অঙ্কে যত শূন্য পেলেপ্রবুদ্ধ বাগচী
পর্ব ১১
গণিতের সঙ্গে খেলা-ভাঙার উপাখ্যানের এইটাই শেষ পর্ব। অঙ্ক কিভাবে একজনকে ফিরিয়ে দেয় শূন্যহাতে তার নিবিড় প্রতিবেদন এবার গুটিয়ে আনার পালা। এটা একটু বিনয়ের সঙ্গেই বলে রাখা ভাল, পঞ্চম বর্ষের পাঠ্যক্রমে নতুন করে কিছু পছন্দসই বিষয় পাওয়ায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার যে ‘কাঙ্ক্ষিত গড়’ ছিল তা শেষ পর্যন্ত অর্জন করা গিয়েছিল, তবে এই আখ্যানে তার কোনও আলাদা মূল্য নেই। পরীক্ষার নম্বর দিয়ে কোনো দিনই কিছু নির্ধারিত হয়নি, হবেও না। সচরাচর, উত্তর-স্নাতক স্তরে পড়াশোনা শেষ করে কেউ কেউ চাকরি খোঁজে, কেউ কেউ খুঁজতে থাকে উচ্চতম গবেষণার দরজা। দুটোই কঠিন কাজ। প্রায় সাড়ে তিন দশক আগেও চাকরি বা গবেষণায় যোগ দেওয়া সহজ ছিল না। হালের অবস্থা আরও শোচনীয় রকম খারাপ জেনেও কথাটা লিখলাম। জেন্ডার-নিরপেক্ষ ভাবেই আমাদের সহপাঠীরা সম্ভবত এই দুইয়ের কোনোটায় লিপ্ত হওয়ার কথা ভাবতে থাকে । ‘সম্ভবত’ —-- কারণ, চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর তাদের বেশির ভাগের সঙ্গেই আর আমার তেমন যোগ ছিল না। মোবাইল ফোন-ইন্টারনেট-ফেসবুকবিহীন সেই ধূসর ও শান্ত বিশ্বে যে যার মতো পথ কেটে এগিয়ে চলছিল নিশ্চয়ই। আমিও। কিন্তু এর অল্প পরেই কুঁজোর চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে হয়। কেমন যেন মনে হল, আমিও কি গবেষণা করতে পারি না ? এখন বুঝি, এর সবটাই ছিল কাঁচা বয়সের ভুল আবেগ। নিজেকে বোঝার ভুল। যে গণিত-সুন্দরী অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে নিজের মাধুরী ও সৌন্দর্য আমায় অবলোকন করতেই দেয়নি, তার সঙ্গে কি আর বাড়তি বোঝাপড়া চলে ? অবশ্য আবারও বলি, এই দূরত্বের বিবিধ কারণ, যার একটা হল আরও নিচের স্তর থেকে অঙ্কের চর্চায় ঘাটতি যা ক্রমে ক্রমে প্রকট হয়েছে, আরও বিকর্ষিত করেছে আমায়।
তাহলে একটু বিছিয়েই বলি। আসলে এই ‘পাগলামিটা’ আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন কবি রাম বসু। আমরা যে-বছর চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে বেরোই, সেই বছরেই ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান এই প্রবীণ কবি। বলতে গেলে, পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যায়, রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে খোলা মঞ্চে যেখানে তখন পুরস্কার-প্রদানের অনুষ্ঠান হত, সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। আজকের ঝাঁ-চকচকে নিরাপত্তা ও প্রাচুর্য-শোভিত মঞ্চগুলির চেহারা দেখে কেউ ধারণাই করতে পারবেন না সেই অনুষ্ঠানের জৌলুষহীন চেহারা। নিতান্তই মাথায় ত্রিপল-খাটানো চারদিক খোলা এবং সাবেকি ডেকরেটার্স এর ভাঁজ করা কাঠের চেয়ার সার-দিয়ে সাজানো। সামনের সারিতে অতিথিদের কিছু ভাল