত্তর করেছিলাম, "বলবো কেন? দেখে এসো গে। ছুঁয়ে ছেনে। নিজের দেখা সে যে এক্কেবারে নিজেরই হয় গো। সুযোগ না মিললে অপরের চোখে দেখার স্বাদেই আহ্লাদী হতে হয়, কিন্তু এখেনে যখন সুযোগ আছে নিজেই নেড়েঘেঁটে দেখে নাওগো বাপু।"
জানি তুমি ঠোঁট ফুলিয়ে ট্রেনে চেপেছিলে কিন্তু সত্যি বলোতো, পরের মুখের ঝালে কি আদতেই অতো আস্বাদ থাকতো যতো তোমার নিজের চেখে দেখায় পেয়েছিলে?
আজও সেই একই কথা বলছি।
ভয় কিসের সই?
লোকমুখে গড়ন গঠন এক সমাজচলতি ভাবনায় এতো নির্ভরতা কেন?
জীবন সেইটুকুই যেটুকু তুমি বাঁচছো। স্বেচ্ছাধীন স্বযাপনে সমগ্রে অথবা অপরযাপনে অংশী হয়ে। বাকি ভবিষ্যে কে হবিষ্য করলো আর কে মৌরীয় গিললো তাতে তোমার কাঁচকলা! যতোটুকু সইয়ে নিতে পারবে ততোটুকু রইয়েই থাকো না বাপু।
ভেঙে যাওয়া আয়নাও মুকুর সই, একটু আগুপিছু করে নিলে মুখ তাতেও ভাসবে। সুন্দর জাগবে।
কে বললে একলা? তোমার তুমি যে আছো!
প্রত্যেকটি বাঁচার একেকখানি নিজস্ব আঙ্গিক থাকে। সেই নিজস্বতা বড়ো মহার্ঘ্য উপলব্ধি সই, তাকে বিকিয়ে দিয়ো না। বাকি যা হবে জাষ্ট দেখে নেবে। কেমন?
খলবলিয়ে হেসে উঠলাম দুটিতে।
– বলো দেখি এইবার তোমরা, এই উৎপটাং ঊণপাঁজুরে আদানপ্রদান কার সাথে হয় জল ছাড়া!
জীবনের আদিতম ধারক।
এই যেমন ধারণ করে আছে ঐ দুই প্রান্তিক নারীকে, ঐকান্তিক আদরে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।