মাধ্যমিকের জ্যামিতিতে উপপাদ্য ছাড়াও সম্পাদ্য বলে একটা ব্যাপার ছিল যা আঁকতে হত পরীক্ষার খাতায়, এখানে ঝুঁকি থাকত একেবারে শেষ মুহূর্তে । কারণ, খুব যত্ন করে কম্পাস বা স্কেল দিয়ে আঁকলেও ‘হিউম্যান এরর’ বলে একটা ব্যাপার আছে, যার ফলে কোণের মাপ ভুল হয়ে যেতে পারত বা বৃত্তের খুঁটিনাটি মিলত না। এজন্য নম্বরও কেটে নেওয়া হত। তবে সম্পাদ্য আঁকার পরে তা প্রমাণ করার একটা ব্যাপার থাকত, সেটা পাঠ্যপুস্তকে থাকলেও পরীক্ষায় ওটা চাওয়া হত না —-- মোটামুটি নিয়ম মেনে এঁকে ফেলতে পারলে সামান্য উনিশ-বিশ হলেও খারাপ নম্বর উঠত না। তার একটা গোপন কারণ বোধহয় এই যে পরীক্ষার যারা খাতা দেখতেন তাঁরা প্রতিটি খাতার ওই সম্পাদ্য-অঙ্কন নিজেরা মিলিয়ে দেখতে পারতেন না —- কার্যত তা সম্ভবই নয়। তাছাড়া নিজেরা আঁকলেও তাঁরাও কি ‘হিউম্যান এরর’ এড়িয়ে যেতে পারতেন নাকি ? অঙ্কের পরীক্ষকরা রাশভারি হয় বলে শুনেছি, তা বলে তাঁরা ‘সুপার-হিউম্যান’ তো নন ! তবে, এটা বলে রাখা দরকার, অন্তত আমাদের সময়ে মাধ্যমিক স্তরে অঙ্কের যেসব বিষয় সিলেবাসে ছিল তাতে তুখোড় হলেও উচ্চস্তরের গণিতের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র যোগ নেই। এক্ষেত্রে মর্নিং শো’জ দা ডে, একদম ডাহা ভুল।
উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বছরে অর্থাৎ ক্লাস ইলেভেনের গোড়াতেই ধাক্কা লেগেছিলে অঙ্ক বইয়ের বপু দেখে। মাধ্যমিকের অঙ্কে পড়ানো হত মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত তাদেরই প্রকাশনার বই —- নাইন-টেন আলাদা আলাদা। উচ্চমাধ্যমিকে তা নয়। স্কুল অনুমোদন করেছিল দাস মুখার্জির প্রবাদপ্রতিম ত্রিকোণমিতি ও স্থানাঙ্ক জ্যামিতির বই আর বীজগ্ণিতের জন্য ছিল ওই একই প্রকাশনের (ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স) গঙ্গোপাধ্যায়-মুখার্জির টেক্সট বই। অনেক পরে জেনেছি, এই গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্কিত মামা —- সিটি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন তার থেকে ঢের বেশি আয় ছিল বই বিক্রির। তিনটে আলাদা আলাদা বই ছিল এগুলি। আবার ‘ভঞ্জ-গাঙ্গুলি’ র বিপুল আয়তনের বইয়ে তিনটে বিষয়ই ধরা ছিল এক মলাটে, একই আয়তনে ধরা দিতেন কেশবচন্দ্র নাগ। প্রাথমিকভাবে এই আয়তনের ধাক্কা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক যে বড় একটা উল্লম্ফন এটা মাস্টারমশাই ও অভিভাবকরা আমাদের বলতেন বারবার। তার প্রাথমিক উচ্চতা বোঝা গিয়েছিল পাঠ্যপুস্তকের এই আয়তনের তারতম্যে। এবং আমাদের সময়ে কিন্তু ইলেভেন ও টুয়েলভ একসাথে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হত —- ইলেভেন পাশ করে গেলে তার পাঠ্য ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আবার তাকে মাঠে নামাতে হত উচ্চমাধ্যমিকের ফাইনাল পরীক্ষার আগে —-- এবেলা ওবেলা তিনঘণ্টা করে পরীক্ষা দেওয়ার ধকল আমাদের পরের প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না। তবে এখন বুঝি, ওই ব্যবস্থা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। আমাদের দেশে পরীক্ষার যা অবস্থা ও ব্যবস্থা তাতে কার্যত পড়ুয়ার মেধাবিচারের কোনো অবকাশই নেই। সেদিক দিয়ে এত চাপাচাপি করে যা প্রসব করানো হয় তার মান নিয়ে হরেক প্রশ্ন উঠতে পারে। বরং তার থেকে অল্প অল্প করে পরীক্ষা নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ভার লাঘব করাই দেশে দেশে স্বীকৃত।