চেয়ার, এইমাত্র। পুরস্কার দেওয়ার পালা শেষ হওয়ার পরে ওই ‘দামি’ চেয়ারে বসে গল্প করছিলেন পুরস্কার প্রাপক কবি ও পুরস্কার-জ্ঞাপক রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী শ্রীবুদ্ধদেব ভট্টাচার্য । আমি গুটি গুটি পায়ে তাঁদের পেছনের সারিতে গিয়ে বসি, কোনো নিরাপত্তা রক্ষী আমায় আটকাননি। মন্ত্রী মহোদয় সভাস্থল ছেড়ে যাওয়ার পরে আমি আলাপ জমাই প্রবীণ কবির সঙ্গে । সেই আলাপ গড়ায় নিবিড় সখ্যে, যার পরিণতিতে প্রায় নিয়মিত রাম বসুর মুরারিপুকুরের আবাসনে আমি আড্ডা দিতে যেতে থাকি। তিনি তখন যথেষ্ট খ্যাত ও বিশিষ্ট কবি, কিন্তু, বাম-ভাবাদর্শের কবিদের বেশিরভাগেরই এই একটা ব্যাপার ছিল —- তাঁরা তথাকথিত ভ্যানিটিকে পাশে সরিয়ে রেখে খুব সহজে তরুণদের তাঁদের সঙ্গে মিশতে অনুমোদন করতেন । রাম বসু তাঁর পুরস্কার-প্রাপ্তির কিছু আগে থেকেই ‘ভাবনা’ সিরিজের কবিতাগুলো লিখতে আরম্ভ করেন, যা তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ য় সঙ্কলিত হয়েছিল। এই কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কবি একদিন আমায় বললেন, আমি এগুলো লিখছি এক নতুন বিশ্ববীক্ষা থেকে। আমার এখনো মনে আছে, উনি বললেন, ‘দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে আমারে’ —- এটা তো তাঁর কসমিক চিন্তার প্রকাশ। মহাকাশের তারার সঙ্গে তিনি একাত্ম বোধ করছেন। আজ কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞান ও কসমোলজির আগুয়ান গবেষণায় আকাশের তারাদের খবর আমরা অনেকটাই জানি। আজকের মানুষের যে রুটলেসনেস বা শিকড়হীনতা তার মূলে তো এই চেতনাগুলো থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।’ ব্যাস এইসব কথা শুনে আমার মাথায় পোকা নড়ল। হবি তো হ, এর অল্প পরেই একদিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে গেলাম তাঁর বালিগঞ্জের ‘পারিজাত অ্যাপার্টমেন্ট’ এর ফ্ল্যাটে। একথা সেকথায় রাম বসুর কবিতাগুলোর কথা উঠল। আগ্রাসী পাঠক সুনীলের সেসব কবিতা পড়াই ছিল, উনিও মেনে নিলেন মানুষের এই শিকড়হীনতার কথা। আর আমায় পায় কে ? মনে হল, কসমোলজির সঙ্গে মানুষের মনকে মিলিয়ে গবেষণার বিষয় বাছলে কেমন হয় ? কী নাম হবে তার ? গাণিতিক দর্শন ? ম্যাথমেটিকাল ফিলোজফি ? আজকে ভাবতে গেলে আশ্চর্য লাগে, সেদিন এক তরুণ শুধু এই বিষয় নির্বাচনটি ঠিক হচ্ছে কি না জানার জন্য কুণ্ঠিত পায়ে পায়ে এক সকালে পৌঁছে গিয়েছিল শঙ্খ ঘোষের ফ্ল্যাটে । আর তিনি স্বভাবসুলভ স্নেহময়তায় প্রশ্রয় দিয়ে শুনেছিলেন তার ভাবনার কথা , নাম লিখে দিয়েছিলেন কয়েকটি বইয়ের (তার একটি হল উইল ডুরান্টের ‘হিস্ট্রি অফ ফিলোজফি’) আর পরবর্তী পরামর্শের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাদবপুরের সুবিখ্যাত অধ্যাপক শ্রীপ্রণব সেনের কাছে। এইসব দুঃসহ স্পর্ধার নামই কি তারুণ্য ?
