অঙ্কে যত শূন্য পেলে
প্রবুদ্ধ বাগচী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পর্ব ৭
‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’ কাহিনির এই সাত নম্বর পর্বে শেষ হয়ে যাবে মাধ্যমিক স্তর অবধি গণিতের আখ্যান। ইতিমধ্যে অনেকগুলি এপিসোডে ধরা পড়েছে অঙ্কের অনেকগুলি বিষয়ের সঙ্গে আমার আন্তঃসম্পর্ক, আমার নির্বুদ্ধিতা, আমার আক্ষেপ। ব্যক্তিগতভাবে এইসব আলোচনার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, জানি —-- আমি এমন কিছু কেউকেটা নয়, তাই আমার দু-আনা-চার-আনা জীবনের গপ্পো শুনে কারোর কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু গণিতের মতো একটি বুনিয়াদি বিষয়ের সঙ্গে আমার প্রেম ও অপ্রেম আসলে হয়তো আরো অনেকেরই জীবনের গোপন অন্দরে বাসা বেঁধে আছে। এটা ঠিক যে অন্তত আমাদের দেশে, পড়ুয়াদের সব থেকে ভয়ের সাবজেক্ট হল অঙ্ক আর সেটা একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসের যে বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়েছিল বলে তিরস্কৃত হয়েছিল, ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ যে একদিন সেই বুরুনের হাত ধরে গণিতের তরণী পার করে দেবে কে জানত ? অঙ্কের ভয় নিয়ে এমন মনোরম উপন্যাস বাংলার আর দুটি পড়েছি বলে তো মনে হয় না। কিন্তু আজও ইংরিজির মতোই ছেলেমেয়েরা অঙ্কেও ভয় পায়, কেবল ফেল করে, বুঝতেই পারে না তার মাথামুন্ডু। কেন এমন হয় ? গণিতে তো যুক্তিই শৃঙ্খলা, সেই ব্যুহ ভেদ করতে পারলে যুক্তি তার নিজের স্রোতে ভেসেই পৌঁছে দেয় উপকূলে। তবে কি এই যুক্তির বোধ তৈরি করে দেওয়ার পথটাতেই কোথাও ভুল থেকে যায়। আমার শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবে এটা কক্ষনোই মনে হয় না বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় ‘গোবর-পোরা’ বলেই তারা অঙ্কে কাঁচা থেকে যায়; বিশেষত, অঙ্কে ‘পিছিয়ে-পড়া’ বলে ছাত্রীদের একটু বাড়তি বদনাম আছে । মেয়েদের অঙ্কের ‘মাথা’ থাকে না, এই আজব উপপাদ্য কোনও প্রামাণ্য সমীক্ষা থেকে গড়ে উঠেছে বলে আমার মনে হয় না, সেটা সম্ভবও নয়—- শারীরিক গঠনে ভিন্নতা থাকলেও বুদ্ধির বিচার বা যাকে বলা হয় কগনিটিভ এবিলিটি তাতে নারীদের পিছিয়ে থাকার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আসলে এগুলো একেকটা ভুল সামাজিক নির্মাণ। যেখান থেকে এদেশে আধুনিক শিক্ষার বিকাশের সময় শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে প্রচার করা হত, মেয়েরা পড়াশোনা শিখলে স্বামীহারা হবেন। আর বেথুন সাহেবের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে যখন বাড়ির বালিকারা ঢাকা ঘোড়ার গাড়ি করে পড়তে যেতেন, বিদ্যাসাগর মশাই সেই গাড়ির গায়ে নিজের খরচে ছবি এঁকে লিখে দিয়েছিলেন, নারীশিক্ষায় শাস্ত্রের কোনো নিষেধ নেই। তবে আধুনিক বিজ্ঞান-শিক্ষায় যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে গোড়ার দিকে মেয়েরা