এগারো ক্লাসের ত্রিকোণমিতির পরিধি ছিল প্রচুর। কিন্তু আস্তে আস্তে তা করে ওঠাও যাচ্ছিল বুঝে বুঝে। শেষের দিকে ‘ত্রিভুজের ধর্ম’ বা properties of traingle ছিল রীতিমতো উপভোগ্য। বীজগণিতে একদম নতুন বিষয় ছিল প্রোগ্রেসন বা প্রগতি ও লগারিদম। এর সঙ্গে ছিল জটিল সংখ্যার বীজগণিত বা কমপ্লেক্স অ্যালজেব্রা— জটিল রাশির জগত এক অনাঘ্রাত হাস্নুহানা যার তীব্র মদিরা-গন্ধে আকুল না হয়ে উপায় নেই। মাইনাস একের বর্গমূল বা ঘনমূল কী হতে পারে, এই জিজ্ঞাসাই কমপ্লেক্স অ্যালজেব্রা-র মৌলিক প্রশ্ন। এর আগে ‘ওমেগা’ শব্দটার সঙ্গে যুক্ত ছিল শুধুমাত্র খ্যাতনামা ঘড়ি প্রস্তুতকারকের , আর জটিল রাশি নিয়ে অঙ্ক করতে গেলে সেই ‘ওমেগা’ যে কত বিচিত্ররূপে ধরা দিল তা আজও অল্পস্বল্প মনে পড়ে বইকি । আর ছিল দ্বিঘাত সমীকরণের (quadratic equation) নানা ধর্ম ও সূত্র । যার কেন্দ্রে ছিল ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীধর আচার্য আবিষ্কৃত দ্বিঘাত সমীকরণের বীজ নির্ণয়ের কালজয়ী গবেষণা। আনুমানিক ৮৭০ খৃস্টপূর্বাব্দে বর্তমান হুগলী জেলার ভুরশুট গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই বাঙালি গণিতবিদই প্রথম পাটিগণিত থেকে বীজগণিতকে পৃথক শাখা হিসেবে বিকশিত করতে থাকেন। আড়াই হাজার বছর পরে তরুণ পড়ুয়ারা যে তারই দেখানো রাস্তায় হেঁটে বীজগাণিতিক অঙ্ক করবেন, শুধু এই তথ্যটুকুর দিকে তাকিয়েই আমরা শিহরিত হতে পারি। এতে আবারও প্রমাণিত হয়, বিজ্ঞান একটি ধারাবাহিক মনীষার বিকাশ। ইউরোপের এক বিজ্ঞানলেখক লিখেছিলেন, discovery comes only to a prepared mind —- এই প্রস্তুতি হয়তো বা অনেক শতাব্দীর মনীষার কাজ। কে জানে! তবে আজও আক্ষেপ এটাই গণিতের চর্চার পাশেপাশে দেশ-বিদেশের খ্যাত গণিতবিদদের জীবনী আমাদের দেশে কোনো স্তরেই পড়ানো হয় না। এর বিপরীতটা ঘটলে অবশ্য আমাদের ‘সস্তা মহামানব’দের একটু ঝুঁকি থেকে যায়।
এগারো ক্লাসের শেষ দিকে বীজগণিতের দুটো টপিক প্রথম আমায় অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। এর একটা হল পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন, বাংলায় বলা হত বিন্যাস ও সমবায়। কোন ক্ষেত্রে বিন্যাস আর কোন ক্ষেত্রে সমবায় বিবেচনা করা হবে এটা একটু তলিয়ে ভাবার ব্যাপার, আর তার হিসেবনিকেশটাও আলাদা। প্রথমে এই হিসেবের নাগাল না পাওয়ায় কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ি —- এই ক্ষেত্রেও পাঠ্যপুস্তকের আলোচনার অংশ ছিল অতি সংক্ষিপ্ত। প্রাইভেটে যিনি আমাদের অঙ্ক শেখাতেন তিনি কিছুটা আমার