আশা করি, পাঠককুল এতক্ষণে বুঝে গেছেন, এইভাবে গবেষণার চিড়ে ভেজে না। ভেজেওনি। সবাই কার্ল সাগান, রজার পেনরোজ বা রিচার্ড ডকিন্স নন, যে কসমোলজির সঙ্গে গাণিতিক দর্শন নিয়ে বই লিখে উঠতে পারবেন —- আর আমি তো তাদের পদরেণুর থেকেও ক্ষুদ্রতর এক আকাট অস্তিত্ব। ফলে যা হওয়ার তাই হল। আমার একজন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু অচিরেই বুঝলাম, যোগ্যতা বা দক্ষতার বাইরেও গবেষণা নামক তালাটি খুলতে গেলে চাবিতে প্রচুর তেল দিতে হয়। তাছাড়া, অন্তত সেই সময় অবধি সত্যি সত্যি গবেষণা করতে গেলে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় তার কোনো প্রশিক্ষণ আমাদের রাজ্যের কোনও পাঠ্যক্রমে ছিল না। এখন সম্ভবত সেটা চালু হয়েছে । এই বিষয়ে বহুকাল পরে আমি একটি বই হাতে পাই, আদপে সেটি শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ধ্রুবপদ’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা যার শিরোনাম ছিল ‘গবেষণার অন্দরমহল’ —- নানা বিষয়ের গবেষকরা এখানে লিখেছিলেন তাঁদের প্রস্তুতির কথা। ফলে এরকম এতোল বেতোল ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কিছুই আমার করণীয় ছিল না। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের এক প্রখ্যাত মাস্টারমশাই, তাঁর কাছে গবেষণার নাড়া বাঁধার জন্য যে শর্ত দিয়েছিলেন তা রক্ষা করতে হলে আমাকে আরেকজন কারোর আওতায় গবেষণা করে তা প্রকাশ করতে হত। তবুও আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পরে, আমি কোনো শ্রদ্ধেয় ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষকদের নামে দোষারোপ করতে চাইব না। প্রথমত ও শেষ পর্যন্ত এটা আমার ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও গণিত বিষয়ে প্রখর অজ্ঞানতার ফসল। এটা আমার হওয়ার ছিল না। কারণ, গবেষণার গভীরে যেতে গেলে বিষয়টা যতদূর পর্যন্ত ভিতর থেকে জানতে হয়, বহুবার বলার চেষ্টা করেছি ওই মাপের গণিতের জ্ঞান আমার ছিল না, আজও নেই। আর নেই বলেই তো গণিত-সুন্দরীর সঙ্গে আমার প্রেম-অপ্রেমের আখ্যান নিয়ে এত কথা বলে উঠতে পারলাম। গণিত এক অপার রহস্যময়ী কুঞ্ঝটিকা, তাকে ভেদ করে ভিতরের বার্তা নিজের মতো করে আত্মস্থ করা বহু সাধনার ফল —- সবাই এটা পারে না শুধু নয়, সকলের এটা পারতে নেই। গবেষণা মানে মূলত একটা সত্যের সন্ধান, তা সে যে কোনো বিষয়েরই হোক না কেন —- বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা প্রত্যক্ষভাবে মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সত্যের অনুসন্ধান নিশ্চয়ই বিদ্বজ্জনের কাম্য, তবে আমি সেই পর্যায়ে পড়ি না। তাই সোফোক্লিসের পরামর্শ মতো আমিও মেনে নিয়েছি, সত্য কী, তা সবসময় জানতে চেয়ো না।