পিছিয়ে ছিল সামাজিক অবদমনের জন্যই। নিজের চেষ্টায় ডাক্তারি পাশ করা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় চিকিৎসকের অনুমোদন পাননি এই কারণেই। আলাদা করে গণিত নিয়ে না হলেও সাধারণভাবে মেয়েরা বিজ্ঞানশিক্ষায় আসতেন কম। ইতিহাসের তথাকথিত ‘হিন্দু সুবর্ণযুগ’ বলে যা অভিহিত হয়, সেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের মহিয়সী গণিতবিদ খনা-র যে জিভ কেটে নেওয়া হয়েছিল, জানি না সেই ট্রমা আজকের নারীও তার রক্তে বহন করেন কি না।
কিন্তু এই আখ্যান তো নিজের অভিজ্ঞতার ভিতর থেকেই উঠে আসা, তাই বারবার মনে হয় একদম প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে যেখানে গাণিতিক বোধ ও চেতনার নির্মাণ হয় সেই গোড়ার জায়গাটাতেই কি শিক্ষকদের খামতি থেকে যায় কোথাও ? কীভাবে গণিত শেখানো হবে বুনিয়াদি স্তরে, এটা নিয়ে কি খুব সদর্থক ভাবনা কোনোদিন হয়েছে ? বিদেশি ভাষা হিসেবে নতুন পড়ুয়ারা ইংরিজি শিখতে কতটা অসুবিধের মুখোমুখি হবে, কীভাবে ইংরিজির ভাষাশিক্ষায় বৈচিত্র্য আনা যায় এসব নিয়ে কিন্তু প্রচুর আলোচনা ওয়ার্কশপ হয়েছে এই রাজ্যেই। ব্রিটিশ কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞরা বসে ইংরিজির মাস্টারমশাইদের সঙ্গে কথা বলেছেন, নতুন নতুন সব মডিউল বানিয়েছেন এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুল থেকে স্কুলে। বলা হয়েছে ইংরিজির ‘আনন্দপাঠ’ বা ‘জয়ফুল লার্নিং’- এর কথা —--- এই ‘জয়ফুল লার্নিং’ কেন প্রয়োগ হবে না গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রেও ? কোথাও হয়েছে কি ? যতদূর জানি, কলকাতায় একটা ‘ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’ আছে যারা গণিত নিয়ে চর্চা করেন —- তাঁরা কি কোনোদিন বুনিয়াদি গণিত-শিক্ষার পদ্ধতি ও প্রকরণ নিয়ে ভেবে দেখেছেন ? তাদের কি মনে হয়নি, ‘অঙ্কে মাথা না-থাকা’র মতো একটা অবৈজ্ঞানিক ধারনা দিয়ে গণিতের শিক্ষকরা তাদের নির্দোষ পড়ুয়াদের গায়ে লেবেল সেঁটে দিতে পারেন না ! অঙ্কের ভয় আবহমান কাল থেকে কেন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে একটা ‘মানসিক ট্রমা’ —- এর কোনো ব্যাখ্যা থাকবে না ? থাকবে না কোনো নিরাময়ের আশ্বাস ? এরই মধ্যে উল্লেখ করা দরকার, ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ইম্প্রুভমেন্ট অফ ম্যাথমেটিক্স টিচিং’ শিরোনামের একটি সংগঠনের কথা —- এঁরা এই বিষয়ে কিছুকাল আগে একটি আলোচনা সভা আয়োজন করেছিলেন (‘কলকাতার কড়চা’ আনন্দবাজার পত্রিকা ২১ অক্টোবর ২৩)। তাদের কাজের বিস্তৃতি নিয়ে আমাদের কোনো ধারনা নেই। তবে প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। হ্যাঁ, এইসব প্রশ্ন আমাকে ভাবায়। কারণ অঙ্কে ‘শূন্য’ পাওয়াটা কোনো পড়ুয়ার নিয়তি হতে পারে না।