সংশয়ের অবসান করলেও পুরোটা তাতে নিষ্পত্তি হয়নি। এর কুপ্রভাব পড়ল সম্ভাব্যতার তত্ত্ব বা থিওরি অফ প্রোবাবিলিটি পড়তে গিয়ে। খুব প্রাথমিক পর্যায়ে কিভাবে সম্ভাব্যতা হিসেব করা যায় তা বুঝতে অসুবিধে না হলেও একটু জটিল ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকেনি। একটা কয়েন টস করলে হেড বা টেল পড়ার সম্ভাবনা হিসেব করা সহজ কিন্তু এই সমস্যার মধ্যে যদি আরো অনেক মাত্রা এসে যায়, সেগুলো কিভাবে হিসেব হবে আমি বুঝতে পারিনি। অথচ, পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন গণিতের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় —- পুরো সম্ভাব্যতার তত্ত্বটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে এর ওপর, এর সঙ্গে যোগ আছে রাশিবিদ্যার। বাস্তব জীবনেও সম্ভাব্যতার প্রয়োগ খুব ব্যাপক। এই বিষয়ে খুব সুন্দর লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসের একটা অধ্যায়ে। সুনীল লিখছেন, আমাদের জন্মটাই তো একটা অনিশ্চিত সম্ভাবনার ভিতর থেকে হয়ে ওঠা। একটি পুরুষের লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু ছুটে চলে একটামাত্র ডিম্বাণুর দিকে —- তার মধ্যে মাত্র একটি নিষিক্ত হয়ে তৈরি হয় মানবভ্রূণ — যদি ওই একটি শুক্রাণু না মিলিত হত ওই একটি ডিম্বানুর সঙ্গে তাহলে কি আমার জন্ম হত ? এটা ভাবলে সত্যি বিস্ময়ের অবধি থাকে না। মহাবিশ্বে প্রাণের বিকাশের ক্ষেত্রেও এমনটাই। কার্বন-হাইড্রোজেন-নাইট্রোজেন পরমাণুর নির্দিষ্ট আয়তনের মিশেলে এবং সমানুপাতিক উত্তাপ ও চাপের সাহচর্যে যে রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিডের (আর এন এ) অণু তৈরি হল, তাই তো প্রাণের ভিত্তি —-এই ক্ষেত্রেও কি থেকে গেল না একটা সম্ভাব্যতা ? যদি এমনটা না হত ? তাহলে কি মিথ্যে হয়ে যেত সৃষ্টি স্থিতি আর প্রলয় ? এগুলো বড় বড় জিজ্ঞাসা। কিন্তু আমার ছোট্ট মগজে যে পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন এর অঙ্ক সেঁদিয়ে যেতে পারল না তার ক্ষতি আমায় বহন করতে হল আজীবন।
কারণ, এই হিসেবটা না বুঝলে আবার বীজগণিতের ‘বাইনোমিয়াল এক্সপানশান’ এর থিওরি ভেদ করা যায় না। সেটাও ক্লাস ইলেভেনেরই পাঠ্য। ওখানেও যথারীতি আমি হোঁচট খেলাম। সামান্য ধারণা থেকে বাইনোমিয়াল যদি বা বুঝি, ওই বিস্তারে যদি (এক্স প্লাস ওয়াই) এর পাওয়ার বা ঘাত হয়ে যায় আট/দশ বা আরো বেশি, তাহলে ঘোর বিপদ। আর পরের ধাপে যদি এন-ঘাতের (n-power) এক্সপানশান করতে হয় তাহলে তো সসেমিরা অবস্থা। কার্যত আমি পারিওনি। রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম। সুবিধে একটাই ছিল, বোর্ডের পরীক্ষায় যে-কটি প্রশ্নের উত্তর করতে হত, তাতে ওই চ্যাপ্টার ছেড়ে দিলেও বাকিগুলি থেকে তা নির্বাচন করতে অসুবিধে হত না। উচ্চমাধ্যমিক পর্ষদ আমায় সে যাত্রা রক্ষা করেছিলেন। তবে এই একই কারণে খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্থানাঙ্ক জ্যামিতিতে পরাবৃত্তের ( হাইপারবোলা) চ্যাপ্টার