গণিতের মোহিনী মায়ার পাশে পাশে আরেকটা কথাও বলা দরকার এই যে বিষয় হিসেবে গণিত যেমন স্বাদু ও রোচক একই হিসেবে তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিপজ্জনকও বটে। এই বিপন্নতার দুটো অভিজ্ঞতা অন্তত আমি বলতেই পারি। প্রথমটির একটু ইশারা দিয়েছিলাম যখন এক মস্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ‘পার্সোন্যালিটি টেস্ট’ এ আমায় প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, উচ্চস্তরে গণিতের কোন বিষয়টা আপনার ভাল লাগে ? দুরুদুরু বুকে বলেছিলাম স্থানাংক জ্যামিতির কথা, কারণ মনে হয়েছিল, এটা নিয়ে আমি কিছুটা জবাব দিতে পারব। তখন আমায় প্রশ্ন করা হয়েছিল, একটি বিন্দুর ভিতর দিয়ে কতগুলি সরলরেখা টানা যেতে পারে ? জ্যামিতির হিসেবে এর উত্তর হল, অসীম-সংখ্যক রেখা একটা বিন্দুর ভিতর দিয়ে যেতে পারে। অথচ উত্তর তাঁদের পছন্দ হল না, বুঝলাম। আমায় তারা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ঠিক বলছেন কি ? বড় বড় পরীক্ষার ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রার্থীকে বিভ্রান্ত করার জন্য এমন করাই হয়। আমি অবিচল থাকলাম আমার জবাবে। পরে তাঁরা বিশদে বললেন, আসলে তাঁদের জিজ্ঞাস্য হল একটি বিন্দুর মধ্যে দিয়ে পরস্পর সমকোণে থাকা কটা সরলরেখা টানা যায়। দুটো কিন্তু আলাদা প্রশ্ন। কিন্তু তাঁরা প্রতিপন্ন করলেন আমি ভুল বলেছি। পরে দেখলাম, এই ভুলের মাশুল হিসেবে আমায় তাঁরা বেশ কম নম্বর দিয়েছেন। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম ! একইভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বিষয় হিসেবে অঙ্ক খুব নির্ভরযোগ্য নয় —- এটাও আমার একটা উপলব্ধি। কারণ, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি বা অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয়ে এই ধরনের পরীক্ষায় বেশ অনেকটা থিওরির অংশ থাকে, ভাল করে তৈরি হয়ে গেলে তা উতরে দেওয়া যায়। কিন্তু অঙ্কের বিপদ হল, যত বেশিসংখ্যক অঙ্কই অভ্যাস করে যাওয়া হোক, তার বাইরেও থেকে যেতে পারে এমন একটি বা দুটি অঙ্ক যা পরীক্ষার খাতায় বসে সমাধান করা কঠিন। এই অভিজ্ঞতাও আমার নিজের। হতেই পারে, গণিত-সুন্দরী হয়তো তার সৌন্দর্যটুকু নিজের প্রিয়তমদের জন্যই ধরে রাখতে চায়, তাকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার হাটে নিয়ে যাওয়ায় তার ঘোর আপত্তি। হবেও বা । সুন্দরীদের মন বোঝা যে -সে কর্ম নয়।
একেবারে শেষে, একটা প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। গণিত বিষয়টি নিয়ে যেমন সাধারণ্যে এক ‘আতঙ্ক আছে ঠিক তেমনই একটা ‘মারণ-চেহারা’ আছে স্কুলস্তরে গণিতের শিক্ষকদের নিয়ে —-- আমাদের চেনা গল্পে-উপন্যাসে-ছবিতে তাঁরা বদমেজাজি, তাঁদের চওড়া গোঁফ, কন্ঠ বাজখাই —- ক্লাসে ঢুকে ‘এই এদিকে আয়’ বলে হাঁক পাড়লে অনেক কোমলমতি বালক-বালিকার গলা শুকিয়ে যায় বা ‘হিসু’ হয়ে যেতে পারে । শিক্ষিকারাও এ বিষয়ে কম যান না । প্রাথমিকস্তরে পড়ার সময় আমরাও এমন এক দিদিমণি পেয়েছি, ‘দুর্ঘটনাচক্রে’ সেই দিদিমণির আবার ছিল হালকা গোঁফের রেখা। তবে এই ইমেজের কিছুটা বাস্তব হলেও অনেকটা নির্মাণ। এটাও ঠিক স্কুলস্তরের গণিতের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সবাই খুব ‘স্টুডেন্ট-ফ্রেন্ডলি’ নন এবং গণিতকে কীভাবে আকর্ষণীয়ভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে উপস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ ও ইনোভেটিভ ভাবনা বেশ কম —-- কোনোক্রমে স্কুলের সিলেবাস শেষ করে দিতে পারলেই তাঁদের রেহাই। এটা অবশ্য আমাদের কালের সীমিত অভিজ্ঞতা, এখনকার খবর আমি জানি না। তবে ইদানিং বঙ্গদেশে স্কুলের ছুটির ‘সীমাহীন আধিপত্যে’ হয়তো এটুকুও তাঁরা করে উঠতে পারেন না, পড়ুয়াদের কথা সহজেই অনুমান করা যায় । আমার পরিচিতা একজন আমায় গল্প করেছেন, বাড়িতে তাঁর বড়দিদি ও স্কুলের অঙ্ক দিদিমণিরা কেমনভাবে তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রখর বিড়ম্বনার, যা তাঁকে বারবার বিকর্ষিত করেছে বিষয়টি থেকে—অথচ তিনি যে গণিতে প্রাথমিকভাবে অনাগ্রহী ছিলেন এমন নয়। এই অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রমী, এটা বলতে পারব না। তবে আমাদের ইস্কুলবেলাতেও আমরা কিছু ভাল শিক্ষক পেয়েছি, যারা তেমন উজ্জ্বল নন, তবে চেষ্টা করতেন কিছুটা শেখাতে। উচ্চমাধ্যমিকে যে অঙ্ক স্যারের কাছে প্রাইভেটে পড়তাম তিনি মাঝে মাঝেই একটা কথা বলতেন, ‘কনসেপচুয়ালি বোঝো’ —- অর্থাৎ মূল থেকে বিষয়টা বোঝো তারপর অঙ্ক করো। আর, আমাদের কানে আসত কলকাতার সরকারি স্কুলগুলির কিছু খ্যাত ও প্রিয় গণিত শিক্ষকদের কথা, তাঁদের কাছে আমাদের পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে অনেক বিদগ্ধ অধ্যাপকরা আমাদের গণিত শেখাতে চেয়েছেন, তাঁরা কেউ কেউ নিশ্চয়ই রাশভারি, হাই-পাওয়ার চশমার আড়ালে তাঁদের দেখে সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা জাগত। বিশিষ্ট গ্ণিতবিদ অধ্যাপক হরিদাস বাগচীর দুই সুযোগ্য পুত্র আমাদের শিক্ষক ছিলেন, ছিলেন মহালানবিশ পরিবারের একজন। সম্ভবত দীপঙ্কর রায় (ডি আর) নামে একজন আমাদের কসমোলজির ক্লাস নেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন —-একটু খ্যাপাটে, বেশিরভাগ ক্লাসেই আসতেন না — কিন্তু শুনেছিলাম তিনি নাকি বিশ্বখ্যাত কসমোলজিস্ট পল ডিরাকের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ খুবই আড্ডাবাজ, ছাত্রদের কাঁধে হাত রেখে কথা বলতেন, ক্লাসের পর ক্যান্টিনে তাঁদের সঙ্গে দিব্যি সময় কাটাতে পারেন। তবে গড়পড়তা গণিতের শিক্ষকদের এই ইমেজ সহজে যাওয়ার নয়। শ্রীরামপুর কলেজের এক নামী গণিতের অধ্যাপককে কেন জানি না সবাই আড়ালে ‘হ্যাঙ্গারে পাঞ্জাবি’ বলত , আমাদের বিভাগের একজন শিক্ষককে তাঁর নামের আদ্যাক্ষর অনুসরণ করে আমরা আড়ালে বলতাম ‘আদ্যিকালের গরু’ ইত্যাদি ইত্যাদি — তাঁদের নাম এখানে গোপনই থাকুক। এছাড়াও ‘মারকুটে’, ‘খেঁকুড়ে’, ‘দেড়েল’ এবং নানা ‘প্রাকৃত’ বিশেষণের অভিধায় গণিত-শিক্ষক শিক্ষিকারা চিহ্নিত হয়েই আসছেন, এটা একটা ঐতিহ্য। এগুলো রসের কারণেই আমি সমর্থন করি। মাস্টারমশাইরা না-হয় এগুলোকে ‘নেসেসারি এভিল’ হিসেবেই মেনে নিন, কারণ বিপরীত দিক দিয়ে ক্লাসের পেছিয়ে থাকা পড়ুয়াদের নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা,মাথায় গাঁট্টা মারা, সহপাঠীদের দিয়ে তাঁদের বুলিং করানো এই ধরনের কদর্য কাজে তাঁদের উৎসাহও কিছু কম থাকে না!