ক্লাস নাইন-টেনের আর একটা বিষয় উল্লেখ করে গুটিয়ে নিতে হবে আখ্যান। সেই বিষয়টা হল, গ্রাফ যা যুক্ত হয়েছিল আসলে বীজগণিতের সঙ্গে। ব্যাপারটা বীজগণিতের মধ্যে হলেও যেহেতু এগুলো করতে একটা আলাদা আয়োজন লাগত ফলে আকর্ষণ ছিল বেশি। গ্রাফ পেপার কাকে বলে, কীভাবে সেখানে বীজগণিতের সমীকরণের নানা মান (ভ্যালু) লিখতে হয়, কেমনভাবে টানতে হয় বিন্দুগুলির সংযোজক সরলরেখা তার সবটুকুই ছিল আনকোরা। পরে জেনেছি, শুধু সরলরেখা নয়, বৃত্ত, অধিবৃত্ত ( প্যারাবোলা) পরাবৃত্ত (হাইপারবোলা) বা উপবৃত্ত (এলিপ্স) সবই গ্রাফের মধ্যে ধরে ফেলা সম্ভব —- সে আরো গভীর বিস্ময়ের দুনিয়া। তবে মাধ্যমিকস্তরে সরলরেখার ধারণাটুকুই ছিল সম্বল ও সিলেবাসের অন্তর্গত। তার আগে জেনেছিলাম অক্ষ বা অ্যাক্সিস কাকে বলে, সেও নাকি দুটি অসীম অবধি বিস্তৃত সরলরেখা, যা লম্বভাবে কাটাকুটি করেছে নিজেদের ভিতর। তারই অনুভূমিক বা হরাইজেন্টাল অক্ষ হল এক্স-পক্ষের আর উল্লম্ব বা ভার্টিকাল রেখাটি হল ওয়াই-পক্ষীয়। এখানে ‘হরাইজেন্টাল’ শব্দটি কেমন মনকেমন-করা দূর-সঞ্চারী তা কি আমরা খেয়াল করলাম ? ‘হরাইজেন’ মানে তো দিগন্ত —-- সুদূরের হাতছানি তার সমস্ত শরীরে মাখামাখি হয়ে আছে আর একটি নিঃসঙ্গ সরলরেখা চলেছে তার অভিমুখে —- কী অসম্ভব উদাসীন একটা ভাবনার সঞ্চার হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে ! আর উল্লম্বের পক্ষটিও তো ভূমিতল থেকে উঠে গেছে ওই আকাশের নিঃসীম শূন্যে —- মেঘের সঙ্গী হয়ে মন যেখানে উড়ে যেতে চায় আর আর্তি জানায় ‘মোর ডানা নাই / আছে এক ঠাই/ সে কথা যে যাই পাশরি’ । এই হল গ্রাফের মর্মকথা। আর এই দুই নিঃসীম রেখা যেখানে এসে একবারই মাত্র কাটাকুটি করে বা ছেদিত হয় সে হল এক পরম মিলনবিন্দু। সেই বিন্দুর নাম কেন্দ্র হতে পারে, গণিতের ভাষায় অরিজিন (origin) হলেও আপত্তি নেই তবে তার স্থানাঙ্ক হল শূন্য —- অর্থাৎ ওই বিন্দুতে এক্স বা ওয়াই এর কোনো মান নেই, দুজনেই শূন্য। শূন্য কথাটার মধ্যে স্থান কাল ও পাত্রের একটা ব্যঞ্জনা আছে, আছে একটা মূল্যমান বা ভ্যালু। ওই মূল্য দিয়েই বুঝি ৫ সংখ্যাটা কেন শূন্যের থেকে বড় আবার মাইনাস ৫ কেন শূন্যের থেকে ছোট। কিন্তু শূন্য মানে আরও কিছু। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মণি ভৌমিক তাঁর ‘কোড নেম গড’ বইতে প্রশ্ন তুলেছেন, ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আদিতে যদি স্থান ও কালের শুরুয়াত হয় তাহলে তার আগের অবস্থাটা কী ? শূন্য না প্রাক-শূন্য? এগুলো আরও জটিল ব্যাপার, সহজে মাথায় ঢোকার নয়। কিন্তু গ্রাফের একেবারে কেন্দ্রে ওই বিন্দুটি যার চারিদিকে অক্ষদুটির বিস্তার তা নিতান্ত ফেলে দেওয়ার মতো বিষয় নয় এটা গোড়াতে আমাদেরও মনে হয়েছিল। তাছাড়া পরের স্তরের গণিতে এই কেন্দ্রকে সুবিধামতন বদলে নেওয়ার একটা কিছু ব্যাপার ছিল বলে মনে হচ্ছে, shifting of origin বা ওইরকম কিছু একটা হবে বোধহয়।