আমাদের পড়ানো হয়নি, উপবৃত্তের ( ইলিপ্স) এর খুব আবছা ধারণা হয়েছিল নমো নমো করে। এর ব্যাখ্যা ছিল, ওই দুটি অধ্যায় না-পড়লেও পরীক্ষায় প্রশ্ন পেতে অসুবিধে হয় না। এগুলো বিধির বিধান। কিন্তু স্থানাঙ্ক জ্যামিতি বিষয়টা আমি সত্যি খুব পছন্দ করতাম, ওই বিষয়ের অঙ্ক করে তৃপ্তি পেতাম। অনেক বছর পরে, আমায় একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ইন্টারভিউ বোর্ডে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, অঙ্কে আপনার প্রিয় বিষয় কী ? জানতাম, যেটাই বলব, সেটা নিয়েই আমার দিকে ধেয়ে আসবে ‘র্যাপিড-ফায়ার’ প্রশ্ন। বাড়তি সমস্যা হল, এর আগে প্রাক্তন- প্রেসিডেন্সিয়ান একজন দুঁদে আমলার কথা লিখেছি, যিনি সরকারি ফাইলে অঙ্ক করে সময় কাটাতেন — সেই ‘মহাজন’ সেদিন ছিলেন ওই ইন্টারভিউ বোর্ডের মাননীয় সদস্য। অনেক ভেবেচিন্তে বলেছিলাম, স্থানাঙ্ক জ্যামিতি। তারপরে কী হয়েছিল তা আপাতত উহ্য থাক, সেই গল্প পরে হবে।
ক্লাস টুয়েল্ভের সব থেকে বড় আকর্ষণ ক্যালকুলাস। মানুষের সভ্যতাকে যে কয়েকটি হাতে-গোনা আবিষ্কার এক লাফে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে, ক্যালকুলাস তার অন্যতম। ঠিক কী পরিমাণ মৌলিক ভাবনা আর ধীশক্তি থাকলে এরকম একটা বিষয় বার করা যায় তা পরিমাপ করার শক্তি আমাদের মত গড়পড়তা মানুষের নেই। সেদিক দিয়ে আইজ্যাক নিউটন সত্যিই এক মহামানব, ঘটনাচক্রে তাঁরও জন্মের দিন ২৫ ডিসেম্বর। কিন্তু ক্যালকুলাসের প্রথম অংশ অর্থাৎ ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের উপকূলে নোঙর করতে গেলে আগে শিখতে হয় লিমিট আর কন্টিনিউইটির ব্যাকরণ। কন্টিনিউইটি ব্যাপারটা বুঝতে তেমন অসুবিধে হয়নি, কিন্তু ঠোক্কর খেলাম লিমিটে। কোনও একটা চলরাশির মান কোনো একটি সংখ্যার দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই —- কিন্তু কিছুতেই তাকে স্পর্শ করছে না — চুলমাত্র ফাঁক থেকেই যাচ্ছে, যাকে গণিতের পরিভাষায় প্রকাশ করা হয় গ্রিক অক্ষর এপসিলোন দিয়ে। এই ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট করে আমায় কেউ বোঝাতে পারেনি, এটা নিয়ে পাঠ্যবইতেও এত কম আলোচনা ছিল যে মাথায় ঢোকা ছিল শক্ত। কল্পনা করার চেষ্টা করছি ব্যাপারটা ঠিক কী, আর মনে পড়ে যাচ্ছে গানের লাইন– ‘ সে কি এল, নাকি এল না/ বোঝা গেল না গেল না গেল না’। এক মূর্ত সংখ্যার দিকে বিমূর্ত চলরাশির এ যেন একটা অভিসার-যাত্রা, সে তাকে পেতে চায়, মিলে যেতে চায় তার শরীরে —- ওইটাই তার সীমানা, ওই তার ভবিতব্য। অথচ কী যেন একটা হচ্ছে না, অণুমাত্র ব্যবধান থেকে যাচ্ছে, যার আর পারাপার নেই — তবু ক্যালকুলাস মেনে নিচ্ছেঃ হ্যাঁ তুমিই সেই মাইলফলক, না ছুঁতে পারলেও ওইটাই তোমার লিমিট, ওইতেই তোমার মুক্তি। মুক্তি আর সীমা একাকার হয়ে গেয়ে ওঠে ‘নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ’ ।এই হল ক্যালকুলাসের প্রথম পাঠ।