গণিত আজ আমার পেশা নয়, জীবিকা নয়, তার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। ঝরা পালকের মতো যখন আচমকা তার একেক টুকরো এসে পড়ে আমার সামনে, প্রাথমিকভাবে আমি বিহ্বল হয়ে যাই —- এগুলো আমি একসময় শিখেছিলাম নাকি ? নিজেই নিজের কাছে চমকে উঠি। তবে এটা নিখাদ সত্যি, জীবনের কয়েকটা জরুরি বছর আমি তার সঙ্গ করেছি। সারাজীবন তাকে বহন করার মতো শিক্ষা ও সামর্থ্য আমার ছিল না। ভালই হয়েছে, অক্ষম আর বেসুরো দাম্পত্যের থেকে এইভাবে দুজনের পথ দুদিকে বেঁকে যাওয়া। তবে গণিত-সুন্দরীর কাছে আজও আমার বিনতি, আমি চেয়েছিলাম তোমার আরো নিবিড় সাহচর্য, পারিনি —- সে আমার অক্ষমতা, আমার মেধা আর বুদ্ধির ঘাটতি। তবু কিছুটা সময় যে আমরা একসাথে পথ হেঁটেছি, আহরণ করেছি তার পড়ে-পাওয়া নানা সুন্দর আকরিক, সেইটুকুই আমার অর্জন, আমার আগলে রাখা সুখস্মৃতি, সেইটুকুই আমার দু-আনা-চার আনার জীবন। লকডাউনের দিনগুলোয় যখন সময় থেমে গিয়েছিল চার দেওয়ালের মধ্যে, তখন খুঁজে পেয়েছিলাম, ঢাকার জাহাঙ্গি্রনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ চিন্তককে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা-বিষয়ের ওপর আলোচনাসভা আয়োজন করে তা পোস্ট করে দিতেন ইউ টিউবের দেওয়ালে —- আলোচকরা সবাই হতেন জাঁদরেল পণ্ডিত ও সুবক্তা । এদেরই আয়োজনে বেশ অনেকগুলো লেকচার শোনার সুযোগ হয়েছিল কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে, আপেক্ষিকতাবাদ, উচ্চতর গণিতের আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে —- সবটাই বাংলায়। এগুলো একরকম স্মৃতির উদযাপন। শুনতে শুনতে উত্তাপ পেয়েছিলাম সেই পুরোনো দিনের। আজ ইচ্ছে করলেই গণিতের যে-কোনো বিষয় নিয়ে উঁচুমানের লেকচার বা নোট সবই ইন্টারনেটে পাওয়া সম্ভব, সবটাই প্রায় বিনি পয়সায়। কিন্তু ভয় পাই অন্য জায়গায়। সম্প্রতি আমারই এক অঙ্কজীবি বন্ধুর কলেজের পোর্টালে তার লেখা নোট আপলোড হয়েছে দেখে কৌতূহলবশত তা খুলে ফেলেছিলাম —-- সত্যি বলতে কি, একবর্ণ বুঝতে পারিনি। নিজেরা যে কোনোদিন এসব শিখেছি, মনেই এল না। গণিত আসলে সাইকেল চালানো বা সাঁতার শেখা নয় যা নাকি চেষ্টা করলেও ভোলা যায় না। অঙ্ক একটা ভালবাসার ব্যাপার, সেই উষ্ণতার ছোঁয়াচ যে পায় তাকে দিনে দিনে আগলে রাখতে হয় সেই উত্তাপ। চৈত্রদিনের ঝরা পথে গণিত-সুন্দরী কাউকে নিজে এসে ধরা দেয় না, যে তাকে ছেড়ে গেছে নতুন করে তার হাত ধরার কোনও দায় তার নেই। এই ভাল। যেটুকু পেয়েছি সেটুকুই সঞ্চয়, যা পাইনি তার হিসেব মিলবে না কোনোদিন। এই তো ভাল লেগেছিল!
আশি বছর পেরোনো পাবলো পিকাসোর সঙ্গে একদল তরুণী দেখা করতে এসে দেখেছিল, তার জামার পকেটে এক প্যাকেট সিগারেট। অথচ শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর তখন ধূমপান একদম নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কৌতূহলী তরুণীরা জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, আপনার কাছে সিগারেট কেন? আপনার তো এগুলো খাওয়া বারণ হয়ে গেছে !
প্রবীণ শিল্পী পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললেন, ইয়েস আই নো ইট…বাট দি ডিজায়ার রিমেইন্স !
হ্যাঁ, দি ডিজায়ার রিমেইন্স… বিপুল বাসনার ছায়া মানুষের পায়ে পায়ে ফেরে তার শেষ প্রশ্বাস পর্যন্ত ! 'আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই/ বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে…'
আমিও বেঁচে গেছি। তাই অঙ্কে যত শূন্য পেয়েছি ততই পূর্ণ হয়েছে আমার ভাঁড়ার। মন্দ কী !
শেষ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।