আবার অন্যদিক দিয়ে গ্রাফের অক্ষ বিষয়ে আরেকটা গাণিতিক ব্যাখা হল, আসলে এই অক্ষগুলি আর কিছুই নয় একটা সরলরেখা একটা কেন্দ্রবিন্দুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে তৈরি করে চলেছে কোণ —-- প্রথম সমকোণ মানে ফার্স্ট কোয়াড্রান্ট ( এই শব্দের অর্থ হল চারভাগের একটি খন্ডাংশ), আরো একবার ঘুরলে দ্বিতীয় কোয়াড্রান্ট, এইভাবে আরও দুবার ঘুরে রেখা ফিরে আসছে তার যাত্রাবিন্দুতে আর ইত্যবসরে সে বুনে দিয়েছে তিনশো ষাট ডিগ্রির একটা সঞ্চারপথ —- যা আবার পরে কাজে আসবে ত্রিকোণমিতির —-- কোণের মাপ অনুযায়ী ঠিক হবে তার সাইন বা কোসাইন বা ট্যানের মান। তবে, টেবিলের ওপর বিছিয়ে ধরা গ্রাফ পেপারের দিকে তাকিয়ে দুটি বিস্ময়ের কথা আজও বেশ মনে পড়ে। এই যে খোপ খোপ করা ছাপা কাগজ এর মধ্যে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সব বিন্দু, তাদের খোলা চোখে দেখা যায় না বটে, তবে যেই বীজগাণিতিক সমীকরণ ফেঁদে তাদের মান বার করা হয় অমনি সাদা গ্রাফ পেপারের মধ্যে ফুটে ওঠে ওইসব অদেখা বিন্দুদের অস্ফুট আদল । ঠিক যেন মন -খারাপ -করা বিকেল পেরিয়ে স্তিমিত হয়ে এল দিনের আলো আর, দূর আকাশের বুকে ফুটে উঠছে একটি দুটি নক্ষত্রের বিন্দু । আর তারপর ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে’ বলে কেউ ফিসফিস করে উঠল কানের পাশে । এরই সমান্তরালে কোথাও কি কথা বলে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ ?
তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে
ফিরে গিয়ে ছাতে
মনে হল আকাশপানে চেয়ে
আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে
নীলাম্বরের আঁচল্খানি ঘিরে
দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চলছে ধীরে ধীরে। (হারিয়ে যাওয়া, কাব্যগ্রন্থ ‘পলাতক’ )
গ্রাফ পেপারের ওপর ছড়িয়ে থাকা সেই বিন্দুগুলির ঠিকানা কোথাও যেন মিশে যেতে চায় আমারই অস্তিত্বের বাকলে আর পাতায়।
গ্রাফ নিয়ে দু নম্বর ‘অবাক-আলোর লিপি’ হল সমীকরণের মধ্যবর্তিতায় কিছু অনিবার্য সম্পর্কের নির্মাণ। বিষয়টা একটু বিশদে বলি। ধরা যাক, একটা একঘাত সমীকরণ বা লিনিয়ার ইকুয়েশন ( একঘাত মানে তার চলরাশিগুলির সব থেকে বেশি ঘাত ‘এক’ অর্থাৎ এক্স স্কোয়ার বা এক্স কিউব নয় শুধু এক্স ) চলরাশিগুলির ( এক্স / ওয়াই ইত্যাদি) একটা বিশেষ সম্পর্কই আসলে সূচিত করে। মূলত এই সমীকরণ মানে আসলে একটা সরলরেখা, যা পরে বিশদ জানা যাবে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি পড়লে। কিন্তু যেই আমরা একটা সমীকরণ খুঁজে বের করলাম, ধরা যাক সেটি ফাইভ এক্স + থ্রি ওয়াই ইজ ইকুয়াল টু টুয়েলভ (5x + 3y=12) —- তার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আসলে বিন্যস্ত হয়ে গেল কিছু সংখ্যার বা বিন্দুর ভবিষ্যৎ । এই সমীকরণে যদি এক্স এর মান ৩ হয় তবে ওয়াই এর মান হবে মাইনাস ১ (-১) —- এই মান (-১) ওয়াই-এর পক্ষে একেবারে নির্ধারিত হয়ে গেছে সমীকরণ নির্মাণের সময় থেকেই। আবার ওই একই সমীকরণে যদি ওয়াই এর মান ৩ হয় তবে এক্স কে হতেই হবে দশমিক ৬ (০.