তবে এই চৌকাঠটুকু কিছুটা অনুমানে পার করতে পারলে তার পরের ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের অনুশীলনীর পর অনুশীলনী কষে ফেলা যায় অনায়াসে। আমাদের টিউশন ক্লাসে সহপাঠীদের মধ্যে তো প্রতিযোগিতা হত, কে কত তাড়াতাড়ি একের পর এক এক্সারসাইজ শেষ করে ফেলতে পারে! এই তাড়াহুড়োর আরেকটা কারণ হল, কার্যত ক্লাস টুয়েলভের সিলেবাস শেষ করার জন্য গোটা একটা বছর পাওয়া যেত না —- অথচ ইলেভেন ও টুয়েলভের পাঠ্যসুচির আয়তন ছিল একই। তাই বারো ক্লাসের অঙ্কসহ সবকিছুই দ্রুত শেষ করতে না পারলে উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় উতরে যাওয়া ছিল মুস্কিল। কারা যে এই ধরনের ঘাড় নিচু-করে-দেওয়া সময়সীমা বানিয়েছিলেন কে জানে! মাস্টারমশাইরা সিলেবাস শেষের তোয়াক্কা করতেন না — কিন্তু পড়ুয়াদের জন্য তো আর সেই সুবিধে নেই। তাই যে বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেব তার আগের বছর পুজোর আগেই শেষ হয়ে গেল ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের সিলেবাস। কিছু শিখলাম কি না কে জানে, তবে দেদার অঙ্ক কষতে পারি তখন। ক্যালকুলাসের ঢাউস বইটায় তিনটে অংশ —- ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস, ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস ও ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন। এই বিন্যাসের পেছনে নিশ্চিত একটা ছন্দ আছে — ডিফারেন্সিয়াল না শিখলে সেই ছন্দের বারান্দায় পৌছানো যায় না।
ডিফারেন্সিয়েসন-এর পরেই আসে ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস বা সমাকলন । তার যে মৌলিক ভিত্তি তা খানিকটা দেখা যায়, বোঝাও যায়। বিশেষ করে ডেফিনিট ইন্টিগ্রাল আসলে যে গ্রাফ পেপারের ওপর একটা ক্ষেত্রফলকে নির্দেশ করে তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি। হয়নি বলেই ইন্টিগ্রালের চ্যাপ্টারগুলোও একদিন শেষ হয়ে যায়। এসে পড়ে ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন, এর মধ্যেও রস আছে। এতাবৎ অর্জিত নানা সূত্র নির্ভর করে টুকটুক করে তাও করে ফেলা যায়। এই বিদ্যার একটা প্রায়োগিক দিকও ছিল আমাদের সিলেবাসে, সেটাও চিত্তাকর্ষক। প্রতিদিনের সমস্যার সঙ্গে মিলিয়ে ধরে অঙ্ককে প্রয়োগ করতে পারার মজাই আলাদা। দুর্ভাগ্য, এর খুব অল্পই আমি জেনে উঠতে পেরেছি। এখানে দুটো কথা বাড়তি বলি। ক্যালকুলাস কথাটা যে আসলে ক্যালকুলি বা ছোট পাথরের টুকরো থেকে এসেছে, এটা আমি সম্যকভাবে জানি যখন আমার এক স্বজনের গল-ব্লাডার বা পিত্তথলিতে ‘স্টোন’ ধরা পড়ে —- আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে লেখা ছিল ‘স্মল ক্যালকুলাস’ , এটা ডাক্তারি পরিভাষা। আসলে ছোট ছোট পাথরের টুকরো সাজিয়ে সাজিয়ে যে বিন্যাস তৈরি হয়, ক্যালকুলাসের ভাবনাটা ওইভাবেই এসেছিল। আর ইন্টিগ্রিটি কথার মানে আমরা সবাই শিখেছি —- ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস আসলে একটা যৌথতার ধারণা দেয়। সে কি আসলে স্বপ্নে-দেখা যৌথ খামারের মতোই সম্ভাবনার এক অনন্ত জিজ্ঞাসা ?
ক্রমশ