৬) — এর কোনও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। হয় সমীকরণের সত্যি মানলে জোড়া জোড়া সংখ্যার বন্ধন আমাদের মেনে নিতে হবে আর নিজেদের মতো এক্স বা ওয়াই এর মান খুঁজে নিতে চাইলে ভেঙে পড়বে সমীকরণের ইমারত। আর এই সমীকরণ যদি মানি তাহলে শুধু এই দুটি মাত্র নয় অসংখ্য এমন জুটি সংখ্যা তৈরি হয়ে গেল—- যে বিশেষ মুহূর্তে ভূমিষ্ঠ হল এই সমীকরণ। অসংখ্য বলা ভুল হল, আসলে অসীম। এই আলোচ্য সরলরেখাটি আসলে গাণিতিক সংজ্ঞায় অসীম অবধি প্রসারিত আর তাই তার লগ্ন হয়ে আছে অসীম সংখ্যক সংখ্যার জুটি —- কী বিচিত্র কল্পনার এক উদাত্ত জগৎ ! আর এই সংখ্যাজুটিগুলির একটা খন্ডাংশ আমরা প্রথমে হিসেব করে করে খাতায় লিখব তার পর সেগুলিকে চিহ্নিত করে দেব গ্রাফের পাতায় —- পেন্সিলের যোজনায় জুড়ে দেব ওই বিন্দুগুলি—- মেলাবেন, তিনি মেলাবেন। আর এমনিভাবে কাগজের সাদা পৃষ্ঠায় ধরা দিতে থাকবে এক অব্যর্থ রেখার আভাস, যার মাত্র কিছুটাই ধরা পড়ে এই খন্ড পৃষ্ঠার আয়তনে, অনেকটাই থেকে যায় আড়ালে —- ফুরায় যাহা ফুরায় শুধু চোখে / অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে !
এই কল্পরেখা দিয়ে কি এমনভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষরা অপার আকাশের বুকে ফুটে থাকা তারার আলোয় এঁকে দিয়েছিলেন একেক যোজক-চিহ্ন ? আর নির্মিত হয়েছিল কালপুরুষ, তার কোমরবন্ধনীতে ফুটে উঠেছিল ঊষা, অনিরুদ্ধ আর চিত্রলেখা, পায়ের কাছে অনুগত লুব্ধক ; কল্পিত হয়েছিল একেক নক্ষত্রপুঞ্জের রাশি ( কনস্টেলেসন) —- বৃশ্চিক, কর্কট, মীন ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসবই তো মহাকাশের বুকে রচিত কল্পনার মহাকাব্য। গ্রিক পুরাণে কালপুরুষের ( Orion) জন্মের সঙ্গে মিশে গেছে আর্টেমিসের আখ্যান —- এপোলোর কথায় প্ররোচিত হয়ে আর্টেমিস হত্যা করে ওরিয়নকে, আ্র, পরে তার ভুল বুঝতে পেরে তাকে অমর স্থান করে দেয় নক্ষত্রের সারিতে। আমরাও তো মনে করে থাকি, প্রিয়জন প্রয়াত হলে চলে যান তারাদের দলে ! আজও মা-হারা বাবা-হারা শিশুদের বোঝাই তাদের মা-বাবারা আসলে দূর আকাশের তারা হয়ে ফুটে আছে মিটমিট করে — ওই সুদূর থেকেই তাঁরা নির্নিমেষে তাকিয়ে আছেন আত্মজের দিকে ! হিমেল হাওয়ামাখা কার্তিকের রাতে সেই তাদের জন্যই তো আমরা জ্বেলে রাখি আকাশপ্রদীপ — গেয়ে উঠি, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’ ! তাহলে মহাকাশ কি আসলে ব্যাপ্ত এক গ্রাফ-পেপার যেখানে সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ কেবল জুড়ে যাচ্ছে বিন্দু আর লিখে চলেছে নিজেদেরই অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের দিনলিপি !
সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো— আকাশে এক তিল
ফাঁক ছিলো না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো
ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;
(হাওয়ার রাত ।। জীবনানন্দ দাশ )
ক্রমশ
পরের পর্ব প্রকাশিত হবে ১০ ফেব্রুয়ারি
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।